ক্যাম্পাস’র সব কিছুতেই দেখেছি দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন

ভবতোষ কুমার সরকার
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ

ক্যাম্পাস’র সাথে আমার পথচলা ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে। এই সময়ে আমি ক্যাম্পাস’র কাছ থেকে অনেক কিছুই পেয়েছি, অনেক কিছু শিখেছি -যা আমার জীবন চলার পথকে পাল্টে দিয়েছে। এখানে যোগদান করার আগে আমি এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। তবে আগের চাকরির সুবাদে মাঝে মাঝে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্যাম্পাস’র ক্যালেন্ডার, লিফলেট বা স্টিকার দেখতাম -যাতে সমাজ সচেতনতামূলক বা মানুষের জীবনমান উন্নয়নের নানা কথা লেখা থাকতো। তখন ভাবতাম, ওটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের দ্বারা পরিচালিত কোনো একটা সংগঠন হবে হয়তো। কিন্তু এখানে এসে জানতে পারলাম, জনসেবামূলক এ প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাস’র কাজের পরিধি কত বিশাল! আসলে বাইরে থেকে কোনো কিছুর ভেতরের গভীরতা বা প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। সেই ধারণাটা অন্ধের হাতি দেখার গল্পের মতো হয়ে যায়। যারা ক্যাম্পাস’র সাথে বা ক্যাম্পাস’র কোনো না কোনো কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত, কেবল তারাই এর বিশালতা বা তাৎপর্য বুঝতে পারে। এর আগে আমি যে কোম্পানিতে কাজ করতাম তার সুবাদে আমাকে দেশের অনেক জেলাতেই যেতে হয়েছে এবং সেখানকার অফিসগুলোর কর্মকর্তা বা অনেক ক্ষেত্রে কর্মচারীর সাথেও কথা বলতে হয়েছে। ওখানে আমাকে মাঝে মাঝে অনেক নেগেটিভ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে, মাঝে মাঝে আবার অনেকের কাছে হেয়প্রতিপন্নও হতে হয়েছে। সবদিক থেকে আমার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষও মাঝে মাঝে আমার দিকে তীর্যক বাক্য ছুড়ে দিত। আমি সেগুলোকে তেমন গায়ে মাখতাম না।

ক্যাম্পাস’র এই জগতটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে সবসময় সততার অনুশীলন করানো হয়; অন্যের প্রতি, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখানো হয়। সত্যিকারের মানুষ হতে হলে যেসব মানবীয় গুণাবলী থাকা দরকার, তা ক্যাম্পাস’র বহুমূখী কার্যক্রমের মাধ্যমে শেখানো হয় এবং তা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেয়ারও চেষ্টা করা হয়। ফ্রি ডায়নামিক কম্পিউটার ট্রেনিং, ফ্রি ইংলিশ এন্ড স্মার্টনেস কোর্স ফর লিডারশিপ, সমাজ সচেতনতা কর্মসূচি, প্রোএকটিভ এন্ড পজিটিভ এটিচিউড সেমিনারসহ বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ তারই কয়েকটি উদাহরণ। এসমস্ত কোর্সের মাধ্যমে একজন মানুষ নিজেকে আমূল পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। কারণ, এখানে শুধু বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা দেয়া হয় না। মূল বিষয়ের বাইরেও একজন শিক্ষার্থীকে আরো অনেক বাস্তবধর্মী জ্ঞানে পারদর্শী করে তোলা হয়, তাদেরকে কর্মজীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়; যেটা তারা পরবর্তীতে বিভিন্নক্ষেত্রে তথা দেশ ও জাতির উন্নয়নকল্পে কাজে লাগাতে পারে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো- এই কোর্সগুলোর জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেয়া হয় না। তারা বিনামূল্যে এই কোর্সগুলো করতে পারে। আবার কোর্সশেষে তাদেরকে সার্টিফিকেটও দেয়া হয়। সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে উচ্চ গ্রেডপ্রাপ্ত একজনের ছবি ক্যাম্পাস পত্রিকাতেও ছাপা হয়। কোর্সের উদ্বোধন এবং সার্টিফিকেট প্রদানের জন্য এখানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেইসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় এমনই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদেরকে, যাঁরা ব্যক্তি এবং কর্মজীবনে সফলতার চূড়ায় আরোহণ করেছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছ থেকে সাফল্যের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হয় এবং নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সেখান থেকে তারা তাদের নিজেদের সফল ক্যারিয়ার তৈরির বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পায়। কোর্স শেষে তারা একেকজন একেক দিকে চলে যায়, কিন্তু ক্যাম্পাস’র সাথে তাদের বন্ধন থাকে অটুট। প্রতিটি কোর্সে অসংখ্য স্টুডেন্ট ভর্তি হয়, যার বেশিরভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এছাড়া অন্যান্য ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্টুডেন্টও এই ফ্রি কোর্সগুলোতে ভর্তি হয়। এরমধ্যে ইংলিশ এন্ড স্মার্টনেস ফর লিডারশিপ কোর্স এর প্রতি ব্যাচে স্টুডেন্ট সংখ্যা হয় প্রায় ৮০/৯০ জন। ক্লাসের দিন পুরো হলরুম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এখানকার অন্যান্য কোর্সগুলোও সমানভাবে জনপ্রিয়।

আর একটা বিষয় আমি বলতে চাই- এমন ধরণের কোনো প্রতিষ্ঠান আদৌ আছে বলে আমার মনে হয় না, যে প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিকভাবে এত বছর ধরে সফলতার সাথে টিকে আছে। ক্যাম্পাস সুদীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে সমাজ-দেশ ও ছাত্র-যুব উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমি এখানে যোগদান করার পর থেকেই একটা বিষয় লক্ষ্য করি- এখানকার পরিবেশ অন্যান্য অফিস থেকে আলাদা। লাক্সারিয়াস বা খুব জাঁকজমকপূর্ণ কোনো অফিস নয়, তবে সবকিছু যেন সুশৃঙ্খল ও পরিপাটি করে সাজানো। লম্বা হল রুমের মতো একটা মাঝারি সাইজের অডিটোরিয়াম, যেখানে এক সারি টেবিল লম্বা করে একটার সাথে অন্যটা লাগোয়া অবস্থায় পাতা আছে। তার উপর নাম না জানা বিভিন্ন ধরণের গাছ সাজানো। তার কোন্টা যে আসল আর কোন্টা যে আর্টিফিসিয়াল বোঝা মুশকিল। এছাড়া সামনের কাঁচে ঘেরা দেয়ালের গা ঘেঁষেও নানা ধরনের বাহারি জীবন্ত গাছের সমারোহ। আর টেবিল সারির উভয় পাশে অনেকগুলো চেয়ার সাজানো। প্রথম অবস্থায় আমার একটু অবাকই লাগছিল। মনে মনে নিজের কাছেই প্রশ্ন করছিলাম, এত চেয়ার টেবিলে কারা কাজ করে? পরে জানতে পারলাম, এখানেই বিভিন্ন ফ্রি কোর্সের ক্লাস নেয়া হয় এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় এটাকেই অডিটোরিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হলরুমের সাথে আরো তিনটি রুম আছে। এর একটা রুম আমাদের সকলের অভিভাবক ক্যাম্পাস স্যোসাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা-মহাসচিব এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক ড. এম হেলাল স্যারের, তার পাশে আছে কম্পিউটার রুম, সেখানে বেশ কতকগুলো কম্পিউটার সেট করা; যেখানে বসে কম্পিউটার কোর্সের শিক্ষার্থীরা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করে। আর একটা রুম হলো লাইব্রেরি, যেখানে বিভিন্ন লেখকের ৬ হাজারের অধিক বই রয়েছে। লাইব্রেরির সাথে আর একটা ছোট স্টোর রুম আছে, যেখানে ক্যাম্পাস পত্রিকার পূর্ববর্তী সংখ্যাগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয় বছরের পর বছর।

আমি এখানে যোগদান করার পর থেকে আজ অবধি শিখছি। এখনো অনেক ক্ষেত্রে নিজের অজান্তেই অজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে থাকি, অনেক কাজ এখনো পুরোপুরি সঠিকভাবে করতে পারি না। কোন্ কাজটা কীভাবে করলে বুদ্ধিদীপ্ত হবে তা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল হয়ে যায়। এখানে ক্ষতিপূরণও গুনতে হয় মন্দ কাজ বা ভুল করার কারণে। ছোট ভুলে কম ক্ষতিপূরণ, বড় ভুলে বেশি ক্ষতিপূরণ। তবে সেই ক্ষতিপূরণের টাকা অফিস ফান্ডে জমা হয় না, জমা হয় স্টাফদের বিশেষ আপ্যায়ন ফান্ডে। যে ফান্ডের টাকা স্টাফরা নিজেরাই তাদের বিশেষ খাবার-দাবার কিংবা রিফ্রেসমেন্টে খরচ করে থাকে। তবে দৈনন্দিন নরমাল আপ্যায়ন বা অতিথি আপ্যায়নের সকল খরচ অফিস ফান্ড থেকেই বহন করা হয়। তাই এটা নিয়ে কারো কোনো কমপ্লেইনও নেই, থাকারও কথা না।

এখানে যে শুধু ক্ষতিপূরণেরই ব্যবস্থা আছে, তা কিন্তু না। ভালো কাজের জন্যও পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে এবং পুরস্কারের পরিমাণ ক্ষতিপূরণের চেয়ে ঢের বেশি হয়। আবার অন্যের ভুল ধরিয়ে দিতে পারলেও কখনো কখনো পুরস্কার মিলে। আর সেইসব পুরস্কারের টাকা অফিস ফান্ড থেকে দেয়া হয়। অর্থাৎ পুরস্কারের সব টাকা অফিস ফান্ড থেকে দেয়া হলেও ক্ষতিপূরণের টাকা অফিস ফান্ডে কখনোই জমা হয় না; তা যায় ক্ষতিপূরণ প্রদানকারীদেরই পেটে। সুন্দর, পরিচ্ছন্নতা ও স্বচ্ছতার চর্চা কিংবা অবিরাম সংস্কার চর্চার এত চমৎকার পদ্ধতি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে আমি দেখিনি, কিংবা কারুর কাছ থেকে শুনিওনি। আরেকটা বিষয় এখানে না বললেই নয়, তা হলো- আমার জানামতে ক্যাম্পাসই হয়তো একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে একজন নিম্ন পদস্থ কর্মচারীও নিঃসংকোচে বসের সমালোচনা করতে পারে, তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতি বলতে পারে। অর্থাৎ এখানে সব কিছুর মধ্যেই একটা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বিরাজ করে। শুধু কাজের ক্ষেত্রেই নয়, স্টাফদের পেমেন্ট দেয়ার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। পেমেন্ট নিয়ে কোনো তালবাহানা বা ঢিলেমী এখানে নেই। প্রতিমাসের নির্ধারিত তারিখে বেতন ও সম্মানী পরিশোধ করা হয়। এছাড়া প্রেস-বাইন্ডিং বিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজের বিল তাদের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পৌঁছে দেয়া হয়, কারুরই বিলের জন্য এ অফিসে আসতে হয় না; যা আরেক নজীরবিহীন ঘটনা। অর্থাৎ যার যা প্রাপ্য তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করা হয়। অন্যের পাওনা দ্রুত পরিশোধ করে দায়দেনা মুক্ত থাকার ক্ষেত্রে ক্যাম্পাস’র ফাউন্ডার ড. হেলাল স্যার একেবারে অনড়। তাই অন্যের কাছে নিজ প্রতিষ্ঠানের কোটি টাকা বকেয়া পড়ে থাকলেও তজ্জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদেরকে কখনো শাস্তি দেননি, কিন্তু অন্যের পাওনা কিংবা অন্যের কাছে এ প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা পরিশোধে ব্যর্থ কর্মকর্তাদেরকে তিনি বহুবার শাস্তির আওতায় এনেছেন। এ বিষয়ে তাঁর লেখা সর্বক্ষেত্রে অবিরাম সাফল্যের বিশেষ মানুষ হতে ১০ দিগ্দর্শন বইয়ে দায়িত্বশীল হওয়া এবং দেনা ও দায় মুক্ত থাকা শীর্ষক আর্টিকেলে তিনি সরাসরি লিখে দিয়েছেন, ‘কেউ যদি যৌক্তিক দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারে যেÑ বিনা কারণে আমার কাছে কারুর পাওনা বাকি পড়ে আছে, তাহলে তার সব পাওনা পূরণতো করবই এবং সেই সাথে তাকে অন্তত ১০,০০০ টাকা পুরস্কার হিসেবে প্রদান করব’।

নিজের মেধা ও কর্মদক্ষতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে আয়ের পরিধিকে ইচ্ছামতো বাড়ানোর সুযোগও এখানে আছে। একজন এভারেজ পার্সনও এখানে এসে সিস্টেম ওয়াইজ বা সঠিকভাবে কাজ করার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে ওঠে অনন্য। এটা যে কারো জন্য অনুপ্রেরণার একটি উৎস হতে পারে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)