দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকায় ফাহ্মিদা তাপসীর অনুলিখনে লেখা এই প্রতিবেদনটি ছাত্র-যুবকদের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে সেই বিবেচনায় এটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকায় পুনঃমুদ্রিত হলো।
স্বপ্ন দেখায় বিশ্বাসী ড. নাজনীন আহমেদ এখন কর্মরত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে। শুধু তা-ই নয়, সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে গঠিত প্যানেল অব ইকোনমিস্ট এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবেও কাজ করছেন নাজনীন আহমেদ।
স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। নিজের সহপাঠীদের মধ্যে অনেকে পুরস্কার পেয়েছে দেখে আমারও পুরস্কার পাওয়ার সাধ হচ্ছিল। তাই বারবার বাবাকে জিজ্ঞেস করছিলাম বাবা আমি কখন পুরস্কার পাব? বাবার দেয়া উত্তরটা ছিল এমন, পুরস্কার পেতে হলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে হয়। তখন কী বুঝেছিলাম জানি না, কিন্তু ভেবেছিলাম, ওই পুরস্কার পেতে হলে আমাকে পরীক্ষায় ভালো করতেই হবে। মাত্র চার কি পাঁচ বছর বয়সের সেই স্মৃতিকথা মনে করে খানিকটা হেসে দিলেন ড. নাজনীন আহমেদ।
ভালো ফলাফল করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, তাই বেশি বেশি পড়তে হবে, এমনটা ভেবে নয়; বরং পুরস্কার পেতে হলে, সবার হাততালি পেতে হলে ভালো ফলাফল করতে হবে- বাবার এ কথা মনে রেখে খানিকটা বেশি মনোযোগ দিলেন পড়াশোনার প্রতি। যেহেতু পেছনের সারির ছাত্রী ছিলেন, তাই একটু বেশিই চেষ্টা করতে হয়েছিল। তবে তাতে কী, আস্তে আস্তে যে পুরস্কার পাওয়ার মতো ফলাফল করলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু ভালো ফলাফল করেই নয়, সব কিছুতেই প্রথম হওয়ার নেশাটা জেঁকে বসেছিল তার ধ্যান-ধারণায়। কেননা সবসময় নিজেকে লাইমলাইটে দেখতে চেয়েছিলেন। অবশ্য প্রথম হতে হবে- এটি থেকে বেশি কাজ করত সবার মনোযোগ থাকার চিন্তাটাই। ফলে স্কুলে থাকা অবস্থাতেই গান, নাচ, আবৃত্তি, বিতর্ক কত কিছুই না করেছেন। সেই ছোট বয়সেই বিতর্ক করে হারিয়েছেন অনেক বিতার্কিককে। খুলনা গভঃ গার্লস স্কুলের সবার কাছে দিনে দিনে পরিচিত মুখ হয়ে উঠছিলেন তিনি। আর না হওয়ারও কোনো কারণ নেই। কেননা পড়াশোনা কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকা- যাই বলা হোক না কেন, সবই তো তার নখদর্পণে। অনেকটা এমন ছিল যে, কোনো প্রতিযোগিতায় নাজনীন আহমেদের উপস্থিতি মানেই প্রথম পুরস্কার তার ঝুলিতেই জমা হওয়া।
জাতীয় পর্যায়ে শিশু পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। তবে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িত থাকলেও পড়াশোনার ব্যাপারে এতটুকুও ছাড় দেননি কখনো। প্রথম স্থান নিয়েই একের পর এক শ্রেণি টপকাচ্ছেন। নবম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হলেন। ক্লাসের প্রথম হওয়া মেয়েটি বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করবে- এমনটাই হয়ে থাকে। এমনটা হলো নাজনীনের ক্ষেত্রেও। পড়াশোনা শুরু করলেন বিজ্ঞান বিভাগেই। কিন্তু কেন যেন জীববিদ্যার ব্যবচ্ছেদ, পদার্থবিজ্ঞানের মাপঝোঁক কিছুই ভালো লাগত না। ইতিহাস, অর্থনীতি-পৌরনীতির বিষয়গুলো বেশ আকর্ষণ করত তাঁকে। ছোটবেলা থেকেই বিতর্ক করে আসছেন, সেক্ষেত্রে এসব বিষয় ঘিরে ভালোলাগা তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সেদিক থেকে বলা চলে বিজ্ঞান বিভাগে অনেকটা জোর করেই পড়া। একদিন কিছুটা বিরক্ত হয়েই বই-খাতা ছুঁড়ে ফেলেন। এ দৃশ্য চোখে পড়ে বাবার। তখন তিনিই তাকে বলেন, এমন ঘৃণা কিংবা বিরক্তি নিয়ে পড়াশোনা করলে কখনো ভালো কিছু হবে না। বিজ্ঞান বিভাগে প্রায় পাঁচ মাস পড়াশোনার পর মানবিক বিভাগে পড়া শুরু করেন। বরাবরের মতো সেখানেও প্রথম হতেন। এভাবে মাধ্যমিকে যশোর বোর্ড ও উচ্চ মাধ্যমিকে ঢাকা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন।
আইনজীবী হবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের পর সেই চিন্তার মোড় ঘুরে গেল। অর্থনীতিবিদ হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হলেন। কিন্তু সম্মান তৃতীয় বর্ষে থাকাকালে বিয়ে হয়ে গেল। তবে তাতে কি? সব সামাজিকতা রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়ে গেলেন। সম্মানেও প্রথম বিভাগ নিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ক্লাস শুরু হতে না হতেই জন্ম হলো তার প্রথম সন্তানের। এবার তো পরিবার, সন্তান, পড়াশোনা তিনটিই সামলাতে হবে এবং সেখানে কোনোটিরই গুরুত্বও তার কাছে কম নয়। সবকিছু সামলে পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন। এমনও হয়েছে, সন্তানের অসুখ নিয়ে হাসপাতালে জেগে ছিলেন সারা রাত। যখন শিশুটি ঘুমিয়েছে আর তখনই পড়তে হচ্ছে পরের দিনের পরীক্ষার পড়া। অবশ্য এসব কঠিন সময়ে বাবা-মা, স্বামী, শাশুড়ি তথা পরিবারের সবার সহযোগিতা পেয়েছেন। স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার আগেই যোগ দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এ। পরের বছরই বিআইডিএস এ যোগ দেন। ততদিনে স্নাতকোত্তর শেষ হয়েছে তার। এরপর কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করতে যান। আর তখন তার মাত্র দুই বছরের সন্তানকে বাড়ি রেখে যেতে হয়। ফিরে আসার পর দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলো। এর পর আমেরিকান একটা স্কলারশিপে পিএইচডি’র সুযোগ পান নেদারল্যান্ডসে।
সেখান থেকেও যথারীতি সফলভাবে পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশে ফেরেন। তবে এবার তার দুই সন্তানকে দেশে রেখে যেতে হয়েছিল। পিএইচডি শেষে দেশে ফেরার পর জন্ম হলো তৃতীয় সন্তানের। এতটা চড়াই-উতরাই পার করে তবেই নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন। অবশ্য বড় স্বপ্ন দেখেছেন বলেই হয়তো এতটা সফল তিনি। আর তাঁর স্বপ্নপূরণে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা পান তাঁর স্বামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এম হেলাল’র কাছ থেকে। ড. নাজনীণ এর মতে স্বপ্ন, আত্মবিশ্বাস ও ইচ্ছাশক্তি- তিনটিই প্রবল ছিল, যার কারণে তিনি এতটুকু পথ হাঁটতে পেরেছেন। যদিও তিনি মনে করেন, আরো অনেক কিছু করার বাকি আছে তার, উপরে ওঠার সিঁড়ির কয়েকটি ধাপ মাত্র শেষ করেছেন তিনি।