মানুষ যখন ভালো হয়, তখন সমাজও সুন্দর হয়। সমাজ সুন্দর হলে রাষ্ট্রও সুন্দর হয়। মানুষ ভালো না হলে যেমন রাষ্ট্র সুন্দর হয় না, তেমনি রাষ্ট্র সুন্দর না হলেও মানুষ ভালো থাকতে পারে না। তবে সমাজের সব ভালো মানুষই আবার সুন্দর সমাজ-রাষ্ট্র বিনির্মানে ভূমিকা রাখেনা।
সমাজে অধিকাংশ ভালো মানুষ কেবল সমাজকে বয়ে নিয়ে যায়, ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দেয়া লোকের সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। ব্যতিক্রমী গতিতে এগিয়ে দেবার তেমনই এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব হলেন, সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের অসাধারণ ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ শাহ্রিয়ার আহ্সান; যিনি সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচনের স্বপ্ন হৃদয়ে ধারণ করে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে অতীতের ন্যায় গতানুগতিক ধারায় বয়ে নিয়েই যাননি, ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে দেয়ার দৃপ্ত শপথে কাজ করে যাচ্ছেন। উন্নত চিন্তার মেধাবী এ বীমা বিশেষজ্ঞ, সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে যোগদানের পর থেকে গতানুগতিক ধারায় চলতে থাকা এ কর্পোরোশেনকে তাঁর বৈপ্লবিক নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে গতিশীল বীমাশিল্প খাতে এক নবদিগন্তের সূচনা করেন। সুদক্ষ এমডি সৈয়দ শাহ্রিয়ার আহ্সান এর গতিশীল কার্যক্রম ও পরিকল্পনাসহ তাঁর সামগ্রিক বীমা-দর্শন সম্পর্কে জানতে ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধি একান্ত এক আলাপচারিতায় মিলিত হন। সেই সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো।
সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৈয়দ শাহ্রিয়ার আহ্সান বলেন, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা ও পুনঃবীমাকারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি দেশের যতগুলো প্রাইভেট নন লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানী রয়েছে তাদের পুনঃবীমাকারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। এটি একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পেয়ে আমি সত্যি নিজেকে গর্বিত মনে করছি।
সরকারি এ বীমা প্রতিষ্ঠানে যোগদানের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি যখন সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে প্রথম যাওয়া-আসা শুরু করি তখন ভাবতাম, এই প্রতিষ্ঠানটির দেশকে অনেক কিছু দেয়ার আছে, অনেক কিছু করার আছে দেশ ও মানুষের জন্য। কিন্তু এখানে এসে যখন দেখতাম নিজ নিজ ডেস্কে দায়িত্বশীল লোকজনকে ঠিকমত পাওয়া যায়না, কাজের গতি খুব সেøা; তখন মনে একধরণের দুঃখ অনুভব করতাম। তবে আমি যেহেতু সাধারণ বীমার রেগুলার এমপ্লয়ী ছিলামনা, তাই সেসময়ে আমার বিশেষ কিছু করার ছিলনা। তাছাড়া প্রাইভেট সেক্টর থেকে সাধারণ বীমায় আসাটাও একটা দুরূহ ব্যাপার ছিল। তখন ব্যবস্থাপনার উচ্চ পর্যায়ে সাধারণত তাদের মধ্যে থেকে প্রমোশন দিয়ে নিয়োগ দেয়া হতো অথবা ক্যাডার সার্ভিস থেকে নিয়ে আসা হতো; যা সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের জন্য মঙ্গলজনক ছিলনা। একটা সময় সাধারণ বীমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং মন্ত্রণালয় উপলব্দি করতে পারলো যে বীমা সংশ্লিষ্ট প্রফেশনাল মানুষ ছাড়া ভালোভাবে সাধারণ বীমা চালানো সম্ভব না। প্রকৃত অর্থে একটা ইন্সুরেন্স এবং রিইন্সুরেন্সকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে প্রফেশনাল লোক দিয়ে চালানো ছাড়া অন্যকোনো বিকল্প নেই। সেই অনুযায়ী একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হলো এবং সেই কমিটি আমাকে নিয়োগ দিলো।
সাধারণ বীমায় যোগদানের পর থেকে এ কর্পোরেশনের উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সৈয়দ শাহ্রিয়ার আহ্সান বলেন, এখানে যোগদানের পর প্রতিষ্ঠানটির যে দুর্বলতাগুলো আমার জানা ছিল প্রথমেই চেষ্টা করেছি সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার। এটি করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, অন্যান্য কাজের পাশাপাশি অফিসে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি। অফিসের সকলেই যেন যথাসময়ে অফিসে আসে এবং ঠিক সময়ে অফিস ত্যাগ করে এই বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। আমি সফলভাবেই সেটি কার্যকর করতে পেরেছি। এখন সাধারণ বীমার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সকাল ১০ টার মধ্যেই চলে আসে এবং কাজ শেষে ৬ টার পর অফিস ত্যাগ করে। তাছাড়া অফিসে যার যার কাজ ভাগ করে দেয়া হলো, একই সাথে কাজের জবাবদিহিতারও ব্যবস্থা করা হলো। ফলে দেখা গেলো ফাইল দ্রুত মুভ করতে শুরু করেছে এবং কোনো কাজ আর টেবিলে পড়ে থাকছেনা। তাছাড়া সাধারণ বীমার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বার্তা দিলাম, অফিসের সবাইকে এই ভবনটিকে সেকেন্ড হোম মনে করতে হবে। কারণ একজন এমপ্লয়ী যতক্ষন তার নিজ পরিবারের সাথে সময় কাটায়, তারচেয়ে বেশি সময় অফিসে কাটায়।
এগুলো বাস্তবায়িত করার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় অনুভব করি, এই প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করে, কর্মক্ষেত্রে তাদের ভালো লাগার ব্যবস্থাও আমাকে করতে হবে। কারণ দীর্ঘক্ষন ধরে যেহেতু অফিসে কাজ করে, সুতরাং ভালো লাগার কর্মপরিবেশ তৈরি করতে না পারলে তারা ভালো কাজ করতে পারবে না। সেই চিন্তা থেকে এই ভবনটি সেন্ট্রাল এয়ারকন্ডিশনিং ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসলাম। তাছাড়া অফিসের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টকে চাহিদা অনুযায়ী পূনরায় সজ্জিত করলাম। এতে করে সাধারণ বীমার এমপ্লয়ীদের মাঝে বড় একটা পরিবর্তন আসলো। তাদের ওয়াশরুম সুবিধা উন্নত করা হলো। পূর্বে খাওয়ার পানি তাদেরকে বাসা থেকে বোতলে করে নিয়ে আসতে হতো। এটি দেখে আমি এই ভবনের প্রতি তলায় তলায় পিউরিফায়েড পানির ব্যবস্থা করলাম। এদের যাতায়াতের বাসগুলো ছিল পুরানো, জানালার কাঁচ ভাঙ্গা, সিট ছেড়া। সিন্ডিকেটের কারণে বাসগুলো পরিবর্তনও করা যেতনা। তাদের সমস্যা উপলব্দি করে, আরামদায়ক যাতায়াতের জন্য এসিযুক্ত মাইক্রো, কোস্টার ক্রয়ের ব্যবস্থা করি। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মানসিকতার বিরাট পরিবর্তন আসলো।
সাধারণ বীমার এমপ্লয়ীদের হেড হিসেবে আমি নিজেও তাদের সাথে একই সময়ে অফিসে আসাটা নিশ্চিত করলাম। অধিকাংশ সময় কাজের কারণে অফিস থেকে একই সময়ে বের হতে পারিনা কিন্তু অফিসে প্রবেশ করি একই সাথে। সাধারণ বীমায় ৬ বছরের কর্মকালে কোনো ফাইল টেবিলে ফেলে রেখে বাড়ি যাইনি। এমনকি যেসব ফাইলে সমস্যা রয়েছে মনে হয় সেগুলোও সাথে সাথেই সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠিয়ে দেই; আমার কাছে কোনো ফাইল জমিয়ে রাখিনা। এটি নিশ্চিত করতে গিয়ে অনেক সময় অফিস থেকে বের হতে রাত ১১টাও বেজে যাায়, ১২টাও বেজে যায়। এভাবে সাধারণ বীমার উন্নয়নে কাজ করতে থাকলাম। একটা সময় লক্ষ্য করলাম, এখানকার এমপ্লয়ীদের প্রমোশন ঠিকমত হচ্ছেনা। দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রমোশন আটকে আছে। এই সমস্যা সমাধানে এবং প্রতিষ্ঠানের কাজকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় থেকে অর্গানোগ্রাম পাশ করালাম, প্রমোশনের ব্যবস্থা করলাম এবং নতুন লোকও নিয়োগ দিলাম। এসব বিষয়গুলো তাদেরকে দারুনভাবে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করলো এবং তাদের মাঝে কর্মচাঞ্চল্য নিয়ে আসলো। বিভিন্ন শাখাগুলো পরিদর্শনে গিয়ে দেখলাম সেখানকার চেয়ার-টেবিল ভাঙ্গা। চেয়ারের পা ভাঙ্গা থাকায় ইট দিয়ে চেয়ারে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক সাইনবোর্ড ভেঙ্গে ঝুলছে। আমি চেষ্টা করলাম সেগুলো ঠিক করার ব্যবস্থা করে যতটুকু সম্ভব তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে।
একপর্যায়ে আমি মনযোগ দিলাম সাধারণ বীমার ব্যবসা বাড়ানোর দিকে। কারণ যে খরচগুলো বাড়ানো হয়েছে তাতে ব্যবসা না বাড়ালে চলা যাবেনা। অফিসের লোকজনকে পরিস্থিতি বুঝাতে চেষ্ঠা করলাম, তাদের মাঝে একটা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরির চেষ্টা করলাম। তাদেরকে বললাম, একটা প্রাইভেট ইন্সুরেন্স কোম্পানী যদি ব্যবসা বাড়িয়ে এত মুনাফা করতে পারে তাহলে আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে কেন পারবোনা! সরকারি অনেক কাজের সাথে জড়িত হয়েও আমাদের ব্যবসা করার অনেক সুযোগ রয়েছে। তখন তারা জানালো, সরকারি কাজগুলো যখন অনুমোদন হয় তখন সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকেই লিখা থাকে ইন্সুরেন্স যার যার ইচ্ছে মত করতে পারবে। তখন আমি বললাম, এটি সঠিক নয়। আমাদেরকে এটা চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
বষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে গেলাম এবং জানালাম, দেশের প্রচলিত Law of the land অনুযায়ী সরকারি সম্পত্তি, সরকারি কাজ, সরকারি সাহায্য, অর্থাৎ সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ইন্সুরেন্স সাধারণ বীমায় করতে হবে। মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয়ার পর সেই চিঠি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা IDRA অফিসে গেলো নো অবজেকশন নেয়ার জন্য। IDRA এই বিষয়ে আমাকে খুব সাহায্য করেছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাকে শুনানির জন্য যেতে হতো। আমাদের যুক্তি উপস্থাপন করতাম এটা Law of the land, তারা বলতো This is our contract. তৎপ্রেক্ষিতে আমি বললাম, কনট্র্যাক্ট কখনও ল অব দি ল্যান্ড এর উপরের অবস্থানে হতে পারেনা অর্থাৎ অগ্রাধীকার পেতে পারেনা। এভাবে বিষয়গুলো সাধারণ বীমার পক্ষে আসতে শুরু করে এবং আমরা সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বীমা পলিসি নিয়ে কাজ করতে শুরু করি।
অতি সম্প্রতি সাধারণ বীমা কর্পোরেশন সেরা করদাতা-২০২২ সম্মাননা পেয়েছে। এ প্রাপ্তিতে অনুভূতি জানতে চাইলে সৈয়দ শাহ্রিয়ার আহ্সান বলেন, এটা নি:সন্দেহে গর্বের বিষয় যে আমরা সেরা করদাতার সন্মান অর্জন করতে পেরেছি। প্রতিষ্ঠানের সকলেই এজন্য আনন্দিত। আমি আশা করি ভবিষ্যতে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন সরকারী কোষাগারে আরও বেশি কর প্রদান করে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
ধারাবাহিক এ সাফল্যের পেছনে মুখ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি মনে করি এ সাফল্যের পিছনে সামগ্রিকভাবে কর্পোরেশনের সকলের অবদান রয়েছে। তদুপরি প্রতিষ্ঠানের প্রতি আন্তরিকতা, কর্তব্যপালন ও ব্যবসা আহরণে আন্তরিক প্রচেষ্টা ধারাবাহিক এ সাফল্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বীমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তা দূূরীকরণে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পদক্ষেপ সম্পর্কে এমডি সৈয়দ শাহ্রিয়ার আহ্সান বলেন, সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজের ইন্সুরেন্সগুলো করতে গিয়ে কিছু কিছু ক্লেইম পেতে শুরু করি। আমরা সেগুলো বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করি। এতে আমাদের উপর গ্রাহকদের আস্থা বেড়ে যেতে শুরু করে। পাশাপাশি দেশে অন্যান্য যে বেসরকারি ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়েও আমি ভাবতে শুরু করি। কারণ সেই ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলো আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। সুতরাং আমি ভেবে দেখলাম দীর্ঘদিন থেকে তাদের অমিমাংসিত যেসব সমস্যা ছিল সেগুলো সমাধান করতে পারলে আমাদের প্রতি বেসরকারি ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলোর আস্থা আরও বেড়ে যাবে। তাই সেগুলো সমাধানে আমরা মনযোগী হলাম। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মাঝে বীমা সম্পর্কে যে নেতিবাচক মনোভাব জন্মেছিল সেইনেতিবাচক মনোভাব দূর করে বীমার প্রতি তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনাটা একটা দায়িত্ব হয়ে পড়েছিল। সুতরাং ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলোর রিইন্সুরেন্স সম্পর্কিত যেসব বড় বড় ক্লেইম ছিল যেমন স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ, পলমলসহ এরকম বেশ কিছু ক্লেইম আমরা দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হই। এতে করে রিইন্সুরার হিসেবে সাধারণ বীমার প্রতি অন্যান্য ইন্সুরেন্স কোম্পানীর যেমন আস্থা বেড়ে গেলো, তেমনি গ্রাহকদের কাছে তাদের ভিত্তিটাও আরো শক্ত হলো।
নেপালে ইউএস বাংলা বিমান দুর্ঘটনার বীমা দাবি মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আমরা নিষ্পত্তি করি। এছাড়া বাংলাদেশ বিমানের মিয়ানমারে দুর্ঘটনার বীমা দাবিটিও দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করি। রিইন্সুরেন্সের ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করেছি বাহিরের দেশের এ রেটেড কোম্পানীগুলোর সাথে রিইন্সুরেন্স করতে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পাইলটদের ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বীমার দাবীকৃত বীমাও আমরা মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিষ্পত্তি করে দিয়েছি। এই বিষয়গুলো ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ সকল ধরণের মিডিয়াতে ব্যাপক কাভারেজ পেয়েছে। আমাদের এই ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো মিডিয়ার কল্যাণে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে যায় ও বীমার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এই নিউজগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এভাবেই সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে বিস্তৃতি ঘটতে থাকে।
বীমা পলিসি সংক্রান্তে সংশ্লিষ্ট ইন্সুরেন্স কোম্পানী কর্তৃক কোন ধরণের অনিয়মের শিকার হলে, সেই অনিয়ময়ের প্রতিকারে একজন সাধারণ গ্রাহকের করণীয় কী সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,
২০১০ সালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁরা বীমা শিল্পের শৃঙ্খলা রক্ষা ও গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। যদি কোন গ্রাহক বীমা কোম্পানী কর্তৃক কোন অনিয়মের স্বীকার হয় সেক্ষেত্রে তারা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বরাবরে অভিযোগ করতে পারে।
গ্রাম ও শহরে আরো বেশী সংখ্যক মানুষের কাছে এ সেবা পৌছে দিতে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, দেশের মঙ্গলের জন্য সাধারণ মানুষ যেন স্বপ্রণোদিত হয়ে বীমার আওতায় আসে সে লক্ষ্যে আমরা মাইক্রো ইন্সুরেন্স পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করি। সেই ধারাবাহিকতায় বন্য, খরা এজাতীয় দুর্যোগজনিত কিছু বীমার পাইলট প্রোজেক্ট বেছে নেই, যদিও এগুলো আগে থেকেই শুরু হয়েছিল কিন্তু সেগুলো খুব ভালো ভাবে চলছিলনা। পূর্বে কিছু অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে আমি উদ্যোগ নেই এগুলো দ্রুত সময়ে মোবাইলের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার। এই উদ্যোগটি বেশ কাজে লাগে এবং মানুষ এতে বেশ উপকৃত হতে শুরু করে।
গাইবান্ধা, রংপুরসহ বেশ কিছু জায়গা পরিদর্শন করে এসে পাইলট প্রোজেক্ট বাদ দিয়ে সারা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এই বীমা সেবা পৌছে দেয়ার পরিকল্পনা করি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সারা দেশে আমাদের সেই চ্যানেল কিংবা লোকবল নেই। এতে করে ভালভাবে সবাইকে আমরা সার্ভিস দিতে পারবনা। আর সার্ভিস দিতে না পারলে আবার বীমার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলাম। বিভিন্ন এনজিও, এমএফআই এদের সাথে আলোচনা করে প্রস্তাব রাখলাম, আপনারা আমাদের ডেলিভারি চ্যানেল হিসেবে কাজ করেন, তাতে আপনাদের আমরা একটা নির্দিষ্ট পরিমান সন্মানীও দিব। সেই সাথে তাদের আরও বুঝাতে চেষ্টা করলাম, সারা দেশে সাধারণ মানুষদের যে ঋণ আপনারা দিয়ে থাকেন সেগুলো ফিরে পেতে অনেক সময় আপনাদের বেশ বেগ পেতে হয়। কারণ গ্রামের অনেক কৃষকদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে অনেক সময় তাদের ফসল নষ্ট হয়ে গেলে তারা আর সেই লোন পরিশোধ করতে পারেনা। সেক্ষেত্রে কৃষকদের যদি ইন্সুরেন্স করা থাকে তাহলে ফসলের ক্ষতি হলেও বীমার টাকা থেকে তারা সহজেই ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। আবার কৃষক ঠিকমত ঋণ পরিশোধ করার আপনারাও পুনরায় তাদের ঋণ দিতে আস্থা পাবেন। অন্যদিকে কৃষক একবার ক্ষতিগ্রস্থ হলেও অলস বসে না থেকে পুনরায় ফসল উৎপাদন শুরু করতে পারবে। এতে করে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির হবেনা, এ চাকা ঘুরতেই থাকবে।
তাদেরকে এই বলে আরও উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করি যে, কৃষকদের শুধু অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সহায়তা করলেই হবেনা, ব্যক্তিগত ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনারা ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার হসপিটালাইজেশন বীমা করে দিতে পারেন। যেমন এপেনডিক্স কিংবা গর্ভবতীদের প্রসূতি সেবাসহ এজাতীয় চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাদের আর টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবেনা। নচেৎ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এ ধরণের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গ্রামের অনেক কৃষকের পালিত গরু পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়। তাদের মুখের হাসি আমাদের ধরে রাখতে হবে। আমাদের দেশে ৪০ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষির সাথে জড়িত এবং আরও ২০ ভাগ পরোক্ষভাবে জড়িত। এই ৬০ ভাগ মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন যদি ঘটানো না যায় তাহলে আমাদের পক্ষে এসডিজি অর্জন করা সম্ভব নয়। সুতরাং দেশের উন্নয়নে এভাবে আপনারা কৃষকদের সাহায্য করতে পারেন। এতে করে গ্রামীন জনপদের মানুষের জীবন-মানও উন্নত হবে, দেশও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
এছাড়াও আমাদের দেশে নিয়মিত বিভিন্ন দুর্ঘটনায় বহু লোক মারা যাচ্ছে। এত করে অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের একমাত্র উপর্জনকারীকে হারিয়ে পুরো পরিবারকে ব্যাপক অর্থকষ্টে পড়ে যেতে হচ্ছে। এ ধরণের দুর্ঘটনার কথা চিন্তা করে আমরা বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা করেছি। এই বীমার আওতায় একজন ব্যক্তি মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে ২ লক্ষ টাকার কাভারেজ পাবেন।
মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে বীমা খাতের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, যেই দেশের বীমা ব্যবস্থা যত বেশি উন্নত, সেই দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। ইন্সুরেন্সকে বলা হয় It is the barometer of economic activities of a country. ইন্সুরেন্সের একটা বিরাট কাজ হল Mobilization of fund from internel sources. একটা দেশের উন্নতির জন্য দুই ধরনের ফান্ডের দরকার হয়। একটা আসে ইন্টারনাল সোর্স থেকে, অপরটি এক্সটার্নাল সোর্স থেকে। দেশের অভ্যন্তরীন উৎস যত শক্তিশালী হবে অর্থনীতির ভিত তত মজবুত হবে। আমরা সারাদেশ থেকে আমাদের প্রিমিয়াম তুলে এনে তা ব্যাংকে রাখছি। এতে ব্যাংকের লেনদেন বাড়ছে। তারা বেশি পরিমান ঋণ দিতে পারছে। তাছাড়া প্রিমিয়ামের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আমরা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করি। ৪০-৪২ ভাগ টাকা আমাদেরকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে হয়। সুতরাং এভাবে বিভিন্ন উপায়ে আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছি।
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের বীমা খাত যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেটিকে সন্তোষজনক বলে মনে করেন কি? ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সাথে বাংলাদেশের বীমা খাতের অগ্রগতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? এ প্রশ্নে জবাবে সৈয়দ শাহ্রিয়ার আহ্সান বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের বীমাখাত এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে বীমার পেনিট্রেশন হার ৫%-৭%। অপরদিকে আমাদের দেশে এই হার এখনও ০.৫% এর নিচে। এখানে বেশিরভাগ সম্পদ এখনও অবীমাকৃত থাকে। যে কোন দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত হলেও বীমাকৃত সম্পদের ক্ষেত্রে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান খুবই কম থাকে। সুতরাং এ সকল বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
বীমা খাতের এ পথচলার ব্যাপ্তি প্রায় অর্ধশত বছরের। সুদীর্ঘ এ অগ্রযাত্রায় এখনও বীমা খাত মানুষের আস্থার শীর্ষস্থানে আসতে না পারার কারণ নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় তিনি বলেন, বীমা খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এখনও এই খাতে অটোমেশন সিস্টেম গড়ে উঠেনি। তাছাড়া দক্ষ জনবলেরও যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে কারিগরিভাবে দক্ষ লোকবল এখনও বীমা খাতে তেমন গড়ে উঠেনি। এর ফলে বীমাখাতে আশানুরূপ সেবাও নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা এবং বীমার প্রতি মানুষের আস্থাও সম্পূর্ণ ফিরে আসছেনা। কারণ বীমা খুবই টেকনিক্যাল একটি বিষয়। সুতরাং এখানে টেকনিক্যালি দক্ষ লোক বিশেষ প্রয়োজন। সরকার এ বিষয়টি অনুধাবন করে এ বিষয়ক ইন্সুরেন্স একাডেমী করেছে। জীবন বীমা, সাধারণ বীমা, IDRA সহ এগুলোর উন্নয়নে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক একটি ফান্ড দিয়েছে। এগুলোর যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে পারলে বাংলাদেশের বীমা খাতে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। বীমাখাতে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে প্রতিবছর দশজন মেধাবীদের দেশের বাহিরে পাঠিয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তবে এদের ক্ষেত্রে শর্ত থাকবে যে পড়াশোনা শেষে তারা ফিরে এসে ১০ বছর এই খাতে সার্ভিস দিতে হবে। সুতরাং এসব কিছু মিলিয়ে বলতে হয় সামনের দিনগুলোতে বীমা খাতের একটি উজ্জ্বল-সম্ভাবনাময় সিলভার লাইন দেখা যাচ্ছে।
ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের এমডি বলেন, বীমা খুবই সম্ভাবনাময় একটি সেক্টর। পৃথিবীর যেকোনো দেশেই বীমা খাতের লোকজন অন্যান্য সেক্টর থেকে অনেক বেশি উপার্জন করতে সক্ষম হয়। তাই আমি ছাত্র যুবকদের উদ্দেশ্যে বলব, তারা যদি বীমা নিয়ে পড়াশোনা করে এবং এতদ্বিষয়ক প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট অর্জন করে তাহলে এই খাতে ব্যাংক থেকেও বেশি উপার্জন করে উন্নত জীবন যাপনে সচেষ্ট হবে। একই সাথে এ বিষয়ে বিশদ জ্ঞান অর্জনের ফলে নতুন নতুন প্রোডাক্টও মার্কেটে নিয়ে আসতে পারবে। বর্তমানে আমরা সীমিত জ্ঞান দিয়ে গতানুগতিক প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছি। নতুনরা যখন ইন্সুরেন্স মার্কেটে নতুন সব প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করবে, তা দেশের জন্য ব্যাপক কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসবে।
জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনে নিবেদিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা ৪ দশক পূর্তি উৎসব এবং ক্যাম্পাস পত্রিকা ও ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্রের অগ্রযাত্রায় পরামর্শ দিতে গিয়ে শাহ্রিয়ার আহ্সান বলেন, এ ধরণের উদ্যোগ সবসময় সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। ক্যাম্পাসের একাধিক প্রোগ্রামে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেখানে ক্যাম্পাসের কথা শুনে এবং তাদের প্রকাশনা পড়ে দেখেছি সেগুলো একটা সমাজকে নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এজন্য অবশ্যই ক্যাম্পাস অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। আমি আশা করব সামনের দিনগুলোতেও ক্যাম্পাস’র এই সমাজ জাগানিয়া কার্যক্রম চালিয়ে যাবে এবং অব্যহতভাবে যুব সমাজকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার জন্য সঠিক নির্দেশনা প্রদান করবে ।