ক্যাম্পাস পরিবারের বার-বি-কিউ সন্ধ্যা এবং একজন ড. নাজনীন এর গল্প

উম্মে সালমা রনি
উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও প্রোটোকল)

মানুষ সাধারণত ঈদ-পরবর্তী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান করে। আর ব্যতিক্রমী ক্যাম্পাস করল ঈদ-পূর্ব আনন্দ আয়োজন। আইডিয়া ও প্ল্যান অবশ্য পুরোটাই আমাদের স্যার তথা ক্যাস্পাস পত্রিকার সম্পাদক এম হেলাল’র। নতুন নতুন আইডিয়া উপস্থাপন ও ব্যতিক্রমী প্ল্যানিংয়ে স্যারের যে জুড়ি মেলা ভার এটিতো আমরা সবাই এতদিনে খুব ভালো বুঝে গিয়েছি। আর তাই ২৪ অক্টোবর বিকেল ৫টায় আমরা, ক্যাম্পাস পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলিত হয়েছিলাম সম্পাদক মহোদয়ের বাসায় ঈদপূর্ব রিক্রিয়েশনে। সবাই একত্রিত হতে না হতেই মাগরিব নামাজের আযান হলো। ছেলেরা ড্রইংরুমে জামাতে আর মেয়েরা ভেতরের রুমে নামাজ পড়ে নিলাম। এরপর লাউড স্পিকারে দোয়া-দরুদ পড়ে সমবেত মোনাজাত হলো। রিক্রিয়েশনে এসেছি বলে নামাজ বা দোয়া-কালাম যে বন্ধ থাকবে না এটি ক্যাম্পাস’র আরেক স্পেশালিটি।
এরই মধ্যে স্যারের মেয়ে রাইসা ও ছেলে মাহীর আমাদের সামনে চকলেট ও খেজুরের বাটি ধরল। খেজুর চয়েজ করে নেয়ার সুযোগ থাকলেও বিভিন্ন ফ্লেভারের বিদেশী চকলেট নিতে হলো চোখ বুঁজে, অনেকটা যেন ভাগ্য পরীক্ষায়। ক্যাম্পাস’র ঘনিষ্ঠ শুভাকাক্সক্ষী লন্ডন প্রবাসী ড. কামাল এগুলো আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। খেতে খেতে তাঁকে উইশ করলাম। আমাদের জন্যতো স্যারের বাসা ও বাসার মানুষজন পরিচিত, যেন আমাদের সবারই বাসা। কিন্তু এবার আমাদের সাথে ছিল ক্যাম্পাস পরিবারের তিন নতুন সদস্য। সদ্য জয়েন করা ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এ কে এম মিজানুর রহমান, মাস দু’য়েক আগে জয়েন করা ডেপুটি এসিসট্যান্ট ডিরেক্টর শেফাউল করিম চৌধুরী এবং ক্যাম্পাস’র ফ্রি কম্পিউটার ট্রেনিংয়ের ট্রেইনার হাসান ইমাম। 
নতুনদের উদ্দেশ্যে স্যার বাসা ঘুরিয়ে দেখালেন। এরপর শুরু হলো রিক্রিয়েশনের অন্যতম আকর্ষণ বার-বি-কিউ তৈরি বা আয়োজনের খুঁটিনাটি বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানা ও দেখার পালা। আমি কখনও কোথাও বার-বি-কিউ করতে দেখিনি। তবে বইয়ে পড়েছি শৌখিন মানুষরা তাদের বাগান বাড়ি বা খামার বাড়িতে রাতের বেলা পার্টি দেয়; সেখানে খোলা আকাশের নিচে বার-বি-কিউ করে। আমার ধারণা ছিল আগুন জ্বালিয়ে তাতে হাঁস-মুরগী, গরুছাগল পুড়িয়ে খাওয়াটাই বার-বি-কিউ। তেল-মসলা নিশ্চয়ই দেয়া হয়; কিন্তু কেন যেন বার-বি-কিউতে আমার আকর্ষণ ছিল না।   যা হোক, কিচেনে বার-বি-কিউ হচ্ছে। আমরা সবাই দল বেঁধে কিচেনে ঢুকলাম। দেখলাম বার-বি-কিউ মেশিন। প্রযুক্তি যেভাবে দিনদিন এগুচ্ছে তাতে আমি ভেবেছিলাম কোনো ইলেকট্রনিক কারিশমা হবে। ওম্মা, এ দেখি চুলায় বসানো। একটি বড় ছড়ানো প্লেটের মতো পাত্র, যার মাঝখান দিয়ে সরাসরি আগুন উঠছে, আর পুরো প্লেট জুড়ে ছিদ্র ছিদ্র। মেশিন সম্পর্কে স্যার আমাদের ব্রিফ করলেন। এবারে বুঝলাম বার-বি-কিউ আয়োজন অফিসে না করে বাসায় করার কারণ। বার-বি-কিউর জন্য প্রয়োজন প্রখর আগুন। ক্যাম্পাস অফিসে আমরা ইলেকট্রিক চুলা এমনকি ইনফ্রা-রে চুলার সার্ভিস পেলেও গ্যাসের চুলার ব্যবস্থা এখনও নেই।  
মাংসকে বার-বি-কিউ করার প্রসেস সম্পর্কে জানালেন স্যারের সহধর্মিনী, আমাদের সবার প্রিয় ড. নাজনীন ম্যাডাম। জানলাম বার-বি-কিউর জন্য মাংস রেডি করতে নাকি ১০/১২ ঘন্টা লাগে। বুঝলাম আমাদের এতগুলো মানুষকে খাওয়ানোর জন্য এই পরিবারটি সম্ভবত গতকাল থেকেই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। যদিও ড. নাজনীনকে দেখে মনে হচ্ছিল অন্যান্য দিনের মতোই তিনি হয়তবা টেলিভিশনের কোনো প্রোগ্রামে যাচ্ছেন অথবা কোনো ফাংশনে গান গেয়ে এলেন। কিচেনে ব্যস্ত বলে যে সবাইকে এলোমেলো বেশ দেখাতে হবে না এটা ড. নাজনীন ছাড়া এত ভালো আর কে বোঝেন? আর তাইতো তিনি আমাদের সবার অনেক প্রিয়।
বার-বি-কিউ চিকেন রেডি হতে হতে একদফা খেলাধূলাও হলো। মেয়েরা লুডু আর ছেলেরা দাবা ও কার্ড নিয়ে বসে গেল। স্যারের ছোট ছেলে দুই বছরের ওয়াসির সব খেলার মাঝেই তার নিজস্ব দুষ্টুমিতে কিছুটা ভূমিকা রাখল; তারপর আরও প্রতিভা দেখাতে একাই একটি লুডুর সেট নিয়ে বসে গেল। পরোটা, সাধারণ নান আর স্পেশাল নান; সাথে টক দই ও ভেজিটেবলের স্পেশাল সালাদ এই ছিল বার-বি-কিউ চিকেনের সাথে আইটেম। মাংসের মধ্যে চিকেন আমার প্রিয় হলেও গত মাস ছয়েক শারীরিক কারণে তা আমি খেতে পারছিলাম না। কিন্তু স্যারের আন্তরিক আয়োজন, ড. নাজনীনের হাতের ছোঁয়া অথবা সকল সহকর্মী মিলে হৈ-হুল্লোড় করে উপভোগের জন্যই হয়ত আমি খুব তৃপ্তি করে বার-বি-কিউ চিকেন খেলাম। এরপর ছিল বিভিন্ন ফ্লেভারের আইসক্রিম।
এত মজার খাবার হলো, খেলা হলো, আড্ডা হলো; লাউড স্পিকারে গানও চলছে ধুমধাড়াক্কা। ক্যাম্পাস পরিবার একত্রিত হয়েছি আর একটু নাচ হবে না তাই কি হয়! মাই নেম ইজ শীলা আর ছাম্মাক-ছালোর উদ্দাম মিউজিকের সাথে নাচ শুরু করল রাইসা। এরপর আর কি, একে একে সবাই অংশ নিল। সবার পারফরমেন্সই ভালো ছিল, কিন্তু সিনিয়র এক্সিকিউটিভ রানা যে ড্যান্স দেখাল, তাতে তার কোরিওগ্রাফারের ব্যাপারে সবাই খোঁজখবর নিতে শুরু করল।
আনন্দ-উল্লাসের মাঝেই সময় হলো বাড়ি ফেরার। ফেরার সময় ড. নাজনীন যখন আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, ঠিক তখনই আমি অনুভব করলাম এই মানুষটির কাছে আমি কত ঋণী। গত ৫ বছরে তাঁর সাথে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রকম কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে; যে সুযোগকে আমার সৌভাগ্য বলেই মনে করি আমি।  জীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম হওয়া, খুব কম বয়সেই নাম করা অর্থনীতিবিদ, বড় বড় জায়গায় নামি-দামি মানুষদের সাথে ওঠা-বসা, বছরে কতবার যিনি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কশপ-সেমিনারে অংশ নিতে দেশের ভেতর-বাহির ব্যস্ত থাকেন তিনি আমার মতো সাধারণ রনি’র সাথে কাজ করেছেন ঠিক যেন আরেক রনি হয়ে। আমি কোনোদিন তাঁর ভেতরে নিজেকে জাহির করার মতো কিছু দেখিনি। বরং মাঝে মাঝে যখন বলতেন, তোমাদের থেকে মানে ক্যাম্পাস কর্মীদের থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আমি লজ্জায় এতটুকু হয়ে যেতাম; যদিও আমার স্বভাব অনুযায়ী সব কিছুতেই নিরুত্তর থাকতাম।  ড. নাজনীন ক্যাম্পাস’র অনারারী রিসার্চ ডিরেক্টর হিসেবে আছেন। একজন ব্যস্ত অর্থনীতিবিদ, বিআইডিএস’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, কত প্রজেক্টের তিনি ডিরেক্টর এরপর একজন গৃহিনী, একজন স্ত্রী, একজন পুত্রবধূ, কারো মেয়ে, কারো বোন, সর্বোপরি তিন সন্তানের মা হয়েও ক্যাম্পাস’র সাথে তাঁর যে সম্পৃক্ততা তা আসলে কোনোদিন পয়সা দিয়ে শোধ করতে পারব না বলেই হয়ত তিনি আমাদের অনারারী পারসন। আমাদের বড় কাজে, কখনও ছোট্ট ছোট্ট কাজে, তাঁর যে আন্তরিকতা ও সময় ব্যয় দেখেছি এটা আসলে বিশ্বাসযোগ্য নয়, বলে বোঝানোরও নয়। আমি বুঝতাম, এটুকু করলে বা এ কাজটি করলে তাঁর পোষায় না; কিন্তু সেজন্য বিরক্তি বা হতাশা দেখিনি।
মাঝে মাঝে কথাচ্ছলে বলতেন আমি গত ২ দিন একফোঁটা ঘুমাইনি; আমি গত ৪ দিনে ৩/৪ ঘন্টা ঘুমিয়েছি। শুধু শুনেই যেতাম। হয়ত ভাবতাম বড় মানুষদের এমনই হয়। তাই যখন আমার অনেক ব্যস্ততা থাকে, নিজেকে পাগল পাগল লাগে, তখন নিজেই নিজেকে বলি হ্যাঁ আমি অনেক ব্যস্ত, কিন্তু আমি নিশ্চয়ই ড. নাজনীনের চেয়ে বেশি ব্যস্ত নই। এটা বলে আবার কাজে লেগে পড়ি। আমার অফিস, স্যার ও ম্যাডামকে নিয়ে বাড়িতে এসে হাজবেন্ডের সাথে গল্প করি, শেয়ার করি। যার ফল হয়েছে এই বাড়িতে কখনও খুব টায়ার্ড হয়ে কোনো ব্যক্তিগত কাজে আলসেমি করলেই আমার হাজবেন্ড বলে, তুমি এটুকুতেই টায়ার্ড হচ্ছো আর তোমার ম্যাডাম কত কাজ করেন। এটা শুনে আমি আর ফাঁকি দিতে পারি না। 
ম্যাডামের ধৈর্যের পরিচয় পেলাম তাঁর ৩য় সন্তান হওয়ার সময়। বেবি ওয়াসির’র যেদিন জন্ম হলো, তার আগের দিনও রাত ৮টার সময় ম্যাডাম আমাদের অফিস থেকে বাসায় গেলেন। আমি যেহেতু জানি, আগামীকাল তাঁর সিজার হবে, তাই কেবল অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। আর তাইতো আমার এই প্রথম বেবি হওয়ার সময় আমিও নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে অফিস করতে পারছি। এ নিয়ে আমাকে কেউ কিছু বললেই আমি তাকে ড. নাজনীনের গল্পটা বলি। ফলে সবার সাথেই আমার কনক্লুশান হয় একইরকম আসলে কাজের মধ্যে থাকলেই শরীর ভালো থাকে।  আমার মনে পড়ে, ওয়াসির হওয়ার সময় ম্যাডামের কি প্রচন্ড ব্যস্ততা ছিল। তাঁর পেশাগত কাজের ব্যস্ততার পাশাপাশি আমাদের সাথে কাজ, ক্যাম্পাস’র কম্পিউটার ট্রেনিংয়ের ১০০তম ব্যাচ পূর্তি অনুষ্ঠানের নানা আয়োজন, ফ্ল্যাট ক্রয় সংক্রান্ত কাজ, ক্যাম্পাস গবেষণা সেলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে মডেল প্রকাশনা সংক্রান্ত জরুরি কাজ, সামাজিক-সাংসারিক কাজ। এর বাইরেও ম্যাডামের শাশুড়ি গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আইসিইউতে ছিলেন দীর্ঘদিন তাই নিয়ে কত্ত ছোটাছুটি। আমার মনে পড়ে না, কোনোদিন মুখটা এতটুকু ম্লান দেখেছি। তাই আমি যখন সামান্য বিষয়ে আপসেট হয়ে মুখ গোমড়া করে থাকি, নিজেকে মনে মনে বলি ড. নাজনীন থেকেতো কিছুই শিখতে পারলাম না। 
ক্যাম্পাস এ আমার কর্ম শুরুর প্রথমদিন থেকে ড. নাজনীনকে দেখে দেখে আমার ভেতরেও একটি ছবি দেখি আমি। আমি দেখি সুস্থ ও সবল এই আমি আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো কাজের সাথে জড়িত আছি। লাইফ থেকে অবসর বা বিদায় আমি একবারই নেব, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বয়স তখন ৫০ বা ১০০ যাই হোক না কেন।   মনে পড়ে, এইতো কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রীর বাসায় একটি কাজে ম্যাডাম আমাদের সাথে যাচ্ছেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। ম্যাডামকে দেখলাম চমৎকার সেজেছেন। ভাবলাম, ছুটির দিন বলে হয়ত সময় পেয়েছেন। ভুল ভাঙ্গল একটু পর। দেখি অনবরত ফোন আসছে। জানলাম নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের তিনি বিশেষ অতিথি, সেখান থেকেই ফোন। বুঝলাম সাজের কারণ। ফেরার পথে বললেন যে সারাদিন কিছু খাননি।
প্রথম থেকেই অত্যন্ত সহজ ও আন্তরিকভাবে ম্যাডাম আমাদের সাথে মিশেছেন বলে আলাদা করে তাঁকে কখনো বলা হয়নি আপনি অনেক সুন্দর, অনেক ভালো বা...। আমি বলার প্রয়োজনও মনে করি না। বললেই যে শেষ হয়ে যায়। আমি চাই তিনি আরো সুন্দর হোন, আরো ভালো হোন, আরো বড় হোন...।  তবু মানুষের জীবনে কিছু না কিছু অপূর্ণতা থাকেই। আমার ম্যাডামের জীবনের সকল অপূর্ণতা দূর করতে তাঁর আছে তিনটি লক্ষ্মী সন্তান। স্নেহের রাইসা, মাহীর আর ছোট্ট ওয়াসির। এই সন্তানেরা যখন বড় হবে, দেশ ও দশের একজন হবে, সেদিনই ড. নাজনীন জীবনের পরীক্ষায় আরেকবার প্রথম হবেন। আর এই জয় হবে সবচেয়ে বড় জয়। কারণ এবার তিনি একজন মা, তিন সন্তানের গর্বিত জননী। তাঁর জন্য সে শুভকামনায় সকলের শুভেচ্ছাপ্রার্থী এই আমি...
প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০১২