ক্যাম্পাস’র নেতৃত্বও ব্যতিক্রমী
উম্মে সালমা রনি
সহকারী পরিচালক (প্রশাসন)
যে কোন কিছুর ক্ষেত্রেই প্রথম অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকম। যেমন- প্রথম দেখা, প্রথম ভালো লাগা, প্রথম প্রেম, প্রথম সন্তান, প্রথম পরীক্ষা ইত্যাদি। আমার জীবনের প্রথম পরীক্ষায় আমি প্রথম হয়েছিলাম। সেটি ছিল আমার স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা। তারপর অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়েছি; কিন্তু কখনই আমার প্রিয় ব্যক্তি, আমার প্রিয় শিক্ষক বা আমার প্রিয়... -এ জাতীয় কোন রচনা লিখতে হয়নি।
কর্মজীবনে প্রবেশ করে দিন-মাস-বছর গড়িয়ে এখন নিজের ভেতর থেকেই তাগিদ অনুভব করছি, একটা বিষয়ে লিখতে। আর তা হলো- আমার কর্মজীবনের প্রথম বস্, যাঁর কর্মদক্ষতা ও নেতৃত্বগুণে আমি প্রতিনিয়ত মুগ্ধ ও বিস্মিত হচ্ছি, তাঁর সম্পর্কে লিখতে। আমার এ লেখা কে কিভাবে নেবে -তা আমি জানি না। সর্বোপরি আমার বস এ প্রকাশকে কিভাবে দেখবেন, সে আশংকাতো রয়েছেই। কিন্তু আগেই বলেছি- এ লেখা আমি লিখতে চাইনি, কখনও লিখব ভাবিনি। এ লেখা আমার ভেতর থেকে এসেছে, এ আমার একান্ত অনুভূতি।
আমি কাজ করি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা এবং ক্যাম্পাস সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (সিএসডিসি) অফিসে, প্রশাসনিক বিভাগে। তাই শুরু থেকেই এর প্রধান নির্বাহী তথা ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এবং সিএসডিসি’র মহাসচিব জনাব এম হেলাল -এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাজ করছি। প্রথম থেকেই স্যারকে খুব রাগী মনে হওয়ায় ভয় পেতাম খুব, এখনও পাই। কোন একদিন সেটা স্যারকে বলেও ফেলেছিলাম, যার জন্য পরবর্তীতে অনেক সময় কথাচ্ছলে স্যার বলেন- কি হাঁটু কাঁপছে? আমি মাঝে মাঝে বলি- জ্বি না স্যার, আবার কখনও বলি- জ্বি স্যার।
জীবনে বড় হতে চাইলেই যে হওয়া যায়, আর সেটা কিভাবে হওয়া যায়, তাই শিখেছি এবং শিখছি স্যারের কাছ থেকে। একজন মানুষ সকল বিষয়ে কেমন করে এত জানে ও বুঝে -তা এ পরিবেশে না এলে কখনই হয়ত আমার জানা হত না। জীবনের এমন কোন দিক নেই, যে বিষয়ে স্যারকে অনভিজ্ঞ বা অজ্ঞ বলে আমার মনে হয়েছে। আর বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্যার যখন বলেন- কি, আমার কথা অযৌক্তিক মনে হয়? এর উত্তরে আমিতো নই-ই, আজ পর্যন্ত অন্য কাউকেও বলতে শুনিনি- হ্যাঁ,অযৌক্তিক। এতে মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে যাই। অনভিজ্ঞতার কারণে আমি অনেক সময় অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু স্যার যখন সরলভাবে অথবা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেন, তখন মনে হয়- এত সহজ...। আমি আজ পর্যন্ত স্যারের কোন যুক্তির সাথে দ্বিমত হতে পারিনি; বরং স্যারের নানা যুক্তি শুনে মনে হয়- তাইতো, এভাবেতো কখনও ভাবিনি।
সবসময় শুনে এসেছি বস’রা অনেক কঠিন হয়। সত্যি কথা বলতে কি, আমার কর্মজীবনে স্যারকে খুব কমই বসসুলভ আচরণ করতে দেখেছি। সবার সাথেই তাঁর আচরণ ভাই-বোনের মত ও বন্ধুসুলভ। অসৎ ও ফাঁকিবাজ মানুষ ছাড়া অন্য যে কোন মানুষের সাথেই তাঁর এরূপ সম্পর্ক, যেন সবাই তাঁর আত্মার আত্মীয়। বাইরে থেকে দেখে তাঁকে মাঝে মধ্যে কঠিন মনে হলেও আসলে স্যার মোটেই কঠিন নন। আর যতটুকু কঠিন, ততটুকু না হলেতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা যায় না। তবে হ্যাঁ, আমার জানামতে স্যারকে আমি একটি বিষয়েই কঠিন হতে দেখেছি, তা হলো- যে কোন অন্যায়ের ব্যাপারে। অন্যায় ও অসত্যের সাথে তাঁর এতটুকু compromise নেই। এ ব্যাপারে তিনি সত্যিই কঠিন। Dishonesty, insincearity ও artificiality -এসবের সাথে তাঁর বিরোধ মজ্জাগত।
মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতায় স্যার খুব বিশ্বাস করেন। আর তাই এখানকার স্টাফরা কাজ করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে, নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী। এটা এমন একটা পরিবেশ, যেখানে নতুন চাকরিপ্রার্থী এলে স্যার প্রথমে তাকে সুযোগ দেন এখানকার পরিবেশ ও কাজের ধরন বুঝতে। তারপর তার কাছেই জানতে চান যে, তিনি কোন ক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী। কাউকে কোন কাজ চাপিয়ে দেয়া হয় না।
ছোটবেলা থেকেই আমার চাকরি করার খুব শখ। কিন্তু ভাবতাম- আমাকে দিয়ে বোধ হয় হবে না, আমিতো জানিনা, কিভাবে চাকরি করতে হয়। অর্থনীতির মত খটমটে সাবজেক্টে মাস্টার্স করলেও চাকরিতে ঢুকেছিলাম কিন্তু খুব ভয় নিয়ে। অথচ আজ কত ধরনের কাজই যে আমি পারি! ভুল করি, কিন্তু পারিতো! আর এখানে ভুল করলেও ভয়ের কিছু নেই। সরলভাবে ভুল স্বীকার করলেই যে স্যারের ক্ষমা পাওয়া যায়, তা এখানকার প্রত্যেক স্টাফই জানে।
আমার চাকরির তখন মাত্র মাসখানেক। একদিন একটা কাজে ছোট্ট ভুল হয়ে গেল। আসলে আমি নিয়ম অনুযায়ীই কাজটা করেছিলাম। কিন্তু সব নিয়মেরই একটু ব্যতিক্রম থাকে। আর এ কাজটা ব্যতিক্রমী নিয়মের মধ্যে পড়েছিল, যা আমি নতুন হওয়ায় বুঝতে পারিনি। পরে বুঝতে পেরে সিনিয়র একজনকে বলতে তিনি এমনই কথা শুরু করলেন যে, আমি ভয়ে শেষ। ভাবলাম, ভুল যখন করেই ফেলেছি অন্যের মুখ থেকে শোনার আগে আমি নিজেই স্যারকে বলি। খুবই ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললাম- স্যার, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। এ কথা বলে আমি অপেক্ষা করছি, এক জোড়া চোখের রাগত দৃষ্টির। আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন, কি ভুল করেছো? আমি আমার ভুল ব্যাখ্যা করলাম। স্যার মুচকি হেসে বললেন, তুমি ঠিকই করেছ। তবে তুমি যখন অভিজ্ঞ হবে তখন তুমিও বুঝবে যে কখনও কখনও নিয়মেরও ব্যত্যয় ঘটে।
সেই শুরু। এ পর্যন্ত যা শিখেছি, সব স্যারের হাতেই শেখা। বকা দিয়ে নয়, ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে। এত যত্ন করে স্যার কাজ শিখিয়েছেন -যা বলার নয়, শুধুই কৃতজ্ঞতার। আর তাই হয়ত আমারই ভুলে স্যারের একটা আর্টিকেল যখন কম্পিউটার থেকে ডিলিট হয়ে গেল, আমি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেছিলাম- আমার এ হাতে স্যারের একটা লেখা নষ্ট হল!
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকায় সম্পাদক স্যারের নিয়মিত কলাম ছাপা হয়। গত কয়েক সংখ্যা ধরে স্যারের এই কলামের কাজ আমি করছিলাম। অর্থাৎ স্যারের হাতে লেখা রাফ অবস্থা থেকে কম্পোজ, প্রুফ, এডিট, কারেকশন সব হচ্ছিল আমার কো-অর্ডিনেশনে। আমার হাত থেকে ফাইনাল হয়ে ডিজাইনারের কাছে যেত পত্রিকায় ছাপানোর জন্য। মন নিয়ন্ত্রণ বা মেডিটেশনের ওপর মোটামুটি গবেষণাধর্র্মী ও টেকনিক্যাল ঐ লেখাটি বারবার এডিটিং ও রিএরেঞ্জ হয়ে মাস দু’য়েক পর ফাইনাল হয়েছে। স্যার আমাকে বললেন, এটা প্রিন্ট দিয়ে আমাকে এক কপি দাও, আর মেকাপের জন্য ডিজাইনারকে সফ্টকপি সেন্ড কর। এই বলে স্যার বাইরে চলে গেলেন। আমি তখন পত্রিকার মেকাপের কাজ নতুন শিখছি এবং ২/১ সংখ্যার কলাম একটু আধটু মেকাপ করে প্রশংসাও পেয়েছি। তাই এবারও আমি এটা সাধারণ প্রিন্ট না দিয়ে মেকাপ করার চেষ্টা করছিলাম। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে কী-বোর্ডের কোন কী’তে চাপ লেগেছে জানিনা, সব লেখা ডিলিট হয়ে গেল। হতভম্ব আমি সেটাকেই সেভ দিলাম, কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। ফাইলের কোন কপি করা হয়নি,ব্যাকআপও নেই।
সত্যি কথা বলতে কি, ঐ মুহুর্তে আমার সারা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমার কর্মজীবনের প্রথম ট্র্যাজেডি। আমি ভাবতে পারছিলাম না, কিভাবে স্যারের সামনে দাঁড়াব। আমি কি মাথার চুল ছিঁড়ব, নাকি দৌড়ে পালাব, নাকি কম্পিউটারটাকে একটা আছাড় দিব -কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হাউমাউ করে কান্না আসছিল, কিন্তু তাও করতে পারছিলাম না। আমার চোখে পানি টলটল করছিল, কিন্তু আমি একফোঁটা পানিও গড়িয়ে পড়তে দেইনি। কারণ তার মাত্র কিছুদিন আগে থেকেই স্যার আমাকে শেখাচ্ছিলেন- যেকোন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে। আমি মাথা ঠান্ডা রেখেছিলাম কিনা জানিনা; তবে অনবরত নিজেকে শোনাচ্ছিলাম, স্যার বলছেন- be cool. স্যার অফিসে না আসা পর্যন্ত এই ‘be cool’ কথাটাই নিজেকে শুনিয়েছি।
আমি জানতাম, স্যার হয়ত আমাকে কিছু বলবেন না। অনিচ্ছাকৃত ভুল করলে তাঁর কাছে কোন ভয় নেই। কিন্তু এটাতো কোন সান্ত্বনা হতে পারে না। আমি কাজ নষ্ট করেছি, এটাই বড় কথা। ...বাস্তবিকই স্যার আমাকে কিছু বলেননি।
একজন লেখকের কাছে তার লেখা নিজ সন্তানের মত। আমি স্যারের সামনে কিভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, মনে নেই। এক কথাতেই তাঁকে জানালাম যে- আমার হাতে পুরো লেখাটা ডিলিট হয়ে গেছে। স্যারও এক কথাতেই বললেন- কি করবে, আবার করো। এক্ষেত্রে আমাদের ডিজাইনার খুব হেল্প করেছে। কোথা থেকে কিভাবে খুঁজে আগের একটা কপি বের করে দিল, যার ফলে নতুন করে খুব বেশি কম্পোজ করতে হয়নি। কিন্তু বারে বারে করা সেই এডিটিংগুলো মনে করে করে ঠিক করতে আমার পুরো একদিন লেগেছে। আমার বিশ্বাস ছিল আমি পারব। পুরো কাজ শেষে প্রিন্ট দিয়ে পরদিন শেষবেলায় স্যারের হাতে যখন লেখাটা দিলাম, স্যার বললেন- অন্য কেউ হলে আমি এটার আশা ছেড়ে দিতাম, তুমি বলেই আশাহত হইনি এবং কিছু বলিনি; আমার বিশ্বাস ছিল তুমি পারবে। এ কথা শোনার পর চোখের পানি না গড়িয়ে পারে! ভাল কাজ করে স্যারের প্রশংসা পেয়েছি, ভালবাসা পেয়েছি, পেয়েছি পুরস্কারও। কিন্তু কাজ নষ্ট করে এতটুকু তিরস্কারও পেলাম না? এ এক বিরল আচরণ।
এমনই আমার স্যার, সকলের ক্ষেত্রে একই ব্যবহার। এখানকার সব স্টাফদের নিয়ে এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। ছোট, বড়, মেজর, মাইনর, অফিসিয়াল কি ব্যক্তিগত -লিখে বা বলে তা শেষ করা যাবে না। এরকম এক ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসতে পেরে, তাঁর সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত। আমার পারিবারিক, সামাজিক এবং কিঞ্চিৎ ক্ষেত্রে জাতীয় চিন্তা-চেতনা ছাড়াও একান্ত ভূবনের কত ধারণার পরিবর্তন যে তাঁর সংস্পর্শে এসে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
স্যারকে নিয়ে একটা মজার কথা প্রচলিত আছে। আর তা হলো- স্যার নাকি পানি দিয়ে দই বসান। কথাটির অর্থ ব্যাপক। যেখানে কিছুই নেই, সেখান থেকেও স্যার কোন না কোন out put create করেন। মানুষের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলা এবং হতাশ মনে আশার দীপ জ্বালানোর ব্যাপারে তাঁর দৃঢ়তা খুবই প্রশংসনীয়। ‘না’ বলে কোন শব্দ তাঁর অভিধানে নেই। সকল অসম্ভবকে সম্ভব করার মাঝেই যেন তাঁর সার্থকতা। আমার নিজের বা কলিগদের ভেতরের লেখকসত্তা আবিষ্কার, তাও স্যারেরই কৃতিত্ব।
স্যারের সামনে ‘জানিনা’ বললে তবু পার পাওয়া যায়, কিন্তু ‘পারিনা’ বলে এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। মানুষ পারেনা -এটা তিনি বিশ্বাসই করেন না। তিনি প্রায়ই বলেন,impossible is a word, I don’t believe. যে কোন প্রবলেম ডিল করা এবং প্রবলেম সল্ভ করা তাঁর নেশা; সেটি হোক ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় কি আন্তর্জাতিক। কেউ হয়ত বলতে পারেন- জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুধীজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত কাজের output তৈরিতে তিনি সক্ষম হননি। কিন্তু আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে মনে হয়েছে- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর সমাধানে নিয়োজিতদের ঐকান্তিকতা, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টির যে অভাব রয়েছে, অন্ততঃ সেগুলোর অভাব স্যারের নেই। অভাব শুধু তাঁর আইডিয়া শোনার মত স্টেক-হোল্ডারের। স্যারের প্রণীত মডেলসমূহে এবং বিভিন্ন কলাম ও লেখায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু সমস্যার সমূহ সমাধান তিনি দেখিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে যারা অধিষ্ঠিত বা সমস্যার সমাধানে যারা দায়িত্বরত, তাদের সময় কই এসব পড়ার বা তাঁর কথা শোনার। আর তাই হয়ত স্যার তাঁর বিভিন্ন লেখায় ও কলামে নিজকে ‘কাঙাল’ বা ‘ভবঘুরে’ বলে পরিচয় দেন।
স্যার খুবই গতিশীল ও ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ। আমরা যারা স্যারের মত ডায়নামিক পারসনালিটির সহযোগী হিসেবে আছি, তারাও অন্য সাধারণের চেয়ে অবশ্যই আলাদা, একটু স্পেশালও। কিন্তু তা হলে কি হবে, স্যারের গতির সাথে আমরা এখনও সমান তালে চলতে পারি না। তাই আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা যতই তাঁকে পেছনে টেনে ধরি না কেন- তিনি তাঁর নিজস্ব গতি দিয়ে আমাদের সবাইকে ঠিকই টেনে নিয়ে চলছেন সামনের দিকে। এই ঘুনে ধরা সমাজের একটা positive change দেখবেন -এটাই তাঁর কায়মনো কামনা এবং সে সংস্কারেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন দিবানিশি।
প্রতিদিন অফিস ত্যাগের পূর্বে আমরা স্টাফরা আমাদের ফিনিশ্ড কাজগুলো তাঁর টেবিলে দিয়ে যাই। সে কাজের পরিমাণ যত বেশিই হোক না কেন, সকালে এসে দেখি- তাঁর কাছ থেকে সবই চলে এসেছে আমাদের নিজ নিজ ডেস্কে। যত ব্যস্ততা থাকুক, যত রাতই হোক, কাজ পেন্ডিং রাখা স্যার একদম পছন্দ করেন না। কাজের ব্যাপারে স্যার নিজে যেমন সবসময় আপডেট থাকেন তেমনি আমাদেরকেও উৎসাহিত করেন পেন্ডিং না রাখতে। স্যারের সারাদিন কাটে আমাদের যত্ত রকম সমস্যার সমাধানে, আর কাজ করেন রাত জেগে এবং ছুটির দিনগুলোয়। সে কাজের পরিমাণ নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। কেবলমাত্র আন্তরিকভাবে কাজকে ভালবাসলেই এমনটি সম্ভব। এসব দেখে আমার মনে হয়, স্যারকে যদি আমরা জাতীয় নেতৃত্ব দিতে পারতাম, তাহলে আমাদের সমস্যাগুলোর রাতারাতি সমাধান হয়ে যেত, কোন পেন্ডিং থাকত না।
সমাজ পরিবর্তন নিয়ে স্যারের কত যে আইডিয়া! এর একটাও যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে দেশটা বদলে যাবে খুব দ্রুত, উন্নয়ন হবে অবধারিত। বাংলাদেশের স্কুলিং ব্যবস্থা নিয়ে স্যারের প্রণীত ‘এলাকাভিত্তিক স্কুলিং’ মডেলটি স্যার যেদিন প্রথম আমার হাতে তুলে দিলেন, সেটি পড়ে তাঁর চিন্তার গভীরতা উপলব্ধি করে আমি অবাক হলাম। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, এমন অসাধারণ একটা আইডিয়া স্যারের মাথায় এল কি করে? সেই প্রথম কাছ থেকে একজন জিনিয়াস’কে দেখা। তারপর এই মডেল নিয়ে আমিও কাজ করেছি। একসময় মডেলটা আমার মুখস্তই হয়ে গেল, এখন কেবল বাস্তবায়নের অপেক্ষা। এবার আমার একটা অপরাধ স্বীকারের পালা। আমার চাকরির বয়স যখন বছরখানেক, তখন একটা ঘটনা ঘটলো। অফিসের এক স্টাফ হঠাৎ করে উধাও। উধাও হওয়াতে সমস্যা ছিল না; সমস্যা হল পালিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের নামে ও প্রতিষ্ঠান-প্রধানের নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জিডি করাতে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের সাথে অপরাধ করে উল্টো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা! বড় বড় অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারে বা তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা পরিলক্ষিত হলেও এক্ষেত্রে দেখলাম quick service। অঘটনের ১০/১২ দিনের মাথায় হঠাৎ একদিন এসআই (তদন্তকারী পুলিশ) উপস্থিত। শখের চাকরি করতে এসে কি ফ্যাসাদে পড়লাম -এ ভাবনায় আমিতো শেষ। যাহোক, আমরা ক’জন মিলে এসআই’র সাথে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু তিনি আমাদের কিছু বলতে নারাজ। তার এক কথা, প্রতিষ্ঠান-প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, আমি তাকেই বলব; কিন্তু আমাদের এতজনকে ডিঙিয়ে তিনি প্রধান পর্যন্ত পৌঁছতে পারছিলেন না।
স্যার কি জেনেশুনে ইচ্ছে করেই এসআই’র সামনে উপস্থিত হচ্ছেন না, নাকি স্যার জানেনই না যে এসআই এসেছে -এটা আমি বুঝতে পারছিলাম না এবং ব্যাপারটা আমার কেমন কেমন যেন লাগছিল, কারণ স্যারকে আমি সাহসী বলেই জানি।
কথার এক পর্যায়ে স্যার উপস্থিত। এসআই’র দিকে তাকিয়ে অভিযোগ জানতে চাইলেন। এসআই কিছুতেই সবার সামনে বলতে চাচ্ছিল না; বারংবার স্যারকে ইনসিস্ট করছিল, আলাদাভাবে একা শুনতে। কিন্তু স্যারও বারংবারই বললেন- আপনার কাছে কি অভিযোগ রয়েছে, তা সবার সামনেই বলতে পারেন; গোপনে বা একা শোনার মত আমার কিছুই নেই। আমি শুধু স্যারের দিকে তাকিয়েছিলাম। মনে মনে চাইছিলাম, প্রথমে স্যার একা অভিযোগগুলো শুনে নিক। সবার সামনে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনার মত বুকের পাটা আমারতো এখনও নেই। আসলে দুর্বল ছিলাম আমিই। গত ১ বছরে স্যারের প্রতি যে বিশ্বাস, আস্থা ও নির্ভরতা জন্মেছিল -তা হারাতে চাইনি। আমার ভয় হয়েছিল- আজ না জানি কি শুনব, স্যারকে হয়ত আর ভাল জানব না।
অভিযোগ পড়া শুরু হল। আমার পায়ের তলায় মাটি ছিল না। পুরো সময়টায় আমি স্যারের দিকে তাকিয়েছিলাম, তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। একটার পর একটা অভিযোগ পড়া হচ্ছে, স্যার হাসছেন। আসলে অভিযোগের সবই ছিল মিথ্যা, মামুলি আর ভিত্তিহীন, যার কোন প্রমাণেরও প্রয়োজন হয় না।
সেদিনের ঘটনা আমার জীবনের একটা ব্যতিক্রমী ও মূল্যবান অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। এখন আর আমি এসব নিয়ে ভাবি না, ভয়ও পাই না। আমি জানি, আমি যতক্ষণ অন্যায় না করছি ততক্ষণ ভয়ের কিছু নেই। আর আমার এ জোরটুকুও স্যারের থেকেই পাওয়া। এরূপ প্রসঙ্গে স্যার বলেন- সৎ থাকলে এবং কল্যাণের উদ্দেশ্য নিয়ে নিয়মনীতি অনুযায়ী কাজ করলে ভয়ের কিছু নেই।
আমরা একটু বড় হলে বা বিখ্যাত হলে অবলীলায় ভুলে যাই নিজের অতীতকে। ছোট বেলাকার ছোট কাজের কথা তখন আর মনে আনতে চাই না এবং অন্যকে বলতেও চাই না। এক্ষেত্রেও স্যার ব্যতিক্রম। ছোটবেলায় গরু চরানো, মাছ ধরা বা চাষাবাদ কিংবা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে হাটে গিয়ে নিজের চাষ করা সবজি বা ফল বিক্রি -ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদকের এ ধরনের অভিজ্ঞতার গল্প আমরা তাঁর মুখ থেকেই শুনেছি। একজন বড় মাপের মানুষ হয়েও নিজের জীবনের ছোট কাজের এরূপ স্মৃতিকথা বলতে তাঁকে কখনও দ্বিধান্বিত বা লজ্জিত হতে দেখিনি।
আমি মনে করি- বড় থেকে বড় হওয়ার চাইতে ছোট থেকে বড় হওয়াতেই বেশি কৃতিত্ব। এক সময়কার এসকল সাধারণ কাজ করা সেই স্যার এখন আল্লাহ ও নিজের বিবেক ছাড়া কাউকেই ভয় করেন না; অকপটে সত্য কথা বলেন সকলের সাথে, সকল সজ্জন সভায়; অন্যায়ের প্রসঙ্গে কাউকেই ছাড়েন না -হোক না তিনি মন্ত্রী, সচিব বা ভিসি!
দুঃখকে সহজে বরণ করে নেয়া বা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে সহজ ও স্বাভাবিক রাখার মত মনোবল ও দৃঢ়তা স্যারের মাঝে যেমনটি দেখেছি, তেমনটি আর কোথাও দেখিনি। এসব ক্ষেত্রে স্যার বলেন- যার যা আছে তাইতো সে দিবে, যা নেই তাতো দিতে পারবে না। এই একটি কথা দিয়ে নিজকে মানিয়ে নেয়ার শক্তি ও ধৈর্য্য আমাকে অবাক করে। আমরা, স্যারের সহযোগীরা মাঝে মাঝে নিরাশ বা হতাশ হতে চাইলেও স্যারের প্রচন্ড প্রো-একটিভ ও পজিটিভ এটিচিউডের কারণে নিরাশ হয়েও যেন হই না, হতে পারি না। স্যারের পজিটিভ এটিচিউড আমাদের সবসময় চাঙ্গা করে রাখে। রিএকটিভ এই আমার প্রো-একটিভ হওয়ার শুরু, সেও কিন্তু স্যারের হাতেই। আমি সবসময় মনে করি, স্যারের সাথে থেকে যদি এসবই না শিখতে পারি তবে আর কি শিখলাম।
এভাবে, স্যারের দক্ষ ও ব্যতিক্রমী পরিচালনায় এগিয়ে চলেছে আমাদের এই ‘ক্যাম্পাস’ প্রতিষ্ঠান। স্যারের তত্ত্বাবধানে কেউ যদি এখানে ৫টি বছর কাজ করে’ তবে তার নাম যে জিনিয়াসদের তালিকায় উঠে যাবে-এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
আমি বিশ্বাস করি, এমন একজন মানুষের ত্যাগ ও কষ্টের ফসল এই ‘ক্যাম্পাস’ একদিন দেশ ও জাতির উন্নয়নে ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সকলের নজর কাড়বে, অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হবে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন দেশের তরুণ সমাজ ব্র্যাক ব্যাংক বা বাংলালিংক’র মত ক্যাম্পাস-এ তার ক্যারিয়ার গড়তে উন্মুখ হয়ে উঠবে। সে সময় ক্যাম্পাস-এ আমি থাকবো না বা ক্যাম্পাস পত্রিকায় আমার নাম থাকবে না -এটা যেন ভাবতেই পারি না।
আমার এ জীবনে রচনা লেখার প্রয়োজন হয়ত আর হবে না। তবু যদি কখনও Aim in life রচনা লিখতে হয়, তবে নির্দ্বিধায় বলব যে- বড় হয়ে আমি এই স্যারের মত ‘স্যার’ হতে চাই!