ক্যাম্পাস’র সব উদ্যোগই যে ব্যতিক্রম, তার পুনঃপ্রমাণ মিলল, যেদিন ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক মহোদয় স্টাফদের সবাইকে নিয়ে ২৪ ঘন্টার ক্যাম্পিংয়ের পরিকল্পনার কথা জানালেন। তাঁর এ আচমকা ঘোষণাটি আরও বেশি চমকপ্রদ ছিল এ কারণে যে, এ ক্যাম্পিং হবে তাঁর সদ্য ওঠা নতুন ফ্ল্যাটে।
ক্যাম্পাস স্টাফরা সবাই মিলে যেন এক পরিবার। এখানে নতুন কোন স্টাফ এলে প্রতিষ্ঠান প্রধান থেকে শুরু করে সকলে তাকে যেভাবে আপন করে নেয় এবং যেভাবে হাতে ধরিয়ে কাজ শেখায়, উন্নত মনন ও জীবন দর্শনের তালিম দেয় -আর কোন কর্মস্থলে এমন সুযোগ ও পরিবেশ আছে কি না, আমার জানা নেই। আর তাই আমাদের স্যার তাঁর নতুন ফ্ল্যাটে উঠে বিভিন্ন সম্পর্কের মানুষদের নিয়ে কত অনুকরণীয় উপস্থাপনায় কতভাবে যে খাওয়ালেন, তার ইয়ত্তা নেই। এরপর আবার ২৪ ঘন্টা থাকার পরিকল্পনা! আমি প্রথমে একটু বিব্রতই বোধ করছিলাম, কিন্তু স্যারের সাথে অন্যদের উৎসাহ দেখে সে ভাব আর বেশিক্ষণ টিকল না।
কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি ও অবসাদ থেকে মুক্তি দিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি বুধবার বিকেল ৪টা থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত ক্যাম্পিংয়ের সময় ঠিক হল। এ সময়ের পুরোটাই যেন কাজে লাগে ও উপভোগ্য হয়, তার জন্য করা হল এক বিশাল পরিকল্পনা। ক্যাম্পিংয়ের নাম দেয়া হল ‘24 hours program of excursion & learning for Campus Staffs’. অফিসে স্যার প্রতি পদে পদে আমাদের গাইড করেন। তাই এ রিল্যাক্সের সময়েও আমাদের জন্য যে শিক্ষণীয় কিছু থাকবে -এটা অবশ্য আমি আগেই বুঝেছিলাম।
পরিকল্পিত কর্মসূচির এক কপি করে সব স্টাফকে দিয়ে দেয়া হল। আমরা যথারীতি বুধবার ৪টায় তোপখানা রোডে স্যারের নতুন ফ্ল্যাটে উপস্থিত হলাম। আসরের নামাজের পর স্যার আমাদের ব্রিফ করলেন -এ ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। যেকোন পরিবেশে সকলের সাথে মিলে থাকা, খাওয়া বা আনন্দ করার তথা মানিয়ে নেয়ার বা এডজাস্টমেন্ট ক্যাপাসিটি বাড়ানোই এ ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্য। তাছাড়া ক্যাম্পিংকালীন সবাই এক কমান্ডে একইসাথে এককাজ করে, যাকে বলে টীম ওয়ার্ক। এক কথায় ক্যাম্পাস স্টাফদের টীম স্পিরিট ও পারস্পরিক এডজাস্টমেন্ট ক্যাপাসিটি বাড়ানোই ছিল এ ক্যাম্পিংয়ের মূল উদ্দেশ্য।
ক্যাম্পিং প্রি-ব্রিফিংয়ের পর বিকেলের নাস্তা সারলাম চিকেন ভেজিটেবল স্যুপ ও ব্রেড দিয়ে। এরপর শুরু হল খেলাধুলা ও আড্ডা। ক্যাম্পিংয়ের পুরো সময়ে আমাদের সাথে ছিল স্যারের মেয়ে রাইসা এবং ছেলে মাহীর। অবশ্য তাদের গেস্টসুলভ আচরনের চেয়ে হোস্টাইল আচরণই ছিল অধিক লক্ষ্যণীয়। কারণ আমাদেরকে সহযোগিতার বিষয়ে তাদের ওপর কিছু কর্তব্য বেধে দেয়া ছিল। ক্ষুদে বিজ্ঞানী মাহীরের কাজ ছিল সাউন্ড সিস্টেম ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসেস কন্ট্রোল। স্কাউট লিডার রাইসার কাজ ছিল গোছগাছ করা এবং সবার খাবার পানি সরবরাহ। ছোট ছেলে ৬ মাসের ওয়াসিরও অবশ্য আমাদের সাথেই ছিল, তবে সবার কোলে কোলে। ইনফ্যাক্ট ক্যাম্পিংয়ে আমার বড় আকর্ষণ ছিল এই ওয়াসির। তাকে কোলে নেয়া, তার সাথে দুষ্টুমি বা খেলা করার কোন সুযোগ আমি মিস করিনি।
যা হোক, খেলাধুলার পর্বটা আমার জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। আমরা চারজন মেয়ে-স্টাফ লুডু খেলছিলাম। স্যার বললেন, আমাদের মধ্যে যে ফার্স্ট হবে, তিনি তার সাথে লুডু খেলবেন। ছেলেরা একপাশে দাবা খেলতে বসে গেল। বাব্বা, কি বোরিং খেলা! সেই যে গালে হাত দিয়ে বসে আছেতো বসেই আছে, কোন গুটিও চাল দেয় না, আবার হারও মানে না। আর এদিকে আমি লুডু খেলায় লাড্ডু খেলাম অর্থাৎ লাস্ট হলাম। কিন্তু আমাদের লুডু খেলার বিজয়ী স্যারের সাথে লুডু খেলতে গিয়ে কি নাকানি চুবানি যে খেল! যাকে বলে একেবারে গো-হারা।
এর মধ্যে মাগরিব নামাজের সময় হয়ে গেছে। ছেলেরা ড্রইং রুমে জামায়াতে আর মেয়েরা ভিতরের রুমে নামাজ পড়ে নিল। স্বাস্থ্যসম্মত ডিনারের সময় অনুযায়ী আমরা সাড়ে ৭টায় ডিনার করলাম। ডিনারের আইটেম ছিল চিকেন সসেজ পোলাও, ব্রেড, ইলিশ দোপেঁয়াজা, ঝাল মুরগি, মেয়নিজ সালাদ আরও কত কী। এত্ত খাবার কি একসাথে খাওয়া যায়! স্যার অবশ্য সবাইকে বারবার বলছিলেন, বেশি বেশি খেতে। খাবার নেয়ার সময় আমাদের জন্য অনেক লেসন ছিল। যেমন সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে প্লেটে খাবার তুলে নেয়া; প্রথমে অল্প নিয়ে টেস্ট করে তারপর পছন্দমত আইটেম বেশি করে নেয়া; ইচ্ছেমত খাওয়া কিন্তু খাবার মোটেই নষ্ট না করা; খাবার নেয়ার সময়ে সবার সমান অধিকারের প্রতি সচেষ্ট থাকা, খাওয়ার পর নিজ নিজ প্লেট ধুয়ে রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি।
ডিনার শেষে এশার নামাজ, তারপর সবাই মিলে সিনেমা দেখা। স্লামডগ মিলিওনিয়ার আমরা অনেকেই দেখেছি, কিন্তু স্যারের ইচ্ছা আমরা সবাই মিলে এ সিনেমাটি দেখব। দৃঢ় সংকল্প ও ইচ্ছা মানুষকে কত বড় করতে পারে, কিভাবে বড় হতে হয়, কিভাবে সামাজিক অবিচার-অনাচার প্রতিরোধ করতে হয় -সে শিক্ষা নিতেই এ ছবি দেখা। তবে সত্যি কথা বলতে কি, সিনেমা থেকে আমি তেমন কিছু শিখেছি কিনা বুঝতে পারছি না। আমার কেবল মনে হয়েছে সিনেমার নায়কের অবজারভেশন ক্যাপাসিটি ভাল ছিল, সাথে ভাগ্যটাও ছিল ভাল। জীবনে বড় হতে হলে অবজারভেশন ক্যাপাসিটি ভাল থাকতে হয় এবং স্মৃতিশক্তিও ভাল হতে হয়। তাছাড়া সৎতো হতেই হবে। তবে কমলা আর আঙুর খেতে খেতে সকল সহকর্মী একত্রে সিনেমা দেখতে ভালই লেগেছে।
রাত সাড়ে দশটার দিকে সিনেমা দেখা শেষে ডেজার্ট খেলাম। তাতে ছিল পুডিং, নাড়ু, গার্লিক বিস্কিট, গ্রীন টি, কফি ইত্যাদি। এরপর শুরু হল আমাদের ক্যাম্পিংয়ের বড় আকর্ষণ- রাতের ঢাকা পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ। ক্যাম্পাস পরিবার হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। এরই মধ্যে স্যার কখন যেন সবার জন্য রং-বেরংয়ের ক্যাপ কিনে রেখেছেন। সেই ক্যাপ মাথায় দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে সে কি হুলস্থুল! বাতাসে সবার ক্যাপ উড়ে যাচ্ছে, একমাত্র আমার ক্যাপ ছাড়া। সবাই ক্যাপের পেছনে দৌড়াচ্ছে, রাস্তার এপার থেকে ওপারে। বাতাসের বেগতিক অবস্থা দেখে আমার ক্যাপটা এমন একজনকে পাচার করে দিলাম -যার ক্যাপ ছিল না।
এ পর্বে আমরা অপূর্ব মজা করেছি; প্রায় ২ ঘন্টা হেঁটেছি। সেগুনবাগিচা থেকে শুরু করে তোপখানা রোড, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, বঙ্গভবনের কোল ঘেঁষে গুলিস্তান, আব্দুল গনি রোড, দোয়েল চত্বর, শহীদ মিনার, বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, শেরাটন, রমনা পার্কের পাশ দিয়ে মিন্টু রোড তথা মন্ত্রীপাড়া হয়ে শিল্পকলা একাডেমী আরও কত কী! আমি গুছিয়ে বলতে পারব না, কারণ আমি রাস্তাঘাট ভাল চিনি না। তাছাড়া আমার একদমই হাঁটা হয় না বলে আমি আরও তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলাম, কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি বুঝতেই পারছিলাম না। তবে পিছে পড়ে থাকিনি। সবার সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটেছি এবং অনেক মজা করেছি। গলা ছেড়ে গান গাওয়া থেকে শুরু করে ক্যানভাসিং, কৌতুক, কমেডি সব চলছিল এবং সবাই কিছু না কিছু করছিল। প্রথমে আমরা হাত ধরাধরি করে শান্তভাবেই হাঁটছিলাম। এরপর কখন যে গলা ছেড়ে, কে কার চেয়ে কত জোরে গাইতে শুরু করলাম.., বাংলা-ইংরেজি-হিন্দী-উর্দু কোন গানই যেন বাদ পড়েনি।
রাতের এই হন্টন পর্বে আমরা আমাদের কলিগদের মাঝে লুকায়িত কত গোপন প্রতিভার খবর যে পেলাম। আমরা সবাই যে এক একজন কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, কৌতুক অভিনেতা বা কবি-সাহিত্যিক-ছড়াকার-এন্টারপ্রেটার এবং আরো বহুকিছু -তাতো শুরুতেই বোঝা গিয়েছে। এরপর একে একে অন্যসব প্রতিভার মুখোশ খুলতে শুরু করল। আমাদের এক সিনিয়র কলিগ অতিরিক্ত পরিচালক মি. গিয়াস হাঁটতে হাঁটতে ড্যান্স দেখিয়ে এবং পুরো সময় জোকিং করে বেস্ট জোকারের উপাধি পেয়ে গেলেন। আর এক জুনিয়র কলিগ সঞ্জয় রাস্তার মাঝখানে এমনই ড্যান্স দেখাল যে বেস্ট ড্যান্সারই হয়ে গেল। এদের প্রতিভায় মুগ্ধ স্যার দু’জনকেই পুরস্কৃত করার তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিলেন।
এখানেই শেষ নয়। স্বরচিত কবিতা শোনাল আমাদের কবি-কলিগ। যখন আর কিছুই মনে পড়ছিল না, তখন খোলা রাস্তায় গলা ছেড়ে সেই যে কি চীৎকার এক একজন! এভাবে স্ব স্ব উদ্ভাবিত উপায়ে আমরা এ হন্টন পর্বকে পুরো সময় প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য করে রেখেছিলাম। ঘরে ফিরেছি রাত একটায়।
ঘরে ফিরে আর এক প্রস্থ খাবার পর্ব; এবার গাজরের হালুয়া, পুডিং ও দুধ। আমাদের সিনেমা দেখা একটু বাকি ছিল, তা শেষ করলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী এবার ‘যেমন খুশি তেমন করো’ পর্ব। কিন্তু হাঁটার পর্বে যেমন খুশি তেমন আমরা এতই বেশি করেছি যে, সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাই সে পর্বে না গিয়ে ঘুমিয়ে পড়াতেই সবার বেশি উৎসাহ ছিল। মাস্টার বেডরুম মেয়েদের ঘুমের জন্য নির্ধারিত ছিল। সেখানে অবশ্য গুটুর গুটুর করে কিছুক্ষণ গল্প চলছিল। ঘুমিয়েছি রাত আড়াইটায়।
পরদিন সকাল ৯টায় আবার শুরু হল ক্যাম্পিং সেশন। আমাদের যেসব কলিগ রাতে ছিল না, তারাও এরইমধ্যে চলে এসেছে। ভিন্ন স্বাদের গাজরের জুস ও সেদ্ধ মটরশুঁটি খেয়ে আমরা ইয়োগা করলাম; তারপর ১০ মিনিটের বিশেষ মেডিটেশন করলাম- ব্যক্তিগত সুখ, সামাজিক কল্যাণ এবং ক্যাম্পাস পরিবারের সমৃদ্ধি কামনা করে।
এরপর সকালের নাস্তা, যা ছিল এক বিশাল আয়োজন। নান রুটি, চিকেন, পায়েস, মিষ্টি আর নানা ফলের সমাহারে সবাই হিমশিম খাচ্ছিল -কোনটা খাবে আর কোনটা খাবে না ভেবে। যা হোক, নাস্তা সেরে আমরা ‘দি ব্রেভ হার্ট’ -আরেকটি শিক্ষণীয় ছবি দেখলাম। এ ছবি আমি আগে দেখিনি, ইংরেজি ছবি আমার তেমন পছন্দও নয়। তবে এ ছবি থেকে একটা শিক্ষা পেয়েছি। আর তা হল, সৎ পরিকল্পনায় অটল থাকলে সাফল্য আসবেই আসবে। আসলে আমরা অল্প দুঃখে এত কাতর হই যে, শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের মনেবাল থাকে না। তাছাড়া আমাদের ধৈর্যও এত কম যে, ভাল পরিকল্পনায় শেষতক লেগে থেকে তা বাস্তবায়ন করতে পারি না। তাই এ ছবি থেকে আমার জন্য লেসন ছিল- ‘তুমি যা চাও, তা না পাওয়া পর্যন্ত লেগে থাক’।
আমার জীবনে অবশ্য এ শিক্ষাটার খুব দরকার ছিল। আমি অনেক ভাল ভাল কথা শুনেছি, জেনেছি। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে এগুলো পালন করায় আমার কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। যার জন্য মাঝে মাঝে আমাকেই লস দিতে হয়। আমি আশা করছি, এ ছবির নায়ক মেল গিবসনের দৃঢ়তা আমার মাঝেও সংক্রমিত হবে এবং আমাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।
সিনেমার মাঝে খাবার ব্রেক ছিল। মাখনে সেদ্ধ ব্রোকলি, বেবিকর্ন, গাজর আর ফুলকপি আমার জন্য ছিল এক নতুন স্বাদের। এছাড়াও ছিল নানা রকম ফল, চা-কফি। সকালের ভরপেট নাস্তার পর এ পর্বে অনেকেই তেমন কিছু খেতে পারেনি।
এরপর যোহরের নামাজের পর শুরু হল আরেক দফা প্রতিভা দেখানো পর্ব, অর্থাৎ যেমন খুশি করো। গান, কৌতুক, ম্যাজিক আর ধাঁধার পাশাপাশি কখন যে নাচ শুরু হল, তা আর মনে নেই। কেবল এটুকুই মনে আছে, আমরা সবাই নিজস্ব তালে ও ছন্দে এক সাথে নাচানাচি করছিলাম। পরিবেশ মানুষকে কতখানি প্রভাবিত করে, তার প্রমাণ মিলল, যখন আমাদের সবচেয়ে লাজুক কলিগ, সিনিয়র ডিজাইনার মনিরকেও দেখলাম, সবার সাথে তাল মিলিয়ে নাচছে। সর্বোপরি আমাদের সম্পাদক স্যারের কণ্ঠে ‘সেদিন দুজনে...’ গানে সুরের কমতি থাকলেও তা উপভোগে কোন কমতি ছিল না।
বেলা সোয়া দু’টায় লাঞ্চ করলাম। পোলাও, ক্যাপসিকাম চিকেন, ইলিশ কাবাব, রুই দোঁপেয়াজা, চায়নিজ ভেজিটেবল, চিকেন সালাদ স্বাদে ও পরিবেশনায় ছিল চমৎকার। এত্তসব ব্যতিক্রমী আইটেমের মধ্যে আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে ইলিশ কাবাব, কারণ মাছের রাজা ইলিশকেই আমি কিঞ্চিৎ পছন্দ করি কি না -তাও আবার নবাবী কাবাবে!
খাবারের পর আবার কিছুক্ষণ আড্ডা চলল। গত ২৪ ঘন্টার অনুভূতি শেয়ার করল অনেকেই। এরই মধ্যে ৪টা বেজে গেছে। আমাদের সবার একসাথে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করার কথা ছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান সন্ধ্যায় শুরু হলে শেষ হতে হতে রাত হয়ে যাবে এবং মেয়েদের বাসায় ফেরার বিড়ম্বনায় পড়তে হতে পারে বলে বিদায় নেয়া শুরু হল। তার আগে চলল আরেক দফা খাবার পর্ব। কাস্টার্ড, হালুয়া, নাড়ু, ফল আরও কি কি ছিল, মনে নেই।
চলে আসার সময় বাসার সবাইকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম, যদিও তাদের আতিথেয়তা ও উদারতার তুলনায় ধন্যবাদ শব্দটা ছিল খুবই তুচ্ছ।
আসলে এভাবে বাড়ির বাইরে থাকা আমার কখনো হয়নি। বিভিন্ন পরিবারের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকমের মানসিকতা ও রুচিবোধ থাকে। তাদের সবার সাথে একই সময়ে একইভাবে থাকা, খাওয়া, আনন্দ করা -আমার জন্য এসবই ছিল নতুন অভিজ্ঞতা এবং অবশ্যই শিক্ষণীয়।
ক্যাম্পিং থেকে শিক্ষণীয় আরও অনেক কিছুই আছে। তবে একটা বিষয় বেশ চমৎকার ছিল। তা হল আমাদের পানি খাওয়ার সিস্টেম। আমরা ১৫/২০ জন মানুষ একেকবার একেক গ্লাসে পানি খাব; গ্লাস ধোয়া, প্রত্যেকের আলাদা গ্লাস রক্ষণাবেক্ষণ -এক বিশাল ঝক্কি-ঝামেলা। এতসব ঝামেলা থেকে বাঁচতে আমাদের প্রত্যেককে যাবার সাথে সাথে একটা করে পানির বোতল দেয়া হল এবং নিজ দায়িত্বে তা সংরক্ষণ করতে বলা হল। এতে করে পানির গ্লাস নিয়ে টানাটানি বা ধোয়ার ঝামেলা থাকল না, আবার প্রত্যেকেরটা আলাদাও হল। এমন সহজ ও বুদ্ধিদীপ্ত টেকনিক আসলে আমাদের স্যার ছাড়া আর কারও মাথায় কদাচিৎ আসে! তবে এখানে আমার একটা ভুল হয়েছে। আমার পানির বোতলটা আসার সময়ে জমা না দিয়ে বা ডাইনিংয়ে না রেখে বেডরুমেই রেখে এসেছি, যা আমার উচিৎ হয়নি। আমাদের বিদায় পর্বটা খুব দ্রুত হয়ে যাওয়ায় এ ভুলটি হয়েছে। তাই কোন কাজে বেশি তাড়াহুড়া করলে যে ভুল হয়, সে শিক্ষাটাও এখান থেকে আরেকবার ঝালাই করে নিলাম।
সবশেষে একটি কথা না বললেই নয়। ক্যাম্পিংয়ের পুরো সময় আমাদের নানা রকমের খাবার যোগান দিয়েছেন, নিজের রুম ছেড়ে দিয়েছেন, সর্বোপরি অত্যন্ত যত্নের সাথে সবার বিশেষ করে মেয়েদের খেয়াল রেখেছেন যিনি, তিনি আমাদের সম্পাদক স্যারের সহধর্মিনী ড. নাজনীন আহমেদ। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রজেক্ট ডিরেক্টর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্যানেল সদস্য, ক্যাম্পাস’র অনারারী রিসার্চ ডিরেক্টর, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, কলামিস্ট, গবেষক এবং একজন কণ্ঠশিল্পীও বটে। এতসব গুণে গুণান্বিত এবং রেগুলার পিএইচডি ডিগ্রিধারী হয়েও তিনি ২৪ ঘন্টার পুরো সময়টা কাটিয়েছেন আমাদের পেছনে। তাঁর এ উদারতা বা বড় মনের পরিচয়ের জন্য ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা আসলে অনেক কম হয়ে যায়। ক্যাম্পাস স্টাফদের পক্ষ থেকে এ লেখার মাধ্যমে তাঁর জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা; সৃষ্টিকর্তা তাঁকে আরো সমৃদ্ধ করুক, তাঁর মনের সকল আশা পূরণ হোক।
এসবের পাশাপাশি একজন ক্ষুদে রন্ধনশিল্পী, যার সুনিপুণ রন্ধনশৈলীতে আমরা এতজন মানুষ একটির পর একটি মুখরোচক ও ব্যতিক্রমী খাবারে আপ্যায়িত হয়েছি, সেই মিস্ রেবা’র প্রতিও রইল আন্তরিক শুভেচ্ছা।
এছাড়াও যাঁর সুদক্ষ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় এবং যাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এ ক্যাম্পিং সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছে, তাদের সকলের জন্য রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালবাসা। এভাবেই সর্বদা শুভ হোক সকল মঙ্গল প্রয়াস।
[usrony@yahoo.com]
উম্মে সালমা রনি
উপ-পরিচালক