শিক্ষার মানে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, পরীক্ষার ফল। পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত করার পরও প্রায় ৭০ শতাংশ ছেলেমেয়ে যথাযথভাবে লিখতে-পড়তে পারে না বা সাধারণ গাণিতিক হিসাব কষতে পারে না। দ্বিতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় ত্যাগের হার। এক সরকারি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পূর্ণ করা বা তার আগে প্রায় ৫০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী বিদ্যালয় ত্যাগ করে চলে যায়; এবং অবশিষ্টদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পূর্ণ করার আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করে; এবং বিদ্যালয় ত্যাগের হার ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে অনেক বেশি।
সাধারণ শিক্ষা বনাম কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা- বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা একত্রে নিয়ে আমরা প্রতি বছর প্রায় ৩ কোটি ১৮ লাখ ছাত্রছাত্রীকে (যার মধ্যে ৮ লাখ ১২ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের) শিক্ষা সমাপনী সার্টিফিকেট প্রদান করছি। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় ওইসব সার্টিফিকেটধারীদের কতজনের অর্জিত জ্ঞান-দক্ষতা তাদের নিজেদের বা বৃহত্তর সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজে লাগে? আমার বিবেচনায়, এর উত্তর নেতিবাচক এবং হতাশাজনক; কারণ, একমাত্র কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো শিক্ষা এ দেশের কর্ম জগৎ বা শ্রম বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ফলে অপরিকল্পিতভাবে স্বল্প শিক্ষিত/অর্ধশিক্ষিত/শিক্ষিত বেকার তৈরি করে চলেছি।
আমাদেরকে বিশ্বায়নের এ যুগের চাহিদার কথা ভাবতে হবে। জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম। কিন্তু এই বিপুল জনশক্তি আমাদের মানবসম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে আমরা সক্ষমতা, জ্ঞান এবং কর্মক্ষেত্রের উপযোগী দক্ষতা তৈরির চেষ্টা করিনি। অন্যদিকে, বর্তমান বিশ্বে নতুন নতুন প্রযুক্তিবিদ্যা, কর্মের নতুন নতুন ক্ষেত্র, মানসম্পন্ন উৎপাদিত পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ইত্যাদি নমনীয় কর্মশক্তি এবং দক্ষতা-সূক্ষ্মতার বিকাশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে (যা প্রকৃতপক্ষে হাতে-কলমে শিক্ষা) অনিবার্য করে তুলেছে। কিন্তু পাঁচ ধরনের শিক্ষার পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষাতেই ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সর্বনিম্ন। এর সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে - এ দেশের সাধারণ জনগণ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব; শ্রম বা চাকরি বাজার সম্পর্কে ছাত্র-যুব সমাজের বেশির ভাগের নেতিবাচক ধারণা। বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী মনে করে, কারিগরি/বৃত্তিমূলক শাখায় এসএসসি পড়লে ওরা কোনো কাজ পাবে না; সমাজে কারিগরি/বৃত্তিমূলক শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতার অভাব। দক্ষ শিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাদির অপ্রতুলতা। আমার বিবেচনায়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণকে সর্বতোভাবে উৎসাহিত করা উচিত। অর্থনৈতিক চাহিদা এবং বহির্বিশ্বের পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা খাত এবং শ্রম বাজারের মধ্যে কার্যকর যোগসূত্র গড়ে তুলতে হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণকে জনপ্রিয় ও শক্তিশালী করতে পারলে দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব একসঙ্গে মোকাবেলা করতে পারব। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষা তুলনামূলকভাবে অধিকতর মেধাবীদের জন্য সীমিত রাখার ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়; কারণ ১৭ বছর-মেয়াদি শিক্ষা গ্রহণকারীর জন্য পর্যাপ্ত কাজ/চাকরি বাংলাদেশে নেই। উন্নত পশ্চিমা বিশ্বেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষা যথেষ্ট সীমিত। শিক্ষা খাতের জন্য সরকারি বাজেটে অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ : জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশে স্বদেশের জিডিপির সাত শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের ব্যাপারে ইউনেস্কোর সুপারিশ থাকলেও ২০০৬ সালে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলনে তাদের আর্থিক অসামর্থ্য বিবেচনায় শিক্ষা খাতে জিডিপি’র ছয় শতাংশ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছিল। পরিতাপের বিষয় যে, উভয় ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী হয়েও বাংলাদেশ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১২-১৩ সময় পর্যন্ত শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ জিডিপির প্রায় দুই শতাংশের আশপাশে রয়েছে। সরকারি প্রতিবেদনেও দেখানো হয়েছে, শিক্ষা খাতে ২০১২-১৩ সালে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২.০৬%। বর্তমান সরকার তার প্রণীত ‘শিক্ষানীতি-২০১০’ বাস্তবায়ন করতে চাইলে আগামী বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয়ের অংশ তাৎপর্যপূর্ণভাবে বাড়াতেই হবে। শিক্ষা নীতিতে সরকার প্রতিশ্রুতবদ্ধ যে, ২০১৮ সাল থেকে সব ছাত্রছাত্রীর জন্য প্রাথমিক শিক্ষার স্তর পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীতকরণ নিশ্চিত করা হবে। প্রস্তাবিত প্রাথমিক স্তরে নতুন শ্রেণিকক্ষ ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তৈরি এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগ প্রদান ও পুরনো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে।
-ড. আজিজুর রহমান, অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়