তিনি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের তিন-তিনবার নির্বাচিত ডিনই নন, তিনি একাধারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনেরও সভাপতি। একজন আজীবন শিক্ষাব্রতী মানুষ, যিনি অন্য পেশার লোভনীয় চাকরি উপেক্ষা করে নিজকে জড়িয়ে নিয়েছেন শিক্ষকতা পেশায়; শিক্ষান্নোয়ন তথা গুণগতমানের শিক্ষা যাঁর সাধনা; যিনি কর্মযজ্ঞের মধ্যেই খুঁজে পান অপার আনন্দ; কর্মজীবন শেষে অবসর সময়ে যিনি নিজের জন্য কিছু না করে সমাজের কল্যাণের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করতে চান। তিনি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সর্বাধিক জনপ্রিয় শিক্ষক, সুদক্ষ শিক্ষা-সংগঠক ও বন্ধুবৎসল, সদালাপী, সদাহাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। কর্মময় জীবনের ব্যস্ততার পাশাপাশি যিনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত।
প্রিয় পাঠক, বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের এই বরেণ্য শিক্ষক নেতার সাথে ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধি গিয়াস উদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি একান্ত আলাপচারিতায় মিলিত হন। তাঁদের হৃদ্যতাপূর্ণ আলাপচারিতার উল্লেখযোগ্য অংশ মোহাম্মদ মোস্তফার অনুলিখনে এখানে সন্নিবেশিত হলো।
ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালনে তাঁর অনুভূতির কথা জানতে চাইলে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় অনুষদগুলোর অন্যতম। ১৩টি বিভাগ নিয়ে এ অনুষদ তার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্যান্য সময়ের চেয়ে বর্তমানে এ অনুষদের কাজ ভালোভাবে চলছে, ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ালেখায় ব্যস্ত রয়েছে। এখানে নিয়মিত পরীক্ষা হচ্ছে, পরীক্ষার ফলাফলও সময়মতো প্রকাশিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় চাহিদার ক্ষেত্রে আমি সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি; অনুষদের শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করে পাঠদানের ক্ষেত্রে সহায়ক সব ব্যবস্থা আমি নিচ্ছি। আমি বিশেষ খেয়াল রাখছি যাতে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিকমানের শিক্ষা-সুযোগ পায়, তাদের শিক্ষাবর্ষের ক্ষতি না হয়, সেশনজটের সৃষ্টি না হয় এবং তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষায় পাস করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে।
আপনার ফ্যাকাল্টি থেকে যারা পাস করে বের হয়, প্রতিযোগিতামূলক জবমার্কেটে তারা কেমন করছে এমন জিজ্ঞাসায় প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের পাস করার সাথে সাথেই চাকরি হয়ে যায়। রেজাল্ট বেরোনোর আগেই কারও কারও কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়ে যায়। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বহুজাতিক কোম্পানি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মসংস্থান দেয়ার প্রস্তাব করে আমাদের কাছে লোক চান; কিন্তু আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের চাহিদা মেটাতে পারি না। এতে আমরা ধরে নিতে পারি যে, আমাদের ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীরা পাস করার পর কেউ বেকার নেই।
ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নতমানের শিক্ষাদানের ব্যাপারে আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন এমন প্রশ্নের জবাবে ডিন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের শিক্ষকগণ মেধাবী এবং নিবেদিত। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে কোনো বিষয় বুঝে উঠতে না পারলে ক্লাসের বাইরে শিক্ষকগণ সেটি যতœসহকারে তাদের বুঝিয়ে দেন। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক পাঠাগার, শিক্ষাবৃত্তি প্রভৃতি সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা তাদের যুগোপযোগী করে গড়ে তুলি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এখন সেশনজটমুক্ত। এজন্য তারা সন্তুষ্টি ও নির্ভরতায় তাদের পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবন সাফল্যের সাথে সমাপ্ত করতে পারছে। তারা সময়মতো পরীক্ষা দিয়ে পাস করে বেরিয়ে যেতে পারছে এবং কর্মজীবনে প্রবেশ করে নতুন জীবনের সন্ধানলাভ করছে এতে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকগণ অত্যন্ত খুশি।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষামান উন্নয়নে কোন্ কোন্ বিষয়ের প্রতি অগ্রাধিকার দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে সেশনজটমুক্ত করা। সেশনজটের কবলে পড়ে তাদেরকে দু’বছর বেশি শিক্ষাজীবন কাটাতে হতো, তাদের জীবন থেকে মূল্যবান ২টি বছর খসে যেত। তদুপরি তাদের অভিভাবকগণ যাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের পক্ষে সন্তানদের অতিরিক্ত দুই বছর শিক্ষাব্যয় বহন খুবই কষ্টকর। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা যদি দু’বছর আগে পাস করে বেরিয়ে জবমার্কেটে ঢুকতে পারে, তাহলে তাদের পরিবার যেমন উপকৃত হবে, দেশও তাদের সেবালাভ করবে। তারা যথাসময়ে বেরিয়ে যেতে পারলে নতুন ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান হবে। নতুনরা আর্থিক সংকট এবং আবাসন সমস্যামুক্ত থাকতে পারবে।
দ্বিতীয়ত আমাদের ফ্যাকাল্টিতে শিক্ষক নিয়োগে মেধার ক্ষেত্রে কোনো আপোশ করা হয় না। এজন্য আমাদের ফ্যাকাল্টি এত সমৃদ্ধ, পরীক্ষার ফলাফল এত কৃতিত্বপূর্ণ। এজন্য আমাদের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ নয়। তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমরা বিশেষ নজর দিচ্ছি। এ ফ্যাকাল্টিতে ৬ তলা ভবন হচ্ছে। আমরা গবেষণার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছি, ফ্যাকাল্টিতে শিক্ষার পরিবেশ সুন্দর রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ফ্যাকাল্টির শিক্ষকগণ যখন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন, তখন তাঁদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিচ্ছি। পারিবারিক সুযোগ-সুবিধা যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে আমরা লক্ষ্য রাখছি। আমাদের ফ্যাকাল্টির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করছি। আমরা অসচ্ছল-মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকি; আগামী বছর তা দ্বিগুণ হবে আশা করি। অসচ্ছল সকল ছাত্র-ছাত্রী যেন সাহায্য পায়, আমরা সে লক্ষ্যে ফান্ড গড়ে তুলছি। এক্ষেত্রে এ অনুষদ থেকে পাস করে যাওয়া প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বা তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান নেয়া হচ্ছে।
ফ্যাকাল্টির শিক্ষকদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি সম্পর্কে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমাদের জবাবদিহি একশ’তে একশ’ আছে। আমাদের ভর্তি পরীক্ষা, শিক্ষক নিয়োগ, পরীক্ষার ফলাফল প্রতিটি ব্যাপারে কাজের স্বচ্ছতা প্রশ্নাতীত। কেউ অনিয়ম করলে তিনি যেই হোন না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি-বিধান অনুসারে তাকে শাস্তি পেতে হবেই হবে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষার্থীদের এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন আমাদের ফ্যাকাল্টির ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, খেলাধুলা, বিতর্ক, আবৃত্তি ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করে। তাদের অনুষ্ঠানগুলো দেখে আমরা মুগ্ধ হই। এমনকি তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও অংশ নেয়।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ গড়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে ডিন প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমাদের ফ্যাকাল্টির বিভিন্ন বিভাগ থেকে যারা পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে তারা সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত থেকে দেশের সেবা করছে। দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে আমাদের ছেলেমেয়েরা অবদান রেখে চলেছে। আমাদের শিক্ষার মান আরও বৃদ্ধির জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ অনুষদ গঠনের উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল হয়েছে। আশা করি, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগামীতে এ অনুষদ আরও উন্নত ও সফল হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অনুষদকে ঘিরে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে ঘিরে অবশ্যই আমাদের স্বপ্ন আছে, পরিকল্পনা আছে। আমরা স্বচ্ছতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি, কোনো অনিয়মের সাথে আপোশ করি না। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ফ্যাকাল্টি এবং তার অধীনস্থ প্রতিটি বিভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গড়ে উঠবে; প্রতিটি ফ্যাকাল্টি সচ্ছল হবে। আমরা সেই লক্ষ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে গড়ে তুলছি। এ অনুষদের প্রোগ্রামগুলো এমনভাবে গড়ে তুলব, যাতে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সরকারি সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে না হয়। কোনো ছেলেমেয়ের পড়ালেখা যাতে আর্থিক অসংগতির জন্য বাধাগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে আমরা সচেতন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-স্বল্পতা বিশেষ করে দক্ষ শিক্ষকের অভাব দেখা যায়, আপনার ফ্যাকাল্টিতে এ ধরনের সমস্যা আছে কিনা, থাকলে কীভাবে তা মোকাবেলা করেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমাদের ফ্যাকাল্টিতে এ সমস্যা আছে; আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে কোনো শিক্ষক গবেষণা বা উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে গেলে আমরা নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিই, যাঁরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় ফার্স্ট, সেকেন্ড হয় তাঁদেরকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দু’বছর পর এরাই যখন বিদেশে যাবে, সে পদে নিয়োগের জন্য নতুন মেধাবীদের সন্ধান করি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রকৃতপক্ষে আমাদের শিক্ষকপদ শূন্য হয় না। এজন্য আমাদের পাঠদানসহ শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয় না। সমগ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই এ ধারায় চলছে। এ স্ট্রিমলাইন অনুসরণ করে আমাদের অনুষদসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক স্বল্পতার সমস্যা সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করছে।
শিক্ষকদের গুণগতমানের উন্নয়নে আপনাদের কোনো কর্মসূচি আছে কি এমন প্রশ্নের জবাবে ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমাদের ফ্যাকাল্টির শিক্ষকগণ মেধাবী হবার কারণে তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা কিংবা গবেষণার জন্য যান। উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে এসে কাজে যোগদান করলে তখন অন্যদের সুযোগ আসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিদেশ গমনের। তাঁরা কমনওয়েলথ স্কলারশিপসহ বিভিন্ন বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে আমরা সরকার, ইউজিসি এবং অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা পাচ্ছি। বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করেও শিক্ষকগণ উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিতে পারছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। সে উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশে বিশ্বমানের শিক্ষকের সংখ্যা আরও বাড়বে, শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। আমাদের এখানে গবেষণার ওপর একটা ক্লাস হতো। এতে মেধাবী, প্রবীণ শিক্ষকগণ, বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারীগণ অংশগ্রহণ করতেন। এতে তরুণ শিক্ষকরা উপকৃত হতেন। কিন্তু সেই মূল্যবান ক্লাস এখন বন্ধ। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন এটি যেন আরও ভালোভাবে পুনরায় চালুর ব্যবস্থা করা হয়।
শিক্ষকদের প্রকৃত সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ না হওয়ায় তাঁদেরকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়, এ সমস্যা নিরসনে করণীয় সম্পর্কে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন এটি দুঃখজনক যে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে শিক্ষকদের মর্যাদা নির্ধারণ হয়নি। আমি আবেদন করব শিক্ষকদের সামাজিক আসনটি যাতে মর্যাদাপূর্ণ হয়, তা নীতিনির্ধারকগণ ঠিক করবেন। তাঁরাওতো কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকদের মর্যাদা তারা ভালোভাবেই বোঝেন। দেশ পরিচালনাকারীদের ৮০% ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কাজেই তাদের শিক্ষকরা যদি যথাযথ মর্যাদা না পান, সেটি তাদের জন্য মর্যাদাকর হতে পারে না।
গতবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের সেøাগান ছিল শিক্ষকের জন্য বিনিয়োগ, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ। এ কথার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, শিক্ষক জাতির মেরুদন্ড এটি কথার কথা নয়, বাস্তব সত্য। শিক্ষক মেধাবী হলে, দক্ষ হলে, দায়িত্বশীল ও যতœশীল হলে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটবে; এজন্য শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক ও যতœশীল হতে হবে। তিনি বলেন ভালো শিক্ষক মানে ভালো ছাত্র, মেধার স্ফূরণ। ভালো বীজ মানে ভালো ফল। এজন্য বেশি সংখ্যক মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলে তার ফল হবে সাফল্যময়, গৌরবময়। শিক্ষকের জন্য বিনিয়োগ তথা শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ কোনো ব্যয় নয় এটি পুনঃপৌণিক ফলদানকারী বিনিয়োগ। এখানে কার্পণ্য করা চলবে না। শিক্ষক প্রশিক্ষিত হলে, দক্ষতা বাড়াতে পারলে সমগ্র জাতি উপকৃত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে দূরদর্শী শিক্ষাবিদ প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন খুব বিচক্ষণতার সাথে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে, যা শিক্ষান্নোয়নে খুবই সহায়ক। ছাত্রদের মধ্যে চেতনা ফিরে আসতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগেও তারা পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করত; এখন আন্দোলন করে সময়মতো পরীক্ষা নিতে এবং তাড়াতাড়ি রেজাল্ট বের করতে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে সহযোগিতা করছে; তারা বিষয়টিকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখেছে। তাদের নিজেদের স্বার্থেই তাড়াতাড়ি পাস করে বেরিয়ে যেতে চাইছে; নতুন ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন রয়েছে তাদের সামনে। এখন তারা অনেক সচেতন। গতবছর দেশে এত অস্থিরতার মধ্যে একদিনের জন্যও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়নি। সব ফ্যাকাল্টির শিক্ষা কার্যক্রম চলছে সাবলীলভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দক্ষতা ও ছাত্র-রাজনীতির বিচক্ষণতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বিরাজ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে আপনার অনুভূতি কেমন, সমিতির সামগ্রিক কার্যক্রমে আপনি কি সন্তুষ্ট এমন জিজ্ঞাসায় প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষকনেতা প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, শিক্ষক সমাজের উন্নতির জন্য এখানে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলা, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উন্নতির চেষ্টা করা হয় এ সমিতির মাধ্যমে। এ সমিতির মাধ্যমে শিক্ষকদেরকে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে তাঁদের গবেষণা ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সরকারি সাহায্যের অপেক্ষা না করে শিক্ষকদের আবাসন গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সমিতি এজন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কাজ করছে। আশা করা যায়, আগামী দু’তিন বছরের মধ্যে এটি বাস্তবায়িত হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ব্যাংক লোন নেব; আমাদের বাড়ি ভাড়ার টাকার অংশ থেকে ঋণ শোধ করব। বাকি টাকা ভবন নির্মাণ খাতে ব্যয় হবে। এতে শিক্ষকদের আবাসন সমস্যার সমাধান অনেকটা সম্পন্ন হবে বলে আশা করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম, নৈতিক স্খলন বিষয়ে কী ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন এমন প্রশ্নে শিক্ষক নেতা স্বচ্ছ চিন্তাধারার অধিকারী শিক্ষক প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমাদের ফ্যাকাল্টিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়ম, শৃঙ্খলা ভঙ্গ, নৈতিক স্খলন ইত্যাদি ঘটনা ঘটলে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের কাছ থেকে রিপোর্ট নেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুসারে অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়; কাউকে ছাড় দেয়া হয় না। আমরা শিক্ষকদের মর্যাদার ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নির্ধারণের জন্য সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছি। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা পে-কমিশনের সাথেও যোগাযোগ রাখছি। কোনো শিক্ষক তাঁর দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করলে, কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতিমূলক কাজ করলে আমরা সমিতির পক্ষ থেকে তাকে প্রোটেকশন দিই না বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে বাধ্য করি।
দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষাঙ্গন নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার কথা জানতে চাইলে শিক্ষক সমাজের প্রিয় নেতা প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, শিক্ষার উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। ফাউন্ডেশন মজবুত না হলে ভবনের স্থায়িত্ব সম্পর্কে যেমনি আশাবাদী হওয়া যায় না; তেমনি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে যদি শিক্ষার্থীর ভিত শক্ত না হয়, তবে আমরা মেধাবী শিক্ষার্থী কোথায় পাব? আমরা আশা করব যারা দায়িত্বে আছেন, তারা প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করবেন। প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেন মেধাবী শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেয়া হয়। তদ্বিরে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলে তাঁদের কাছ থেকে ভালো পারফরমেন্স আশা করা যায় না। তাছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে। তাই প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ নজর দেয়ার জন্য শিক্ষক সমাজের কাছে আহ্বান জানাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শিক্ষান্নোয়নে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেগুলো অনুসরণ করলে সমগ্র দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তার ভালো প্রভাব পড়বে। এভাবে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বেশি সংখ্যক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর সমাবেশ ঘটাতে পারলে দেশের উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে। শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রাথমিক-মাধ্যমিক থেকে কোয়ালিটি শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। শিক্ষার এ ক্ষেত্রে আমরা যদি বেশি অর্থ বিনিয়োগ করি, তাহলে ফলাফল হবে অনেক সুদূরপ্রসারী। বাজেট এলোকেশন বাড়ালেই হবে না; টাকার সদ্ব্যবহার যাতে হয়, সে ব্যাপারেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
এইচএসসি-তে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ৮০% ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছে, এর কারণ কী বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে দূরদর্শী শিক্ষাবিদ প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, পড়ালেখার মান বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা সীমিত, অথচ পরীক্ষার্থী অনেক। এজন্য প্রশ্নপত্রও কঠিন করতে হয়। অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী বর্তমান পরীক্ষামানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না বলে ভর্তি পরীক্ষায় অস্বাভাবিকভাবে ফেল করছে। বোর্ডগুলোকে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে পরীক্ষামানের সাথে যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের উন্নীত করে সে ব্যাপারে যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ নজরদারির মাধ্যমে শিক্ষান্নোয়নে যথাযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু অনেক ছাত্র-ছাত্রী কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। এভাবে গড়ে উঠছে কোচিং-বাণিজ্য। কোচিং সেন্টারগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের মেধাবিকাশে কিংবা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে কতটুকু সহায়ক হয়? কোচিং সম্পর্কে সমাজে যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে আপনার অভিমত কী এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন বলেন, কোচিং সেন্টার ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশের ধারেকাছেও থাকে না। তারা কীভাবে ভর্তি করাবে সেই ফিকিরে থাকে। আসলে প্রকৃত মেধাবীরাই সফল হয়; এতে কোচিং সেন্টারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।
তিনি আরও বলেন, ভর্তির ক্ষেত্রে আমরা এক মাসের মধ্যে ২টি পরীক্ষা নিয়ে ফলাফল জানিয়ে দিয়েছি। এতে বোঝা যায়, বোর্ড পরীক্ষার পরপরই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নিলে আর কেউ কোচিংয়ের দরজায় পা রাখবে না। আমরা কোচিংয়ের আগ্রাসন থেকে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের রক্ষার জন্য তৎপর রয়েছি।
প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ রেখে ছাত্রপ্রিয় শিক্ষাবিদ প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রধান কাজ হলো নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে পড়ালেখা করা। তাদের অভিভাবকগণ অনেক কষ্ট করে তাদেরকে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন; তারা যেন সময়ের অপচয় না করে পড়ালেখা চালিয়ে যায়। সরকার জনগণের টাকায় তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে এটি যেন তাদের মনে থাকে। পাস করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে তারা যেন দেশের কথা মনে রাখে। তারা যেন এমন কাজ করে, যা দেখে দেশবাসী গর্ব করতে পারে। সবসময় দেশপ্রেম যেন তাদের মনে জাগরুক থাকে। দেশ আমাদের অনেক দিয়েছে। আমরা দেশকে কী দেব, তা ভাবতে হবে। সবাই যদি দেশের জন্য কাজ করি, তাহলে দেশের অগ্রগতি হবে অচিন্তনীয়।