রাজধানী ঢাকাতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন বা টিউটরিয়াল স্কুল ও কোচিং সেন্টার। এগুলোতে আদায় করা হচ্ছে উচ্চহারে মাসিক ফিসহ বিভিন্ন ধরনের চার্জ। নিয়ন্ত্রণহীন এসব স্কুল বা কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে না শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তাদের অধিদপ্তরগুলো। তাদের যুক্তি, এই টিউটরিয়াল বা কোচিং সেন্টারের নিবন্ধন আমরা দিই না। তাহলে কারা এগুলোর নিবন্ধন দেয়? তদারকির দায়িত্বই বা কাদের?
খুঁজতে খুঁজতে গলদঘর্ম হয়ে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল লোকাল গভর্নমেন্ট (সিটি করপোরেশন) অ্যামেনডেড অ্যাক্ট-২০০৯-এর তৃতীয় অধ্যায়। সেখানে টিউটরিয়াল স্কুল, কোচিং সেন্টার ইত্যাদি নিবন্ধীকরণের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এই আইনের ১১১ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কর্পোরেশনের নিবন্ধন ব্যতীত বেসরকারিভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত টিউটোরিয়াল স্কুল বা কোচিং সেন্টার চালু করা যাবে না।’ (২) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কর্পোরেশন এলাকায় বেসরকারিভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিতব্য টিউটোরিয়াল স্কুল বা কোচিং সেন্টার নিবন্ধনের জন্য কর্পোরেশন কর্তৃক নির্দিষ্টকৃত ফিস জমা দিয়ে মেয়র বরাবরে আবেদন করতে হবে এবং মেয়র বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রদত্ত কোনো কর্মকর্তা, প্রয়োজনীয় তদন্ত করে সন্তুষ্ট হলে কর্পোরেশনের সভার অনুমোদনক্রমে, সংশ্লিষ্ট টিউটোরিয়াল স্কুল বা কোচিং সেন্টারকে নিবন্ধন করবেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের মাসিক টিউটোরিয়াল বা কোচিং ফিস ধার্য করে দিবেন।’
সিটি করপোরেশন আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও বাস্তব অবস্থা পুরোটাই উল্টো। রাজধানীতে টিউটরিয়াল স্কুল বা কোচিং সেন্টারের নামে প্রায় ১০ হাজার প্রতিষ্ঠান চলছে। এগুলো মূলত সিটি করপোরেশনের নিবন্ধন নিয়ে চললেও করপোরেশন তাদের কোনো খোঁজই রাখে না। যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেয়া হচ্ছে এগুলোর নিবন্ধন। আর ফি নির্ধারণ করে দেয়া তো দূরের কথা, একবার নিবন্ধন দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে তারা। শিক্ষা নিয়ে তাদের কোনো বিভাগই নেই। ফলে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়ই গড়ে উঠেছে এসব প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে ফার্মগেট, মৌচাকসহ বেশ কিছু এলাকা এখন কোচিং সেন্টারের দখলে। আর এক এলাকায় ২০-৩০টি কিন্ডারগার্টেন থাকলেও অন্য এলাকায় দেখা যায়, একটিও নেই। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় প্রতিদিনই ছোট্ট শিশুদের নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে অভিভাবকদের। আর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও দুই সিটি করপোরেশনে সমতা নেই। এক এলাকার শিক্ষার্থীদের অন্য এলাকায় দৌড়াতে দৌড়াতেই রাজধানীতে যানজট বাড়ছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন দায় এড়িয়ে গেলেও অন্যান্য দেশের সিটি করপোরেশনের ভূমিকা সম্পূর্ণই আলাদা। মূলত সিটি করপোরেশন এলাকার শিক্ষাব্যবস্থা করপোরেশনই দেখভাল করে। এমনকি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও এ ব্যাপারে বড় ভূমিকা রাখছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে মাত্র একটি কলেজ রয়েছে। আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রায় ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। তাদের পরিচালনায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে।
জানা যায়, ঢাকা মহানগরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ৩৪১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ২১০টি কলেজ রয়েছে। আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর অনুমোদিত সরকারি ও বেসরকারি দুই হাজার ১৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে কম নয়; এরপরও রাজধানীতে মানসম্পন্ন স্কুল-কলেজের ঘাটতি রয়েছে। মাত্র ৪০-৫০টি স্কুল-কলেজ অভিভাবকদের অগ্রাধিকারে রয়েছে। ফলে বছরের শুরুতেই সন্তানদের নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে নামতে হয় তাদের। কাঙ্খিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে। দক্ষিণের বাসিন্দাদের যানজট ঠেলে সন্তানদের নিয়ে আসতে হয় উত্তরে।
ঢাকা বলতে একসময় পুরান ঢাকাকেই বোঝাত। সেই ঢাকার খ্যাতিমান স্কুলগুলোর মধ্যে ছিল পোগোজ উচ্চ বিদ্যালয়, আহমেদ বাওয়ানী একাডেমী, আনন্দময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউশন, নবকুমার ইনস্টিটিউট, নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়, সেন্ট গ্রেগরীজ উচ্চ বিদ্যালয় প্রভৃতি। এসব বিদ্যালয়ে রয়েছে প্রশস্ত মাঠ, বড় বড় ক্লাসরুমসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু তাদের আগের সুনাম আর নেই। সাম্প্রতিক সময়ে এসব বিদ্যালয় মেধা তালিকায় আসতে পারেনি। দক্ষিণে অবস্থিত ঢাকা কলেজও সুনাম হারাতে বসেছে। ঢাকা দক্ষিণে বিশ্ববিদ্যালয় ১১টি; তিনটি সরকারি, আটটি বেসরকারি।
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল শিশুদের লেখাপড়ার আওতায় আনতে সিটি করপোরেশনের কিছু প্রজেক্ট আছে; সেগুলোকে জোরদার করব। খেলার মাঠ ও পার্ক, যেগুলো বেদখল আছে সেগুলোকে উদ্ধার করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করব। আমাদের একটি বিশেষ ভাবনা আছে- হায়ার এডুকেশনের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে ঋণের ব্যবস্থা করব।’
বেশির ভাগ নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান উত্তর সিটি করপোরেশনে। রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রথম স্থান অধিকার করে রেখেছে। মিরপুরের মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাথমিকে প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে। ফল বিবেচনায় ঢাকা বোর্ডের সেরা ২০ স্কুলের মধ্যে ঢাকা সিটিরই ১৬-১৭টি স্কুল থাকে। এগুলোর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের থাকে চার-পাঁচটি স্কুল। সেগুলোর বেশির ভাগ আবার উত্তর সিটি করপোরেশনের সীমানাঘেঁষা।
দুই সিটি করপোরেশনের কোনোটিই শিক্ষা বিষয়ে তেমন কোনো কর্মকা- পরিচালনা করে না। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে একটি প্রতিষ্ঠান ‘মহানগর মহিলা কলেজ’ পরিচালিত হয়। শিক্ষায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অবদান বলতে এটুকুই।
গত বছর বিশ্বব্যাংক তাদের শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদনে বলেছে, এখনো স্কুলের বাইরে আছে প্রায় ৫০ লাখ শিশু। তাদের একটি অংশ রাজধানীতেই অবস্থান করে। উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি বড় বস্তি। ছোট ছোট আরো অনেক বস্তি রয়েছে। এসব বস্তিতে অনেক শিশু রয়েছে, যারা স্কুলে যায় না। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই শিশুদের নিয়ে সিটি করপোরেশন কাজ করতে পারে। এনজিওর সহায়তায়ও তাদের শিক্ষা নিশ্চিত করা যেতে পারে। এ জন্য কোনো একজনকে উদ্যোগ নিতে হবে। মেয়র সেই উদ্যোক্তা হতে পারেন। তাঁরা বলেন, স্কুলগুলোতে মাঠ নিশ্চিত করা না গেলেও অন্তত এলাকাভিত্তিক কিছু মাঠের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘গার্মেন্ট শিশুদের জন্য স্কুলের ব্যবস্থা করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে উত্তর সিটি করপোরেশনের অবহেলিত ছিন্নমূল ও বস্তিবাসী শিশুদের জন্য ৭০-৭৫টি স্কুল স্থাপনের পরিকল্পনা করেছি। উত্তরে মাঠের খুব অভাব। সে বিষয়টিও আমাদের ভাবনায় রয়েছে।’
শিক্ষাবিদ ড. মমতাজ উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাই সিটি করপোরেশনের একমাত্র কাজ নয়। পুরান ঢাকার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার জন্য আসতে হয় নতুন ঢাকায়। এ সমস্যার সমাধানে সিটি করপোরেশনকেই দায়িত্ব নিতে হবে। চট্টগ্রামে শিক্ষায় বিপ্লব এনেছে সিটি করপোরেশন। জনসংখ্যা অনুপাতে ওয়ার্ডভিত্তিক স্কুল, কয়েকটি ওয়ার্ডের ভিত্তিতে কলেজ ও সিটি এলাকার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে। ’