একটি জলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ ‘নাই’ হয়ে যেতে পারে; যেতে পারে না-ফেরার দেশে, অসংখ্য মানুষে মনে রেখে যায় তীব্র বেদনা।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় ক্যাম্পাস পরিবারের সজ্জন ব্যাক্তি মাহমুদুল হাসানের আকস্মিক মৃত্যু আমাদের সে কথা মনে করিয়ে দেয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ জাল্লা শানুহু এরশাদ করেছেন, ‘কুল্লে নাফসীন যায়কাতুল মওত’ - প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।
বলা হয়ে থাকে - Death lays its icy hand even on kings. মৃত মাহমুদুল হাসানও স্বাভাবিক নিয়মে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেও ক্যাম্পাস-এ রেখে গেছেন বিরাট শূন্যতা। হায়াৎ-মউত, রেজেক-দৌলত, ইজ্জত এ পাঁচটি বিষয় একমাত্র মহীয়ান, গরীয়ান, সর্বশক্তিমান আল্লাহর হাতে, সেই হিসেবে মৃত্যু কাকে কখন ডাক দেবে কেউ বলতে পারে না। তবে আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন মানুষ মৃত্যু সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন। একবার পীরে কামেল তাঁর মৃত্যুর আগে মুরীদদেরকে বলেন- আমাকে ভালো করে দেখে রাখো, লম্বা সফরে যাইতেছি, ফিরে আসতেও পারি, নাও আসতে পারি। এর ৮/১০ দিন পর পীর সাহেব ইন্তেকাল করেন।
মাহমুদুল হাসান স্বীকৃত পীর না হলেও ধ্যান বা মেডিটেশনে ছিলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, ধ্যান ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। ক্যাম্পাস এ ধ্যান শিক্ষার প্রাণপুরুষ। মেডিটেশন ক্লাসে তিনি অংশগ্রহণকারীদের শিখিয়েছেন- কিভাবে ধ্যানের মধ্যে শরীরের স্ট্রেস দূর করা যায়, শরীরকে শিথিল করে, সব ধরনের জড়তা-অবসাদ দূর করে দুর্দান্ত কর্মক্ষম মানুষ হিসেবে দাঁড়ানো যায়-মেডিটেশনের সেদিকগুলো হাসান ভাই ক্লাসে বর্ণনা করতেন। নতুন একজন পার্টিসিপেন্ট মেডিটেশন ক্লাসে আসলেও তিনি ধ্যান সর্ম্পকিত ভূমিকা প্রথম থেকেই বলতেন, কাউকে উপেক্ষা করতেন না।
মাহমুদুল হাসানের মৃত্যু সংবাদ প্রথমে আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ক্যাম্পাস অফিসে তিনি প্রতিমাসের ১ম শনিবার এবং ৩য় শনিবার মেডিটেশন ক্লাস নিতেন। ১ম শনিবার তিনি ক্লাস করে গেছেন, কোনো রোগের লক্ষণ তার শরীরে দেখা যায়নি। সেই সুস্থ সবল মানুষটি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে এভাবে চলে যাবেন- এটি ছিল আমাদের চিন্তারও বাইরে।
হাসান ভাই তার জীবনের শেষ দিনটিতে ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদককে বলে গেছেন- হেলাল ভাই, আপনি সকালের নাস্তা এখন বিকেলে খাচ্ছেন; এ কেমন কথা! আপনার শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটু সুযোগ করে সময়মত খাবারটুকুন খেয়ে নিতে হবে। কাজের চাপে খাবারের কথা ভুলে গেলেতো শরীর টেকাতে পারবেন না; জ্ঞানভিত্তিক-ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার আন্দোলনে জয়ী হতে সুস্থ থাকতে হবে। সেইদিনই সম্পাদক হেলাল সাহেবের সম্মুখে বসে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই মৃত্যু সম্পর্কে বহুকথা বলে গেলেন। তিনি বলছিলেন- মৃত্যু অস্বাভাবিক কিংবা অপ্রাকৃতিক কোনো বিষয় নয়; কেবল এপাশ থেকে ওপাশে কিংবা এপাড় থেকে ওপাড়ে গমন...। মৃত্যুর স্বাদ কেমন হতে পারে, মৃত্যুর পর ভাল আত্মা দেহত্যাগ করে কোথায় থাকে, কি কাজ করে...। অন্যদিকে খারাপ আত্মা...। মৃত্যু সম্পর্কিত এরূপ অনেক তথ্য ও জ্ঞান তিনি শেয়ার করে গেলেন আমাদের সম্পাদক মহোদয়ের সাথে। Bad Energy.., Good Energy.. ইত্যাকার আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক বহু বিষয়ে তিনি একনাগাড়ে বলে গেলেন। এর দু’দিন পরেই তিনি চলে গেলেন।
অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর আমার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন- তোমাদের অফিসে মেডিটেশন করান যে হাসান সাহেব তার কোনো খবর জানো কি? বললাম কেন জানবোনা, তিনিত’ ক’দিন আগে মেডিটেশন ক্লাস নিয়েছেন। স্ত্রী বিস্মিত হয়ে বললেন- মাহমুদুল হাসান আর নাই। আমি বজ্রাহতের মতো বসে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম- তুমি কার কাছে শুনেছ? বলল, কণি (তার ছোটবোন) টেলিফোন করে জানিয়েছে। ও’তো কাশেমের কলিগ। রাতে কেবল ছটফট করেছি, ভালোভাবে ঘুমোতে পারিনি। পরদিন অফিসে এসে খবরটি বলার পর এখানেও কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না; ক্যাম্পাস-এ আমার কলিগদের মধ্যে এ মৃত্যু সংবাদটি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। যেনো এখনও কোনো দিক থেকে টেলিফোন বেজে উঠবে, মাহমুদুল হাসানের যে মৃত্যু সংবাদটা শুনেছেন, তা ঠিক নয়। এর ওপর ভিত্তি করে ভয়ে ভয়ে হাসান ভাইয়ের বাসায় টেলিফোন করলাম; জানতে চাইলাম হাসান ভাইয়ের কি হয়েছিল? বাসা থেকে বলা হলো, তিনি জ্বর হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, ৩/৪ দিন পর জ্বর নেমে যাওয়ায় তিনি বাসায় ফিরে আসেন। এর দুদিন পরেই তিনি সুস্থতার মধ্যেও হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। আত্মীয় স্বজন, ঘনিষ্ঠ জনরা এ খবর শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। খবর কনফার্ম হবার পর ক্যাম্পাস অফিসে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর আত্মার মাগফেরাতের জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। মাহমুদুল হাসান ছিলেন ক্যাম্পাস পরিবারের ঘনিষ্ট সদস্য। তিনি শুধু ক্যাম্পাস অফিসের পরিবেশকেই ভলোবাসেননি, ক্যাম্পাস’র মানুষগুলোকেও আপন করে নিয়েছিলেন। মেডিটেশন ক্লাস শেষ হবার পরও কোনো কোনো অংশগ্রহণকারীর অনুরোধে তিনি অনেকক্ষন আলাপ করতেন। কোনো বিরক্তবোধ বা ক্লান্তিবোধ করতেন না। মেডিটেশনকে তিনি জীবনের সাথে মিশিয়ে নিয়েছিলেন। এজন্য তার ক্লাসে বক্তব্যগুলো হতো প্রাণবন্ত, কোনোদিন যান্ত্রিক মনে হয়নি। তিনি মেডিটেশন সরোবরের অনেক গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন, সেখান থেকে ডুবুরীর মতো তুলে এনেছিলেন রাশি রাশি মুক্তো। ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ধ্যানপ্রেমী মানুষের মাঝে। তাঁর শেখানো লং রিলাক্সেশন, গ্রীন এনার্জি, পিরামিড প্রোটেকশান, থ্রি ফিংগার একটিভিটিজ প্রভৃতি।
মেডিটেশন ক্লাস নেয়ার মধ্যেই তাঁর কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ ছিল না; ক্যাম্পাস আয়োজিত বার্ষিক মেডিটেশন সেশনে মাহমুদুল হাসান ছিলেন একজন আকর্ষণীয় ও অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব। দু’দিনব্যাপী উক্ত সেশনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রচুর আগ্রহ দেখা গেছে। এভাবে অনেক মানুষের মাঝে মেডিটেশনের গুণাগুণ, শুভ প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে দেয়াকে মাহমুদুল হাসান জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। টেনশন-ফ্রি, স্ট্রেস-ফ্রি বিপুল কর্মশক্তিসম্পন্ন মানুষ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। উন্নত মানুষ গড়তে যেসব মানুষের প্রয়োজন-কর্মঠ, উদ্যমী, উদ্যোগী মানুষ। এসব মানুষের সমাজ থেকে বেরিয়ে আসবে কর্মযোগী মানুষ, নতুন সমাজ, নতুন দেশ গড়ার মহান লক্ষ্যে তারা হবেন নির্ভরশীল, সহায়ক শক্তি। মেডিটেশনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য রক্ষার ও প্রভূত সুযোগ রয়েছে। মাহমুদুল হাসানের মৃত্যুতে ক্যাম্পাস আয়োজিত মেডিটেশন ক্লাসগুলোতে দীর্ঘদিন শূন্যতা বিরাজ করবে।
হাসান ভাই বারবার ফিরে আসবেন, তাঁর স্নেহসিক্ত ভালোবাসার স্পর্শ অনুভব করবো, কারণ ক্যাম্পাস ভুলতে পারেনা হাসান ভাইকে। ক্যাম্পাস’র কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা অর্জন করেছেন, আপনি আমাদের আত্মার আত্মীয়। ফিরে আসুন হাসান ভাই, ২০২০ সাল আমাদের টার্গেট সামনেই- এ সময় আপনার বড্ড প্রয়োজন হাসান ভাই!
-লেখকঃ মোহাম্মদ মোস্তফা
কন্ট্রিবিউটর, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা