ক্যাম্পাস’র ক্যাম্পেইন অভিজ্ঞতা থেকে বলছি..
স্বর্ণা শারমিন
উপ-সহকারী পরিচালক
ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র (সিএসডিসি) পরিচালিত বহুমুখী সমাজ সেবামূলক কার্যক্রমের একটি হলো সামাজিক সচেতনতা কর্মসূচি। এ কর্মসূচির আওতায় প্রতিবছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে শুরু হয়ে বছরব্যাপী দেশজুড়ে চলতে থাকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস তথা ক্যাম্পেইন। বছরের শুরুতে নববর্ষের শুভেচ্ছা কার্ড, দেয়াল ক্যালেন্ডার ও পকেট ক্যালন্ডার, পত্রিকা, ডেস্ক স্লিপ, লিফলেট ক্যাম্পাস’র এসব উপহার এখন সবার কাছে বেশ সমাদৃত, অনেকটা যেন প্রত্যাশিতও। জাতীয় সমস্যা ও সম্ভাবনার ওপর নতুন নতুন স্লোগান নিয়ে প্রকাশিত হয় ক্যাম্পাস’র ক্যালেন্ডার। এবারের স্লোগান হলো
দুর্নীতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয়াবহ সমস্যা,
এ অভিশাপ প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন।
বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-যুবকরা শিক্ষানবিশ হিসেবে এ ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করে। এর মাধ্যমে ছাত্র-যুবকরা জ্ঞানার্জনের অবসরে সমাজ সেবামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, পায় পকেটমানি। তাছাড়া এর মাধ্যমে তারা অফিস আচরণ, টিম-ওয়ার্ক, নিয়মানুবর্তিতা ও ন্যায়নিষ্ঠা, নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ, সম্পাদিত কাজের রিপোর্টিং ইত্যাকার বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান লাভ করে।
মূলত এসব শিক্ষানবিশদের গাইড করার জন্য ক্যাম্পাস’র স্টাফরাও তাদের সাথে এ ক্যাম্পেইনে অংশ নেয়। এতে একদিকে স্টাফদের বাৎসরিক শারীরিক কসরত হয় এবং অন্যদিকে যেসব স্টাফ সারাবছর In house কাজ করে তাদের Field experience হয়।
২০০৮ সালে ক্যাম্পইনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই ক্যাম্পাস’র সাথে আমার জড়িয়ে পড়া। বর্তমানে আমি ক্যাম্পাস’র উপ-সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত। পরপর ৩ বছর অংশগ্রহণ করেছি বাৎসরিক ক্যাম্পেইনে।
ক্যাম্পাস’র সাথে পরিচয়ের আগে রাজধানীর ব্যস্ততম অফিস পাড়া মতিঝিলে গিয়েছি বড়জোর ২/১ বার। কিন্তু সেখানকার কোথায় কোন্ অফিস, সেগুলো কী রকম, সেখানকার কার্যক্রম কী তা কিছুই জানতাম না বা জানার ইচ্ছাও হয়নি কখনো। অথচ ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমার জীবনধারাই পাল্টে গেছে। এখন মতিঝিলের প্রতিটি বিল্ডিং বা প্রতিটি অফিস আমার মুখস্থ। চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি কোন্ বিল্ডিংয়ের পর কোন্ বিল্ডিং বা অফিস।
সচিবালয়, সংসদ ভবন, মন্ত্রীপাড়ার নাম সবাই শুনেছে এবং দেখেছেও হয়ত কেউ কেউ। কিন্তু এগুলোর অন্দরমহলে প্রবেশ এবং পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ কয়জনের হয়েছে? অতি সাধারণ হয়েও ক্যাম্পাস কর্মী হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশের এসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে একাধিকবার।
২০০৯ সালের কথা। ক্যাম্পেইন করতে গিয়েছি সংসদ ভবনে। গেইট থেকে আমাদের ভেতরে ঢোকার পাস দিল, সার্বক্ষণিক সহযোগিতার জন্য সাথে একজন লোকও ঠিক করে দিল। আমাদের কাজ শেষ হতে সারাদিন লাগল, তিনিও আমাদের সাথে সারাদিন ঘুরলেন। সংসদ ভবনের স্টাফ হয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত আমাদের ধন্যবাদ দিলেন, বললেন আমি ৫ বছর ধরে কাজ করলেও এভাবে রুমে রুমে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আজ আপনাদের বদৌলতে আমারও পুরো ভবন ঘুরে দেখা হলো।
প্রকৌশলী লুই আই কান এর ডিজাইনে নির্মিত সংসদ ভবনটি সত্যিই চমৎকার, প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে ডুয়েল সিস্টেম। বছরের পর বছর ধরে কর্মরত কোনো ব্যক্তিও যদি এখানে হারিয়ে যায় আমি অবাক হব না। পুরো ভবনের প্রায় প্রতিটি রুম খুব সুন্দর করে সাজানো-গোছানো। এগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে লাইব্রেরি। এটি এতই বিশাল যে শুধু লাইব্রেরিতেই হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখি দেয়ালে ক্যাম্পাস’র নিদর্শন। গত ৫ বছরের ক্যালেন্ডার একটির ওপর একটি লাগানো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় এমন অনেক নিদর্শন প্রায়ই চোখে পড়ে ক্যাম্পাস কর্মীদের।
আর মন্ত্রীপাড়া? মিন্টু রোড, বেইলী রোড বা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে শুরু করে মন্ত্রী-সচিব বা আইজি’র বাসভবনে যাওয়া আমার রুটিন হয়ে গেছে। তাঁদের অনুরোধে এসব বাসায় আপ্যায়িত হবার অভিজ্ঞতাও মজার।
মন্ত্রীপাড়ায় এ বছরের ক্যাম্পেইনের একটি ঘটনা। সেদিন ছিল ১ জানুয়ারি, শুক্রবার। একজন শিক্ষানবিশ নিয়ে আমার কাজে যাওয়ার কথা সকাল ৯টায়। কিন্তু সে আসতে না পারায় আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কীভাবে কাজ করব। আমার এ অবস্থায় যোগাযোগ হয় আমাদের সি. এক্সিকিউটিভ মোঃ ইউসুফ আলী রানা এর সাথে। তার সেদিন কাজের শিডিউল ছিল না, তাই বাইরে বেরুনোর প্রস্তুতিও ছিল না। ক্যাম্পাস, মানুষ গড়ার কারিগর এমনই ট্রেনিং দিয়েছে এখানকার কর্মীদের যে তাৎক্ষণিক বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন রানা ভাই; আমাকে সহযোগিতা করার জন্য নাস্তা খাওয়ার দেরিটুকু পর্যন্ত তিনি করেননি।
বেইলী রোডের মিনিস্টার্স এপার্টমেন্টের সব মন্ত্রীর বাসায় ক্যাম্পেইন শেষ করে তার বিপরীতে একটি বিল্ডিংয়ে যাব। এমন সময় রানা ভাই বললেন- সামনের বিল্ডিংটা শেষ করেই কিছু একটা খেয়ে নিব, খুব ক্ষুধা লেগেছে। আমি বললাম, ঠিক আছে। সেই বিল্ডিংয়ের একটি ফ্লোরে থাকেন এটর্নী জেনারেল। আমরা তার বাসায় গেলাম, ছুটির দিন বলে তার সাথে দেখাও হলো। নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম; তাকে ক্যাম্পাস’র পক্ষ থেকে গ্রিটিংস কার্ড, পত্রিকা, ডেস্ক সিøপ, ক্যালেন্ডার প্রভৃতি উপহার দিলাম। চলে আসব এমন সময় এটর্নী জেনারেলের স্ত্রী আন্তরিকভাবে অনুরোধ করলেন, কিছু খেয়ে যেতে। বললেন নতুন বছরের প্রথম মেহমান তোমরা, আমার বাসা থেকে তোমরা যদি কিছু না খেয়ে যাও তাহলে সারাবছর আমার ঘর মেহমানশূন্য থাকবে।
নাস্তার টেবিলে কম করে হলেও ১০ রকম আইটেম ছিল। তার মধ্যে ২ রকম মিষ্টান্ন খেলাম আমি। আর রানা ভাই সকালের নাস্তা ভালোমতোই সারলেন। তারপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এসে রানা ভাই আর আমি হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার উপক্রম এই ভেবে যে, ভাবলাম কী আর হলো কী! এতো গেল এবছরের কথা। এর আগের বছরগুলোতেও ক্যাম্পাস’র সুবাদে মন্ত্রী-সচিবদের বাসায় আপ্যায়িত হবার বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছে। এছাড়াও ক্যাম্পেইনকালীন প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন হোটেল/রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভিজ্ঞতার সুযোগতো আছেই।
ক্যাম্পেইন শেষে সফল শিক্ষানবিশদের সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে ক্যাম্পাস। আবার বেস্ট লিডার, বেস্ট কো-লিডার এবং বেস্ট-পার্টিসিপেন্ট পুরস্কারও দেয়া হয়। ২০০৮ সালে ক্যাম্পেইনের সফল অংশগ্রহণকারী হিসেবে সার্টিফিকেট পেয়েছিলাম। ২০০৯ এ পেয়েছি বেস্ট পার্টিসিপেন্ট পুরস্কার। ২০১০ এ আমার জন্য কোনো কিছু অপেক্ষা করছে কিনা এখনও জানি না।
ক্যাম্পেইন করতে গিয়ে একটি বিষয় আমার নজরে পড়েছে, তা হলো- রাস্তায় চলার পথে অনেককে অনেক রকম লিফলেট বিতরণ করতে দেখা যায়। সাধারণ লোকরা সেগুলো হাতেই নিতে চায় না বা নিলেও না পড়েই সাথে সাথে ফেলে দেয়। অথচ ক্যাম্পাস’র সমাজ সচেতনতামূলক যে সকল লিফলেট আমি বিতরণ করেছি, তার একটিও কাউকে ফেলে দিতে দেখিনি। বরং অনেকেই চেয়ে নিয়ে পড়ে, এমনকি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে যায়। ক্যাম্পাস’র ক্যালেন্ডার বা স্টিকারের ক্ষেত্রেও এরূপ আগ্রহ ও ভালোবাসা লক্ষ্য করা যায়। প্রায় ৯৫% মানুষের কাছেই ক্যাম্পাস’র এ ধরনের কার্যক্রমের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, ৩% মানুষের মধ্যে আছে নিরপেক্ষতা, বাকি ২% মানুষ এ ধরনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে। ক্যাম্পাস’র সমাজ সচেতনতামূলক বিভিন্ন সেøাগান সংবলিত স্টিকার-ক্যালেন্ডার-লিফলেট ইত্যাদি জনগণের মাঝে বিতরণ করা এ ২% মানুষ পছন্দ করে না অর্থাৎ তাদের স্বার্থে আঘাত হয় বলে প্রতীয়মান। অবশ্য আমাদের স্যার অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক সব সময় উদাহরণ হিসেবে পানির গ্লাস দেখিয়ে বলেন ‘যেটুকু পানিতে ভরা আছে সবসময় সেদিকে তাকাবে, যেটুকু খালি আছে সেদিকে তাকিয়ে আফসোস করবে না, বা নিজেকে ছোট করবে না। দেখবে খালিটুকু কোনো এক সময় ভরে উঠেছে’ এ বিশ্বাসেই উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা ক্যাম্পাস কর্মীরা নিজেদেরকে পরিচালনা করছি।
আসলে ক্যাম্পেইনে এতরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে যে বলে শেষ করার নয়। এ ক্যাম্পেইনে সফলতার মূলমন্ত্র হলো নিজে সৎ ও দেশপ্রেমী হওয়া, অন্যের মাঝে সততা ও সেবার মানসিকতা তৈরি করা এবং সামাজিক সচেতনতায় উদ্বুদ্ধ করা। ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক স্যার সবসময় বলেন শুধু টাকা-পয়সার দিক থেকে সৎ হলেই তাকে সৎ বলে না, অন্যের প্রতি চিন্তার ক্ষেত্রেও সৎ হতে হবে। অর্থাৎ কাউকে ঠকানো বা কারো প্রতি ঈর্ষা-হিংসা, অমঙ্গল চিন্তা, অসহযোগিতার মনোভাব ত্যাগ করতে তিনি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন সর্বদা। এর সাথে আর একটি দর্শন যোগ করেন তিনি। সততার ক্ষেত্রে ৯৯% হলে চলবে ঠিকই, তবে ১০০% হলেই প্রচন্ড সৃজনীশক্তি বা আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন সম্ভব। আমরা সবাই (ক্যাম্পাস কর্মীবৃন্দ) তাঁর এ ধরনের দর্শনে আকৃষ্ট হই, পালন করার চেষ্টা করি। শুধু ক্যাম্পাস’র কর্মীবৃন্দই নয়, ক্যাম্পাস অফিসে অতিথি হয়ে যখনই যারা এসেছেন, তারাও সম্পাদক মহোদয়ের এরূপ দর্শনে মুগ্ধ হয়েছেন।
ক্যাম্পেইনের যে মূল উদ্দেশ্য, তাহলো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও আলোকিত জাতি গঠনে নিজে সচেতন হওয়া এবং সমাজের অন্যদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। নিজের কাজের প্রতি সততা, নিষ্ঠা, আস্থা আর ভালবাসা থাকলে সৎ সাহস নিজের ভেতর থেকেই তৈরি হয়, যা এ ক্যাম্পেইনের জন্য অতীব জরুরি। শুধু এ ক্ষেত্রে নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এ বিষয়গুলো বিশেষ প্রয়োজনীয়।
প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা এ মর্মে আবব্ধ হই সততা, আস্থা, ভালোবাসা আর জবাবদিহিতার সাথে কাজ করব সর্বদা। তবেই সেদিন খুব বেশি দূর নয় যেদিন এই সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ চির উন্নত শির হয়ে বেঁচে থাকবে পৃথিবীর বুকে।
সমাজের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক আলোকিত জাতি গঠনে ক্যাম্পাস’র কার্যক্রম সফল হোক এ কামনা করছি।
প্রথম প্রকাশঃ মে ২০১০