সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ কীর্তি- বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা। শোষিত বঞ্চিত বাঙালীকে একটি সার্বভৌম ভূখ- উপহার দিয়ে ইতিহাসের মহানায়ক হয়েছিলেন তিনি। অথচ স্বপ্ন দিয়ে গড়া দেশে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে খুন হন স্বপ্ন দেখার সর্বোত্তম পুরুষটি। স্বাধীনতা এনে দেয়ার মাত্র আড়াই বছরের মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। সপরিবারে হত্যা করা হয়। কালো দিবসটি- ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা এবং স্বাধীনতার চেতনাকে মুছে ফেলার অপচেষ্টায় এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে ঘৃণিত ঘাতকরা। বাঙ্গালি নামধারী অকৃতজ্ঞ ঘাতকরা ১৫ আগস্ট কালোরাতে শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, ঘৃণ্য নরপশুরা একে একে হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালকে। জঘন্যতম এই হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি, কর্নেল জামিলসহ ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়স্বজন।
দেশি বিদেশি শত্রুরা ভেবেছিল, শিকড়সুদ্ধ উচ্ছেদ করা গেছে মুজিবকে। আদতে মুজিব মৃত্যুঞ্জয়। মুজিব বাংলাদেশের অপর নাম। এই নাম কী করে মুছে যাবে? আজকের বাংলাদেশ তাই মুজিবের মানচিত্র। তবে হ্যাঁ, এতকিছুর পরও, বঙ্গবন্ধুকে হারানোর গভীর ক্ষত শুকোয়নি। কপালে কলঙ্ক তিলক মেখে আছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে আগস্ট এলে পিতা হত্যার পাপ গিলে খেতে চায় বাঙালীকে। মুজিবের মতো নেতাকে রক্ষা করতে না পারার গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়। সব মিলিয়ে অন্যরকম এক আবহ তৈরি করে আগস্ট।
প্রতিবারের মতো এবারও শোকের মাসে আমূল বদলে গেছে রাজধানী শহর ঢাকা। যেদিকে চোখ যায়, শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি। বিলবোর্ড, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড সবখানে তিনি। বড় রাস্তার ধারে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে গুলিবিদ্ধ বাংলাদেশ দৃশ্যমান হচ্ছে। লালের পাশাপাশি শোকের কালো রঙে ছেয়ে গেছে সব অলি গলি। কালো পতাকায় মোড়ানো যেন চারপাশ। মাঝে মাঝে মনে হয়, সবুজ বৃক্ষরাও শোকের কালো রং মেখে নিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে রেসকোর্স। কোনো কোনো ছবিতে উত্তাল রাজনীতির শেষ গন্তব্য শেখ মুজিব। তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। ধারাবাহিক সংগ্রাম। আগস্টে বাঙালীর শৌর্য বীর্যের প্রতীক হয়ে ফিরে এসেছেন মুজিব। নতুন প্রাণ পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের গানের কথায়- ‘একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণী...।’
১৯৪০ সালে গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলের ফুটবল ক্লাবের নেতৃত্বে খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠক শেখ মুজিব বনাম গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেখ মুজিবের বাবা শেখ লুৎফর রহমান, এ দুটি ক্লাবের মধ্যে ফাইনাল খেলা পরপর পাঁচবার ড্র হয়। পরদিন সকালে ষষ্ঠবারের মতো খেলায় উৎসাহী শেখ লুৎফর রহমানের দল। তবে দু-এক দিন বিরতি নিয়ে খেলার পক্ষে শেখ মুজিব। অবশেষে প্রধান শিক্ষক শ্রী রসময় সেনগুপ্তের অনুরোধে শেখ মুজিব পরদিন সকালেই খেলতে রাজি হলেন ক্লান্তিতে পর্যুদস্ত তাঁর টিম হেরে যাবে জেনেও। ১৯৬৯ সাল। শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তথা স্বাধীনতাসংগ্রামের আরেকটি অধ্যায় সূচনার দায়ে কারাবন্দি। দলের প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ ভুল পরামর্শ দিলেন যেন প্যারোলে আইয়ুব আহুত রাওয়ালপিন্ডি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব যিনি অতন্দ্র প্রহরায় ও বঙ্গবন্ধুকে বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে বিরাট অবদান রেখেছেন, তাঁর পরামর্শ ছিল, প্যারোলে যাওয়া ঠিক হবে না, স্বৈরশাসক নিজের প্রয়োজনেই এবং দেশের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সামাল দিতে শেখ মুজিবকে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে হলেও পিন্ডি সম্মেলনে নিতে চাইবে। শেখ মুজিব শুনলেন সে কথা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের মহাসমাবেশ। প্রচণ্ড চাপ বঙ্গবন্ধু যেন স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা দেন। যুক্তির কাছে পরিস্থিতির পূর্বাপর বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু ঠিক করে ফেললেন, স্বাধীনতা চাই; কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীর বদনামের বোঝা মাথায় বয়ে নয়। সৃষ্টি হলো রাজনীতির শ্রেষ্ঠ কবিতা, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। প্রত্যক্ষভাবে উচ্চারণ করলেন না স্বাধীনতা শব্দটি, কিন্তু কিছু বাদও রাখলেন না।
সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী, বিশাল অবয়ব আর বৃহত্তর হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধুকে দেশ স্বাধীন করার রাজনীতিতে বারবার কুচক্রীরা বিতর্কে ফেলার চেষ্টা করেছে।
অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত জীবনে খাঁটি সোনার মতোই চরিত্রবান ছিলেন। মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে নরম পন্থা ও সমঝোতাপূর্ণ মনোভাবে বিশ্বাসী ছিলেন জাতির জনক। নিজ হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রতি বঙ্গবন্ধুর একটি সহজাত দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক ছিল বৈকি। কিন্তু সর্বোপরি দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নিয়েই তিনি একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, আশ্রয়হীনতা ও রোগশোকমুক্ত শোষণহীন সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। নতুন অর্থনৈতিক ধারা এবং প্রশাসনিক পদ্ধতি প্রবর্তন করার আগ মুহূর্তে ঘাতকের বুলেট তাঁকে সে সুযোগ দিল না। উন্নয়নের চাকা ঘুরে গেলো সম্পূর্ণ উল্টো দিকে। জাতির উপর জেঁকে বসলো পুঁজিবাদের নিকৃষ্টতর শোষণ।
সমসাময়িক বিশ্বের সব বড় নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তো তিনি অতি সহজেই পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে জাপানিদের সহায়তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পেরেছিলেন। জাতিসংঘের সদস্য হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী হেনরি কিসিঞ্জারও বঙ্গবন্ধু দর্শনের পর বলেছিলেন, ‘আমি অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সাক্ষাৎ পাই, কিন্তু আজই প্রথম একজন রাষ্ট্রনির্মাতার দেখা পেলাম।’ এহেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি, আত্মত্যাগ, আদর্শ ও স্বদেশ-স্বজাতি প্রেমের কথা স্মরণ করে কি আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সর্বশক্তি নিয়োগ করে বিশ্বের দরবারে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করতে পারি না? কেন পারব না বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আধুনিক, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রযুক্তিনির্ভর কল্যাণ রাষ্ট্রকে অচিরেই বাস্তবে রূপ দিতে? নিশ্চয়ই পারব, বঙ্গবন্ধুইতো আমাদের চিরকালের প্রেরণা। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ, লক্ষ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের কাছে মাথা নোয়াতে পারে না। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং উন্নত দেশের সারিতে বাংলাদেশকে স্থান করে দিতে পারলে মুজিবের অতৃপ্ত আত্মা শান্তি পাবে। সোনার বাংলা সেই কাক্সিক্ষত ছবি ভাসছে আমাদের দৃষ্টির সামনেই।