৬। আত্মঅনুসন্ধান ও আত্মউপলব্ধি
জীবন চলার পথে খেয়ালের বশে বা অচৈতন্যে, অনভিজ্ঞতা বা অজ্ঞানতায় মানুষ ভুল-ত্রুটি করবে, অন্যায় করবে -এটি অপ্রত্যাশিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সচেতন মুহূর্তে সেই অন্যায় বা ভুল-ত্রুটির বিষয়ে আত্মউপলব্ধি আসা জরুরি, যা মনুষ্যত্বের তথা মানবিক গুণাবলীর পরিচায়ক। আর যার মধ্যে এ আত্মউপলব্ধির প্রবণতা দেখা যায় না, তাকে মনুষ্যত্ববিবর্জিত বলেই ধরে নেয়া যায়।
রাগের বশে, খেয়ালে-বেখেয়ালে কিংবা অনুরূপ কোনো নেগেটিভ ইমোশনে পড়ে অনেকেই বিভিন্ন ভুল বা অন্যায় করে ফেলেন -যা অন্যরা হয়ত সাময়িক মেনে নেন, তবে মনে নেন না। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ভুল বা অন্যায় সম্পর্কে নিজের উপলব্ধি, অনুশোচনা এবং দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষমাপ্রার্থনা না করাকে কেউই মেনে নেন না, মনে নেয়াতো দূরের কথা। তাই ভুলত্রুটি বা অন্যায়ের অসৌন্দর্য সম্পর্কে আত্মসচেতনতা ও আত্মউপলব্ধির মাধ্যমে নিজকে সর্বদাই পরিশীলিত, মার্জিত ও বিশুদ্ধ করা উন্নত বা মহৎ জীবনের পূর্বশর্ত।
সুন্দর, মহৎ ও সুস্থ জীবনযাপনে এবং সম্মুখে চলার পথ কন্টকমুক্ত ও গতিশীল করতে প্রয়োজন আত্মঅনুসন্ধানের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। নিজেকে পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ ও শুদ্ধ করতে হলে পাপ-পঙ্কিলতা ও ভুলত্রুটি কাটানো অত্যাবশ্যক এবং তা কাটানোর পূর্বশর্ত হচ্ছে এসবের সঠিক অস্তিত্ব নির্ণয় ও কার্যকারণ জানা। নিজের অজান্তেই নিজের মধ্যে বিভিন্ন কুপ্রবৃত্তি, দোষত্রুটি, হিংসা-বিদ্বেষ, অহমিকা, জটিলতা-কুটিলতা, সন্দেহ-সংশয় থেকে যায় -যা নীরোগ, সুস্বাস্থ্য ও সাফল্যের প্রতিবন্ধক।
এ এক নিদারুণ ট্র্যাজেডি যে, আত্মউপলব্ধির অভাবে নিজের মধ্যে থাকা এসব নেতিবাচক বিষয়ের উপস্থিতির কথা অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারে না। তাই নেতিবাচক ও মন্দ বিষয় থেকে পরিত্রাণের প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে নিজের মধ্যে এসবের অস্তিত্ব আছে কিনা -তা আত্মঅনুসন্ধানের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা এবং আত্মউপলব্ধিতে নিয়ে আসা। কারণ আত্মসমালোচনার চেয়ে সত্য লুকানোর প্রচেষ্টা যাদের মধ্যে প্রকট, তারা কখনো উন্নত মানুষ হতে পারে না। তারা কেবল অন্যের ভুলই ধরে, নিজের ভুল দেখে না।
ইচ্ছাশক্তি (উবংরৎব) থাকলে এ কাজটি একেবারে সহজ; আর না চাইলে অত্যন্ত কঠিন এবং কারো কারো জন্য অসম্ভবও বটে। অর্থাৎ এ অভিযানে সাফল্য অর্জনে প্রয়োজন সুকঠিন সদিচ্ছা, সুদৃঢ় আকাক্সক্ষা ও সুনিবিঢ় সাধনা এবং বিশেষ মানুষদের ততোধিক বিশেষ মনোবল। তবে এজন্য যে সদিচ্ছা, সরলতা ও সুশিক্ষা থাকা দরকার -তা থেকে বঞ্চিত থাকে বেশিরভাগ মানুষ। তবু চেষ্টা করে যেতেই হবে- কঠিন রোগ থেকে বেঁচে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টার মতো। এ প্রচেষ্টায় সফল হলেই আপনি সুস্থ, সফল ও শান্তিময় জীবনের পথে এগিয়ে গেলেন। কারণ রোগমুক্তির প্রথম শর্ত যেমনি রোগের অবস্থান ও কারণ জানা, অর্থাৎ রোগ বুঝতে পারলেই আরোগ্যের ব্যবস্থা বা চিকিৎসা সহজ হয়ে যায় যেরূপ -সেরূপ নিজের মধ্যকার ভালো-মন্দ সম্পর্কে আত্মঅনুসন্ধান ও আত্মউপলব্ধি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের অন্যতম পূর্বশর্ত। পবিত্র কোরআনেও আছে- যারা অপরাধ উপলব্ধি করে ফিরে আসতে পারে, তাদের প্রতি আল্লাহ ক্ষমাশীল।
প্রকৃতই আত্মউপলব্ধির পথে এগুনো মানেই সত্যের পথে এগুনো, সুন্দরের ভুবনে প্রবেশ। মহান দার্শনিক সক্রেটিস সেই যুগে বলে গেছেন- কহড়ি ঞযুংবষভ অর্থাৎ নিজেকে জানো। ক্যাম্পাস’র সেøাগান- খবঃ ঁং শহড়ি ড়ঁৎংবষাবং; আসুন, আমরা সবাই নিজকে জানার মাধ্যমে উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তুলি।
এরূপ আত্মঅনুসন্ধান ও আত্মউপলব্ধিতে সক্ষমদের জন্যই রয়েছে ক্ষমা। আত্মউপলব্ধি ও অনুশোচনা ছাড়া অন্যের থেকে ক্ষমা অর্জন করে নিজের কোনো লাভ নেই বরং তাতে নিজের মধ্যে আত্মপ্রবঞ্চনাজনিত আরো কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগ জন্ম নিতে পারে। ক্ষমা করে ক্ষমাকারী সুস্থ হয়ে গেলেন; কিন্তু অনুশোচনা ব্যতীত ক্ষমা পাওয়া মানে শুভেচ্ছাহীন উপহার বা কল্যাণহীন ভিক্ষা।
আত্মউপলব্ধি ও অনুশোচনার মানুষরা সর্বজন গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয়ও বটে। এভাবে মানুষের প্রিয় হওয়া মানে স্রষ্টার নৈকট্যলাভ; ঞযব ড়িৎফং ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ধৎব ঃযব ড়িৎফং ড়ভ এড়ফ.
অনুশোচনার মানুষরা সুবোধ ও সহজ-সরল বলেই তারা যেমনি অন্যের কাছে ক্ষমাশীল, অপরাধমুক্ত ও আশীর্বাদপুষ্ট; তেমনি নিজের চর্চায় নিজেই সুস্থ-সুন্দর ও মহৎ। তাই যিনি যত বড় মাপের মানুষ, তিনি তত বেশি আত্মঅনুসন্ধানী-আত্মউপলব্ধ ও অনুশোচনার বিশুদ্ধ মানুষ; তিনি আয়নায় নিজের চেহারা দেখেন এবং মনের আয়না ও বিবেকের কাছে?কঠিন শিকলে বন্দী থাকেন।
এভাবে আত্মঅনুসন্ধান, আত্মউপলব্ধি ও অনুশোচনার পরের পর্ব হচ্ছে- ক্ষমাপ্রার্থনা। এরূপ অনুশোচনার পর্বেই অনেক পাপ-পঙ্কিলতা সাধারণত কেটে যায়, স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা চলে আসে। এরপরও ক্ষমাপ্রার্থনা এবং ক্ষমালাভ মানে হচ্ছে আত্মশুদ্ধির সনদলাভ।
তাই সারকথা হচ্ছে- যার নিকট যে অন্যায় বা অপরাধ করেছি, তার নিকট তজ্জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া। আত্মঅনুশোচনা নিশ্চিত করে সরল ও কায়মনোবাক্যে ক্ষমাপ্রার্থী হতে পারলে ক্ষমালাভ অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়, বিশেষত স্রষ্টার কাছে। আর মানুষের কাছে? মানুষের ক্ষমা পাওয়া গেল কিনা, ক্ষেত্রবিশেষে এরূপ সংশয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত বড় অন্যায় ও মিথ্যার ক্ষেত্রে। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা ও ক্ষমালাভ সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে ঝবষভ ঈড়সসধহফ বা অঁঃড়ংঁমমবংংঃরড়হ এর কৌশল অবলম্বন করা যায়। অর্থাৎ অনুশোচনার মাধ্যমে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার মহৎ গুণে আপনি যে গুণান্বিত হলেন, সেই গুণের কথা চিন্তায় এনে স্রষ্টার মাধ্যমে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া যায়; অনেকটা জমি অগ্রক্রয় মামলার মতো। অর্থাৎ আপনার পার্শ্ববর্তী জমির মালিক তার জমি বিক্রি করতে চাইলে তা ক্রয়ের ক্ষেত্রে আপনি অগ্রাধিকারী। যদি তিনি আপনার কাছে জমি বিক্রি করতে ইচ্ছুক না হয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করেন, তাহলে আপনি সরকারের ঘরে টাকা জমা দিয়ে ঐ জমি নিজ মালিকানায় নিয়ে নিতে পারেন।
এরূপ ক্ষমালাভের পর নিজকে এত স্বচ্ছ-সুস্থ-সবল, শক্তিশালী, আলোকিত ও ঈড়হভরফবহঃ মনে হবে যে- তখন যেকোনো রোগ-বালাই জয় এবং সুস্থ, সুন্দর ও আলোকিত সমৃদ্ধ জীবনলাভ একেবারেই সহজ হয়ে যাবে; সফলতা আসতে থাকবে একের পর এক।
উন্নত জীবনযাপনের এতরকম উপায় ও কলাকৌশল বা অৎঃ থাকতেও যারা খাসলতের দোষে, অহমিকা ও জটিলতা-কুটিলতার বশে অথবা সুবুদ্ধি ও সরল জ্ঞানের অভাবে এরূপ সহজ ও নিষ্কন্টক পথে এগুতে পারে না বা আসতে চায় না -তারা কত বড় হতভাগ্য ও নির্বোধ!
তবে সাধু সাবধান! সহজ-সরল আত্মউপলব্ধি ও অনুশোচনা ছাড়া ক্ষমাপ্রার্থনা কিন্তু আরেক ছলনার শামিল। তাতে ক্ষমালাভ ও সুস্থ-সুন্দর হওয়াতো দূরের কথা বরং এতে আত্মদহন বেড়ে যেতে পারে। পবিত্র কোরআনে আছে- ছলনাকারীরা আত্মদহনে জ্বলবে, আর সত্য ও ন্যায়ের ধারকদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।
৭। সততার লালন ও চর্চা
প্রিয় পাঠক, ইতিপূর্বেকার বিভিন্ন কনসেপ্ট নিয়ে আলোচনায় খুব একটা বিচলিতবোধ করিনি। কিন্তু সততা সম্পর্কিত আলোচ্য পয়েন্টে এসে খানিকটা বিব্রত বৈকী! এর মূল কারণ জ্ঞানার্জনে নুড়িখেলা পর্যন্ত এগোতে না পারলেও এ যাবৎ যতটুকুনই পড়াশুনা করেছি, তাতে সুনির্দিষ্টভাবে সততার ওপর কোনো পুথি-পুস্তক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ দেখা বা পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। তাই এ বিষয়ে আমার সহজ-সরল অনুভব ও বিশ্বাস শেয়ার করছি।
সততা হচ্ছে মানব চরিতের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, আকর্ষণীয় ও সুকঠিন বিষয়। সততা মানুষের স্থায়ী ও অপরূপ সৌন্দর্য, যা না থাকলে অন্যের কাছে তার আকর্ষণ ও কদর চিরন্তন হয় না। বলতে গেলে মানুষের সকল আচার-আচরণ দু’ভাগে বিভক্ত- সৎ এবং অসৎ অর্থাৎ সততা ও অসততা। সততার ধরনও বিভিন্নরূপী। যেমন- বিশেষ সততা, সাধারণ সততা, সম্পূর্ণ অসততা, সততা নয় তবে অসততাও নয় এরূপ বা অনুরূপ।
ধরুন, কেউ আপনার কাছে তার একটি ব্যাগ রেখে গেছে বা ফেলে গেছে। অবারিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঐ ব্যাগ থেকে কিছু নেয়াতো দূরের কথা, ব্যাগ খুলে দেখার চিন্তা বা কৌতূহলও হয়নি বরং এরূপ চিন্তাকে অপরাধ বলে মনে হয়েছে, তাহলে একে বিশেষ সততা বলা যায়।
ব্যাগ থেকে কিছু নেননি বটে, তবে ব্যাগ খুলে দেখার ইচ্ছা বা কৌতূহল হয়েছে; কিন্তু খোলেননি। একে মোটামুটি বা সাধারণ সততা বলা যায়।?
ব্যাগ খুলে দেখার কৌতূহল হয়েছে এবং খুলে দেখেছেন, কিন্তু ব্যাগ থেকে কিছু সরাননি বা নেননি। এটি সততা নয়, তবে চট করে একে অসততাও বলা যাবে না।
আর ব্যাগ খুলে দেখা এবং ব্যাগ থেকে কিছু নেয়া কিংবা নেয়ার চেষ্টা বা চিন্তা সরাসরি অসততা।
সততা ও অসততা কেবল কথার কথা নয়, কথার ফুলঝুরি কিংবা দোষাদোষির বিষয়ও নয়। সততা ভেতরে লালনের বিষয়, পাশাপাশি প্রমাণের বিষয়; ক্ষেত্রবিশেষে দেখানোরও বিষয়। তবে সুদৃঢ় লালন ও প্রমাণ ছাড়া সততার দাবি তোলা আরেক অসততা ও প্রতারণা। সততা ও অসততার নানা রূপ ও ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন-
কাজ না করা সততা নয়, বরং অন্যায় কাজে বাধা দেয়া এবং ন্যায় কাজ যথাসময়ে করে দেয়াই সততা। আবার সর্বদাই ভালোর চর্চা করা এবং মন্দ ত্যাগ করা বা মন্দ থেকে দূরে থাকা মৌলিক সততা। তাই সর্বক্ষেত্রে ভালোকে ‘হ্যাঁ’ এবং মন্দকে ‘না’ বলতে পারাটাই এক ধরনের সততা। অন্যদিকে মুখ ফুটে বা স্পষ্ট করে সত্য কথা বলতে না পারা এক ধরনের অসততা। এজন্যই ভালোকে ‘হ্যাঁ’ এবং মন্দকে ‘না’ বলতে অভ্যস্ত না হয়েও মিথ্যা আত্মপ্রসাদধারী কেউ কেউ নিজেকে সৎ বলে মনে করেন। অথচ সত্যকে এড়িয়ে চলা এবং মিথ্যা ও অন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে পারাও যে এক ধরনের অসততা, সেটি তাদের বোধেই আসে না।
অন্যায় সহ্য করাটাও এক ধরনের অসততা। রবীঠাকুর যথার্থই বলেছেন-
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।
মানুষে মানুষে বিবাদ-বিসংবাদ ও অশান্তি দেখে সেক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা না করা বা এড়িয়ে যাওয়া এক ধরনের অসততা।
অন্যের কল্যাণচিন্তা এবং সেবা ও সুখ-শান্তিতে নিবেদিত থাকা সততার লক্ষ্যাভিসারী চেতনা। তাই দুর্ঘটনা কবলিত বা বিপদে নিপতিত মানুষকে উদ্ধার না করে অথবা দুস্থ-অসহায়কে সাহায্য না করে কেবল আপন ধর্মের কর্মে লিপ্ত থাকা সততা নয়। তাছাড়া নিজের অর্জিত জ্ঞান ও শিক্ষা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে না দেয়ার মানসিকতাও সততা নয়।
সততা কাচের মতো স্বচ্ছ এবং আলোর মতো স্পষ্ট। সততা প্রদীপের আলোর সাথে আঁধারের খেলা নয়, আলো-আঁধারীর লুকোচুরিও নয়; সততা দিনের আলোর মতোই তেজোদীপ্ত ও স্বচ্ছ। অসত্যের তুলনায় কেবল ভালো কিছু হলেই চলবে না, নাই দেশে ভ্যারেন্ডা বৃক্ষ হলেও নয়, সততা হবে স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল এক অনির্বাণ আলোকবর্তিকা।
অসত্য ও মিথ্যার জগতে সততা অপ্রিয় বা উপেক্ষিত হলেও কোনোক্রমেই তা মাথা নোয়াবার নয় বরং অবিচল ও উচ্চশির এক মহাশক্তি। সততার ঝান্ডা সর্বদাই উড্ডীন, গৌরব ও সৌরভে সততা সর্বদাই ঐশ্বরীয়। তেলেজলে না মেশার মতোই সততা সততই অসততার সাথে অবিমিশ্র থেকে যায় এবং স্বমহিমায় থাকে অকুন্ঠ ও অবিচল।
সততা চিরকালই অমলিন। ব্যাপক অসততার ভীড়ে ও দাপটে মলিন দৃষ্টি দিয়ে সততাকে আপাত ম্লান করা হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা দিগ্্বিজয়ী ও কালজয়ী এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি।
সৎ মানুষ সাহসী, অন্যের চেয়ে আলাদা। এমনকি সৎরা নিঃসঙ্গ এবং অন্য অনেকের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুও হতে পারে। অসৎরা সৎদের কাজের মধ্যে মহৎ উদ্দেশ্য খুঁজে নাও পেতে পারে, কোণঠাসাও করে রাখতে পারে। সৎ হতে গিয়ে এই যে এত ব্যতিক্রম, এই যে অন্যের চেয়ে আলাদা, অন্যের ঈর্ষা ও ঘৃণা বা ভয়ের কারণ -এটাইতো সততার হীরক মূল্য। তাইতো হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, ‘কেউ মূল্য না দিক তুমি সৎ কাজ করবে’।
একথাও মেনে নিতে হবে যে, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে সৎ হতে পারেন না। কারণ সততা অর্জনে চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও অধ্যয়ন, ধর্মীয় দাওয়াই এবং নীতি-নৈতিকতার কঠোর অনুশীলন ও অনুশাসন। এরূপ গঠনমূলক, সুশৃঙ্খল ও স্বর্গীয় চেতনা এবং মত ও পথ সবার ধাতে সয়না। এ কারণে অনেকে সৎ হতে চেয়েও সততার সুকঠিন স্বরূপের সাথে খাপ খাওয়াতে বা গধঃপয করতে পারেন না। কারণ সততা লালন-পালনের জন্য যে পণ-প্রতিজ্ঞা-দৃঢ়তা ও স্বচ্ছ জ্ঞান দরকার, সেসবের অভাবে তারা সততার স্বর্ণালী আলো থেকে বঞ্চিত থেকে যান। এজন্য মাওলানা রুমি যথার্থই বলেছেন- চরিত্রে যদি সত্যের শিক্ষা দীপ্ত না হয়, তবে জ্ঞান-গৌরব-আভিজাত্য ও শক্তি সবই বৃথা। মহাকবি শেখ সাদী বলেছেন- যে সৎ হয়, মিথ্যা তার কোনো অনিষ্ট করতে পারে না।
এমন অনেকেই আছেন -যারা সৎ হতে বা থাকতে চান, আবার অসততায় অর্জিত অন্যের ধনসম্পদ বা ক্ষমতার আস্ফালন দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এরূপ বিভ্রান্তির কারণে তথা সততায় নিবিষ্ট হতে না পারার কারণে সততার অমীয় সুধা থেকে বঞ্চিত রয়ে যান। তারা বুঝতেই পারেন না যে, অমঙ্গল কর্মের টাকায় মঙ্গলজনক কাজেও মঙ্গল হয় না। তাইতো এক মনীষী বলেছেন- বিভ্রান্ত-সৎরা বাইরের চাকচিক্য দেখে নিজের সততা সম্পর্কে প্রশ্নবিদ্ধ হয়; অথচ প্রকৃত জ্ঞানী সেই ব্যক্তি, যে দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে বিভ্রান্ত হয় না।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি- সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ ব্যালেন্সড; তারা সুশৃঙ্খল-সুদৃঢ় মনের অধিকারী। অন্যদিকে চিন্তায় যাদের অসততা থাকে, তারা ভারসাম্যহীন ও বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত; কথাবার্তায় অসংলগ্ন। একটি প্রশ্নে বা জিজ্ঞাসার জবাবে এদের মাথা থেকে এক কথার উত্তর আসতেই চায় না। অর্থাৎ প্রশ্ন একটি করলে উত্তর আসে অনেকগুলো। এরা মূল প্রসঙ্গে থাকতেই পারে না; প্রসঙ্গ থেকে দূরে তথা অপ্রাসঙ্গিক বা আবোল-তাবোল উত্তরে অভ্যস্ত। এরা অস্থির ও দোদুল্যমান। অসততাজনিত অস্থিরতায় এদের ব্রেন প্রায়ই ঐধহম হয়ে যায়। তাই গরহফ পড়হপবহঃৎধঃব করাও এদের জন্য দুরূহ। অর্থাৎ অসততার প্রতিক্রিয়ায় এদেরকে এক ধরনের মানসিক রোগ পেয়ে বসে, যে রোগের কারণ চিকিৎসকের অনুদঘাটিত এবং নিজের কাছেও অজানা থেকে যায়। বিরূপ ও ভারসাম্যহীনতার সুদীর্ঘ মানসিক এ রোগের পরিণতিতে শরীরে তৈরি হয় কঠিন থেকে কঠিনতর রোগ; সুবাসিত স্বর্গীয় জীবন ধীরে ধীরে ধাবিত হয় নরকের দিকে।
মানুষের সুস্থতার জন্য দেহ-মনের ওপর ব্রেনের কমান্ড এবং ব্রেনের ওপর আত্মার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। আত্মার প্রশান্তি বা সুখ ও সমৃদ্ধি থাকলে ব্রেনের মাধ্যমে দেহ-মনকে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুস্থ রাখা সহজ হয়। তাই দেহ-মনের সুস্থতার জন্য আত্মার প্রশান্তি এবং আত্মার প্রশান্তির জন্য সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনযাপন একান্ত প্রয়োজন। মৌলিক সততা ছাড়া আত্মার প্রশান্তিলাভ অসম্ভব বা দুরূহ। সৎজীবন স্রষ্টারও প্রিয়। মসজিদ-মন্দিরের পবিত্রতায় এবং প্রস্ফুটিত ফুলের সৌরভে-গৌরবে সৎজীবন বিকশিত হতে থাকে অন্তরে।
তাই আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মার প্রশান্তি এবং দেহ-মনে ভারসাম্য ও সুস্থতা লাভের জন্য আসুন, আমরা সবাই সততার সুমহান পথে আসি। অসৎ অহমিকা, তর্জন-গর্জন বা আস্ফালনে যেন আর বিভ্রান্ত না হই। এখন থেকে প্রার্থনা করি- হে স্রষ্টা, আমাকে জ্ঞান দাও; সৎ ও সঠিকভাবে চলার পথ সুগম করো; নেক্কার বান্দাদের সাথে সাক্ষাৎ করাও, আমিন! -চলবে।