আমার প্রিয় ক্যাম্পাস পত্রিকা
গিয়াসউদ্দিন আহমেদ
উপ-পরিচালক
আলোকিত জাতি গড়ার অসীম স্বপ্নকে বুকে লালন করে যে প্রতিষ্ঠানের পথ চলা, সে প্রতিষ্ঠানের নাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাস সম্পর্কে লিখতে গেলে ২/৪ পাতায় লিখে শেষ করা যাবে না। তবে ক্যাম্পাস’র সাথে নিজেকে জড়িয়ে আমার যেসব প্রাপ্তি, সেগুলোর কথাই এ লেখায় বলার চেষ্টা করছি।
ক্যাম্পাস’র সাথে আমার কিভাবে পরিচয়, সেটাই প্রথমে বলি। ১৯৯৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে আমি ঘরে বসা। আমার চাচা প্রফেসর নাজির উদ্দিন আহমেদ সে বছরই ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের পদে থাকাকালীন সরকারি চাকরি হতে অবসর নিয়েছেন। বাবাকে হারিয়েছি ৩য় শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে। তখন থেকেই চাচার কাছে মানুষ, আমার পুরো পরিবারই চাচার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাই চাচা সবসময় আমাদের নিয়ে চিন্তিত থাকতেন।
একদিন খুব ভোরে চাচা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন- আমি সারারাত অনেক চিন্তা করে দেখেছি, আমার অবসর জীবনে আর খুব বেশিদিন তোদের সহযোগিতা করা সম্ভব নয়। তুই বিদেশ চলে যা, আমি টাকা দেব। আমার এক ছাত্র আছে বিদেশে লোক পাঠায়, আমি তার সাথে গতকাল কথা বলেছি। তুই রাজি থাকলে আজই আমি তোকে তার কাছে নিয়ে যেতে চাই। চাচার এ প্রস্তাবে কিছু না ভেবেই মনের অজান্তে বলে ফেললাম- আমি বিদেশ যাব না; যদি কিছু করতে হয় এ দেশেই করব। আর যদি যেতেই হয় তবে আর কখনও দেশে ফিরে আসব না। আমার কথা শুনে চাচা কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন এবং আমাকে বললেন, তোর বিদেশ যাওয়া বাবদ আমার কাছে ১ লক্ষ টাকা আছে, তুই ইচ্ছা করলে এ দিয়ে অন্য কিছুও করতে পারিস।
পরে চাচার দেয়া ১ লক্ষ টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে পুকুর কাটালাম, মাছ চাষ করব বলে এবং সিদ্ধান্ত নিলাম, বাকি জীবনটা গ্রামেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার সে ভাবনায় ছেদ পড়ল। চাচার এক পত্র পেয়ে আমি গ্রাম থেকে আবার ঢাকায় ছুটে এলাম। চাচা আমাকে বললেন, তুই ক্যাম্পাস পত্রিকায় চাকরির দরখাস্ত কর। আমি চাচার কথামত ক্যাম্পাস পত্রিকা অফিসে গিয়ে চাকরির দরখাস্ত দিলাম এবং ক’দিন পর চাকরিতে যোগদান করলাম। তখন ক্যাম্পাস’র অফিস ছিল ৫৩ মতিঝিল, মডার্ন ম্যানসনের ১৫ তলায়।
২ রুমের ছোট্ট অফিসে সারি সারি পত্রিকার ফাঁকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসার স্থান। সবাই কাজে ব্যস্ত,এদিক ওদিক তাকাবার ফুরসত নেই। কর্মচঞ্চল এমন পরিবেশ, পাশাপাশি সবার আন্তরিক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করল। ক্যাম্পাস’র সম্পাদক এম হেলাল স্যারের সাথে সাক্ষাতে অত্যন্ত অনুপ্রাণিত হলাম। আমার মনে হলো, আমি বোধ হয় সঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছেছি।
ক্যাম্পাস অফিসে প্রথম দিকে আমার কাজ ছিল দৈনিক পত্রিকাগুলো পড়া এবং সম্পাদক মহোদয়কে এর সারসংক্ষেপ বলা। আসলে এর মাধ্যমে তিনি আমার জ্ঞান-মান উন্নয়নের একটা বাধ্যকতা সৃষ্টি করলেন। এরপরই শুরু হল অন্যান্য কর্মকর্তাদের মত কাজকর্মের জন্য আমাকে প্রস্তুত করার পালা। প্রথমেই আমাকে ভর্তি করে দিলেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত কম্পিউটার প্রশিক্ষণে এবং আত্ম-উন্নয়নমূলক কোর্স সিলভা মেথডে। দু’টি কোর্স করাতে তখন ক্যাম্পাস’র খরচ হয়েছিল প্রায় ৯,০০০ টাকা। কোন কর্মকর্তাকে কর্মোপযোগী করতে সরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক-বীমা কোম্পানির মত বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও ক্যাম্পাস’র ন্যায় ছোট একটি প্রতিষ্ঠানে সে সুযোগ থাকতে পারে, তা ছিল আমার কল্পনার বাইরে। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাকি জীবনটা পার করে দেব ক্যাম্পাস’র সাথে।
ছোট জীবনে কখনই স্থিতিশীল হতে না পারায় এবং সংসারের অভাব-অনটনে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে গিয়ে জীবনকে সাজানোর কোন কৌশলই আমার জানা ছিল না। কিন্তু ক্যাম্পাস’র স্টাফ মিটিংগুলোতে সম্পাদক মহোদয়ের সুচিন্তিত এবং গঠনমূলক আলোচনা থেকে ধীরে ধীরে আমি আমার জীবনের সীমাবদ্ধতা ও অজ্ঞতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি।
কর্মকর্তাদের কর্মোপযোগী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি ছাত্র-যুবকদের আত্মনির্ভরশীল ও আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে বিভিন্ন সময়োপযোগী ও ব্যতিক্রমী কার্যক্রম। তন্মধ্যে ফ্রি কম্পিউটার ট্রেনিং, ফ্রি মেডিটেশন ও ইয়োগা, শিক্ষানবিশ কর্মসূচি ইত্যাকার সেবামূলক কার্যক্রম দেশ ও জাতির ভবিষ্যত কান্ডারী তথা ছাত্র-যুব সম্প্রদায়কে কতটা উজ্জীবিত ও উদ্বেলিত করছে, তা ক্যাম্পাস কার্যক্রম ও এর কার্যালয় পরিদর্শন করে বিভিন্ন মন্ত্রী, সচিব ও ভিসিসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বগণ ইতোমধ্যে তাদের মতামতে বলেছেন।
ক্যাম্পাস’র এসব ট্রেনিং নিয়ে আজ অনেকেই স্বাবলম্বী। আত্ম-উন্নয়নমূলক বিবিধ কার্যক্রম ছাড়াও ক্যাম্পাস লাইব্রেরী আন্দোলন, স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রম, সততা পুরস্কার, ত্রাণ কার্যক্রম, সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম, ওপেন ডায়ালগ প্ল্যাটফরম, শিক্ষা-বৃত্তিসহ নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেবা দিয়ে আসছে।
ক্যাম্পাস’র প্রতিটি কাজেই মানবতার সেবার আদর্শ অন্তর্নিহিত থাকায় এ প্রতিষ্ঠান আজ একটি মডেল। তবে আমাদের সমাজে ভাল কাজেরও নেতিবাচক সমালোচনা হয় অজ্ঞতাবশত। গঠনমূলক সমালোচনাকে আমি পছন্দ করি, কিন্তু যখন দেখি ক্যাম্পাস’র কার্যক্রম না জেনে না বুঝে কিছু লোক অযথা নেতিবাচক সমালোচনা করে, তখন তাদের নির্বুদ্ধিতা ও অবাস্তবতায় হতবাক হই, কষ্ট পাই।
ক্যাম্পাস’র সম্পাদক এম হেলাল -এর সুদূর প্রসারী চিন্তা-চেতনা এবং তাঁর উদ্ভাবিত মডেলগুলো বাস্তবায়িত হলে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ হবে পাশ্চাত্যের যে কোন উন্নত দেশের সমতুল্য।
ক্যাম্পাসকে আমি কি দিতে পেরেছি বা ক্যাম্পাস থেকে আমি কি নিতে পেরেছি, তার হিসাব আমি কখনো মিলাতে চেষ্টা করিনি। আমি কেবল এটাই মনে করি, আমি ক্যাম্পসকে যা দিয়েছি তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছি। আমার প্রায়ই মনে হয়- গ্রামের সেই ছোট্ট পরিবেশে জীবনকে সাজালে হয়ত গ্রামীণ উন্নয়নে সামান্যই অবদান রাখতে পারতাম, কিন্তু ক্যাম্পাস’র সাথে নিজেকে জড়িয়ে আজ আমি সমাজ উন্নয়ন ও মানব ক্যলাণের বিভিন্ন শাখায় যেমন অবদান রাখতে পারছি, তেমনি পারছি প্রতিনিয়ত নিজেকে সমৃদ্ধ করতে।
ক্যাম্পাস’র সাথে পথ চলার কারণে আজ সরকারের নীতি নির্ধারকসহ মানুষ গড়ার সর্বোচ্চ কারিগর বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সান্নিধ্য আমাকে স্বশিক্ষিত ও আলোকিত হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করছে। আমার ভিতরের সুপ্ত আলোকে জ্বালিয়ে তোলার জন্য ক্যাম্পাসকে অনেক ধন্যবাদ। ক্যাম্পাস, তোমাকে আমি সত্যিই ভালবাসি।