দিন বদলের সরকারের একটি সফল সংস্থার কথা বলতে বললে যে কেউ বলবে-দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), যার অন্যতম কান্ডারী মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। যিনি প্রতিজ্ঞায় অটল, ন্যায়নিষ্ঠ, লক্ষ্যাভিসারী ও কৃতী সমাজ সংস্কারক। যৌবনে জীবন বাজি রেখে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করেছেন। ৭১’র উত্তাল দিনগুলোতে অকুতোভয় বীর সেনানি হিসেবে সম্মুখ সমরেও অংশ নিয়েছেন। তিনি স্বাধীন বাংলা ছাত্রপরিষদের পাবনা জেলার সভাপতি হিসেবে পাবনায় স্বাধীন বাংলার পতাকার উত্তোলনকারী। ৭৫এর পরে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করায় ২০ আগস্ট সামরিক আইনের ৭ধারায় আটক হয়ে প্রায় তিন বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। সমৃদ্ধ দেশ ও উন্নত জাতি গঠনে কাজ করতে যেয়ে এই নির্লোভ ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষটি অনেক নির্যাতন ভোগ করেছেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু দেশের মাটি ও মানুষের স্বার্থে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন সবসময়ই আপোশহীন। এখনও লাল সবুজ পতাকার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ও একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মানচিত্রকে আরো দেদীপ্যমান করে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী ও ডায়নামিক ব্যক্তিত্ব সাহাবুদ্দিন চুপ্পু একাধারে আইনজীবী, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও বিচারক। ১৯৮২ সালে তৎকালীন বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে যোগদান করেন। কর্মজীবনে অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম-অনুরাগের কারণে তিনি সহকারী জজ থেকে জেলা জজ, আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচিত মহাসচিব থেকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান, পরবর্তীতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
কথাবার্তায়, চালচলনে তিনি সাদাসিধে মানুষ; একজন সাদা মনের মানুষ। সফল ও চৌকস এই ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তিনি ১৯৭৩-৭৫ সালে পাবনা জেলা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সম্পাদক, ১৯৭৮-৮২ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা পরিবার পরিকল্পনা সমিতির কোষাধ্যক্ষ, পাবনা জেলা প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য, অন্নদা পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য। কর্মপ্রিয় ও দূরদর্শী এই মানুষটির সাথে ক্যাম্পাস’র প্রতিনিধি গিয়াস উদ্দিন আহমেদের একান্ত কথোপকথনের কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকাঃ দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনে আপনার অনুভূতি কী এবং দেশের দুর্নীতি দমনে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছেন বলে আপনি মনে করেন?
মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুঃ আমি ৫বছর যাবৎ দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয়। কেননা এখানে যে কাজ করতে হয়, মানুষের মধ্যকার আস্থাকে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয় প্রতিটি মুহূর্তে। দুর্নীত দমন কমিশনকে সৃষ্টিই করা হয়েছে দেশে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতি সঞ্চার করতে হলে, দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে হলে, উন্নয়নের উচ্চধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে মূল অন্তরায় যে দুর্নীতি, তা দমন করতে হবে। আমাদের দেশে যেভাবে প্রতিবছর দুর্নীতির প্রসার ঘটছে, তাতে দুর্নীতিকে যদি সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব হয়, তাহলে আমরা সার্থক হয়েছি বলে মনে করবো।
দুর্নীতি দমন কমিশন বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে। তাতে প্রতিষ্ঠানটি অনেকাংশেই সফল। অনেক বড় বড় দুর্নীতির বিষয় আমরা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছি। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন সারাবিশ্বে দুর্নীতিতে দেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেখান থেকে উত্তরণ ঘটেছে, দুর্নীতির মাত্রা অনেকাংশেই কমে আসছে। আমাদের সফল অভিযানের ফলে, নিরলস চেষ্টার কারণে এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছি। অর্থনৈতিক সেক্টর থেকে শুরু করে ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের দুর্নীতি ও অনিয়ম যা ছিল তা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। সামাজিকভাবে দুর্নীতির ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করে তোলা, প্রতিরোধের কাজ চলছে। আমি সত্যিই এসব পদক্ষেপে সন্তুষ্ট।
ক্যাম্পাসঃ দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল কি আদৌ সম্ভব?
চুপ্পুঃ দুর্নীতি একেবারেই নির্মূল করা আদৌ সম্ভব বলে আমি মনে করি না। এটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবে আমি আশাবাদী বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে না হলেও অদূর ভবিষ্যতে গড়ে উঠবে। তবে এই পর্যায়ে দুর্নীতিকে একটা সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে পারলেই তা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সার্বিক গতি সঞ্চারে অনেক সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
ক্যাম্পাসঃ প্রতিবছর দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালনের উদ্দেশ্য ও ফলাফল কী?
চুপ্পুঃ দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ ৫-৬ বছর ধরে পালন করে আসছি। প্রতিবছর ২৬ মার্চ দেশের স্বাধীনতা দিবস থেকে সপ্তাহটি পালিত হয়। এই দিন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তি শব্দটার অন্তর্নিহিত বিষয়টি ছিলো এদেশের সাধারণ মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুবিধা দেয়া। মৌলিক যে অধিকারের জন্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেটা যাতে পূরণ হয় এটা ছিলো উদ্দেশ্য। ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এই সপ্তাহটা পালন করে থাকে দুদক। জনগণের মাঝে দুর্নীতি বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে সিম্পোজিয়াম, কার্টুন প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, মানব বন্ধন ও সেমিনার আয়োজন করা হয়ে থাকে। মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড চালু করেছি পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে উৎসাহিত করতে। ঢাকাতে বড় ধরনের সেমিনার হয়, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আসেন। সকল বিদগ্ধ ব্যক্তির সমন্বয়ে এই সেমিনারে তাদের মতামত নেয়া হয়। মুক্ত আলোচনায় তারা দুদকের ভাল-মন্দ বিশ্লেষণ করেন। তাদের ভাল পরামর্শগুলো আমরা সাদরে গ্রহণ করি। আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করি। আমাদের এই সপ্তাহটা ফলপ্রসূ করতে আমরা নানান ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।
ক্যাম্পাসঃ দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ ছাড়া দেশব্যাপী সচেতনতা বাড়ানোর কোনো প্রোগ্রাম আছে কী?
চুপ্পুঃ The United Nations Convention against Corruption (UNCAC) সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। এই সনদের অধ্যায় ১২ তে আছে দুর্নীতি প্রতিরোধ। এখানে দেখা যাচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনা হয়েছে। যদি দুর্নীতির উৎস থেকেই আমরা দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করতে পারি তাহলে আর দুর্নীতির সুযোগই থাকে না। দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য সমগ্র বাংলাদেশের ৬৪ জেলাতেই ‘দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি’ আছে। প্রায় ২২ হাজার স্কুল কলেজ ও মাদরাসায় ‘সততা সংঘ’ বা ‘ইন্টিগ্রিটি ইউনিট‘ আছে। এখানে শিক্ষক, অভিভাবক ও ম্যানেজিং কমিটির লোকজনও আছেন। ২৩টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের লোকজন সেগুলোতে ভিজিট করেন ও উৎসাহ- অনুপ্রেরণা দেন। ক্লাস শুরুর আগে আ্যাসেম্বলিতে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্পর্কে কথাবার্তা হয়ে থাকে। এসব সংঘ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সততা চর্চা প্রসারের লক্ষ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটিসমূহের সহযোগী সংগঠন হিসেবে কাজ করে। দেশব্যাপী ছাত্র সমাজের মাঝে দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহায়তায় সততা সংঘগুলো জেলা ও শহরগুলোতে বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা, সেøাগান, পোস্টার, নাটক, বিতর্ক ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, যাতে স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। দুদক সততা সংঘ’র সদস্যদের মধ্যে ‘সততা সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’ এবং ‘আমরা দুর্নীতি করবো না, সইবো না, মানবো না’ লেখা হাজার-হাজার পোস্টার বিতরণ করে। এইভাবে গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন-থানা-উপজেলা-জেলা পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ সংগ্রামে সাংবাদিকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে “দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড“ প্রদানের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর উদ্যোগে সরকারি দপ্তরে দুর্নীতিমুক্ত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গণশুনানি অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে সেবা প্রদানকারীকে নাগরিকের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ করা যায়। গণশুনানির আইনগত কাঠামো হচ্ছে- সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ (২) এ বলা হয়েছে ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’
জনগণের সামনে যারা তৃণমূল পর্যায়ে সেবাদান করেন উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তার, উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার, সাব রেজিস্ট্রার, ভূমি অফিসার এসিল্যান্ড, যেখানে মানুষ সবচেয়ে বেশি যায় কাজের জন্য, ভোগান্তির উদ্রেক যেখানে বেশি হয়, এই সমস্ত জায়গায় আমরা সংশ্লিষ্টদেরকে একসাথে করি এবং আমাদের যে প্রতিরোধ কমিটি আছে তারা তখন ভুক্তভোগীদেরকে তাদের সামনে হাজির করে। তখন তারা দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কমিশনার বা একজন ডিজির উপস্থিতিতে সরাসরি তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। উন্মুক্ত শুনানি হয়। ভুক্তভোগী বলে দেয়- আমি মিউটেশনের জন্যে এতো তারিখে দরখাস্ত করেছিলাম আমার সমস্ত পেপারস প্রস্তুত, তবুও আমাকে ঘুরানো হচ্ছে অথবা আমার কাছে উৎকোচ দাবি করা হয়েছে। অথবা ডাক্তার সাহেব আমাকে ঔষুধ দেন নাই। ইঞ্জিনিয়ার ঐ রাস্তাটা করেছেন মানসম্মত হয়নি। সাব রেজিস্ট্রি অফিসে আমার দলিলটি সম্পাদনের ক্ষেত্রে এই এই অজুহাত দেখানো হয়েছে। এই ধরনের অভিযোগগুলো যখনই আসে তখনই আবার সেগুলোর সুরাহা হয়ে যায়। এটা মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্তের আলোকেই হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এবং সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২০১৪ সালের জুন মাসে জারি করা অফিস স্মারক অনুযায়ী কমিশন গণশুনানি পরিচালনা করছে।
জেলাপ্রশাসকদের গণশুনানি করার সিদ্ধান্ত দেয়া আছে। দুদক এই ধারণাকে গ্রহণ করেছে এবং এই পর্যন্ত ৮/১০টি জায়গায় গণশুনানির ব্যবস্থা করেছে। এটার ফলাফল অত্যন্ত ভালো। ৫টি মডেল জেলাতে কাজ শুরু করেছি। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে সমস্ত জেলা টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত আমাদের প্রোগ্রাম অব্যাহত থাকবে। গণশুনানি মানুষের মধ্যে অনেক অনেক সচেতনতা তৈরি করেছে। তারা এই ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেখিয়েছে।
গণশুনানি থেকে প্রত্যাশা হচ্ছে- ১. সরকারি দপ্তরগুলোর কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। ২. সেবা-সংক্রান্ত নাগরিকদের সমস্যা সমাধানকল্পে তাদের করণীয় সম্পর্কে অবহিত করা। ৩. সেবাপ্রত্যাশী নাগরিকের অভিযোগ সরাসরি শ্রবণের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তি করা। ৪. সেবা প্রদানের পদ্ধতির উন্নয়ন করা; এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে কল্যাণকামী সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
ক্যাম্পাসঃ এই দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে যেধরনের লোকবল দরকার, সেধরনের পর্যাপ্ত লোকবল কি দুদকের আছে?
চুপ্পুঃ আগে যখন কমিশন ছিল না ব্যুরো ছিল, তখন যথেষ্ট ছিলো বলে মনে হয়। তখন প্রতিটি জেলায় একটি করে অফিস ছিল। সেখানে জেলা দুর্নীতি বিরোধী অফিসার বসতেন। কিন্তু গত তত্ত্বাবধায়কের সময় কোনো এক অজানা কারণে, উদ্দেশ্যও আমি জানি না, তারা বললেন দুর্নীতি নির্মূল করবেন অথচ তারা বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাকে সংকুচিত করে ফেললো। তারা মাত্র ২৩টি জায়গায় অফিস স্থাপন করলো। যেখানে ৬৪টি জেলায় অফিস ছিলো, জনবল ছিলো, মানুষ ছিলো। একটা সাইনবোর্ড থাকে দুনীতি দমন ব্যুরো, থাকে ডিস্ট্রিক্ট এন্ট্রি করাপশন অফিসার। দুনীতি দমন ব্যুরো দেখলেই দুর্নীতিবাজ এমনেই চমকে যায়। এখানে জবাবদিহির একটা জায়গা আছে, ধরতে পারে যেকোনো সময়। ৩-৪টি জেলা নিয়ে ৩-৪টি অফিস মিলিয়ে একটি অফিস করা হলো। এতে অন্য জেলার লোকজন দুর্নীতি দমন সম্পর্কে কিছু জানে না। এর ফলে জনবল কমেছে এবং সংকট তৈরি হয়েছে। এখন সেই সংকট নিরসনে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমরা সরকারের নিকট প্রস্তাব দিয়েছি আগের মতো জেলায় জেলায় অফিস করার ব্যবস্থা করা হোক। পূর্বের অফিসগুলো ফিরে পেলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম আরো গতিশীল ও বেগবান হবে।
ক্যাম্পাসঃ স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সচেতন করতে কোনো পদক্ষেপ আছে কী?
চুপ্পুঃ ছাত্র সমাজের মধ্যে সততা ও মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে সততা সংঘের কমিটি আছে। ছাত্রছাত্রীদের দুর্নীতি প্রতিরোধের কাজে উজ্জীবিত করার জন্য চেষ্টা চলছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বুঝানোর মাধ্যমেইতো দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকে ফলপ্রসূ করা যায়। ধরুন, একজন কর্মকর্তা দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত, তার ছেলে-মেয়েরা যদি তাকে ঘৃণা করে। পারিবারিক এই ধরনের অবস্থার কারণেই সে তখন দুর্নীতি থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবে। সে ভাববে আমার ছেলে মেয়ে স্ত্রীতো আমার কাজকর্ম পছন্দ করছে না, আমাকে ঘৃণাও করছে। তাই তৃণমূল পর্যায় থেকে, পারিবারিক পর্যায় থেকে ‘দুর্নীতিকে ঘৃণা করি’ এমন একটা মনোভাব তৈরি হলে দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি করতে নিরুৎসাহিত হবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেই এই ধরনের পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। ঘরে ঘরে যখন এটি ছড়িয়ে পড়বে তার ফলাফল অবশ্যই ভালো হবে। এজন্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে।
ক্যাম্পাসঃ আপনারা কি এখানে চাপমুক্তভাবে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন?
চুপ্পুঃ বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার অধিষ্ঠিত হবার পর আমি গত ৫ বছর যাবৎ দেখতে পাচ্ছি- এখানে কোনোরকম চাপ বা প্রভাব নেই। সমস্ত চাপ ও রাজনৈতিক প্রভাবের উর্ধ্বে আমরা কাজ করার সুযোগ এখানে পাচ্ছি। এজন্যে আমি খুব সন্তুষ্ট।
ক্যাম্পাসঃ দুর্নীতি দমন কমিশন যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিলো সে উদ্দেশ্যের কতটুকু সফল হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
চুপ্পুঃ দুর্নীতি দমনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণই আমাদের অনুপ্রেরণা। আমরা দুর্নীতি দমনে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্নীতি লাঘবের জন্য। তখন চিন্তা ছিল ব্যুরো হিসেবে সংস্থাটির যে সীমাবদ্ধতা, তা কাটিয়ে উঠতে হবে। ব্যুরোকে ভেঙ্গে দিয়ে কমিশন ভালোর জন্যেই করা হলো। যারা কমিশন গঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের যে উদ্দেশ্য ছিলো- আমার মনে হয় কিছুটা ব্যত্যয় থাকলেও বা অতীতে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটলেও কমিশন গঠন করার যে অভিপ্রায় তা অনেকাংশে পূরণ হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো হলোঃ দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টি করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা (ধারা ১৭ চ); এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচিত অন্য যেকোনো কার্য সম্পাদন করা (ধারা ১৭ ট)। এসব উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে, দিনদিন এটি শক্তিশালী হচ্ছে।
যদিও মাঝেমধ্যে কিছু কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়। যেহেতু আমাদের কর্মকান্ডে আর্থিক স্বাধীনতা নেই, বাজেটের জন্য সরকারের উপর নির্ভর করতে হয়। কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, সেগুলোর উর্ধ্বে উঠেও আমরা সফলভাবেই কাজ করছি এবং ভবিষ্যতে আরও ভালোভাবে কাজ করে যাব। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আরো উন্নততর পরিবেশে আরও বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে আমি অত্যন্ত আশাবাদী।
ক্যাম্পাসঃ দুদককে ঘিরে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা দুদকের কার্যক্রমকে আরও বিস্তৃতকরণে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
চুপ্পুঃ আমি মনে করি যে, এখানকার কর্মকতা-কর্মচারীরা হৃদয় উজাড় করে দিয়ে কাজ করে। তারপরও তাদেরকে আরো বেশি যতœশীল হতে হবে, তাদেরকে আরো বেশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এখনতো নতুন নতুন প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ হয়ে যাচ্ছে, তাই পশ্চাদপদ বা পুরনো চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমি প্রায়ই বলি, আমাদের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী বুড়ো আমলের মানসিকতা নিয়ে কাজ করে। এই ধরনের পুরনো ধ্যান-ধারণা দিয়ে কাজ করলে চলবে না। দুদক গঠনই করা হয়েছে নতুন আঙ্গিকে কাজ করার জন্যে, নতুনত্ব আনার জন্যে। এখন দুদক ভিডিও কনফারেন্স করছে। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্যদের সহায়তায় কমিশনকে আরও বেশি প্রযুক্তি নির্ভর করা হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে দেখা যাবে কমিশনে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিদেশে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, নতুন নিয়োগ প্রাপ্তদেরও দুর্নীতি নির্মূলের জন্যে জাগরণের মনোভাব সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করা যায়, এভাবে ভবিষ্যতে অবস্থা আরো অনেক ভালো হবে।
ক্যাম্পাসঃ কমিশনের কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীর দুর্নীতি প্রকাশ পেলে সেক্ষেত্রে আপনারা কি ব্যবস্থা নেবেন?
চুপ্পুঃ কমিশন তার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেআইনি কাজ ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে তৎপর। দুর্নীতি দমন কমিশন বিধি ২০০৭ এর ১৯(১) এর অধীনে কর্মকর্তাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিবীক্ষণ, তত্ত্বাবধান, অনুসন্ধান, দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মীর বিরুদ্ধে আইনি ও বিভাগীয় পদক্ষেপ নিতে পরামর্শদানের জন্য কমিশন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি স্থায়ী অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি গঠন করেছে। এতে কর্মচারীদের দুর্নীতি চর্চার বিরুদ্ধে কমিশনের প্রত্যয় দেখা যায়।
ইন্টারনাল মনিটরিং সেল এ চেয়ারম্যান এর নেতৃত্বে ডাইরেক্টররাও আছেন। তারা নিয়মিত মনিটরিং করেন। যেটা ধরা পড়ে বা দৃশ্যমান হয়, অনেক সময় রিপোর্টের মধ্যেও দুর্নীতির গন্ধ খুঁজে পাই। এসব ক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করি, অনেক সময় আদালত থেকেও বিভিন্ন প্রশ্ন আসে। বিচারের সময় বিচারকগণ দেখেন মামলাটির তদন্ত যদি এইভাবে না করে এইভাবে করতো তাহলে প্রকৃত সত্যটা বের হয়ে আসতো, প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ত। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করে অন্য কাউকে জড়িয়ে দায়সারা গোছের একটা তদন্ত রিপোর্ট হয়তো দেয়া হয়েছে। এই সমস্ত ব্যাপার নজরে আসলে আমরা তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ও আপিল নীতিমালা অনুযায়ী এ্যাকশন নিয়ে থাকি। কারো চাকরি চলে যায়, অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে। কারো হালকা আবার কারো কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা হয়। এগুলো আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম। এসব ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত কঠোর।
ক্যাম্পাসঃ দুদক’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যে আপনার পরামর্শ কী?
চুপ্পুঃ আমার পরামর্শ হচ্ছেÑ তোমরা তোমাদের নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। মানুষ যেনো হয়রানির শিকার না হয়। মানুষ যেনো স্পষ্ট দেখতে পায় যে, সঠিক ব্যক্তি সঠিক দুর্নীতিবাজকে চিহ্নিত করতে পারছো, ধরতে পারছো, বিচারের সম্মুখীন করতে পারছো, সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারছো। সমাজে বসবাসকারী লোকজন যাতে মনে করে দুর্নীতির এই কর্মকর্তা সঠিকভাবে এটা অনুসন্ধান করেছে, সঠিকভাবে তদন্ত করেছে। সেজন্যে তোমরা তোমাদের বিবেককে জাগ্রত রাখবে।
ক্যাম্পাসঃ বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কে একজন অভিভাবক হিসেবে কিছু বলুন?
চুপ্পুঃ আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এখন অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এখনতো সেশনজটও কমে আসছে। কিছু কিছু সময় ক্ষণিকের জন্যে কিছু কিছু জায়গায় অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তবে গণমুখী শিক্ষার যে নীতিমালা হয়েছে, যে ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে তাতে আমি খুব আশাবাদী। এভাবে যাতে চলে, স্থিতিশীলতা যাতে বজায় থাকে, অহেতুক রাজনৈতিক কলহে যাতে জড়িয়ে না পড়ে। শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি হবে শিক্ষা নির্ভর রাজনীতি। এই রাজনীতির সাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতেই পারে তবে তার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে। তারা যেহেতু রাজনীতির ব্যাপারে সচেতন ও জ্ঞান রাখেন সেহেতু এড়িয়ে যেতে পারবেন না। তবে রাজনীতিই যাতে মুখ্য না হয়ে দাঁড়ায়। মূল বিষয়টি যাতে পাঠ্যক্রমের মধ্যেই ঘুরপাক খায়, সীমাবদ্ধ থাকে। তাহলে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা কমে আসবে। সেক্ষেত্রে সেশনজটও কমে যাবে। শিক্ষার পরিবেশও সুন্দর স্বাভাবিক থাকবে। সারাদেশে সরকার বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই দিচ্ছে, বই উৎসব হচ্ছে। এসবে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। ভবিষ্যতে এধরনের সুযোগ সুবিধা আরও বেশি বৃদ্ধি পাবে।
ক্যাম্পাসঃ আপনারা যখন পড়াশুনা করেছেন সেই সময়ের শিক্ষার মান আর এখনকার শিক্ষার মানের মধ্যে কোনো তফাৎ লক্ষ্য করেন কী?
চুপ্পুঃ শিক্ষা এখন অনেক উন্নত, প্রযুক্তি নির্ভর। শিক্ষাখাতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বহুমাত্রিক প্রেক্ষিতে শিক্ষা পাঠচক্র চলছে।
ক্যাম্পাসঃ আপনি যখন শিক্ষার্থী ছিলেন ঐ সময় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন ছিলো?
চুপ্পুঃ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অনেক অনেক ভালো ছিলো। আমরা বলতাম গুরু। শিক্ষককে দেখলে তার সামনে দিয়েই হেঁটে যেতাম না, এতো ভয় পেতাম। সেই সময়ই আমরা অনুধাবন করতাম পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকের অবস্থান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকের অবস্থান সবার উপরে বিবেচিত হয়। এখন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা অবক্ষয় হয়েছে। এথেকে উত্তরণে শিক্ষকদের যেরকম দায়িত্ব আছে, শিক্ষার্থীদেরও সেরকম দায়িত্ব আছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্বটা অনেক বেশি। রাজনীতি নয়, শিক্ষা বিষয়কেই মূল ধরে নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক থাকা উচিৎ।
ক্যাম্পাসঃ ছাত্র-যুবকদের বিপথগামিতার জন্যে তাদেরকে দায়ী করা হয়ে থাকে, আসলে কে দায়ী? তাদের বিপথগামিতা রোধে পরিবার ও সমাজের ভূমিকা বলবেন কী?
চুপ্পুঃ পরিবার ও সমাজের মূল ভূমিকা এবং পারিপার্শ্বিকতাও গুরুত্বপূর্ণ। এক সহপাঠী বিপথগামী হলে তার সাথে দূরত্বতো তৈরি করে নেয়াই উচিৎ। কারণ সেতো সংক্রমিত। পরিবারের বিরাট ভূমিকা আছে। কেউতো ইচ্ছে করে তার সন্তানকে বিপথগামী হতে দেয় না, দিবেও না। আজকাল আর্থিক কারণে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে চাকরি করতে হয়। ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা করার পরিবেশ থাকে না। অভিভাবকহীন অবস্থা হয়ে যায়। এই সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবারের ভূমিকা অনেক বেশি। বাস্তবতার কারণেই এসবক্ষেত্রে অনেক কর্মজীবী বাবা-মা সন্তানের খোঁজখবর নেয়ার সময়-সুযোগ করে উঠতে পারে না। কিন্তু যেভাবেই হোক এই বাস্তবতার মধ্যেও সন্তানের জন্যে কিছু সময় বের করতে সচেষ্ট থাকা উচিৎ।
সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তাদের কাছে স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে সেবা-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট সমস্যা উপস্থাপন এবং তা সমাধানকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা হলো গণশুনানি। গণশুনানির উদ্দেশ্য হচ্ছে- সেবাপ্রত্যাশী নাগরিকের অভিযোগ সরাসরি শুনে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা এবং প্রতিটি সরকারি দপ্তরে নাগরিক সনদের ভিত্তিতে নাগরিকদের প্রদেয় সেবার মান উন্নত করা।
ক্যাম্পাসঃ ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে মূল্যবান পরামর্শের কথা বলবেন কী?
চুপ্পুঃ ছাত্র যুবকদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ হলো ছাত্ররা লেখাপড়া করবে। তাদের ভিশন হবে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছানো। তারা মানুষের মতো মানুষ হবে। শিক্ষাটা শিক্ষার জন্যেই গ্রহণ করবে। যে শিক্ষা দ্বারা নিজের মন, চরিত্র সবকিছুকেই পরিশুদ্ধ করতে পারবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে। এমনভাবে তারা তাদের জীবন গড়ে তুলবে, যাতে ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দিতে পারে, দেশের মানুষের কল্যাণ করতে পারে, দেশের ভালো-মন্দের বিষয়ে চিন্তা করবে, সমাজকে পরিশুদ্ধ করার কাজে নিবেদিত হবে। মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের কাজে তারা নিয়োজিত হবে।
বর্তমান প্রেক্ষিতে মাদক সমাজের উন্নতি অগ্রগতির পথে অন্যতম অন্তরায়। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এভাবে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, নবীন প্রজন্মের মাঝে মাদকাসক্তি সংক্রমিত না হয়। এর সাথে যে সমস্ত ব্যবসায়ী জড়িত, যারা আইনশৃঙ্খলার সাথে জড়িত, যারা বিচারের সঙ্গে জড়িত- সকলকেই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নিয়ে তরুণদেরকে এই জায়গা থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে।
ক্যাম্পাসঃ আপনার শৈশবটা কেমন ছিল?
চুপ্পুঃ শৈশব কৈশরে খুব দুরন্ত ছিলাম। লেখাপড়ায় প্রাধান্য ছিল না । খেলাধুলা, মাছ ধরা, পাখি শিকার করা, গাছ থেকে আম পাড়া, ডাব পাড়া-এই সমস্ত করতাম। যাকে বলে দস্যি ছেলে। এসএসসি পাসের পরে নতুন জীবন শুরু হয়। ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান যখন ৬দফা ঘোষণা করলেন, সারা বাংলাদেশের সফরসূচি নিয়ে পাবনায় এলেন তখন তার সান্নিধ্যে চলে আসি। আমার পাশের বাসা ছিলো আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের। তার ছেলে মেয়েরা ছিলো আমার বন্ধু। তখন তার বক্তৃতা শুনতাম। ভাললাগতো। ছাত্র-রাজনীতির সেই সময়টা ছিলো অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। ১৯৭১ সালে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমি তখন ডিগ্রি পরিক্ষার্থী। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জয়েন্ট কনভেনার হিসেবে আমি পাবনায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করি। ছাত্রলীগের শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির এজেন্ডার সাথে মুক্তির আন্দোলনে জনগণকে সংগঠিত করায় সম্পৃক্ত ছিলাম। তারুণ্য ও যৌবনের সেই দিনগুলোতে পাবনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, ভারতে যেয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ৯ এপ্রিল ১৯৭১সালে পাবনা ত্যাগ করি, জুন মাসে দেশে আসি। সেই সময়ে মাঝে মধ্যে মুজিবনগর সরকারের সাথে কথাবার্তা বলতে হয়েছে, ভারতে যেতে হয়েছে বিভিন্ন কাজে। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাবনা মুক্ত হয় এবং আমি নিজের বাড়িতে ফিরে আসি।
ক্যাম্পাসঃ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের উল্লেখযোগ্য স্মৃতির কথা বলবে কি?
চুপ্পুঃ একটি স্মৃতি আছে, যা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হবে। জীবনের বিনিময়ে ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই মিষ্টি খেতে পছন্দ করতাম। পাবনাতে লক্ষ্মী মিষ্টান্ন নামের দোকান ছিলো। আমি এতোটাই মিষ্টিপ্রিয় ব্যক্তি ছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাবনা থেকে ৮/১০ কিলোমিটার দূরে আওতা পাড়া চরে অবস্থান করছিলাম। সেদিনই ভারত থেকে দেশে আসি। মিষ্টির নেশা আমাকে ছাড়ছে না। আমি নির্দিষ্ট পছন্দের দোকানের মিষ্টিটাই নেবো। আমরা এই খবরও পেলাম- ঐ মিষ্টির দোকানে অমুক অমুক রাজাকার, শান্তি কমিটির লোকজন প্রতিনিয়ত থাকে। একটা মিষ্টি আমাদেরকে যুদ্ধের মধ্যে ফেলে দিতে পারে এমন আশংকা থাকার পরও একজনকে পাঠালাম। তখন যে মিষ্টির দোকানে বসতো সে ছিল রাজাকারের কমান্ডার। আমার কাছে টাকাও নেই। টাকা যার কাছ থেকে নিতে হবে সে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী লোক। কিন্তু একসময় সে আমার খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। ঝুঁকি নিয়ে তার কাছেই পাঠালাম। বলে দিলাম-আমার কথা বললে সে ৫টাকা দিবে, টাকা নিয়ে ২কেজি রাজভোগ নিয়ে আসবা। সে ভালভাবেই মিষ্টি নিয়ে আসে। এবং বন্ধু-বান্ধবসহ সবাই মজা করে খাই।