বিশ্বে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ পদ্ধতির উদ্ভাবক বা জনক বলা হয় ফজলুর রহমান খানকে (এফআর খান)। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্থাপত্যের এ কিংবদন্তি ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় কনসাল্টিং ফার্ম এসওএমে থাকাকালে এক নতুন স্ট্রাকচারাল পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ভবন নির্মাণ কৌশলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা ওই ব্যবস্থাকে বলা হয়, ‘টিউব টু টিউব’ পদ্ধতি। এখন পর্যন্ত বিশ্বের সর্বত্র সুউচ্চ ভবন (স্কাইস্ক্র্যাপার) নির্মাণে অনুসৃত হয় তার এ পদ্ধতিটি। এবার এ পদ্ধতিকে আরও এক ধাপ ছাড়িয়ে গেলেন বাংলাদেশেরই আরেক প্রকৌশলী ফিরোজ আলম। তার উদ্ভাবিত পদ্ধতি সুউচ্চ ভবন নির্মাণে নতুন যুগের সূচনা ঘটাবে বলে আশা করা হচ্ছে। নির্মাণ করা সম্ভব হবে এক কিলোমিটার উচ্চতার ভবনও।
প্রকৌশলী ফিরোজের উদ্ভাবিত নতুন স্ট্রাকচারাল পদ্ধতির কৌশলটি হচ্ছে কলাম-বিমের পরিবর্তে ‘প্যারালাল শিয়ার ওয়ালস কনসেপ্ট’। এই কৌশলে প্রায় এক কিলোমিটার উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হবে। একক গবেষণায় তার আবিষ্কৃত এই পদ্ধতিটি ‘আমেরিকান জার্নাল অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং’ এ চলতি বছরের জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এরই মধ্যে তার এ পদ্ধতি ব্যাপক প্রশংসিতও হয়েছে। এতে প্রচলিত পদ্ধতির অনেক সীমাবদ্ধতা যেমন দূর হয়েছে, তেমনি ব্যয়ও হ্রাস পাবে।
ফিরোজ আলম বলেছেন, বাংলাদেশে কম খরচে সাধারণ ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন ও হাইরাইজ ভবন নির্মাণে সহযোগিতা দিতে চান তিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশে শততলার ওপরে ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে। সেখানেও তাকে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ফিরোজ। রংপুর সদরে জন্ম নেয়া ফিরোজ আলম এখন কর্মসূত্রে সস্ত্রীক কাতারে রয়েছেন। সেখানে তিনি ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাতার সরকারের পাবলিক ওয়ার্কস অথরিটিতে কর্মরত। পরিবারের ছোট ছেলে ফিরোজ আলম ১৯৯১ সালে ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স (এএমআইই), বাংলাদেশ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি সার্টিফিকেট নেন। চাকরি নিয়ে প্রথমে সৌদি আরব ও পরে ২০০৭ সালে কাতার যান ফিরোজ আলম। এর আগে মোহাম্মদপুর বাংলা মিডিয়াম হাই স্কুল ও সরকারি তিতুমীর কলেজে লেখাপড়া করেন তিনি। তার এক ভাই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা মাহাবুবুল আলম তারু। ফিরোজ আলমের একমাত্র ছেলে ঢাকায় ও-লেভেলে পড়াশোনা করছে।
২৫ তলার ওপরের ভবনকে হাইরাইজের কাতারে ফেলা হয়। বর্তমানে এমন ভবন নির্মাণে বাতাস আর ভূমিকম্পের প্রভাবকে প্রাধান্য দিয়ে ভবনকে মজবুত করার জন্য আরও অতিরিক্ত স্ট্রাকচারাল সিস্টেম যোগ করতে হয়। যেমন ব্রাসিংস, আউট্রিগারস, বেল্ট ট্রাস ইত্যাদি, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু ২০১৪ সালে ফিরোজ আলমের আবিষ্কৃত এই ‘প্যারালাল শিয়ার ওয়ালস কনসেপ্ট’ এর স্ট্রাকচারাল পদ্ধতিতে এসবের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া তিনি পূর্ববর্তী কাঠামোগত পদ্ধতির অনেক অসুবিধাও অতিক্রমে সক্ষম হয়েছেন।
নতুন ধারার এ নির্মাণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার জন্য ফিরোজ আলমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল শিকাগোর প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ইলিয়নস অ্যাট আরবানা-শ্যাম্পেইন। সেখানে তিনি গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ‘কাউন্সিল অব টল বিল্ডিং অ্যান্ড আরবান হ্যাবিটেট (CTBUH)’ এর সম্পাদক অধ্যাপক মীর আলী প্রকৌশলী ফিরোজ আলমের আবিষ্কৃত নতুন স্ট্রাকচারাল পদ্ধতিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন।
বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের ‘বুর্জ আল খলিফা’ বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন, উচ্চতা ২৭১৯ ফুট। এর মধ্যে ১৯১৮ ফুট বা ১৫৪ তলা পর্যন্ত মানুষের বসবাসের উপযুক্ত। বাকি ৮০১ ফুটকে বলা হয় ভ্যানিটি হাইট। এই ভ্যানিটি হাইট বা উচ্চতাকে বাদ দিলে এটি ইউরোপের ১১তম উঁচু ভবন হিসেবে পরিগণিত হবে। এর চূড়ার দোলন ২০০০ মি.মি.। ফিরোজ আলম যে স্ট্রাকচারাল পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, সেটি দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা বা ৩২৮২ ফুট উঁচু ভবন নির্মাণ করা সম্ভব, যা প্রায় ২৭৮ তলার সমান। এটাতে কোনো ভ্যানিটি হাইট রাখা হয়নি। দোলন হবে অর্ধেক, প্রায় ১০৪১ মি.মি.।
ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স কাতার চ্যাপ্টারের সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন আকন এ ব্যাপারে বলেন, ফিরোজ আলমের তত্ত্বমতে, প্যারালাল শিয়ার ওয়ালস কনসেপ্টের মাধ্যমে ১০০০ মিটার উঁচু ভবন তৈরি করা সম্ভব। তার সূত্রমতে, এ পদ্ধতিতে কলামের পরিবর্তে ২৭৮ তলা ভবন বানানো সম্ভব। যাতে কাঠামোগতভাবে নিরাপদ, ব্যবহার উপযোগী, অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী, অধিক প্রাকৃতিক আলো পাওয়া সম্ভব। আনোয়ার হোসেনের মতে, স্কাইস্ক্র্যাপারসের দোলন প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হলে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হবে, যা বর্তমান বিশ্বে বিরাট চ্যালেঞ্জ। আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ফিরোজ আলম চাকরির ফাঁকে ফাঁকে নিজস্ব উদ্যোগে তার গবেষণা নিয়ে কাজ চালিয়ে যান। ২০১৪ সালে তার গবেষণা থেকে আমি জানতে পারি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন বুর্জ আল খলিফা থেকে প্যারালাল শিয়ার ওয়ালস পদ্ধতিতে আরও ১৭২ মিটার উঁচু ভবন নির্মাণ সম্ভব।
নিজ পেশায় ২১ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে ফিরোজ আলমের। এর মধ্যে ১৪ বছর স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তিনি কাতারের দোহায় কংক্রিট কলাম দিয়ে স্টিলবিম হাইরাইজ ভবনের নকশা করেছেন। সেটি হচ্ছে ১২৯৬ বর্গমিটারের ৫১ তলা স্টোরয়েড আবাসিক টাওয়ার। ভূমি থেকে এটি ১৯২ দশমিক ২ মিটার লম্বা। ফিরোজ আলম এ ব্যাপারে বলেন, ‘৫১ তলা একটি ভবনের মূল নকশা পুনর্বিবেচনার সময় আমি তাতে স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে অনেক বড় ধরনের ত্রুটি পেয়েছিলাম। ক্লায়েন্টরা আমাকে পুনঃনকশা করার অনুরোধ করলে আমি একটা সঠিক ডিজাইন করে দিই।’