ক্যাম্পাস`র অনুকরণে ভালোবাসাময় পারিবারিক শিক্ষা
ড. এম হেলাল
সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা
সামাজিক, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যেকোনো উন্নয়ন, উৎকর্ষ ও আধুনিকতার উৎসস্থল হচ্ছে পরিবার। অথচ অধিকাংশ মানুষই পারিবারিক সম্পর্কের বিষয়ে উদাসীন। বিশেষত বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতি ও সমাজ ব্যবস্থায় পারিবারিক মূল্যবোধের বিষয়টি একেবারেই অবহেলিত। এই একটিমাত্র বিষয় তথা পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবেই ব্যক্তিজীবনে হতাশা ও বিকারগ্রস্ততা, সামাজিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা এবং জাতীয় পর্যায়ে অব্যবস্থাপনা বেড়েই চলেছে।
অধিকাংশ শিশুই জন্মের পর থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের নেতিবাচক ও বিভ্রান্তিমূলক আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং উচ্ছৃঙ্খল-বিশৃঙ্খল নানা বিষয় তার মস্তিষ্কে গেঁথে যায় বা প্রোগ্রামিং হয়; পরবর্তীতে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।
বাণিজ্য-সংস্কৃতি ও ক্ষমতাপিপাসু সমাজ ব্যবস্থায় ঈর্ষা, হিংসা, ঘৃণা, ক্রোধ, লালসা, পরনিন্দা, পরচর্চা, টিজিং, অপহরণ, গুম, খুন ইত্যাকার নেতিবাচক ধ্যান-ধারণায় বিষায়িত এখন বাঙালি-মানস। পরিবারই এসবের উৎপত্তিস্থল। তাই এসবের পরিত্রাণ-আন্দোলনও শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই। পারিবারিক ভাব বিনিময় ও ভালোবাসার বন্ধনেই উদ্বোধিত করতে হবে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বিশ্ব শান্তির ভিত্তি। পারিবারিক পরিবেশে আজকের শিশু-সন্তান আগামীর বিশ্ব-সভার দুর্জয় সদস্য। তাই আজকের শিশু-সন্তানের লালন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করছে আগামীর বিশ্বশান্তি ও সভ্যতা।
অসৎ ও অন্যায় উপার্জনে গড়ে ওঠা বিত্তশালী পরিবারে বেড়ে উঠছে অবুঝ সবুজ শিশু-কিশোররা; তাদের পেছনে ঢালা হচ্ছে অঢেল টাকা; পরিণামে তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে পরাজিত হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে সকল অন্যায় আবদার।
বিত্তের প্রতি উন্মত্ত আসক্তি, বিত্তের কাছে সকল নৈতিকতার পরাজয় আমাদের সন্তানদের মাঝে জাগিয়েছে লোভের আগুন। নীতি-আদর্শ-বিবেক কোনোকিছুর স্থান নেই এ অন্ধ নেশার কাছে।
গন্তব্যহীন এক সর্বনাশা প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি আমরা। কি আত্মীয়, কি বন্ধু, কি স্বজন; সবার সঙ্গেই আমাদের অঘোষিত যুদ্ধ, নিত্য প্রতিযোগিতা, সমানে সমান হতে হবে; অর্জন করতে হবে লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, ফ্যাশনের বাড়ি। আর এই প্রতিযোগিতার যুদ্ধংদেহী ডামাডোলে জড়িয়ে পড়েছে শিশুরাও।
স্বার্থপরতা, হীনম্মন্যতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার পারিবারিক শিক্ষালাভ করছে আমাদের সন্তানরা। তাই কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মাথায় পড়ালেখার বিষয় কিঞ্চিৎ খেলা করলেও কল্যাণকর জ্ঞানের বিষয় কাজ করে না মোটেও। সৃজনশীল বিষয় নিয়ে কথা বলে না তারা সহপাঠীর সাথে, এমনকি পিতা-মাতার সাথেও। পাঠের ভালো নোট তৈরির চেয়ে কড়কড়ে টাকার নোটের গন্ধ তাদের বেশি প্রিয়। ফলে পারিবারিক বা সামাজিক কোনো পর্যায়েই সন্তানের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত আচরণ পাওয়া যাচ্ছে না।
আমাদের সন্তানরা এখন কথা বলে অদ্ভূত ভাষায়। আধো বাংলা, আধো ইংরেজি, কিঞ্চিৎ হিন্দী। জগাখিচুড়ির এই ভাষাকে তারা স্মার্টনেসের প্রকাশ বলে মনে করে। কিন্তু পরখ করলে দেখা যায় যে তারা না জানে শুদ্ধ বাংলা, না জানে ইংরেজি, না জানে হিন্দী। কোন্ ভাষা বা কোন্ পরিচয় তাকে সম্মান দেবে বা সমৃদ্ধ করবে; কোন্ আচরণ-চালচলন তাকে করবে স্মার্ট বা সম্ভ্রান্ত, পরিবার-সমাজ ও বিশ্ব পরিসরে কার জন্য কী করণীয় এসবের কোনো কিছুই তারা জানে না।
কড়কড়ে টাকার নোট, বিলাসী রঙিন গাড়ি, জগাখিচুড়ির ভাষা সব মিলিয়ে শিশু-কিশোর-তরুণ-যুব সমাজ আজ চরম বিভ্রান্ত। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে চাতুর্যপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর ধারণায় তারা ভুগছে মূল্যবোধ সংকট ও পরিচয় সংকটে। এরূপ নানা বিভ্রান্তি ও অশিক্ষায় আমরা সন্তানদের সঠিক পথ চেনাতে ব্যর্থ হচ্ছি, তারাও ব্যর্থ হচ্ছে জীবন ও জগতের কাক্সিক্ষত পাঠ নিতে। বঞ্চিত হচ্ছে মমতা ও ভালোবাসার আনন্দ থেকে, মানব সেবার তৃপ্তি ও সুখ থেকে।
আমাদের ফিরে আসতে হবে সৌন্দর্যের কাছে, পারিবারিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধগুলোর কাছে। সন্তানদেরকে দিতে হবে অনন্ত সৌন্দর্যময় জগতের সন্ধান। দেখাতে হবে আনন্দের জগৎ, নিয়ে যেতে হবে আনন্দালোকে, শেখাতে হবে দেশপ্রেম, ভালোবাসার মাধুর্য ও ত্যাগের আনন্দ। তবেই তারা হবে পরিপূর্ণ মানুষ। দেশ যাদের নিয়ে গর্ব করবে এবং যারা গর্ব করবে দেশ ও জাতিকে নিয়ে।
এরূপ সৃজনশীল মানব সম্পদ এবং জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ তথা আলোকিত জাতি গড়ে তোলার প্রথম ও প্রধান সোপান পারিবারিক পাঠ। পরিবার হবে জাতীয় ও বিশ্ব শান্তির পাদপীঠ।
পারিবারিক পাঠ এখনই শুরু করলে এর ফল পাওয়া যাবে ন্যূনতম ২০ বছর পর। তার পূর্বে যদি জাতীয় শান্তি বা বিশ্ব সভ্যতার উন্মেষ ঘটাতে চাই তাহলে বাবা-মা’র পারিবারিক শিক্ষা-সংকটের উত্তরণ ও স্ফূরণ ঘটাতে হবে শ্রেণিকক্ষে, ক্লাবে, কর্মস্থলে।
সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে আমার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাস সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (CSDC)। ক্যাম্পাস পরিবারের বিভিন্ন দর্শন, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতি এখন অনেকের কাছেই অনুকরণীয় মডেল হিসেবে প্রতিভাত। ক্যাম্পাস’র সকল কর্মী নিজেদেরকে একই পরিবারের সদস্য বলে মনে করে। তাই ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠান সমধিক পরিচিত ‘ক্যাম্পাস পরিবার’ হিসেবে। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন পরিবেশ থেকে ক্যাম্পাস পরিবারে এসে যেভাবে ভারসাম্যময় ও একই মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠে, তা ক্যাম্পাস’র অভাবনীয় সাফল্য। এর পেছনে রয়েছে ক্যাম্পাস’র সাপ্তাহিক স্টাফ-সভা তথা অধ্যয়নমূলক উন্মুক্ত আলোচনা। প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ছাড়াও জীবনের এমন কোনো দিক বা দর্শন নেই, যা নিয়ে এ সভায় আলোচনা হয় না। ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক সকল ক্ষেত্রে নিজকে দায়িত্ববান, সৎ, স্বচ্ছ, সফল ও সুউন্নত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পুঙ্খানুপুঙ্খ দিক-নির্দেশনা দেয়া হয় ক্যাম্পাস পরিবারের এ সভায়। ওপেন ডায়ালগের মাধ্যমে পারস্পরিক গঠনমূলক সমালোচনায় স্টাফ ও শিক্ষানবিশদের দোষত্রুটি চিহ্নিতকরণ ও সংশোধনের এরূপ নজির বিরল। এ সভার মাধ্যমে ক্যাম্পাস পরিবার প্রত্যেক মানুষকে Superior Human Being তথা উন্নততর মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শিক্ষা দেয়। তজ্জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে যেমনি বলা হয়, তেমনি তার চর্চা ও অনুশীলনের দিকেও থাকে বিশেষ নজর। নিজ ধর্মের যথার্থ অনুসারী হওয়া, সর্বক্ষেত্রে প্রকৃত ও প্রাকৃত হওয়া, ক্ষমাশীল হওয়া, ধন্যবাদার্হ ও সকৃতজ্ঞ হওয়া, নিজ দায়িত্বের প্রতি ও অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন হওয়া, সকল ক্ষেত্রে যুক্তিভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক আচার-আচরণে অভ্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে বিচারিক যোগ্যতা অর্জন প্রভৃতি গুণাবলী চর্চার শিক্ষা ক্যাম্পাস কর্মীগণ পেয়ে থাকে এ স্টাফ-সভা থেকেই যা ক্যাম্পাস পরিবারের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
ক্যাম্পাস পরিবার শিক্ষা দেয় কীভাবে সফল ও জনপ্রিয় হওয়া যায়, প্রোএকটিভ এন্ড পজিটিভ এটিচিউড লালনের মাধ্যমে কীভাবে যেকোনো পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, মেডিটেশনের মাধ্যমে কীভাবে জীবনকে বদলে দেয়া যায়, কীভাবে আত্মোন্নয়ন করা যায় বা সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করা যায় ইত্যাকার নানা কিছু। ক্যাম্পাস পরিবার এসকল বিষয় কেবল নিজেদের মধ্যেই চর্চা করে না, আলোকিত জাতি গড়ার প্রয়াস হিসেবে বিনামূল্যে এসব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সেবা দিয়ে যাচ্ছে সাধারণ ছাত্র-যুবকদেরও।
ক্যাম্পাস’র স্টাফ-সভার সমালোচনা পর্ব অত্যন্ত শিক্ষণীয়। এখানে ঊর্ধ্বতনদের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কেও অধঃস্তনরা খোলামেলা আলোচনা করতে পারে। অন্যের পেছনে বা অগোচরে নয় বরং সর্বসমক্ষে অন্যের ভালো দিক ও মন্দ দিক সম্পর্কে সমান আলোচনার মাধ্যমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আত্মোন্নয়নের এক অনন্য নিদর্শন ক্যাম্পাস পরিবার।
ক্যাম্পাস পরিবারের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ গঠন ও জাতি জাগরণমূলক নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়নে নিয়োজিত রয়েছে ক্যাম্পাস কর্মীবৃন্দ। সমাজ সেবামূলক বহুমুখী কার্যক্রমের সাথে জড়িত এই কর্মীবৃন্দ সৎ, দক্ষ ও প্রোএকটিভ এটিচিউড ধারণের ফলে কোনো বাধাকেই বাধা মনে করে না, অন্যের সমলোচনা বা গঞ্জনায়ও তারা রি-এক্ট করে না। ক্যাম্পাস পরিবারের পরিবেশটাই এমন যে এখানে কিছুদিন কাজ করলে স্পেশাল হয়ে যেতে হয়; যেকোনো ক্যাম্পাস-কর্মী নিজেই বুঝতে পারে সমাজের অন্যদের চেয়ে সে আলাদা। সকল কাজে স্টাফরা পরস্পর পরস্পরকে আন্তরিক সহযোগিতা করার ফলে নবাগত স্টাফ বা কর্মীও অচিরেই হয়ে ওঠে দক্ষ, সৌহার্দপূর্ণ ও অনুকরণীয়।
ক্যাম্পাস পরিবারের এই শিক্ষার বিকাশ ও স্ফূরণ ঘটে স্টাফদের নিজ পরিবারেও। ক্যাম্পাস’র পরিবেশে বিবেক ও মূল্যবোধের যে বাস্তব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তারা পায়, তা নিজের পরিবারে-পাড়ায়-মহল্লায় মোটিভেশন ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে ক্যাম্পাস পরিবারের স্টাফ সভার নিকট তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এমনকি বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক পরিবেশে কিংবা পাড়া-মহল্লার প্রতিবেশের যেসব নেতিবাচক চর্চার রোধ ও প্রতিকার সম্ভব হয় না, সেসব জটিল সমস্যা সমাধানের দিক-নির্দেশনাও দেয়া হয় ক্যাম্পাস’র বিভিন্ন সভায়।
বাবা-মা’র নিবিড় যত্ন ও নিয়ন্ত্রিত ভালোবাসায় তথা Intensive care & controlled love এ গড়ে ওঠা পরিবারে যেমনি প্রোএকটিভ ও পজিটিভ এটিচিউডের সৃজনশীল সন্তান তৈরি হয়, তেমনি সামাজিক দায়িত্বশীল এবং অনুকূল ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক পরিবারেও সুস্থ-সমৃদ্ধ জাতির কাক্সিক্ষত উচ্ছল-উজ্জ্বল ও মেধাবী নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব। বিশ্ব-পারিবারিক আন্দোলনের মাধ্যমে আলোকিত জাতি গড়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রয়াসের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক-সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদেও আলোকিত জাতি গড়া সম্ভব; যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ক্যাম্পাস পরিবার আন্দোলন এবং ভালোবাসাময় পারিবারিক শিক্ষার প্রসার।
লেখকঃ এম হেলাল, সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা
মহাসচিব, ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র