সিলেটের শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন কোচিং সেন্টার নির্ভর হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানের স্কুল থেকে শুরু করে নগরের নামিদামি স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারে নিয়ে ভর্তি করাচ্ছেন অভিভাবকরা ভালো ফলের প্রত্যাশায়। এই সুযোগে নামে-বেনামে পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে কোচিং সেন্টার। আর এসব কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে সন্তানদের ব্যয় মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। সিলেটের একাধিক স্কুল ঘুরে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন চিত্র।
অভিভাবকরা বলছেন, স্কুলগুলোতে মানসম্পন্ন পড়াশোনা না হওয়ায় অপারগ হয়েই তাঁদের কোচিং সেন্টারমুখী হতে হচ্ছে। তবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের দাবি, স্কুলগুলোতে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হয় ভালো পাঠদানের। কিন্তু অভিভাবকরা তাতে আস্থা না রেখে কোচিং সেন্টারে ছোটেন।
হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের পাশে ওসমানী মেডিকেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনেই কথা হয় সাংস্কৃতিককর্মী আবিদ ফায়সালের সঙ্গে। তাঁর ছেলে ওই বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। আবিদ ফায়সাল বলেন, স্কুলে পাঠদান পর্যাপ্ত না হওয়ায় সন্তানের মঙ্গল চিন্তায় আমাদের কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষকের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। একই ক্লাসে পড়ে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের কর্মকর্তা শুকলা রানী চন্দের মেয়ে। মেয়ের সমস্যা হতে পারে ভেবে প্রথমে কথা বলতে না চাইলেও পরে তিনি বলেন, স্কুলে পড়ার মান নিয়ে কিছু বলতে চাই না। সামনে এসএসসি পরীক্ষা, ভালো ফলাফলের চিন্তা থেকে মেয়েকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়েছি।
মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী আবদুস সাত্তার দেশে থিতু হয়েছেন বছর দুই আগে। নগরের পুলিশ লাইন স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে তাঁর মেয়ে। এসএসসি পরীক্ষায় মেয়ে যাতে ভালো ফল করতে সক্ষম হয় সে জন্য রেখেছেন তিনজন গৃহশিক্ষক। পাশাপাশি তাকে ভর্তি করিয়েছেন ‘নিউ ক্লাস’ নামের একটি কোচিং সেন্টারে। আবদুস সাত্তার বলেন, লেখাপড়া আগের চেয়ে কঠিন হয়ে গেছে। এখন শুধু স্কুলের পড়ায় ভালো ফল সম্ভব নয়।
নগরের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজে সন্তান ভর্তি করাতে পারলে অভিভাবকরা রীতিমতো হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। সেই স্কুলের পাঠদানেও পুরোপুরি আস্থা নেই অভিভাবকদের। সন্তানদের নিয়ে তাঁরাও ছোটেন কোচিং সেন্টারে। ব্যবসায়ী শমশের আলম জানান, তাঁর মেয়ে ব্লু-বার্ড স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের পুনঃভর্তি ফি তিন হাজার টাকা ছাড়াও মাসিক ফি ৮০০ টাকা। পাশাপাশি মেয়ের দুটি কোচিং বাবদ শমশের আলমকে মাসে গুনতে হচ্ছে ছয় হাজার টাকা। তিনি বলেন, আমার দুই সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং একজন মেডিক্যালে পড়ে। তাদের পড়াশোনার ব্যয়ের পাশাপাশি স্কুলপড়ুয়া মেয়ের শিক্ষার পেছনে এত ব্যয় করা আমার জন্য খুব কষ্টকর। কিন্তু সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তা করতে হচ্ছে।
ওই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন, ব্লু-বার্ড স্কুলের পড়াশোনার মান আগের মতো নেই। শিক্ষকদের অনেকে বাসায় প্রাইভেট পড়ান। সে কারণে তাঁরা স্কুলে ততটা গুরুত্ব দিয়ে ক্লাস নেন না। ওই অভিভাবক আরো বলেন, স্কুলের একজন শিক্ষক তাঁর বাসায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে পড়ান। বাসায়ই তিনি রীতিমতো ‘মিনি ব্লুু-বার্ড স্কুল’ খুলে বসেছেন। স্কুলে যদি ভালো পড়ানো হতো তাহলে একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আবার বাসায় নিয়ে কোচিং করাচ্ছেন কেন?
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হুসনে আরা বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো পড়াচ্ছি। মাসে তিনটি টেস্ট পরীক্ষাও নিচ্ছি। তাদের কোচিংয়ে নিরুৎসাহিত করছি। তবুও তারা কেন সন্তানদের কোচিং সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছেন বুঝি না।
জেএসসি পরীক্ষায় তাঁর স্কুল থেকে ২৮৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে ২৩৮ জন ‘জিপিএ ৫’ পেয়েছে জানিয়ে অধ্যক্ষ হুসনে আরা বলেন, শিক্ষকরা যদি ঠিকমতো না পড়াতেন তবে এই ফল অর্জন সম্ভব হতো না। অভিভাবকরা আস্থা সংকটে ভোগেন, যে কারণে কোচিং সেন্টারে যান। আবার অনেক ক্ষেত্রে একজনের দেখাদেখি অন্য অভিভাবক সন্তানদের কোচিং সেন্টারে নিয়ে যান। এটা এক ধরনের সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। স্কুলের শিক্ষকরা কেন কোচিং ব্যবসায় জড়িত জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষকরা বাইরে পড়াতে পারবেন না এমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। নিয়ম অনুযায়ী একজন শিক্ষক বাইরে তাঁর স্কুলের ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারেন। এই স্কুলেরই এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষার্থীকে পড়ানোর অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা ঠিক নয়।