রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বেসরকারি তেজগাঁও কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছেন অধ্যাপক মো. হারুন-অর-রশিদ। ১৩ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এই কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- তেজগাঁও কলেজের সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আবদুর রশীদ, পরিচালনা পরিষদের সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী, পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান, কলেজের উপাধ্যক্ষ (একাডেমিক) আঞ্জুমান আরা, ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক বেদার উদ্দিন, তেজগাঁও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলামসহ কলেজের শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণ।
রাজধানী ঢাকার সর্বোচ্চ যোগাযোগ স্থলের সুবিশাল ও ঐতিহ্যবাহী তেজগাঁও কলেজ। এ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে গৌরবোজ্জ্বল দায়িত্ব গ্রহণের অনুভ‚তি জানতে চাইলে নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর হারুন-অর-রশিদ বলেন, একজন শিক্ষক হিসেবে এই কলেজে আমি দীর্ঘ দিন ধরে জড়িত। উপাধ্যক্ষ হিসেবে সুদীর্ঘ ৬ বছর দায়িত্ব পালন করার পর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছি। অনন্য এ প্রাপ্তিতে সত্যিই আমি অভিভ‚ত। শিক্ষক হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ এই পদ প্রতিটি শিক্ষকের কাছেই কাক্সিক্ষত। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তাই বলা যায় এই দায়িত্ব পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
নতুন অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করে কি কি বিষয়ের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে এখানে যখন কর্মরত ছিলাম, তখন এই তেজগাঁও কলেজকে আধুনিক কলেজে রূপান্তর করার লক্ষ্যে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবদুর রশিদ স্যারের নেতৃত্বে কলেজটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করেছি। সেই কর্মপরিকল্পনাগুলোর বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াসেই আমি এখন কাজ করে যাচ্ছি। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি আধুনিকায়নের মাধ্যমে ফলপ্রসু উপায়ে যোগ্য শিক্ষার্থী গড়ে তোলা সর্বোপরি এ কলেজকে ঘিরে উদ্দেশ্য একটাই; তেজগাঁও কলেজকে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার্থীদের উন্নত জীবন গঠনে উপর্যুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করার মাধ্যমে কার্যকর একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
তেজগাঁও কলেজের বর্তমান চেয়ারম্যান সম্পর্কে অধ্যক্ষ জানান, আমাদের বর্তমান চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা ও প্রবীন অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক। তিনি সেখানকার ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষক। এছাড়াও তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ব অগ্রণী ব্যাংক লি. এর চেয়ারম্যানসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। অতি সম্প্রতি তিনি জাতীয় মৌলিক বিভিন্ন বিষয়াদিতে গবেষণার প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
আমাদের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. খন্দকার বজলুল হক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার ও সিনেটের মেম্বার ছিলেন। সেই সাথে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও তিনি কাজ করেছেন। স্বাক্ষরতা আন্দোলনেও তাঁর অনন্য ভ‚মিকা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায় শিক্ষাব্যবস্থায় তিনি অপরিসীম ভ‚মিকা রেখে চলেছেন। গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে পেয়ে আমরা আনন্দিত, গর্বিত।
সুবিশাল এ কলেজের বিশেষত্ব ও বিশেষ কার্যক্রম সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি উল্লেখ করেন, তেজগাঁও কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি মডেল কলেজ এবং সর্ববৃহৎ বেসরকারি কলেজ। অবশ্যই এটি কলেজটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া আমাদের কলেজে প্রফেশনাল কম্পিউটার সাবজেক্ট, বিবিএ, হোটেল ম্যানেজমেন্ট এন্ড ট্যুরিজমসহ ২৮টি বিভাগে অনার্স ও ১৭টি বিভাগে মাস্টার্স রয়েছে যা অন্যান্য অনেক কলেজেই নেই। আমাদের বিশেষত্ব হলো আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা। উপযুক্ত ও দক্ষ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের অন্যতম বিশেষত্ব। শিক্ষার্থী অনুযায়ী আমাদের অবকাঠামো পযাপ্ত নয়। তবুও আমরা খুব সুন্দরভাবে তা চালিয়ে নিচ্ছি। পরিকল্পনা সুন্দর থাকলে যে বহু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে আমাদের তেজগাঁও কলেজ।
আমি এপ্রিলের ১২ তারিখ এই কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করি। এর আগে দীর্ঘ ২৪ বছরে আমাদের সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আবদুর রশিদ স্যারের নেতৃত্বে তেজগাঁও কলেজ ধীরে ধীরে সুবিশাল বিদ্যাপীঠে রূপান্তরিত হয়েছে। সর্বদা এই কলেজের প্রতি সুদৃষ্টি এবং সহযোগিতার হাত প্রসারিত রেখেছেন মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জাম খান কামাল ভাই। সেই সাথে আমাদের গভর্নিং বডির অন্যতম সদস্য, এই এলাকার কাউন্সিলর জনাব ফরিদুর রহমান ইরান ভাইও এই কলেজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে যথেষ্ঠ সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। গভর্নিং বডির অন্যান্য সদস্যরাও সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন। একইসাথে তেজগাঁও কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল আঞ্জু আপাও কলেজের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক ও তৎপর। এ কলেজের উন্নয়নে অধ্যক্ষ হিসেবে প্রফেসর আবদুর রশিদ স্যারের অবদান অনস্বীকার্য।
এ কলেজকে ঘিরে প্রফেসর হারুণ-অর-রশিদ এর ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ভবিষ্যত পরিকল্পনা একটাই; শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে কলেজটিকে ইউনিভার্সিটির মানে উন্নীত করা অর্থাৎ নাম কলেজের থাকলেও ইউনিভার্সিটির সমস্ত বৈশিষ্ট্য যেন এই কলেজে বিদ্যমান থাকে এবং এধরণের মনোভাব যেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যেসকল শিক্ষার্থী বের হবে তারা যেন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য ও মানুষের জন্য অনেক ভালো কাজ করতে পারে এবং তাদের যেন আমরা সেভাবেই যোগ্যতররূপে তৈরি করতে পারি সেই ব্রত নিয়েই আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
সুদীর্ঘ কর্মজীবনের কিছু সফল কর্মকান্ড প্রসঙ্গে কলেজের প্রতিভাদীপ্ত ও স্মার্ট অধ্যক্ষ আলোকপাত করেন, আমি তেজগাঁও কলেজে যোগদানের পূর্বে শিক্ষা ক্যাডারে চাকুরি করেছি। তাছাড়া ১৮তম বিসিএস থেকে ফ্যামিলি প্ল্যানিং ক্যাডারেও চাকুরি করি। পরবর্তীতে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে তেজগাঁও কলেজে বোটানি বিভাগে যোগদান করি। আমি যখন এই বিভাগে যোগদান করি তখন এই কলেজে সবেমাত্র অনার্স শুরু হয়। সেসময়ে অনার্সের শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে কলেজে আসত না, ক্লাস করত না। এ পরিস্থিতিতে তাদেরকে আমি যথাযথ মোটিভেশন দেই। অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বোটানি বিভাগের সেই শিক্ষার্থীদের মনোভাব আমি বদলে দিতে সচেষ্ট হই এবং এতে করে শিক্ষার্থীরা কলেজমুখী হয়। এটি তেজগাঁও কলেজে আমার প্রথম সফলতার আত্মতৃপ্তি ও অনন্য স্মৃতি। তৎপরবর্তীতে অধ্যাপনার জায়গা থেকেও এই বিভাগকে অনেক দূর নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। মাত্র ৮ জন শিক্ষার্থী থেকে প্রতি বছর এখন এই বিভাগে ৮০-৯০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয় এবং তারা খুব ভালও করছে বলা যায়। পরবর্তীতে আমি যখন উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করি তখন অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ স্যারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। সেসময়ে বৃহৎ এই কলেজটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং সুশৃঙ্খলভাবে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ’র কিছু ডায়নামিক ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন কিছু উপাধ্যক্ষ’র প্রয়োজন ছিল। আমি, আঞ্জু আপাসহ আমরা চেষ্টা করেছি প্রফেসর আব্দুর রশীদ স্যারের সেই প্রত্যাশা পূরণে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে। বর্তমানে আমরা সকলে মিলে খুব ভালো আছি। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি, আমাদের মধ্যে যেরূপ ঐক্য ও সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতা বিদ্যমান রয়েছে তা অন্য কোথাও নেই।
একজন অগ্রজ হিসেবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের ছাত্র-তরুণদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি শিক্ষক হিসেবে আগামী প্রজন্মের ছাত্র-তরুণদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ছাত্রজীবনে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হবে। পড়াশোনার মূল বিষয়বস্তুর পাশাপাশি গেøাবাল চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলার করার জন্য গেøাবাল যে ডিমান্ড রয়েছে, জব মার্কেটে যে ডিমান্ড রয়েছে, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে ডিমান্ডগুলো রয়েছে সেগুলোও অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মানসিকতা পোষন করতে হবে। যারা দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, দেশকে ১৯৭১ সালের পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাদেরকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং প্রতিহত করার মানসিকতা পোষন করতে হবে। আরেকটি বিষয় আমি বলব, এই সমাজে নেশাগ্রস্ত যুবকের সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে। গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত একই অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। নেশাগ্রস্ত যুবক মানে অসুস্থ যুবক। একজন নেশাগ্রস্ত শিক্ষার্থী একটি পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বোঝা। তাদের প্রতি আমার উপদেশ, তারা যেন এই নেশার পথ পরিহার করে জননেত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০৪১ ও ডেল্টাপ্ল্যান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিজেদের যোগ্য মানুষরূপে তৈরি করে। সেই সাথে তারা যেন নিজের প্রতি যতœবান হয়, বাবা-মায়ের প্রতি যতœবান হয়, সামজের প্রতি ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হয়; সেটিই তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা ও পরামর্শ।
স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ও সুশাসনের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করছে ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা। এ প্রতিষ্ঠানের ৪ দশক পূর্তি উপলক্ষে মূল্যবান পরামর্শ জানতে চাইলে তেজগাঁও কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, আমি গতকালও কলেজের শিক্ষকদের সাথে মিটিংয়ে একটি সেøাগান উদ্ধৃত করেছি, যা ক্যাম্পাস অফিসের প্রবেশ পথে দেয়ালে লিখা আছে। উদ্ধৃতিটি হলো-
উষর মরুর ধূষর বুকে যদি একটি শহর গড়ো,
একটি মানুষ মানুষ করা তার চেয়েও অনেক বড়।
এই কথাটি আমাকে যেভাবে স্পর্শ করেছে তাতে আমি বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন জায়গায় এটি কম করে হলেও ৫৫০ বার উল্লেখ করেছি। তাই এ পত্রিকার ৪০ বর্ষ পূর্তিতে পত্রিকার সম্পাদক ড. এম হেলাল ভাইকে ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই। সেই সাথে ক্যাম্পাস পত্রিকার নিকট প্রত্যাশা, তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে আরও অনেক মানুষ আলোকিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলোকিত হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলোকিত হবে। ক্যাম্পাস’র মহৎ উদ্দেশ্য যেন আরো উন্নত হয়, আরও বেগবান হয়, দেশের জন্য ও মানুষের জন্য ক্যাম্পাস যেন আরও বেশি ভ‚মিকা রাখতে পারে ৪০ বর্ষ পূর্তিতে আমার এই শুভ কামনা থাকলো।