স্মৃতিতে সমুজ্জল ক্যাম্পাস পরিবারের সেই ২৪ ঘন্টা
স্বর্ণা শারমিন
উপ-সহকারী পরিচালক
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদকের নেতৃত্বে ক্যাম্পাস স্টাফদের নিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল ২৪ ঘন্টার দুর্দান্ত প্রোগ্রাম। এই ২৪ ঘন্টাকে বলা যায় এক ধরনের শিক্ষা সফর। প্রিয় পাঠক, হয়ত ভাবছেন শিক্ষা সফরটা নিশ্চয় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, সিলেটের চা বাগান কিংবা কুমিল্লার ময়নামতি অথবা এমন কিছু একটা হবে। কিন্তু না। Recreation এর জন্য ক্যাম্পাস স্টাফদের খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এম হেলাল স্যারের প্রোগ্রাম ব্যবস্থাপনার আইডিয়াটাও ছিল ব্যতিক্রম। ক্যাম্পাস স্টাফদের Discipline, Manner শেখার এ ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত হয় ক্যাম্পাস অফিস থেকে মাত্র ৫ মিনিট হাঁটার পথ সেগুন বাগিচায়, স্বয়ং সম্পাদক মহোদয়ের বাসায়।
প্রোগ্রামটি ১৬ই ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টা থেকে শুরু হয়ে পরদিন বিকাল ৪টায় সমাপ্তি ঘটে। এ প্রোগ্রামটিকে আমি এক ধরনের শিক্ষা সফর বলছি। কারণ হৈচৈ, আড্ডা, নাচ-গান আর খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি এ প্রোগামের প্রতিটি মূহুর্ত ছিল শিক্ষণীয় বিষয়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। সেই সাথে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ পড়াতো Mandatory. এ ব্যাপারে স্যার বরাবরই আপোষহীন।
পূর্বেই তৈরি করা হয়েছিল এ প্রোগ্রামের রুটিন। কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত কোন্ সেশন চলবে তার একটি সুসজ্জিত তালিকা পূর্বেই কম্পিউটারে টাইপ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল স্যারের বাসার দরজায়। এমনকি কখন কোন্ আইটেম খাওয়া হবে সেটিও পূর্বেই এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল।
১৬ই ফেব্রুয়ারি, বিকাল ৪টা। শুরু হল ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে অর্থাৎ রুটিন মাফিক ২৪ ঘন্টার সফর। ক্যাম্পাস’র কয়েকজন শিক্ষানবিশসহ সকল স্টাফ একে একে স্যারের বাসায় সমবেত হলো। একটি বিশেষ কারণে আমার সেদিনের অনুপস্থিতি পূর্বেই অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলাম। আমি সবার সাথে সমবেত হই পরদিন সকালে। তখন কলিগদের কাছে জানতে পারলাম পূর্বদিনের সেশনগুলো সম্পর্কে। সেগুলোর মধ্যে দাবা খেলা, তাস খেলা, খাওয়া-দাওয়া ছাড়াও সবচেয়ে দুর্দান্ত সেশনটি ছিল নাইট ওয়াক। অর্থাৎ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আমেজ মাখানো ঝলমলে রাতের আলোকিত রাজধানী দর্শণ করার অপূর্ব সুযোগ। রাত ১০-৩০ মিনিটে বাসা থেকে বের হয়ে বায়তুল মোকাররম স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে গুলিস্তান-কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার-বাংলা একাডেমী-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- শেরাটন-শাহবাগ-রমনা পার্ক হয়ে রাত ২টায় বাসায় ফেরা। শুনে বুঝলাম, এমন একটি ব্যতিক্রমী এডভেঞ্চার সত্যিই মিস করেছি।
পরদিন সকাল ৯-৪৫ মিনিটে আমিও উপস্থিত হই স্যারের বাসায়। সেখানে গিয়ে ১ মিনিটও দেরি না করে সবার সাথে অংশগ্রহণ করি ইয়োগাতে। তারপরই মেডিটেশনের ১৫ মিনিটের একটি সেশন পরিচালনা করেন স্যার। মেডিটেশনের বিষয়বস্তু ছিল নিজ নিজ উন্নতি কামনা এবং ক্যাম্পাস প্রকাশিত ইউনিয়ন ভিত্তিক উন্নয়ন মডেলের সার্বিক সাফল্য কামনা করা। মডেল সম্পর্কে এক কথায় বলা যায় এই মডেলটি ‘বিদ্যুৎ, যানজট, দুর্যোগ, বেকারত্ব, দারিদ্র্যসহ জাতীয় সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্বলিত বাংলাদেশে ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়নের অত্যাধুনিক মডেল।’
শেষ হলো মেডিটেশন। তারপরই Break-fast. আগেই বলেছি ক্যাম্পাস’র সকল কাজে রয়েছে কিছু না কিছু ব্যতিক্রমী ছোঁয়া। Break-fast নেয়ার জন্য সকলে দাঁড়িয়ে গেলাম লাইনে। তখন ছিল Ladies-first সিস্টেম। আরেকটি সিস্টেম ছিল অনুসরণীয়। সেটি হলো খাওয়া শেষে যার যার প্লেট ধোয়া। স্টাফদের যার যার নিজস্ব বাসাতেও এ পদ্ধতি চালু রাখার নির্দেশ দেন স্যার। পাঠকবৃন্দ, আপনারাও সিস্টেমটি মেইনটেন করতে পারেন। প্রথমে শুরু করতে পারেন নিজ পরিবার থেকেই। কারণ Charity begins at home. উল্লেখ্য যে, নির্দিষ্ট সময়ে Breakfast ডাইনিং টেবিলে সুসজ্জিত করে রেখেছিলেন যিনি তিনি হলেন BIDS এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং স্যারের মিসেস ড. নাজনীন আহমেদ। নাজনীন ম্যাডামের রান্না ও টেবিলে পরিবেশনের কৃতিত্ত্বের বড় একটি অংশের দাবীদার হলো, আমাদের সবার প্রিয় রেবা আহমেদ। তিনি ক্যাম্পাস অফিসের সকল আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার পাশাপাশি বড় বড় হাড়িতে বিভিন্ন রেসিপির ব্যালেন্স সীটও তৈরি করতে পারেন সুনিপুণ হাতে। একথা বলার অপেক্ষা থাকে না যে, মিস রেবা রন্ধনশীল্পে বরাবরই পটু। মিস রেবার অন্য আরেকটি পরিচয় হচ্ছে, তিনি নাজনীন ম্যাডামের চাচাতো বোন।
এবারে ইংরেজি ফিল্ম দেখার পালা। ১২০০ শতকে স্কটল্যান্ডে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত The Brave Heart’ শিক্ষণীয় বিষয়ে পরিপূর্ণ চমৎকার একটি ফিল্ম। পায়েস আর আঙ্গুর খেতে খেতে খুব মনোযোগ সহকারে ফিল্মটি Enjoy করলাম সবাই।
ফিল্ম শেষ হলো। তখন প্রায় লাঞ্চ টাইম। কিন্তু পূর্বেই তৈরি করা প্রোগ্রামের Schedule অনুযায়ী লাঞ্চের পূর্বে আরেকটি সেশন বাকি রয়ে গেছে। এক মিনিট করে সকলের তাৎক্ষণিক উপস্থাপন। এ সেশনে ক্যাম্পাস’র সি. এক্সিকিউটিভ নাবিলা সুমধুর কণ্ঠে গেয়ে শোনাল ‘আমি বাংলায় গান গাই’; As a bathroom singer আমি গাইলাম কেন দূরে থাক শুধু আড়ালে রাখ। Magic পরিবেশন করলেন ক্যাম্পাস’র সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদ এবং সহকারী পরিচালক মিসেস রনি বললেন একটি ধাঁধাঁ। এভাইে এক মিনিট করে সকলেই কিছু না কিছু Perform করলেন। এরপরই শুরু হলো ধামাকা পর্ব। বড় স্পিকারে মুন্নি বদনাম হুয়ি, মাই নেম ইজ শীলা এমন ধুম-ধামাকা গানের তালে তালে ক্যাম্পাস পরিবারের সম্মিলিত নাচে স্যারের বাসা হয়ে ওঠে মুখরিত। যে যেভাবে পেরেছে সেভাইে কিছুক্ষণের জন্য এক একজন নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠে সেদিন। জীবনতরীর সকল ক্লান্তি, অবসাদ, পিছুটান সবই যেন মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গিয়েছিল সবাই।
নাচ-গান, হৈচৈ শেষে দুই মিনিট বিশ্রাম নিলাম। এরপর সবার যোহরের নামাজ শেষ হতেই স্যার বললেন, লাঞ্চ রেডি। নববধুর সাজে সজ্জিত কিচেনের পরিচ্ছন্ন পরিবেশনায় পোলাও, ইলিশ মাছের কোপ্তা, ক্যাপসিকাম চিকেন, রুই দোপেঁয়াজা, চায়নিজ ভেজিটেবল, চিকেন সালাদ ও জলপাইয়ের চাটনী ছিল স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। আমি আগের দিন অনুপস্থিত থাকায় সেদিনের তালিকাভুক্ত খবারগুলো খেতে মিস করেছি। যখনই স্টাফদের কেউ কোনো খাবার কোনো কারণে মিস করে, ক্যাম্পাস’র সম্পাদক মহোদয় তাকে অন্য কোনো সময়ে সেই খাবারটা যতটুকু সম্ভব সার্ভ করতে কিন্তু কখনও মিস করেন না। তাই বরাবরের মত সেদিনও নারকেলের নাড়–, বড়ই, গাজরের হালুয়া সার্ভ করেন আমাকে। এভাবে খাওয়া-দাওয়ার সেশন চলতে থাকে সারাদিন। খেতে খেতেই যখন ক্লান্ত, ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা হাতছানি দিয়ে বলছে, এবার সময় হলো শুভ বিদায়ের।
এ ২৪ ঘন্টার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শীতল উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। অনেকটাই ইনফরমাল ও ঘরোয়া পরিবেশের এ আয়োজনে ক্যাম্পাস পরিবারের প্রতিটি সদস্য যেন মেতে উঠেছিল মুক্ত প্রাণের উচ্ছ্বাসে। ক্যাম্পাস পরিবারের কোনো সদস্য কোনোদিন সেই মুহূর্তগুলো ভুলবে না, ভুলতে পারবে না।
ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তাকে, ধন্যবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস’র সম্পাদক মহোদয়কে এমন অপূর্ব মিলনমেলার মাধ্যমে ক্যাম্পাস পরিবারকে এত সুন্দর একটি প্রোগ্রাম উপহার দেয়ার জন্য। বিশেষ ধন্যবাদ নাজনীন ম্যাডাম ও রেবাকে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের এত সুস্বাদু খাবার পরিবেশনের জন্য। ক্যাম্পাস এ আমার সকল সহকর্মী ও প্রিয় পাঠকদের জন্যও রইল শুভকামনা।
প্রথম প্রকাশঃ আগস্ট ২০১১