ময়মনসিংহের এক তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে টানা ছয়বার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
কয়েকটি ব্যাংকেও নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফলের অপেক্ষায় আছেন। ঢাকা শহরে থাকা-খাওয়াসহ চলার জন্য কয়েকটি টিউশনি করছেন তিনি। সবার কাছে তিনি বেকার হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, সাইফুল বেকার নন। তিনি যেহেতু টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন, অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, তাই তাঁকে বেকার বলা যাবে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদ- অনুযায়ী, সপ্তাহে কেউ এক ঘণ্টা কাজ করলেও তাকে কর্মজীবী হিসেবে গণ্য করে বিবিএস। বিবিএসের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ।
বিবিএস’র ওই জরিপ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংজ্ঞার মারপ্যাঁচের কারণে আরো ৪৫ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি বেকার হয়েও বেকার নন। এদের মধ্যে ১৭ লাখ কর্মক্ষম তরুণ টিউশনি ও খ-কালীন কাজ করছে; পাশাপাশি চাকরিও খুঁজছে। বিবিএস বলছে, এরা খ-কালীন কাজ করায় এদের বেকার বলা যাবে না।
অন্যদিকে এক মাসে কাজ খোঁজেনি, কিন্তু কাজ করার মতো সক্ষমতা আছে এমন তরুণের সংখ্যা ২৮ লাখ। বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, এই ২৮ লাখ মানুষের কাজ করার সক্ষমতা আছে। কিন্তু বর্তমান বাজার তাদের চাহিদামতো চাকরি দিতে পারছে না। বিবিএস বলছে, এরাও বেকার নয়। সব মিলিয়ে ৭১ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো ধরনের কাজ করেন না।
বিবিএস’র ওই জরিপে উল্লিখিত বেকারের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদেরও। তাঁদের মতে, দেশে বেকারের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কিন্তু সংজ্ঞার মারপ্যাঁচের কারণে সংখ্যা এত কম দেখানো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বরকত ই খুদা এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। ছদ্মবেশী অনেক বেকার আছে দেশে, যাদের সঠিক চিত্র বিবিএসের জরিপে উঠে আসেনি।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার হওয়ার কারণ দু’টি। প্রথমত, একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি যে মানের চাকরির প্রত্যাশা করে, সেই আলোকে চাকরি পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, বর্তমান চাকরির বাজারের সঙ্গে পড়াশোনার সম্পর্ক না থাকা। বর্তমান বাজারে যে ধরনের বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে জ্ঞান চাওয়া হয়, তা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর নেই। সে কারণে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারের হার বেশি। এ অবস্থায় চাকরির বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন তিনি। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালগুলোতে এখন বাজারভিত্তিক বিষয় চালু করা জরুরি।
এদিকে বিভিন্ন মহল থেকে আইএলওর মানদ- অনুযায়ী বেকারের সংজ্ঞা পরিবর্তনের দাবি ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে বিবিএস সংজ্ঞা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোজাম্মেল হকসহ বিবিএসের কারিগরি কমিটির সভায়। তবে বিবিএস বলছে, সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হলে ৫০ লাখ থেকে এক কোটি কর্মসংস্থানের সংখ্যা কমে যেতে পারে। এতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে সরকার। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসবে বিবিএস।
উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারের হার কত বেশি তার প্রমাণ মিলল সর্বশেষ ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষায়। প্রায় দেড় হাজার পদের বিপরীতে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল চার বছর মেয়াদি অনার্স শেষ করা আড়াই লাখের মতো শিক্ষার্থী। বিসিআইসি’র ৩০টি সহকারী ব্যবস্থাপক পদের বিপরীতে গত ৬ জুলাই আবেদনের সময় শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে, আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ৫০ হাজার।
বাজারভিত্তিক বিষয় চালু করা জরুরি
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালগুলোতে নতুন নতুন বিষয় সংযুক্ত করার সময় এসেছে। সংস্কৃত ও পালি, শান্তি ও সংঘর্ষ, ইতিহাস, ফারসিসহ যেসব বিষয় বর্তমান বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই, সেসব বিষয় পরিবর্তন করে নতুন বিষয় যুক্ত করার চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে। এখন বাজারভিত্তিক বিষয় চালু করা জরুরি। আর সেটা হতে পারে প্রযুক্তি, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণসহ কারিগরি বিষয়ে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত ও কারিগরি জ্ঞান থাকা আবশ্যক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেসরকারি খাতের নীতিনির্ধারকদের একটা সম্পর্ক থাকা জরুরি। ব্যক্তি খাতে চাকরির জন্য কী ধরনের জ্ঞান দরকার, সেটি বিশ্ববিদ্যালয়কে জানাতে পারেন মালিকরা। তিনি আরো বলেন, আমাদের এখন কারিগরি ও আইটি বিষয়ের ওপর সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। এটি করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত হারে কর্মসংস্থান হবে না। বেকার বাড়বে।
বেসরকারি খাতের একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, দেশে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে আইটি, কারিগরিসহ বিভিন্ন খাতে। কিন্তু বাজারে যে ধরনের দক্ষ মানুষের চাহিদা আছে, সেই আলোকে কর্মী খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে দেশের বাইরে থেকে লোক নিয়োগ দিতে হয়।