ক্যাম্পাস পরিচালিত ফ্রি সেমিনার অন প্রোএকটিভ এন্ড পজিটিভ এটিচিউড

যিনি প্রথমে সবার কথা শোনেন, পরে নিজের মতামত দেন -তিনিই লিডার,
তার সাথেই সবার সুসম্পর্ক থাকে

অনাবিল প্রশান্তি, সুস্বাস্থ্য ও অবিরাম সাফল্যের ধারায় জীবন বদলে দিতে ক্যাম্পাস’র নিয়মিত কর্মসূচি ফ্রি সেমিনার অন প্রোএকটিভ এন্ড পজিটিভ এটিচিউড। হতাশামুক্ত উচ্ছল-উজ্জ্বল আলোকিত জাতি গঠনে ক্যাম্পাস’র এ সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ ইতোমধ্যে ছাত্র ও তরুণ সমাজে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে আয়োজিত হয় এ সেমিনারের ১৯তম পর্ব। এবারের বিষয় ছিল- How to develop relationship, অর্থাৎ কীভাবে সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এবং ক্যাম্পাস সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (সিএসডিসি) এর মহাসচিব এম হেলালের সঞ্চালনায় উক্ত সেমিনারে মূল বক্তা ছিলেন প্রোএকটিভ এটিচিউডের জনপ্রিয় প্রবক্তা, গবেষক ও চিত্তাকর্ষক উপস্থাপক ড. আলমাসুর রহমান।

ড. আলমাসুর রহমান
ক্যারিশম্যাটিক উপস্থাপক ড. আলমাসুর রহমান বলেন, আমাদের রাগ ও মানসিক চাপকে ইতিবাচক শক্তিতে পরিণত করতে হবে; নিজেকে Mentally সুন্দর করতে হবে, তা না হলে Relationship গড়ে তোলা যাবে না। আর এসব কিছু করা সম্ভব মেডিটেশনের মাধ্যমে। তিনি বলেন, সফল মানুষ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? সফল মানুষ এক মিনিটের মধ্যে ৪৫টি চিন্তা করতে পারেন। তবে এ চিন্তাকে ধরে রাখার জন্য ধ্যান বা মেডিটেশনের প্রয়োজন হয়। কারণ চিন্তাকে স্থির করতে না পারলে লক্ষ্যভেদী হওয়া যায় না। ক্যাম্পাস’র ফ্রি মেডিটেশন কোর্সে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আপনারা এ সুযোগ সহজে গ্রহণ করতে পারেন।
ড. আলমাস Relationship এর গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এমন অনেক লোক দেখা যায়- যার কোটি কোটি টাকা আছে, অথচ তিনি Proper relationship গড়ে তুলতে পারেননি; ফলে তার জীবনটাই বৃথা। আবার অনেককে দেখা যায়- সম্পর্ক ঠিকই গড়েছেন, কিন্তু সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রথম কয়েক বছর ভালোই থাকে, প্রেম-প্রীতি থাকে, ভালোবাসা থাকে, পরস্পরের প্রতি আকর্ষণও থাকে; কিন্তু Relationship মেইনটেন করতে পারেন না বলে সে সম্পর্কে চিড় ধরে।
সন্তানের সাথে বাবা-মা’র সম্পর্কের উল্লেখ করে ড. আলমাস বলেন- বাবা-মা হলেন সন্তানের সবচেয়ে আপনজন, অথচ অনেক পরিবারে দেখা যায় বাবা বাসায় ফিরলে সন্তান দূরে সরে যায়। কিন্তু যারা সন্তানের সাথে সম্পর্ক গড়তে পেরেছেন তারা বাসায় ফিরলে সন্তান দৌঁড়ে কাছে চলে আসে, বাবা কেমন আছে তা জানতে চায়। অসুস্থ সন্তান চায়- বাবা-মা তার পাশে বসুক, তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিক। কিন্তু কোনো কোনো বাবা-মা তা করেন না, সন্তানের সাথে তারা সম্পর্ক গড়েন না। তিনি বলেন, সন্তান বাবা-মা’র প্রশংসা চায়, কিন্তু অনেকক্ষেত্রে তারা তা পায় না। দেখা গেলো সন্তান পরীক্ষায় ভালো করেছে, কিন্তু বাবা Appreciate করলেন না, তাকিয়েও দেখলেন না; এতে সন্তান দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হলো। অথচ সন্তানের সুখ-আনন্দের জন্য তারা সবই দিচ্ছেন, শুধু দিতে পারেননি ভালোবাসা। পেটের ক্ষুধা নিবারণে সব খাবারই দিচ্ছেন কিন্তু মনের খাবারের কথা ভাবেন না।
ড. আলমাস বলেন- মানুষ Appreciation চায়, এটি তার সহজাত প্রবৃত্তি। আপনি পাশের ভদ্রলোক থেকে কলম চেয়ে নিয়ে লাখ টাকার চেক লিখলেন, কিন্তু তাকে সামান্য ধন্যবাদও দিলেন না! অথচ তাকে ধন্যবাদ দিলে তিনিতো খুশি হবেনই, আপনারও শরীর-মন ভালো থাকবে। তিনি বলেন, মানুষের সাথে চলতে গেলে, মানুষের সাথে মিশতে গেলে ঢং বা ভঙ্গির আশ্রয় নিতে হয়। ঢং করার ক্ষমতা স্রষ্টা একমাত্র মানুষকেই দিয়েছেন। ড. আলমাসুর রহমান সম্পর্ক উন্নয়নের কৌশল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, আমাদেরকে IQ এর চেয়ে EQ এর শক্তি বাড়াতে হবে। Emotional Intelligence Question এর ক্ষেত্রে ইমোশনকে বোঝার ক্ষমতা যার যতবেশি, সম্পর্ক গড়ার ক্ষমতাও তার ততবেশি। যার EQ বেশি তিনি সবার সাথে মানিয়ে চলার দক্ষতা বেশি অর্জন করেন।
উদাহরণ টেনে ড. আলমাস বলেন- আপনি একটি বড় সংস্থায় কাজ করেন। বাসায় আপনার স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে সংস্থা-প্রধানের কাছে ছুটি চাইতে গেলেন। তিনি ছুটিত’ দিলেনই না, উল্টো নতুন কাজ চাপিয়ে দিলেন। এখানে সংস্থা-প্রধান Relation গড়তে জানেন না; তিনি যদি তা জানতেন, তাহলে আপনাকে বলতেন- আপনার স্ত্রীর অসুখ, আপনি এখনো অফিসে বসে আছেন; তাড়াতাড়ি চলে যান, দরকার হলে অফিসের একটি গাড়ি নিয়ে যান। তখন তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপনার মন ভরে যাবে। সংস্থার প্রতিও আপনার আনুগত্য বেড়ে যাবে। Proper relationship এর তারতম্যের কারণে এখানে আমরা দু’রকম এটিচিউড লক্ষ্য করছি।
আরেকটি উদাহরণ উপস্থাপন করে ড. আলমাস বলেন, আমেরিকার একটি স্টিলমিলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন। এর রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেন - আমি স্টাফদের বুঝতে চেষ্টা করি, তাদের কাজের Appreciate করি, তাদের Emotion বুঝি। স্টাফরাও প্রাণপণ কাজ করে, উৎপাদন বাড়ায়, পণ্যের কোয়ালিটি বজায় রাখে। এজন্য আমাদের কারখানায় উৎপাদন বেশি হয় -এটিই আমার বেশি বেতন পাওয়ার রহস্য।
ড. আলমাস বলেন, সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হলো Judgement attitude বা বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় আপনি আরেক বন্ধু সম্পর্কে বললেন- ও’ খুব খারাপ! অন্যান্য বন্ধুরা আপনার সাথে একমত না হয়ে বললেন- তুই ঠিক বলিসনি, ও’র অনেকগুলো গুণ আছে; সেগুলো দেখিস না কেন! এর মানে অন্য বন্ধুর সমালোচনা করতে গিয়ে আপনি আড্ডার বন্ধুদের কাছে বিতর্কিত হয়ে গেলেন। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত- আপনি কারো সম্পর্কে অভিমত জানাতে পারেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। কেননা Judgement attitude এর কারণে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
সম্পর্ক উন্নয়নের আরেকটি কৌশল সম্পর্কে ড. আলমাস বলেন- কথা কম বলবেন, শুনবেন বেশি। মানুষ মনের কথা অন্যের কাছে বলতে পারলে বেশি খুশি হয়, এতে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। খ্যাতিমান বক্তা ও উপস্থাপক অস্টিন বলেছেন- সম্পর্ক সুন্দর হয় কথা শোনার ওপর, কথা বলার ওপর নয়। কারও বলা কোনো তথ্য আগে হাজারবার জানা থাকলেও ভাব দেখাবেন যেন আপনি এইমাত্র কথাটা শুনলেন, তাহলে বক্তা আপনার প্রতি খুশি হবেন; তিনি কোটি টাকার আনন্দলাভ করবেন। ড. আলমাস বলেন - যিনি লিডার তিনি প্রথমে সবার কথা শোনেন, পরে নিজের মতামত দেন। তাই সম্পর্ক গাঢ় করতে হলে পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে কথা শুনতে হবে। কথা শোনার সময় অন্যমনষ্ক হলে চলবে না।
ড. আলমাস বলেন, সম্পর্ক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো Respect বা শ্রদ্ধাবোধ। মানুষকে যতবেশি শ্রদ্ধা করবেন, তার মূল্যায়ন করবেন -সম্পর্ক ততবেশি গাঢ় হবে। কোনো ব্যক্তির মূল্যায়নে আপনি যেমন ভাববেন, আপনার মনে তার সম্পর্কে তেমন ইমেজ তৈরি হবে; এর Reflection হিসেবে ঐ ব্যক্তির প্রতি আপনার ব্যবহার ভালো বা খারাপ হবে।
উদাহরণস্বরূপ ড. আলমাস বলেন, ফারসী সাহিত্যের কিংবদন্তী কবি-দার্শনিক শেখ সাদী’র জীবনের সত্য ঘটনার কথা অনেকেই জানেন; প্রথমে সাধারণ বেশভূষায় রাজ দরবারে দাওয়াতে গেলে শেখ সাদীকে পাত্তাই দেয়া হলো না; পরে রাজসিক পোশাক পরে আসার পর তাঁকে অনেক দামি দামি খাবার দেয়া হলো। তিনি সেগুলো না খেয়ে তাঁর আস্তিনের পকেটে পুরতে লাগলেন, আশপাশের লোকজন এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় শেখ সাদী বললেন- এটা পোশাকের প্রাপ্য, আমাকেতো দেয়া হয়নি।
ড. আলমাসুর রহমান বলেন, মানুষের lnternal beauty এর মূল্যায়ন করা উচিত। মানুষের জীবনে ভালো-খারাপ দু’টোই থাকে; মানুষের ভালো দিকগুলোর কথা ভাববেন, এ ধরনের চিন্তা ভালো Relationship গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর।

এম হেলাল
সেমিনারের সঞ্চালক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এবং সিএসডিসি’র মহাসচিব এম হেলাল বলেন, ড. আলমাসুর রহমান তাঁর মোহনীয় বাচনভঙ্গি এবং নান্দনিক উপস্থাপনায় Relationship বা সম্পর্ক গড়ার ওপর যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা আমাদের নিজেদের জীবনে কাজে লাগাব, এতে আমরা নিজেরাই লাভবান হব।
তিনি বলেন, সবার সাথেই আমাদের Relationship তৈরি ও রক্ষা করতে হবে। ধনী-গরিব বিবেচনায় Relationship গড়া যাবে না। কারণ কখন কাকে আপনার দরকার পড়বে, আপনি নিজেও জানেন না। আপনার বিরুদ্ধে কখনো হুলিয়া জারি হলে কিংবা আত্মরক্ষার্থে কোথাও পালাতে হলে আপনাকে বস্তির মানুষের কাছেও আশ্রয় নিতে হতে পারে। আপনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জরুরি সার্ভিসম্যান আপনার সহযোগিতায় মধ্যরাতেও ছুটে আসবে, যদি তার বা তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক দৃঢ় হয়। অর্থাৎ সম্পর্কই সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা এবং সর্বাধিক বড় সম্পদ।
এম হেলাল বলেন, সম্পর্ক স্থাপন ও বজায় রাখার মাধ্যমেই সম্ভব উন্নত জাতি গঠন। আর একটি উন্নত জাতিই পারে জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে। আমরা সুসম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হব, উন্নত জাতি গঠনে অবদান রাখব -এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। ক্যাম্পাস পরিচালিত পরবর্তী প্রোএকটিভ সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে ১১ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায়; সেমিনারের বিষয়- Know Thyself.