বিদ্যুৎ, যানজট, দুর্যোগ, বেকারত্ব, দারিদ্র্যসহ
জাতীয় সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান
বাংলাদেশে ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়নের অত্যাধুনিক মডেল
॥ এম হেলাল, সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা ॥
ভূমিকা
বাংলাদেশ যেমনি বহুমুখী সম্ভাবনার দেশ, তেমনি এর বর্তমান সমস্যাও বহুবিধ। জাতীয় এসব সমস্যার অন্যতম হচ্ছে অশিক্ষা ও অপরিকল্পিত শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, দুর্বিষহ যানজট, বেকারত্ব, দুর্যোগ ও দারিদ্র্য, অনুন্নত কৃষি পদ্ধতি, আইল ও দেয়াল সংস্কৃতি, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা, শ্রেণী-বৈষম্য, পরিকল্পনাহীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা।

এত্তসব সমস্যার সমাধানের পথ একটিই; তা হচ্ছে দেশব্যাপী উপজেলা-শহরের আধুনিকায়ন এবং ইউনিয়ন-শহর তৈরির মাধ্যমে একদিকে তৃণমূলের স্থায়ী উন্নয়ন, অন্যদিকে ভূমিহীন ও ছিন্নমূল মানুষদের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য ও শ্রেণী-বৈষম্য নিঃশেষ করে দেয়া।

শিক্ষা-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণই দরিদ্র; ফলে শ্রেণী-বৈষম্য দানা বেঁধে আছে। আবার হামাগুড়ি দিয়ে দারিদ্র্য কাটিয়ে ওঠার পথেও তাদের রয়েছে বড় বাধা- প্রাকৃতিক দুর্যোগের দুর্গতি এবং আইল ও দেয়াল সংস্কৃতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দু’টি মূল সমস্যার স্থায়ী সমাধান করে দিতে পারলে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য বদলে নিতে সক্ষম। দরিদ্রদের ভাগ্যোন্নয়নে ধনিক শ্রেণী ও সরকার সহৃদয়ে সদয় হলে শ্রেণী-বৈষম্য হ্রাস পাবে। আর শ্রেণী-বৈষম্য হ্রাস পেয়ে যখন ন্যায়ভিত্তিক ও ভারসাম্যময় সমাজ গড়ে উঠবে, তখন সরকার ও ধনিক শ্রেণীর সামাজিক বোঝা হ্রাস পাবে। এতে অসামাজিক কার্যকলাপ ও উচ্ছৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলা হ্রাস পেয়ে সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টি হওয়ার ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও ধনিক শ্রেণী বিশ্ব-প্রতিযোগিতার প্রতি মনোনিবেশ করতে সক্ষম হবে। সে পর্যায়ে বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিক হবে অত্যাধুনিক বিশ্বের অবশ্যম্ভাবী সম্পদ।

এদেশে ভূমিহীনের সংখ্যা ১১ কোটির বেশি; কৃষকদের সিংহভাগই বর্গাচাষী, যাদের স্থায়ী আবাসনতো নেই-ই বরং নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ ২০০৯ অনুযায়ী দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৭৫% এখনো কাঁচাঘর ও ঝুপড়িতে বাস করে; রাতের বেলা এখনও প্রায় অর্ধেক পরিবারে আলোর ব্যবস্থা হয় কেরোসিনের কুপিতে; ৬০% পরিবারে কোন রেডিও-টিভি বা তথ্য-যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই; প্রাথমিক শিক্ষার স্তর পার করতে পারে এক তৃতীয়াংশের কম শিক্ষার্থী। এ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না বরং দরিদ্রের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

বিভিন্ন সরকার অনেক পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক উন্নতির নানা সূচকের কথা বললেও সরকারি সংস্থা পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে ঠিকই ধরা পড়েছে যে- দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে না। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে হাজারো প্রকল্প গ্রহণ এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কমছে না দারিদ্র্যের হার। আমার মতে, এর অন্যতম কারণ অস্থায়ী কাঁচা ঘরবাড়ি বা ঝুপড়ির আবাসন।

আসলে ক্ষণস্থায়ী কুঁড়েঘরই দরিদ্রদের বড় liability তথা দায়। প্রায় বছরই ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা আগুনে ধ্বংস হয় এদের ঘরবাড়ি। ফলে আবাসনের বন্দোবস্ত করতেই লাগাতার ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের; নিজেদের উন্নতি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ সৃষ্টির অবকাশ থাকে না। আবার তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ে যে কুঁড়েঘর, তা নিয়ে চলে তেলেসমাতি ও বাণিজ্য-সংস্কৃতি।

শিশুবেলা পাঠ্যপুস্তকে যে কৃষক গনি মিয়ার কাহিনী পড়েছিলাম, বড় হয়ে এখন দেখি এই গনি মিয়ারাই বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ; যাদের ধার-কর্জ-ঋণ কখনো শেষ হয় না। মহাজনদের কাছে গনি মিয়াদের সুদ দৈনিক বাড়ে প্রায় দুইগুণ। এমনকি অনেকের মতে, উদারপ্রাণ ও মহৎ ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠিত বর্তমানের নামী-দামি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোও সেরূপ মহাজনি গ্যাঁড়াকল, যা থেকে কৃষক ও দরিদ্ররা নিষ্কৃতি পায় না। বরং তাদের মতে, এগুলো হচ্ছে সনাতন মহাজনি সুদপ্রথার উন্নততর সংস্করণ বা মডার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং মাত্র। আমি কারো ব্যর্থতার কথা বলছি না, আমি দুর্বিনীত দুর্বৃত্তপনার কথা বলছি না; আমি বলছি গনি মিয়াদের সংগ্রামের কথা, এ সংগ্রামে তাদেরকে আর স্বপ্ন না দেখিয়ে এবার একটু বাস্তব সুখ-স্বস্তি দেবার বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার কথা বলতে চাচ্ছি।

উপরোক্ত মহাজনি ব্যবস্থায় বড় গনি মিয়ার ঘরে জন্ম নেয়া ছোট গনি মিয়াদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে জ্যামিতিক হারে। তারাই আবার পরিণত হচ্ছে বড় গনি মিয়ায়; আটকে যাচ্ছে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে। এমতাবস্থায় চরাঞ্চল, উপকূলীয় ও গ্রামীণ মানুষের জন্য স্থায়ী আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মের সংস্থান করে দিতে পারলে উক্ত দু’টি মূল সমস্যাসহ অন্য সকল জাতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়ন তথা ইউনিয়ন শহর স্থাপন। সুউন্নত দেশের কান্ট্রি সাইডে বা তাদের মফস্বল এলাকায় রয়েছে অনুরূপ টাউন সেন্টার, যেখানে গ্রামীণ মানুষরাও পেয়ে থাকে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা। বাংলাদেশের জন্য এরূপ একটি উন্নয়ন মডেলের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এ নিবন্ধে।

এ মডেল বাস্তবায়ন সম্ভব ১৫ বছরের পরিকল্পনায়। এখনই এ উদ্যোগ গৃহীত হলে বাংলাদেশ ১৫ বছরের মধ্যেই থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা কোরিয়ার চেয়েও কয়েকগুণ শক্তিশালী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা, যানজট রোধ, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও শ্রেণী-বৈষম্য হ্রাস, বেকার ও বস্তি সমস্যার সমাধান, ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা হ্রাস, আইল ও দেয়াল রোধ, ভূ-মানচিত্র ও পরিবেশ রক্ষা, বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা, সাগর ও নদীবক্ষে জেগে ওঠা চরসমূহকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পশ্চাৎ ভূমিরূপে ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ ‘জাতীয় সকল দুর্গতি’ মোকাবেলার সোপান এ মডেল। ইউনিয়নভিত্তিক শহর প্রতিষ্ঠার এ মডেলে যাবার পূর্বে মৌলিক কিছু সমস্যার গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যাপক মানুষের ভাসমান জীবন
বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশ প্রায়ই বিভিন্ন দুর্যোগের কবলে পড়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে দক্ষিণ এশিয়া, তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাপলক্রফট’ ১৭০টি দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে ১৬টি দেশকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে, যার শীর্ষে আছে বাংলাদেশের নাম। এর কারণস্বরূপ বলা হয়েছে, এখানে সর্বোচ্চ মাত্রায় অনাবৃষ্টি হয় এবং চরম খাদ্যাভাব বিরাজমান। বাংলাদেশে রয়েছে ভয়াল দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ এবং কৃষির ওপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীলতা। ফলে দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বেশিরভাগ শাখাই বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হবে। বিপদের অন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল- বাংলাদেশ এসব বিরূপতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর খুব বেশি সামর্থ্য রাখে না।

এরূপ ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবেলার টেকসই ও স্থায়ী উদ্যোগ না থাকায় প্রতি বছরই নিহত হয় অসংখ্য ভাগ্যহত মানুষ; ঘর-বাড়ি ও ফসলের ক্ষতি হয় অপূরণীয় ও অবর্ণনীয়। ফলে ভাসমান ও ছিন্নমূল পরিবারের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে, ঘনীভূত হচ্ছে জাতীয় সংকট।

ভবিষ্যতে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে বাংলাদেশঃ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি আগামীতে আরো বহুগুণ বাড়বে। ২০২০ সালে বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে দেশের প্রায় ৪০% এলাকা। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর প্রফেসর ড. মনিরুল কাদের মীর্জা বলেন, বাংলাদেশে সব শ্রেণীর মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে পড়লেও দরিদ্ররাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী সংঘটিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দরিদ্ররাই সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব দরিদ্রদেরকে দরিদ্রতর করে তোলে। ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়বে এখনকার চেয়ে ৭০%। জনসংখ্যার এ ক্রমবর্ধিষ্ণু হার বাংলাদেশের দারিদ্র্য বাড়াবে কি কমাবে, তা দেশের নীতি-নির্ধারকরাই বলবেন। তবে জনগোষ্ঠীর এ চাপের সাথে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেসময়ে যে ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত করবে সবাইকে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

স্পারসো’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. আনোয়ার আলীর মডেল বিশ্লেষণ করে ড. মীর্জা জানান, সাগরপৃষ্ঠের তাপ ২ ডি. সে. বাড়লে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা আগামীতে ২১ থেকে ৪৭ ভাগ পর্যন্ত বাড়তে পারে। জলবায়ুর উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আশংকাও বেড়ে যাবে। তাঁর মতে, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির দিক থেকে বাংলাদেশই শীর্ষে। ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্বের মোট প্রাণহানির ৫৩% ঘটে বাংলাদেশে। অথচ বিশ্বে সংঘটিত সামুদ্রিক ঝড়গুলোর মাত্র ১% আঘাত হানে এখানে। এটি বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

ড. মনির এবং ড. আনোয়ার আলীর উপরোক্ত মতামত বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে অতীতে ঝড়-ঝঞ্ঝায় যে ক্ষয়-ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটেছে, ভবিষ্যতে তা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং তার ফলে সকল শ্রেণীর মানুষকেই ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। তাঁদের মত বিশেষজ্ঞগণ এরূপ আগাম বার্তা দিয়ে সতর্ক হবার সুযোগ করে দিলেও এসব বিষয়ে আমাদের নীতি-নির্ধারক ও ত্রাণ কর্তাদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত স্থায়ী কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না।

বর্তমান অবস্থায় বসে বসে সাগরের জলরাশির দৃশ্য উপভোগের বা ঢেউ গণনার অথবা ভূমিকম্প নিয়ে কল্পনার সুযোগ নেই। কারণ আগামীর দুর্যোগ-ভয়াবহতা শুধু দরিদ্রকেই নয়, ধনীর নিশ্চিন্ত জীবনকেও নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। তখন আর সুযোগ থাকবে না রিলিফ-রাজনীতি ও ত্রাণ-সংস্কৃতির। নিরীহ-দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষদের দুর্গতি নিয়ে হা-পিত্যেশ দেখিয়ে ত্রাণের টাকায় রাজনীতির বরপুত্ররা বানায় নৈসর্গিক অট্টালিকা, বৃদ্ধি করে নিজ বাড়ি-বাগানের শোভা, ত্রাণের টিনে বাগান বাড়ির সন্নিকটে মসজিদ-মাদ্রাসা-স্কুল নির্মাণের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ নিশ্চিতকরণে ভোট ব্যাংক তৈরি করে, ব্যক্তিগত আয়েশ ও প্রতিপত্তির জন্য করে আরো কত রাজনীতি-সম্প্রীতির কর্মকান্ড।

এসব আলালের দুলালরা রাজনৈতিক ছাতা ব্যবহারের মাধ্যমে নিঃস্ব ও গৃহহীন মানুষের টিন বা ত্রাণ-সামগ্রী দিয়ে যে ফ্যাক্টরী বানায়, সে ফ্যাক্টরীর ছাদ থেকে ত্রাণের টিন খুলে নিয়ে পরবর্তী সরকার বিশেষতঃ তত্ত্বাবধায়কগণ এলাকাবাসীকে বাঁচায়। নইলে ওদের ‘পাপের ধনের প্রায়শ্চিত্ত’ -এর তোপে পড়ে নিরীহ এলাকাবাসীও হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ক্ষমতা পেয়ে ‘উদ্দিন তত্ত্বাবধায়কগণ’ দুর্নীতি বিরোধী এমনই অভিযান চালান, বছর না যেতেই তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি-অপশাসন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। কেনইবা দুর্নীতিকে শিকল পরানোর মহোৎসব, আবার কেনইবা দুর্নীতি-মুক্তির মিছিল বা আনন্দ-উল্লাস; বাংলার জনগণ এসব রা-জ-নী-তি ও কূটনীতির কিছুই জানতে পারে না যেমনি, তেমনি এই খেলারাম খেলে যা -এর ক্রীড়নক সেই উদ্দিনদেরও করতে হয় না কোন জবাবদিহিতা। বাংলার মাটিতে এরূপ ‘বাজিকর’ রাজনীতির হোলিখেলা চলতেই থাকবে, যতদিন পর্যন্ত দেশ উন্নয়নের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনায় সমন্বিত উন্নয়ন মডেল জাতীয়ভাবে গৃহীত না হয়।

তাই এখনই সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমস্যার সমাধানে কার্যকর ও জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ; দুর্যোগ থেকে বাঁচার স্থায়ী ও টেকসই উপায় অন্বেষণ। এখনই সময় মনুষ্য-সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে দেশ রক্ষা; মহাচোর-মহাদুর্নীতিবাজ-লুটেরা-জলদস্যু-ভূমিদস্যু ও বনদস্যুদের জবর দখলকৃত খাল-বিল-হাওড়, নদী-নালা, লেক-পাহাড়, জেগে ওঠা চরাঞ্চল, বনাঞ্চল, সরকারি বাড়ি ও ফ্ল্যাট প্রভৃতি উদ্ধার করা।

বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ এবং ভূমিকম্পের ভয়াবহতা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য দরকার হল্যান্ড, জাপান বা অনুরূপ দুর্যোগজয়ী সুউন্নত দেশের ন্যায় স্থায়ী ব্যবস্থা। প্রয়োজন যথাযথ প্রকল্প-পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংকুলানে দেশী-বিদেশী সাহায্য গ্রহণ। প্রতিবছর বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে যে বিপুল ক্ষতি হয় এবং সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যে অর্থ ব্যয় হয়, সে তুলনায় স্থায়ী সমাধানে খুব বেশি ব্যয় হবে না। তবে এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এখন আর দ্বিমত হবার অবকাশ নেই যে, অনাগত ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্থায়ী সমাধানে এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

এদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরবর্তী কিছুদিন দুর্গত মানুষদের নিয়ে চলে মায়াকান্না, রিলিফ-রাজনীতিসহ নানা তৎপরতা। কিন্তু দুর্গতরা উঠে না দাঁড়াতেই তাদের ওপর থেকে নজর ফিরিয়ে নেয়া হয়। ধ্বংসের ক্ষতচিহ্ন আপাত মুছে দেয়া হয় ত্রাণ দিয়ে। দুর্গতদেরকে ত্রাণনির্ভর করিয়ে হাত পাতার সংস্কৃতিতে এমনই নিবদ্ধ করা হয় যে- হাত পাতায় এরা কেবল অভ্যস্ত ও পেশাগ্রস্তই হয়ে ওঠে না, নেশাগ্রস্তও হয়ে যায়। পরবর্তীতে কাজের সুযোগ পেলেও আর কোন কাজ করতে চায় না এরা। তাই এদেরকে শুধু ত্রাণ দিলেই হবে না, উঠে দাঁড়ানো ও আত্মনির্ভরশীল হবার সুযোগও করে দিতে হবে।

দুর্যোগ মোকাবেলায় হল্যান্ডের দৃষ্টান্তঃ পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ই নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। কিন্তু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম হয়েছে, স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জয় করেছে প্রকৃতিকে।

বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় সমস্যা বাংলাদেশের একার নয়, অনেক দেশেরই রয়েছে এ সমস্যা। প্রাকৃতিক সমস্যা বলে এগুলোর দ্বারা কেবল ক্ষতিরই সম্মুখীন হতে হবে -এরূপ ‘ধ্রুব সত্য’ বাংলাদেশ মেনে নিলেও অনেক দেশই তা মেনে নেয়নি। বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের আশীর্বাদকে কাজে লাগিয়ে তারা মোকাবেলা করছে প্রকৃতির এসব খেয়ালীপনা। উদাহরণস্বরূপ হল্যান্ডের কথা বলা যায়। বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় সে দেশের গৃহীত কতিপয় পদক্ষেপ দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে আমার।

রটারড্যামে যা দেখেছিঃ ইউরোপের পশ্চিমে অবস্থিত হল্যান্ড একটি ছোট্ট দেশ, যার আয়তন বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ। হল্যান্ড এমনই একটি দেশ, যে দেশের ভৌগলিক গঠন অনেকাংশেই বাংলাদেশের মত। এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমস্যার দিক থেকেও সে দেশ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক করুণ অবস্থানে ছিল। সে দেশের ৬০ ভাগ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচের লেভেলে অবস্থিত হলেও দেশটি এখন আর সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যায় না। বুদ্ধিবলে ডাচ্ জাতি প্রতিহত করেছে প্রকৃতির ছোবলকে, বশীভূত করেছে প্রকৃতিকে। এক সময়ে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হত হল্যান্ড, যেরূপ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এখন বাংলাদেশ। ১৯৫৩ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়জনিত জলোচ্ছ্বাসে ১৮৫৩ ডাচ্ মৃত্যুবরণ করে। তখন সে দেশের সরকার বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিহত করার জন্য যুগান্তকারী এক প্রকল্প গ্রহণ করে, যা Delta Works নামে পরিচিত। সে প্রকল্পের অধীনে হল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সমুদ্রের পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পথগুলোতে বিশেষ ধরনের গেইটসহ বিশাল বিশাল বাঁধ নির্মাণ করা হয়। গেইটগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় খোলা থাকে কিন্তু সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস দেখা দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জলোচ্ছ্বাসে হল্যান্ডের ভূমি প্লাবিত হয় না। বাঁধের স্থাপত্যশৈলীও অত্যাধুনিক। এসব বাঁধ ও প্রকল্প প্রদর্শন করে ডাচ্রা পর্যটকদের কাছ থেকেও কাঁড়ি কাঁড়ি ইউরো আয় করছে।

২০০২ সালে হল্যান্ডের Rotterdam নগরীতে অবস্থিত এমনই একটি বাঁধ পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে, যার স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধ করেছে আমাকে। বুদ্ধিবলে প্রকৃতিকে জয়ের সে বিশাল কর্মযজ্ঞ না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না যে, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের প্রবল প্রতাপকেও মানুষ ঠেকিয়ে রাখতে পারে। উল্লেখ্য, Delta Works ছাড়াও বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে মূলভূমি রক্ষার জন্য হল্যান্ডের উপকূলীয় এবং নদী তীরবর্তী এলাকায় Dike ও Polder নির্মাণ করা হয়েছে বহুবছর আগেই।

মানুষ-সৃষ্ট দুর্গতি ও ক্রমবর্ধিষ্ণু শ্রেণী-বৈষম্য
দুর্গতি ও দারিদ্র্য একই সূত্রে গাঁথা; আবার দুর্গতি যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষের সৃষ্ট। তাই সমাজের দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিতরাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয় বেশি। ধনীদের জীবন যাপনের নিত্য-নতুন পদ্ধতি ও ব্যবহৃত উপকরণ প্রকারান্তরে সৃষ্টি করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাড়িয়ে তুলছে দরিদ্রের দুর্দশা। ধনী দেশ ও সমাজের ধনিক শ্রেণী কর্তৃক ব্যবহৃত বিভিন্ন কনটেইনার, বোতল ও পানীয় ক্যান পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। তাই পরিবেশ বিপর্যয়কারী এরূপ জীবন-পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবি উঠছে এখন বিশ্বব্যাপী।

দারিদ্র্য দূর করতে পারলে দরিদ্র শ্রেণীর নানা দুর্গতির পাশাপাশি প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত দুর্গতি হ্রাস পেতে বাধ্য। একটি এলাকায় বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখা দিলে সে এলাকার কুঁড়েঘর ও কাঁচাঘরে বসবাসকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সর্বাধিক, তাদের ক্ষয়ক্ষতিও হয় অপূরণীয়। অন্যদিকে পাকাঘর বা দালানে বসবাসকারীদের ক্ষয়ক্ষতি বা দুর্গতি হয় তুলনামূলকভাবে কম। আবার বহুতল ভবনের ‘উপরতলার মানুষরা’ তথা সমাজের সুবিধাভোগীরা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময়েও থেকে যান উপর তলায়ই। অন্যান্য সামাজিক দুর্গতি তাদের কম-বেশি ছুঁলেও বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস তাদের ছুঁতেই পারে না। সুতরাং প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল দুর্গতিতে গরীব-অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিতরাই আক্রান্ত হয় সর্বাধিক। এজন্যই এসব দুর্গতির স্থায়ী সমাধান হচ্ছে- গরীবদের ভাগ্য উন্নয়ন বা তাদের বঞ্চনা দূর করা, অন্যকথায় তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা বৃদ্ধি এবং স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া।

আইল ও দেয়াল সংস্কৃতি এবং কৃষি জমির দ্রুত হ্রাস
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসমূহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এগুলো চর, পতিত ও খালি জমিতে ভরপুর। এসব এলাকায় বাড়িঘর উঠানো হচ্ছে এলোমেলোভাবে। একান্নবর্তী পরিবার প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় এক বাবার ৫/৭ সন্তান প্রত্যেকে আলাদা বাড়িতে থাকার মানসে নতুন নতুন ভিটা ও চালা নির্মাণ করে বসতি গড়ছে। এর ফলে কৃষিজমি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

২০/২৫ বছর পূর্বে যে গ্রামাঞ্চলে দেখা যেত দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, এখন সেখানে গিয়ে ফসলতো দূরের কথা, মাঠই খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই ফসলের মাঠ এখন ভরে গেছে কুঁড়েঘরে অথবা একচালা-দোচালা টিনের ছাউনির কাঁচা ঘর-বাড়িতে। এসব ঘর-বাড়ি তৈরিতে কোন কর্তৃপক্ষীয় অনুমোদন বা নীতিমালা মানার প্রয়োজন হয় না। ফলে অশিক্ষিত ও শিক্ষিত সকলের খেয়াল-খুশিমত যাচ্ছেতাইভাবে গড়ে উঠছে এসব বসত ভিটা।

যেখানে সেখানে বিশেষতঃ ফসলী জমিতে এরূপ যথেচ্ছ বাড়ি নির্মাণের কোন সুযোগ নেই উন্নত দেশে। সেখানে কৃষিজমির চিরস্থায়ী বরাদ্দ থাকে ফসল উৎপাদনের জন্য; কৃষি জমিতে বাসা-বাড়ি নির্মাণে থাকে কঠিন আইনী বাধা। আমাদের দেশের কৃষি জমিতে বাড়িঘর নির্মাণে তেমন আইনী বাধা বা কোন নীতিমালা না থাকায় দেশের ভূ-মানচিত্রও দ্রুত বদলে যাচ্ছে, যা উন্নত বিশ্বের কোন দেশেই বদলায় না। বাংলাদেশের যেকোন গ্রামে ৩/৪ বছর পর পর গেলে মানচিত্রের এ পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হবেই। কৃষি জমিতে ব্যাঙের ছাতার মত বসতবাড়ি নির্মাণের ফলে শুধু ভূ-মানচিত্রের পরিবর্তনই হচ্ছে না, ফসল উৎপাদনের সক্ষমতাও হারাচ্ছে দেশ, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে ব্যাপকভাবে। কৃষি জমিতে নির্মিত ছোট ছোট বাড়িগুলোর পুকুরও এত ছোট্ট যে এগুলোতে মাছ থাকে না, বর্ষার পরে পানিও থাকে না। নবনির্মিত বসত-ভিটার জায়গাটি শুধু ফসলের মাঠকেই খেয়ে ফেলছে না, গাছ-গাছালির ছায়ার কারণে বাড়ির চতুর্দিকের জমিতে ফলনও হয় না। অর্থাৎ ১ বিঘার একটি বাড়ির কারণে দেড়বিঘা জমির ফলন বন্ধ হয়ে যায়। আবার বাড়িঘরের বাইরে যেটুকুন জমি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে সেটুকুনও অজস্র আইলে খন্ডবিখন্ড।

এক পিতার মালিকানাধীন একই সম্পত্তির অংশীদার হয়ে ওঠে তার বহু সন্তান। পিতার প্রতিখণ্ড জমির ওপর পড়ে বহু অংশীদারী সীমানা বা আইল; আইলে আইলে লুপ্তপ্রায় ফসলী জমিগুলো। বর্তমানে প্রতি ৫ একর জমিতে আইল গজিয়েছে ১ একর এবং এই ১ একর আইলের দু’পাশের অন্ততঃ আরও ১ একর জমি থেকে যাচ্ছে ফসল উৎপাদনের বাইরে। তাহলে প্রতি ৫ একরের মধ্যে ২ একরই থেকে যাচ্ছে ফসল উৎপাদনের বাইরে এবং বাকি ৩ একরে ফসল ফলানো যাচ্ছে। অন্যদিকে এই কৃষি জমির পরিমাণও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে নতুন নতুন বসত ভিটার কারণে। আবার উপকূল ও হাওড় এলাকার অধিকাংশ জমির এক ফসলের ফলনে কষ্টেশিষ্টে চলে কৃষকের সারা বছর।

অপরিকল্পিত বসত নির্মাণের ফলে গত ২০ বছরে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৫০ লক্ষ একর এবং প্রতিদিন গড়ে ২২০ হেক্টর কৃষিজমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার ও আইল রোধ করা না গেলে ২৫ বছর পর বাংলাদেশে কৃষি জমির পরিমাণ কতটুকু থাকবে বা আদৌ থাকবে কিনা, তা নিয়ে ভাবা এবং এর প্রতিকারে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। সচেতন দেশপ্রেমীদের এ বিষয়ে গঠনমূলক আন্দোলনেও নামা উচিত। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক চাষাবাদের জন্যও এ আইল এমনই প্রতিবন্ধক যে, আইল বিলোপ বা হ্রাস কর্মসূচি তথা আন্দোলন এখন অতীব জরুরি। এমনকি জমির এ খ-ন আমাদের মধ্যকার পারিবারিক বন্ধন ও আত্মিক সম্পর্ককেও খণ্ডিত করছে।

একান্নবর্তী পরিবারের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ সোনার বাংলার সোনার মানুষরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে পরস্পর থেকে। ক্ষেতের আইল এখন সম্প্রসারিত হয়েছে বাড়ির প্রাচীরে বা দেয়ালে। কোটি কোটি আইল, দেয়াল ও প্রাচীরে ভরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আইল ও দেয়াল সংস্কৃতি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে- পৃথিবী মানে শুধু ‘আমি’; আমার বাইরে কেউ নেই, কিছু নেই। আমার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র (সিএসডিসি) -এর ধূমপান ও নকল বিরোধী আন্দোলন ইতোমধ্যেই সফল হয়েছে। দু’দশক পূর্বে ক্যাম্পাস’র শুরু করা দুর্নীতি বিরোধী সচেতনতা আন্দোলন তীব্রতর হয়ে এখন বিপ্লবে রূপ নিয়েছে। নাগরিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম বৃদ্ধিতে নিবেদিত ক্যাম্পাস’র এবারের মিশন হচ্ছে- জমির আইল ও দেয়াল বিলোপের আন্দোলন এবং সমাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

চরাঞ্চলে অপরিকল্পিত বাড়ি-ঘর নির্মাণের কারণে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। চরাঞ্চলে শিক্ষালয় দূরে বলে অধিকাংশ অভিভাবকের পক্ষে সন্তানকে বিদ্যালয়ে বা মক্তবে পাঠানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। চিকিৎসা, বিচার ও সরকারি সুযোগ-সুবিধাতো সুদূরপরাহত। ফলে এসব প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ দিন দিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর ও নিঃস্ব হয়ে রাজধানীমুখী হচ্ছে। ভিক্ষাবৃত্তি, ছিনতাই-চুরি-ডাকাতি, কলিংবেল পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ইত্যাকার অশোভন ও অসামাজিক কর্ম ও পেশায় লিপ্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। এসব উচ্ছৃঙ্খল কর্ম ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে বা সামাল দিতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সর্বদাই হিমশিম খেতে হয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিপুল অংকও ব্যয় করতে হয় এসব অসামাজিক বা অনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিরোধে তথা ধনী ও মধ্যবিত্তদের নিরাপত্তা বিধানে।

এক কথায় গ্রামীণ নিরীহ ও সুবিধা-বঞ্চিতদের দারিদ্র্য ও সংকট জিইয়ে রেখে শহুরে অট্টালিকাবাসীদের নিশ্চিন্ত থাকা কোনক্রমেই সম্ভব নয় এবং তা এতই স্পষ্ট -এ বিষয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়া বা বক্তৃতা-বিবৃতি করে অযথা সময় ও অর্থব্যয় একেবারেই নিষ্ফল। বরং এর উত্তরণে জরুরি প্রয়োজন জনশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, যা ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে পাবলিক ট্রেনিং এন্ড মিডিয়া সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্ভব; যে সম্পর্কে বিস্তারিত এ মডেলে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের মোট জমির পরিমাণ ৩ কোটি ৬৭ লাখ হেক্টর। তন্মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ১ কোটি ৯৩ লাখ হেক্টর, যা মোট জমির ৫৩ শতাংশ। অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট, শিল্প-কারখানা নির্মাণের কারণে প্রতিবছর ৮২ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। এতে বছরে গড়ে কমে যাচ্ছে মোট আবাদি জমির ১ শতাংশ। সে হিসাব অনুযায়ী ১০০ বছর পর এদেশে আর কোন আবাদি জমি থাকবে না।

নীতিমালা বা আইন না থাকায় যার টাকা আছে, সে মাঠের পর মাঠ রাস্তার পার্শ্ববর্তী ফসলী জমি কিনে বাগানবাড়ি করছে, গড়ে তুলছে শিল্প-কারখানা বা বৈধ-অবৈধ হাউজিং সোসাইটি। এতে প্রতিবছর হাজার হাজার একর কৃষিজমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জমিজমা নিয়ে যে চরম বিপর্যয় চলে আসছে, তা কিন্তু মানুষেরই সৃষ্ট। ভূমিদস্যু ও দুর্বৃত্তদের হানাহানি ছাড়াও এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মনীতি, সামাজিক রীতিনীতি বা সংস্কৃতি সবই হচ্ছে তেলা মাথায় তেল দেয়া। ফলে জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে ভূমিহীন ও উদ্বাস্তুর সংখ্যা। সরকারের রাজস্ব আদায়, রেজিস্ট্রি, নামজারী, রেকর্ড সংশোধন, মালিকানা পরিবর্তন, ভূমিহীনদের তালিকা তৈরি ও জেগে ওঠা চরে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, অবৈধ দখল রোধ ইত্যাকার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যথেষ্ট নয়। তাছাড়া ভূমি নিয়ে মানুষ যেসব চূড়ান্ত সমস্যার মধ্যে পড়ে, সেগুলো হল- খাসজমি বন্দোবস্তে দুর্নীতি, জাল দলিল সৃষ্টি, বেআইনীভাবে নাম সংশোধন, রাজস্ব আদায়ে হয়রানি, বেআইনীভাবে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন, তদন্ত ছাড়াই প্রতিবেদন পেশ, ভুল রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি।

বিভিন্ন দেশে চাষ-বাস ব্যবস্থার পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক, চ্যানেল আই’র বার্তা পরিচালক এবং কৃষি বিষয়ক বিশিষ্ট সাংবাদিক শাইখ সিরাজ বলেন- কৃষিজমি সংরক্ষণের উদ্যোগ বহু আগেই নেয়া উচিত ছিল সরকারের। ইতোমধ্যে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। আর বিলম্ব না করে সরকারকে এখনই এ উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন- পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এরূপ যথেচ্ছভাবে জমি ব্যবহৃত হয় না। আমাদের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, কিন্তু কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। তাই আগামীর বিপুল খাদ্য-চাহিদা মেটানোর জরুরি পদক্ষেপ এখনই নেয়া অত্যাবশ্যক।

দুর্বিষহ যানজট ও স্থবির বাংলাদেশ
দুর্বিষহ যানজটের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে স্থবির, বাঙালিরা রাস্তাঘাটে ঠাঁয় দাড়িয়ে! বিশ্ব যেখানে দ্রুত গতিতে এগিয়ে, আমরা সেখানে কচ্ছপের গতিতে দায়সারা জীবন-যাপনে ক্লান্ত ও অবসন্ন। যানজট আমাদের জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় চুরি করে নিচ্ছে। ফলে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি কাংখিত লক্ষ্যে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই শুধু যানবাহনের ক্ষেত্রে নয়, সমগ্র জনজীবনেও গতির সঞ্চার করতে যানজট নিরসনের উদ্যোগ অতীব জরুরি। সেক্ষেত্রে ইউনিয়নভিত্তিক এ মডেল বর্তমান দুর্বিষহ যানজট নিরসনে কঠিন অঙ্কগুলোর সরল সমাধান এনে দেবে। এ মডেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে শহর ও গ্রামের মধ্যকার বর্তমান ব্যবধান কমে যাবে এবং মানুষ ইউনিয়ন শহরেই থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। ফলে বড় বড় শহরে বর্তমান যানজট থাকবে না। এ মডেল যেহেতু জাতীয় সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাবনা, সেহেতু রাজধানীর যানজট নিরসনে এখানে দু’টি কথা বলে রাখা প্রয়োজন।

যেখানে মানুষ থাকে, মানুষের বাহন থাকে, সেখানে যানজট থাকাটাই স্বাভাবিক। উন্নত চিন্তার জাতিরা অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি যানজট সমস্যার সমাধানও করে নিয়েছে। কিন্তু The Bengalese can’t manage themselves -এর ন্যায় দুর্বিষহ যানজট নিরসনেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আসলে যানজট নিরসনে বাঙালি জাতির জন্য পৃথক কোন জাদু নেই, নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগে আপাতঃ সমাধান এবং এ মডেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান ছাড়া কোন উপায় নেই।

ভয়াবহ যানজট সমস্যার সমাধানে কয়েকটি সহজ উপায়ের কথা ইতঃপূর্বেও লিখেছি। বিশেষতঃ ঢাকার চতুর্দিক দিয়ে রিং রোড বা সার্কুলার রোড নির্মাণের পাশাপাশি এয়ারপোর্ট থেকে মহাখালী-মগবাজার-যাত্রাবাড়ী এবং মহাখালী-ফার্মগেট-শাহবাগ পর্যন্ত ২ স্তরের ফ্লাইওভার (গ্রাউন্ড লেভেলে স্থানীয় যানবাহন, ১ম ফ্লাইওভারে দূরগামী মোটরযান এবং ২য় ফ্লাইওভারে ট্রেন/ট্রাম) নির্র্মাণের কথা উল্লেখ করেছিলাম। যানজট নিয়ে হা-হুতাশ দেখা গেলেও সেসব প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে এসেছে উন্নততর প্রযুক্তি। তাই এখন চীনা ও জাপানি সমাধানে আমরাও চালু করতে পারি ‘থ্রি ডি এক্সপ্রেস কোচ’। ১২০০ যাত্রীর এ কোচ চলবে সৌরশক্তিতে। এতে অন্যসব গাড়ির ওপর দিয়েই চলে যেতে পারবে সাধারণ যাত্রীরা এবং সে কোচের নিচ দিয়ে অনায়াসে চলাচল করবে অন্যান্য যানবাহন।

উপরোল্লিখিত বহুমুখী প্রকট সমস্যাসমূহ এখনও বেশিরভাগ মানুষের নিকটই স্পষ্ট নয়। তাই এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে আমার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাস। চিন্তাশীল দেশপ্রেমীদের মননে এ প্রকট সমস্যা স্পষ্ট হলেই আমার বা ক্যাম্পাস’র দায় কমবে। কারণ সমাধান বা উত্তরণের পূর্বশর্ত হচ্ছে সমস্যার বিরুদ্ধে তেজোদ্দীপ্ত যোদ্ধা তৈরি করা। দেশমাতৃকার কল্যাণ ও মানবতার স্বার্থ সংরক্ষণের যুদ্ধ কখনই বিফলে যায় না।

জাতীয় বহুমুখী সমস্যার একক সমাধানের অন্বেষায়
উপরে বর্ণিত প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্গতিতে গরীব, অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিতরাই আক্রান্ত হয় সর্বাধিক। এ আক্রান্তদের দায়-দায়িত্ব ঘুরেফিরে আসে সরকার ও সচ্ছলদের ঘাড়ে। এদের প্রতি পিছুটানের ফলে সরকার ও ধনিক শ্রেণী এগুতে পারে না সম্মুখে। তাদের অবস্থা এরূপ- তুমি যারে ঠেলিছ পশ্চাতে, সে তোমারে টানিছে পিছনে। সে কারণে এসব দুর্গতির স্থায়ী সমাধান হচ্ছে- গরীব বা নিম্নবিত্তদের ভাগ্য উন্নয়ন ও তাদের সুবিধাবঞ্চনা দূর করে দেয়া, অন্যকথায় তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলা।

অবশ্যম্ভাবী এ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে যেমনি স্থায়ী ও টেকসই প্রতিরোধ বা মোকাবেলা ব্যবস্থা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দুর্গতদের দুর্ভোগ মোচনে স্থায়ী ব্যবস্থা। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট দুর্গতি মোচনের ওপর। এরূপ উন্নয়ন-পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। তাই গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ পরিচালনায় বর্তমান ইউনিয়নসমূহকে ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনিক একক (Managerial or Administrative unit) হিসেবে চিহ্নিত করে একে উন্নয়ন-অর্থনীতির সকল কর্মযজ্ঞের কেন্দ্র হিসেবে ঢেলে সাজানো যায়। এভাবে ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়ন-পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ; প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা; যানজট, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তাসহ জাতীয় সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

দেশের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি অনিবার্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দারিদ্র্যের প্রকোপ থেকে দরিদ্রদের রক্ষাকল্পে কয়েকটি বিকল্প ও সম্পূরক প্রস্তাব রয়েছে আমার। তন্মধ্যে একটি প্রস্তাব হচ্ছে অত্র মডেল। এ প্রস্তাবটি আমার মাথায় আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে UOTC (যা পরবর্তীতে BNCC-তে রূপান্তরিত হয়) -এ কাজ করতে গিয়ে। ফলিত অর্থনীতি তথা অর্থ ও হিসাব বিজ্ঞানের নগণ্য ছাত্র হিসেবে এ প্রস্তাব বা মডেল আমার একান্ত চিন্তার ফসল। সমাজ ও দেশের টেকসই বা স্থায়ী উন্নয়নের পন্থা হিসেবে আমার এ চিন্তার সাথে ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে একমত হওয়া কারো কারো পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সামষ্টিক স্বার্থকে বা দেশ ও জাতির কল্যাণকে অধিক গুরুত্ব দিলে আমার এ প্রস্তাব কিঞ্চিৎ হলেও বিবেচনার দাবি রাখে বলে দৃঢ় বিশ্বাস।

নিম্নোক্ত মডেল অনুযায়ী ইউনিয়নভিত্তিক সমাজ কাঠামো তথা ‘ইউনিয়ন শহর’ গড়ে তুললে একদিকে যেমন গ্রামীণ মানুষের দারিদ্র্য দূর হবে, অন্যদিকে অবশ্যম্ভাবী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলাসহ জাতীয় বহু সমস্যার সমাধানও সহজ হয়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতি হবে সুউন্নত; সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে পুরো দেশই ধনী দেশে পরিণত হবে স্বল্প সময়ে।

ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়ন রূপরেখা
বর্তমানে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের মূল ভিত্তি হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। বিভিন্ন ইউনিয়নের সমন্বয়ে উপজেলা এবং বিভিন্ন উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জেলা। তাই ইউনিয়নবাসীদের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে Social Capital সৃষ্টি করা এবং গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ পরিচালনায় ইউনিয়ন শহর গড়ে তোলার প্রয়াসে প্রণীত হয়েছে ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়ন মডেল। প্রস্তাবিত মডেল অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নে একটি ইউনিয়ন সমিতি গঠিত হবে, যা স্থানীয় সরকারের ন্যায় ইউনিয়নের সকল কর্মকাণ্ডের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে। এ সমিতির অধীনে থাকতে পারে গ্রাম সমিতি। সার্বিক এ কাঠামোটি বর্তমানের ইউনিয়ন কাউন্সিলের আদলে হলেও এর গঠন, কার্যপদ্ধতি ও লক্ষ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন, যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা পরবর্তীতে দেয়া আছে। স্থায়ীভাবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এসব ইউনিয়ন সমিতিকে সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার একক বা unit হিসেবেও সুদৃঢ় করা যেতে পারে।

ইউনিয়নে খাতওয়ারী ভূমি বন্টন হারঃ ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রতি ইউনিয়নের ভূমিকে কমবেশি ৬ ভাগে ভাগ করতে হবে। তন্মধ্যে ১ ষষ্ঠাংশে থাকবে আবাসিক এলাকা; ১ ষষ্ঠাংশে থাকবে স্থানীয় প্রশাসন (ইউনিয়ন পরিষদ, সালিশকেন্দ্র, পুলিশ-আনসার কেন্দ্র), হেল্থ সেন্টার ও হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ-বাজার, ট্রেনিং এন্ড মিডিয়া সেন্টার, পার্ক, খেলার যথোপযুক্ত মাঠ ইত্যাদি অর্থাৎ প্রথম ২ ষষ্ঠাংশ মিলিয়ে হচ্ছে ইউনিয়ন শহর; ১ ষষ্ঠাংশে থাকবে খামার বাড়ি (যেখানে মৎস্য এবং গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগী-কবুতরসহ নানা জাতের গবাদি পশু-পাখি উৎপাদিত হবে); বাকি ৩ ষষ্ঠাংশ জমি তথা মোট ভূমির অর্ধেক থাকবে কৃষিকাজের জন্য।

চাষাবাদ পদ্ধতি, কাঁচামালভিত্তিক গুদাম ও কারখানাঃ চাষাবাদ হবে ‘কালেকটিভ ফার্মিং’ পদ্ধতিতে। কারণ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিফলন বাড়াতে হলে কালেক্টিভ ফার্মিংয়ের বিকল্প নেই। তাছাড়া কৃষিপণ্য ফলানো হবে মাটির ধরন অনুযায়ী। যে এলাকার মাটিতে যে ফসল বেশি হবার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে সে ফসলই ফলানো হবে; যে এলাকায় যে শস্য উৎপাদনের সুযোগ কম, তা অন্য এলাকা থেকে যোগান দিয়ে ঐ ইউনিয়নের চাহিদা মেটানো হবে। যে ইউনিয়নের মাটি কোন ধরনের ফসলের অনুকূল নয় -সে ইউনিয়নে কুটির শিল্প ও অকৃষিজ কারখানা অথবা সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। তাও সম্ভব না হলে সেখানে বিদ্যুতের চাষাবাদ হবে, যে সম্পর্কে পরের অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে।model
ফসলী জমির সন্নিকটে অর্থাৎ খামারের সাথে থাকবে কৃষিজাত পণ্যের গুদাম ও কৃষিভিত্তিক কারখানা। যে এলাকার মাটিতে প্রচুর টমেটো হয় সেখানে টমেটো জুস-সস-আচারের কারখানা এবং যে এলাকায় আলু বেশি হয় সেখানে আলুভিত্তিক বিভিন্ন কারখানা স্থাপিত হবে। অনুরূপভাবে ভুট্টা, গম, আখ, সরিষা, চিনা বাদাম, আনারস, সয়াবিন, গাজর, পেঁপে, কলা, লেবু, সিম, বরবটি, মাশরুম প্রভৃতির ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট এলাকায় অনুরূপ শিল্প-কারখানা স্থাপিত হবে।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনঃ গবাদিপশুর খামারে থাকবে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, যা দিয়ে জ্বালানি-গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। মানুষ ও পশু-পাখির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হবে বায়োগ্যাস। তাই বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের সাথে আবাসিক এলাকার টয়লেটসমূহের সংযোগ থাকবে। প্রয়োজনে খামারের সাথে থাকবে সৌর-বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং উইন্ডমিল বা বায়ুকল।

ইউনিয়ন শহর (ফ্ল্যাট ভবন, শপিং সেন্টার ও নাগরিক সুবিধা): আবাসিক এলাকার ভবনসমূহ হবে ৬ তলাবিশিষ্ট, যা ভূমিকম্প রোধে সক্ষম করে নির্মিত হবে। তবে ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের বিবেচনায় এসব ভবনের ফাউন্ডেশন থাকবে ১০/১৫ তলাবিশিষ্ট; নিচতলা খালি থাকবে (বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার পাশাপাশি গ্যারেজ সুবিধাসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিসের জন্য), বাকি ৫ তলায় ২টি করে ফ্ল্যাট থাকবে এবং প্রত্যেক ফ্ল্যাটের দু’দিক খোলা থাকবে। এভাবে প্রতি ১০ পরিবারের বসবাসের জন্য নির্মিত হবে একটি ভবন। এরূপ ২০টি ভবন বা ২০০ পরিবার নিয়ে গঠিত হতে পারে উপ-সমিতি বা গ্রাম সমিতি। উপ-সমিতির অধীন ১টি সমিতি অফিস, ১টি মিলনায়তন বা কমিউনিটি সেন্টার, ১টি খেলার মাঠ ও পার্ক, ১টি করে উপাসনালয়, ফার্মেসীসহ ১টি সুপারস্টোর, ১জন সাধারণ ডাক্তার, ২জন নার্স প্রভৃতি নৈমিত্তিক ও জরুরি বিষয় থাকতে পারে।

ইউনিয়ন সেন্টারে এক বা একাধিক প্রাইমারী ও হাইস্কুল এবং কলেজ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়, টেকনিক্যাল কলেজ ও মেডিকেল কলেজ থাকবে উপজেলা বা জেলা শহরে। ইউনিয়ন শহরে থাকবে সুপারশপ ও শপিংমল, সাইবার ক্যাফে ও কল সেন্টার, পাবলিক ট্রেনিং এন্ড মিডিয়া সেন্টার; সেখানে বাজার বসবে, থাকবে ব্যবসা-পল্লী।

রাস্তাঘাটঃ বর্তমানের আঁকাবাঁকা ও সরু পথ বা রাস্তা বা সড়ক বাতিল হয়ে নির্মিত হবে সোজাভাবে ২/৩ লেনের আন্তঃইউনিয়ন রাস্তা, যাতে কোন যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে পড়ার সুযোগ থাকবে না। এসব রাস্তার গন্তব্য হবে উপজেলা ও জেলামুখী সড়কের দিকে। কৃষি জমির শস্য ও পশু-খামারের উদ্বৃত্ত পণ্য-সামগ্রী জেলা শহরে, বিভাগীয় শহরে ও বন্দরে দ্রুত পৌঁছানোর উপযোগী কয়েক লেন বিশিষ্ট সোজা রাস্তা হবে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে। এতে টাটকা শস্য সুলভ মূল্যে পেয়ে যাবে শহরবাসী, অন্যদিকে ফসলের ন্যায্য দাম লাভে সক্ষম হবে উৎপাদনকারী।

বনায়ন ও পরিবেশ রক্ষাঃ সকল রাস্তা ও সড়কের ধারে ঔষধি, ফলদ ও বনজ গাছ থাকবে। তাছাড়া ইউনিয়নের চতুর্দিকে সীমানা জুড়ে হবে অনুরূপ বৃক্ষ চাষ। সকল ভবনের ছাদে ফুল-ফল-ঔষধি গাছ চাষের পাশাপাশি সৌর-বিদ্যুতের চাষ হবে। পরিসর ও সুযোগ অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ফল-ফুল, ঔষধি ও বনজ বৃক্ষের বিচ্ছিন্ন বনায়ন ছাড়াও পরিবেশ ভারসাম্যের জন্য ইউনিয়নের ২০% ভূমিতে বনায়নের নিশ্চয়তা থাকবে।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও পানি ব্যবস্থাপনাঃ tarbain
এ মডেলে রেসিডেন্সিয়াল এন্ড ফার্মিং সিস্টেম এমনভাবে করা হবে, বন্যা-ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস যাতে মানুষ বা গবাদিপশুর ক্ষতি করতে না পারে।তারপরও বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলার বাড়তি পদক্ষেপ হিসেবে উপকূলীয় ইউনিয়নসমূহের চতুর্দিকে দেয়াল নির্মাণ করা যেতে পারে এবং ইউনিয়ন শহরের প্রবেশ রাস্তায় সøুইস গেইটের আদলে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের পানি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে সিদ্ধহস্ত হল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও সহযোগিতা কাজে লাগানো যায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও পানি ব্যবস্থাপনা এমন হবে যে, ঝড়কে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং জলোচ্ছ্বাসকে সেচ কাজে লাগানো হবে। অর্থাৎ বর্তমানের অভিশাপরূপী ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসকে মানুষ তখন গ্রহণ করবে আশীর্বাদরূপে।

ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়ন মডেলে দুর্যোগ মোকাবেলার সরাসরি কার্যকারিতা
ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়ন মডেল বাস্তবায়ন হলে কেউ গৃহহীন বা দরিদ্র থাকবে না। সকলেই পাকা ঘর তথা দালান বা ফ্ল্যাটে বসবাস করার ফলে কাউকেই ছুঁতে পারবে না বন্যা-ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস। ফলে প্রাণহানির কোন আশংকা থাকবে না। উপকূলীয় ইউনিয়নের চতুর্দিকে শক্ত প্রাচীর ও স্লুইস গেটের আদলে প্রবেশ গেট থাকার ফলে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস ব্যাপক হলেও তা মানুষ বা গবাদি পশুকে ছুঁতে পারবে না।

বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, বায়ুকল, সোলার সেন্টার ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার স্থায়ী সমাধান
ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের যে পানি বর্তমানে অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত, সে পানিকেই আশীর্বাদরূপে কাজে লাগানো কঠিন কিছু নয়। প্রকৃতির লীলাকে প্রতিহত করার চেয়ে আলিঙ্গনের মাধ্যমে তাকে কাজে লাগানোই ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ -এর বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার পরিচায়ক বলে আমি মনে করি। তাই এ মডেলে পরিকল্পিত উপায়ে পানি ও বায়ু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ কৃষি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা থাকবে। পানি নিয়ন্ত্রণে হল্যান্ডের দৃষ্টান্ত এবং ঝড়ো হাওয়া বা বাতাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ প্রস্তাবনায় উপস্থাপিত ‘বিদ্যুতের চাষাবাদ’ শীর্ষক মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।

বাতাসের মাধ্যমে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রযুক্তি বেশ পুরনো, অথচ আমরা এখনো সে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরুই করিনি। আমেরিকার রকপোর্ট শহরসহ বিভিন্ন স্থানে এভাবে বাতাসের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় এবং তা সংশ্লিষ্ট শহরের চাহিদা মিটিয়ে অন্যত্র সরবরাহ হচ্ছে। রকপোর্টে ৭৫টি টারবাইন বসানো হলেও সে শহরে ব্যবহৃত হয় মাত্র ৪টি টারবাইনের বিদ্যুৎ। মিসৌরি ইউনিভার্সিটির এক গবেষক বলেন, ‘আমরা এখানে বিদ্যুতের চাষাবাদ করছি। প্রতি একরে অন্য ফসলের তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশ লাভজনক’। মিসৌরির এ বিদ্যুৎ-প্রকল্প থেকে সরকার বছরে ১.১ মিলিয়ন ডলার কর পাচ্ছে। শুধু আমেরিকাই নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় টারবাইন ঘুরিয়ে অর্থাৎ বাতাস দিয়ে। প্রাকৃতিক উপাদান বা শক্তি দিয়ে মানুষের চাহিদা মেটানোর এসব বিজ্ঞান এখন আর নতুন নয়।

বাংলাদেশের চরাঞ্চলে পতিত রয়েছে ব্যাপক জমি, যেখানে কোন ফসল উৎপাদন হয় না -এরূপ জমিতে বাতাস চালিত টারবাইন বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা খুবই সহজ। আমেরিকা ও ইউরোপের উক্ত প্রযুক্তির অনুকরণে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকগণ বিদ্যুতের সে সহজ উৎপাদনের বিষয়ে না গিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বড় বড় কনফারেন্স রুমে আলো ঝলমল সভায় সাংবাদিকদের মহাবিবৃতি দিয়েই যাচ্ছেন। নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পতো করছেনই না, বরং পুরনো প্রকল্পের বিদ্যুৎ তাঁরা সাবাড় করে যাচ্ছেন ‘পরি’ হীন পরিকল্পনা করতে করতে। কর্তা ও আমলাদের বিদ্যুৎ যোগানোয় ব্যস্ত পিডিবি’র ফুরসত কোথায় আমাদের ন্যায় কামলাদের জন্য কিছু করার!

সাগর পাড়ে ও নদীতীরে বায়ু প্রবাহ বেশি থাকে বিধায় সেখানে লাইন ধরে উইন্ড-মিল বা বায়ুকল স্থাপন করা যায়। এমনকি ইউনিয়নসমূহের প্রস্তাবিত সীমানা-দেয়াল জুড়ে উইন্ড-মিলের সুউচ্চ পিলার স্থাপন এবং সে পিলারের নিচ দিয়ে বৃক্ষরোপণ করা যায়। এভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি ব্যাপক বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষাতো হবেই, অধিকন্তু সুন্দরী ও গর্জন কাঠের তর্জনই বলে দেবে- ওহে হতভাগা, তোমাদের কাঠের কোন অভাব নেই, বরং বিদেশে কাঠ রপ্তানি করেও পেতে পার বৈদেশিক মুদ্রা। তাছাড়া চরাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে উপরোক্তরূপে বায়ুকল বা টারবাইন স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুতের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য শহর ও শিল্প-কারখানার বিদ্যুৎ যোগানো সম্ভবতো বটেই, তদুপরি বিদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কঠিন নয়। বায়ুবিদ্যুৎ প্যানেলের মাধ্যমে বজ্রপাত থেকেও চরাঞ্চলের মানুষকে রক্ষা করা যাবে।

সোলার এনার্জি বা সূর্যরশ্মি থেকেও প্রচুর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে, যদিও বর্তমানে স্বল্প মাত্রায় হচ্ছে। তাই আলোচ্য উন্নয়ন মডেলে সোলার সেন্টার স্থাপনের ব্যবস্থাও থাকবে। মডেলে উল্লিখিত আবাসিক সকল ভবন যেহেতু একই উচ্চতায় নির্মিত হবে, তাই এসব ভবনের ছাদে ঔষধি ও ফলদ গাছের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ চাষের সুযোগ থাকবে অবারিত।

ডেনমার্কের একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ৩৫ ফুট দীর্ঘ বিস্ময়কর স্পীড বোট আবিষ্কার করেছে, যা চলে কেবল সৌর-শক্তিতে। ২০০৫ সাল থেকে প্রতিবছরই নর্থ-আমেরিকায় সৌরশক্তি চালিত গাড়ির রেস অনুষ্ঠিত হয়। এসব গাড়িকে পাড়ি দিতে হয় ২৪০০ মাইল। অনুরূপভাবে সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন থেকে “সোলার ট্যাক্সি” (www.solartaxi.com) বিশ্বভ্রমণের কথা অনেকেই জানেন। সৌর চালিত এ ট্যাক্সি ৩৮ দেশ তথা ৫২ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছে অনায়াসে। এমনকি আমার ন্যায় বাঙাল এক ‘কাঙাল’ বগুড়ার আমির হোসেনও সম্প্রতি তেল-মবিলহীন গাড়ি ‘রফ রফ তাহিয়া’ আবিষ্কার করে বিজ্ঞজনদের দেখিয়ে দিয়েছেন, মাথা খাটিয়েই বড় বড় অভাব ও সমস্যা দূর করা সম্ভব।

সম্প্রতি ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্য ক্রাউন হোটেল বিদ্যুৎ উৎপাদনে নয়া পদ্ধতি চালু করেছে। এ হোটেলের অতিথিরা ১৫ মিনিট সাইকেল চালিয়ে ১০ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে সে অতিথিদেরকে ৩৬ মার্কিন ডলার মূল্যের খাবারের টোকেন দেয়া হয় বিনামূল্যে। সাইকেলের সঙ্গে আইফোন সংযুক্ত থাকে, যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ জানা যায়। এ প্রক্রিয়ায় সাইকেল চালিয়ে ৩টি উদ্দেশ্য সাধিত হয়- ক) দূরত্ব অতিক্রমণ, খ) ব্যায়াম ও বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ) আর্থিক লাভ। উল্লেখ্য যে, সেখানকার কর্মজীবীদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ প্রতিদিন সাইকেল চালিয়েই কর্মস্থলে যায়। এভাবে সোলার এনার্জি এবং কনসেন্ট্রেটেড সোলার এনার্জির উন্মেষ ও বিকাশের মাধ্যমে তেল-পাগলা বিশ্বনেতাদের পাগলামি প্রশমনও সম্ভব।

আবার বায়োগ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান করা যায় অনায়াসে। সম্প্রতি ফরিদপুর জেলা সফরকালীন এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলী এবং ফরিদপুরের সুসন্তান ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল হাসান দেখালেন, কিভাবে সেখানকার মুসলিম মিশন মাত্র কয়েকটি গরুর বর্জ্য এবং মিশনের হোস্টেলবাসীদের বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার স্থায়ী সমাধান করে ফেলেছে। এমনকি শেরপুর সদরের কালিগঞ্জ গ্রাম আলোকিত হয়েছে মুরগির বিষ্ঠা থেকে উৎপাদিত গ্যাস দিয়ে। কালিগঞ্জ গ্রামের কে নাহার পোলট্রি ফার্মে মুরগীর বিষ্ঠা থেকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে পোলট্রি কমপ্লেক্সে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের পাশাপাশি আশপাশের বাসাবাড়িতেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে রান্নার কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে বায়োগ্যাস। এ ফার্মের স্বত্বাধিকারী আবুল হাসেমের মতে- দেশের সকল পোলট্রি খামারের মালিক যদি এ রকম প্ল্যান্টের মাধ্যমে বিকল্প বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনের চিন্তা করেন অথবা সরকার যদি তাদেরকে অনুরূপ প্ল্যান্ট স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন, তাহলে দেশ বিদ্যুৎ ও গ্যাসসংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারবে।

নৈরাশ্যবাদী হাবাগোবারা বলে বেড়ায়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এত বেশি যে এ জনসংখ্যার চাপে উন্নয়ন কর্মকা- বিফলে যাচ্ছে। কিন্তু তারা বুঝতেই চাচ্ছে না যে, সরকার ও সমাজপতিদের অব্যবস্থাপনার কারণে স্রষ্টার দান এসব মানুষ রাস্তায় কিলবিল করছে, চেঁচামেচি করছে; এদেরকে যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে সৃজনশীল হিসেবে এরাইতো বিশ্বব্রহ্মান্ডের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগালে এ বিপুল জনসংখ্যার মল-মূত্র দিয়েই অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। মানুষ ও পশুর বর্জ্য বা মল দিয়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সার উৎপাদনের কথা বহুপূর্ব থেকেই আমরা জানি; কিন্তু জেনেও কাজে লাগাই না। মলমূত্র ত্যাগের পর তা থেকে গ্যাস উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে মাত্র ২৩ দিন সময় লাগে। মানববিষ্ঠা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া যুক্তরাজ্যেও বেশ ভালভাবে চালু রয়েছে।

কিন্তু এরূপ প্রাকৃতিক উপায়ে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর বা মহা সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা। উদভ্রান্ত ও বিশৃঙ্খল বসবাস তথা যার যেখানে ইচ্ছা অট্টালিকা-বাড়ি বা মাচা পেতে দিলেতো সম্পদরূপী মলমূত্র সংগ্রহ যেমনি অসম্ভব, তেমনি সভ্য-সুউন্নত নাগরিক জীবনও সুদূরপরাহত। এতো গেল গ্রামীণ জীবনে বিদ্যুৎ যোগানের কথা। শহুরে জীবনেও বিদ্যুৎ সংকুলানের সুযোগ রয়েছে নানাভাবে, যে বিষয়ে বহু হিতৈষী বহুভাবে বলেছেন। তাঁদের সাথে সুর মিলিয়ে আমার বাড়তি চিন্তা হচ্ছে, রাজধানীর মানুষের মূত্র দিয়েই আগামীতে রাজপথের গাড়ি চালানো সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। তাদের আবিষ্কৃত প্রযুক্তির ব্যবহারে মূত্র-জ্বালানি নির্ভর গাড়ি শীঘ্রই বাজারজাত হবে। এ নতুন প্রযুক্তিতে মূত্র থেকে সস্তায় হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদনের জন্য নিকেলযুক্ত ইলেকট্রোড ব্যবহার করবেন বিজ্ঞানীরা।

বাংলাদেশে নির্বাচনে হারজিতের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিদ্যুতের সার্বিক চাহিদার কৃত্রিম সমাধান করলে এ জাতি আগামীতে আরও গভীর সমস্যায় পড়বে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান রসদ যে গ্যাস বা কয়লা, সে গ্যাস বা কয়লা ২০ বছর পর শেষ হয়ে গেলে তখন কি হবে? তাই সৌর (যা উজবেকিস্তানে ব্যাপক ব্যবহৃত), জৈব ও বায়ুকলের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিদ্যুতের চরম সমস্যার সমাধানে এখনই জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ না করলে এ অবারিত সম্ভাবনাময় জাতি কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়নের অত্র মডেল বাস্তবায়নেই প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্ট সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিহিত।

বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে বেসামরিক ও সামরিক বাহন সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে পেট্রোল, কয়লা ও গ্যাসের মজুদ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এসব খনিজ সম্পদ শেষ হয়ে গেলে কি হবে- তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ, হানাহানি ও যুদ্ধ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তেল নিয়ে তেলেসমাতি এবং তেল নিয়ে তেলায়েতি ও চালিয়াতি করতে করতে বাঘা বাঘা রাষ্ট্র-নায়কের মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটেছে। তাই উন্মাদনা ও মাতলামিতে তেল-ভূখ- ছিনতাই ও জবর দখলের খেলা চলছে হরদম। ফুটপাতের টোকাই বা ছিনতাইকারীকে আটক করতে পুলিশ তৎপর থাকলেও বুশ -এর ন্যায় তেল ছিনতাইকারীদের ধরার বুঝিবা কেউ নেই।

জবর দখলের কোন যুদ্ধ কখনই শান্তি আনেনি। বরং এরূপ যুদ্ধে নেমে নিজ সম্পদ হারানোসহ ধ্বংস করেছে অমূল্য বিশ্বসম্পদ, তৈরি করেছে বিশ্বসংকট, বৃদ্ধি করেছে তেল-ডলারের দাম, সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী দুর্ভোগ-অরাজকতা-অশান্তি। আগেকার যুদ্ধে পরীক্ষা হত মানুষের শক্তির, আর এখনকার যুদ্ধে পরীক্ষা হয় যন্ত্রশক্তির। তাই যন্ত্রনির্ভর যুদ্ধ পরিচালনাকারী দানবরা যুদ্ধের নামে নিরস্ত্র-নিরীহদেরকে হত্যা-নির্যাতন করে যাচ্ছে অবলীলায়। কিন্তু যে দানবের অঙ্গুলি হেলনে ধ্বংস হচ্ছে বিশ্ব-সম্পদরাজি, হতাহত হচ্ছে সামরিক-বেসামরিক অগণিত মানুষ, সে দানবের বিচার হচ্ছে না কোন আদালতে। বড় মাছরা আদালতের অক্টোপাস এমনই কারিশমায় নির্মাণ করে রেখেছে যে, আদালত-ফাঁদ বা কাঠগড়া শুধুই ছোট ও মাঝারি মাছের জন্য। অন্যায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করাটা মানুষের যে সর্বাধিক বড় পুণ্য -সে পুণ্যের যুদ্ধ এখন উবে যাচ্ছে। তাই আমাদের সবার উচিত, দানবিক যন্ত্র-যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানবিক মহাযুদ্ধ ঘোষণা করা।

আমার মতে, তেলের জন্য বিশ্ব তেলেসমাতি তথা যুদ্ধ-হানাহানি না বাড়িয়ে বাড়ানো উচিত মানব কল্যাণের সেই গবেষণা -যাতে মহান প্রকৃতি থেকেই ব্যাপক শক্তি আহরণ ও ব্যবহার করা যায়। এক কথায় জৈব গ্যাস, উইন্ডমিল (বায়ুকল), সৌর-বিদ্যুৎ এবং পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ শুধু টিউবলাইট-ফ্যান বা কারখানাই চালাবে না, এ পরিকল্পনায় উৎপাদিত বিদ্যুৎশক্তি বিদ্যুৎ গতিতে চালাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সাবেক শীর্ষকর্তা ড. ম তামিম সগর্বে বলেছিলেন- আগামী ২০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা রয়েছে বাংলাদেশের। তাঁর ২০ বছরের হিসাব যদি নির্ভরশীলও হয়, তাহলেও উদ্বেগ থেকে যাচ্ছে যে- ২০ বছর পর কি হবে? গ্যাস-কয়লা যখন শেষ হয়ে যাবে তখন আমরা কি করব? কোন পরাশক্তিই আর আমাদের জ্বালানি বা বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাবে না; বরং তারা গুপ্তচরবৃত্তি ও কূটচাল চালাবে আমাদের খনিজসহ বিভিন্ন গুপ্তধন হরণে। ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিয়ে ধনী দেশগুলো যেখানে নিজেরাই বেসামাল এবং ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা’ অবস্থায়, সেখানে আমাদের দরিদ্র দেশ নিয়ে ভাববার অবকাশ কই তাদের!

তাই সমাজে, রাষ্ট্রে ও বিশ্ব পরিসরে বড় মাছ কর্তৃক ছোট মাছ ভক্ষণ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং ধনী কর্তৃক গরীবের ওপর শোষণ-নির্যাতন-মাস্তানি বন্ধের চেতনায় তৈরি হয়েছে ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়নের এ মডেল।

ইউনিয়ন সমিতি বা ইউনিয়ন পৌরসভার গঠন প্রকৃতি
সাগরের দেয়া চরে তথা সরকারি মালিকানার ভূমিতে এ মডেল এখনই বাস্তবায়ন করা যায়। তবে প্রাথমিক ও পরীক্ষামূলকভাবে ‘মডেল ইউনিয়ন শহর’ বাস্তবায়নের যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানার পরিত্যক্ত জায়গায় করা উচিত। কারণ সাধারণ ইউনিয়নে এ মডেল বাস্তবায়ন করতে গেলে ভূমি-মালিকদের কেউ কেউ ভূমি বেহাতের আশংকায় কোন কোন ক্ষেত্রে বাধ সাধতে পারে। তাই সরকারি মালিকানাধীন ইউনিয়নে এ মডেলের পরীক্ষামূলক বাস্তবায়নের সুফল দেখে এবং দেশমাতৃকার স্থায়ী উন্নয়ন ও বংশধরদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে এ বিষয়ে তারা এগিয়ে আসতে কুন্ঠিত হবে না। এ মডেল অনুযায়ী যেহেতু চাষাবাদ হবে ‘কালেকটিভ ফার্মিং’ পদ্ধতিতে, সে লক্ষ্যে ইউনিয়নস্থ ভূমির মালিকানা নিম্নোক্ত দু’টি বিকল্প পদ্ধতিতে স্থির করা যায়।

প্রথমতঃ এ প্রস্তাবে কেউ সরাসরি ভূমি-মালিক থাকবে না, ভূমির মালিক থাকবে ইউনিয়ন সমিতি অথবা ইউনিয়ন পৌরসভা, যাকে ইউনিয়ন সরকারও বলা যেতে পারে। বর্তমান ভূমি-মালিকরা জমি-মালিকানার অনুপাতে ইউনিয়ন সমিতির শেয়ারহোল্ডার হবেন।

এ বিষয়টি বর্তমান ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে ডেভেলপারের সাথে ভূমি-মালিকের চুক্তি বা শর্তের অনুরূপ। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রামে স্বল্প পরিসরে গড়ে ওঠা কনকর্ড লেক সিটি, পিংক সিটি, বসুধা সিটি, স্যাটেলাইট সিটি, ডিজিটাল সিটি প্রভৃতি স্থাপনের প্রক্রিয়ার আদলে গঠিত হতে পারে প্রস্তাবিত ইউনিয়ন সমিতি। একতলা বা দোতলা বাড়ি সংবলিত ভূমির মালিক যেরূপ ডেভেলপারকে তার জমি ও বাড়ি দিয়ে দেয়, বিনিময়ে ঐ জায়গায় নির্মিত ১০০টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৫০টির মালিকানা লাভ করে এবং চুক্তিকালীন একসঙ্গে পেয়ে যায় বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ -সেরূপ এ ইউনিয়ন সমিতিতেও ভূমি মালিকানা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ভূমি-মালিক অনুরূপভাবে লাভবান হবেন।

দ্বিতীয়তঃ ভূমি মালিকদের নিকট মালিকানা স্বত্ব সংরক্ষিত থাকলেও তারা ৫০ বা ১০০ বছর ব্যবহারের নিমিত্তে সমিতির নিকট জমি লিজ দিয়ে সে জমির বিপরীতে শেয়ারহোল্ডার বা বন্ড মালিক হবেন। তারা এ মর্মে নিশ্চয়তা বা ঘোষণা দিবেন যে, সমিতির সর্বত সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে একক কোন সিদ্ধান্ত নিবেন না। তবে এ প্রস্তাবে বর্তমান ভূমি-মালিকদের অধিকার ও সুবিধাকে কোনক্রমেই উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করা যাবে না।

ইউনিয়নের বর্তমান অধিবাসীদেরকে সমিতির সদস্যভুক্ত করে গঠিত হবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন সমিতি। অর্থাৎ ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা বা ভোটার প্রত্যেকে হবেন সমিতির সদস্য। বর্তমানে যার যত পরিমাণ ভূমি রয়েছে, তিনি তত সংখ্যক শেয়ারের মালিক হবেন। এরূপ শেয়ার প্রতি কাঠার জন্য, প্রতি শতাংশের জন্য বা অনুরূপ যেকোন পরিমাণ জমির অনুপাতে বা এককে হতে পারে। ভূমিহীন ব্যক্তিও সমিতির সদস্যভুক্ত হবেন এবং সমিতিতে তার ভোটাধিকার থাকবে, তবে তিনি কোন ভূমির মালিক নন বলে সমিতির শেয়ারহোল্ডার হবেন না এবং সংগত কারণে লভ্যাংশও পাবেন না।

জমি নেই বলে এবং শেয়ার ও লভ্যাংশ পাবার সুযোগ নেই বলে ভূমিহীনকে হতে হবে চাকরিজীবী বা শ্রমজীবী। অর্থাৎ শ্রম ও মেধার বিনিময়ে তার রোজগারের ব্যবস্থা থাকবে। গ্রাম সমিতি বা উপ-সমিতির সুপারিশের ভিত্তিতে তার চাকরির ব্যবস্থা করবে ইউনিয়ন সমিতি। পশু খামারে, ফসলের মাঠে, স্থানীয় ফ্যাক্টরীতে, ব্যবসা কেন্দ্রে, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল, ট্রেনিং সেন্টার, অফিস-আদালত-নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ইত্যাকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবেই চাকরির সুযোগ তৈরি ও শ্রম সরবরাহের ব্যবস্থা থাকবে। ভূমিহীনরা স্বল্প পরিসরের আবাসিক ফ্ল্যাটে থাকবেন, যা তাদেরকে ১৫/২৫ বছর অন্তর নবায়নযোগ্য লীজ হিসেবে প্রদান করা যেতে পারে।

ইউনিয়ন সমিতি হবে বাণিজ্যিক কোম্পানীর আদলে অথবা মিউনিসিপ্যালিটিরূপে। তবে এর লক্ষ্য হবে সুষম-সেবার মাধ্যমে ইউনিয়নভিত্তিক দেশ উন্নয়ন এবং সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি (Maximization of social wealth)। অর্থাৎ মুনাফা অর্জন দ্বারা সমিতির সাফল্য নির্ধারিত হবে না বরং নাগরিক সেবার মাধ্যমে সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি করাই হবে এর লক্ষ্য। এ সমিতির শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য। তাই কর্মসংস্থান ও বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে ভূমিহীন ব্যক্তি কর পরিশোধে সক্ষম হয়ে উঠলে সেক্ষেত্রে তিনি অন্য শেয়ারহোল্ডার থেকে শেয়ার কিনতে পারবেন এবং শেয়ার কেনার পর তিনি শেয়ারহোল্ডার হিসেবে নির্ধারিত সকল সুযোগ ও অধিকার অর্জন করবেন।

ইউনিয়ন পরিষদ কাঠামো এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি
ইউনিয়ন সমিতি বা ইউনিয়ন সরকার বা মিউনিসিপ্যিাল বোর্ড গঠিত হবে সাধারণ সদস্য ও শেয়ার হোল্ডারদের নিয়ে। তারা ভোট দিয়ে, তাদের মধ্য থেকে এবং তাদেরই স্বার্থে এ পরিষদ গঠন করবে। পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২১ বা ৩১ এমনকি ৫১ হতে পারে। এ সংখ্যা নির্ভর করবে সমিতির মোট সদস্য সংখ্যার ওপর। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয় নয়।

ইউনিয়ন পরিষদের অধীন থাকবে স্টাফ-বোর্ড, যারা সমিতির কর্মকর্তা ও কর্মচারী হিসেবে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে। স্টাফ-বোর্ডের প্রধান নির্বাহী থাকবেন অন্য অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী সরকারি বা বেসরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এমনকি প্রকল্পের প্রাথমিক অবস্থায় এ পদে কোন বিদেশীকেও নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদে কয়েকটি উপ-পরিষদ থাকবে। যেমন- কৃষি উপ-পরিষদ, যা কৃষি কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তদারকিতে থাকবে। অনুরূপভাবে পশু খামার উপ-পরিষদ, কারখানা ও বাজার উপ-পরিষদ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উপ-পরিষদ, জন উপ-পরিষদ (ধর্ম পালনের সুযোগ-সুবিধা, বৃদ্ধ নিবাস, নারী কল্যাণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য), সালিশ ও নিরাপত্তা উপ-পরিষদ (ইউনিয়নবাসীদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধ মেটানো, দ্বন্দ্বের কারণ অনুসন্ধান, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পূর্বেই প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য চৌকিদার-ভিডিপি বা আনসাররূপী বাহিনী গঠন ও পরিচালনা) প্রভৃতি।

সাধারণ সদস্যরা ভূমিহীন বলে তাদেরকে সাধারণত ট্যাক্স দিতে হবে না, তবে ভোগ্যপণ্যের জন্য ভ্যাট দিতে হবে এবং চাকরিজীবীরা পর্যাপ্ত আয়ের ওপর ট্যাক্স দিবে। শেয়ারহোল্ডাররাই মূলতঃ ইউনিয়ন-ট্যাক্স প্রদান করবে, এছাড়াও তারা জেলা ট্যাক্স ও কেন্দ্রীয় সরকারে ট্যাক্স দিবে স্বল্প পরিমাণে। ট্যাক্সের পরিমাণ নির্ধারিত হবে কর প্রদানকারী ও সাধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার ওপর। তাদের প্রদত্ত ট্যাক্সে ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত উন্নয়ন কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকবে।

আধুনিক ও স্থায়ী আবাসনঃ আবাসিক এলাকা অন্ততঃ ৩ ভাগে বিভক্ত থাকবে। শেয়ারহোল্ডার ও কর প্রদানকারীদের এলাকা, ভূমিহীন ও সাধারণ সদস্যদের এলাকা, প্রশাসন-সংশ্লিষ্ট এবং সমিতির সদস্য নন -এমন প্রবাসীদের এলাকা। এই ৩ শ্রেণীর মানুষের সুবিধা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ৩ ধরনের ও মানের আবাসিক ভবন বা ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মিত হবে। ফ্ল্যাটসমূহে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা থাকবে। অবাণিজ্যিকভাবে বিতরণকৃত এ গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য নামমাত্র বিল পরিশোধ করতে হবে।

এ মডেলের ভূমিকায় বলেছি যে- অস্থায়ী ও জীর্ণ-শীর্ণ আবাসন ব্যবস্থার কারণে দরিদ্ররা মাথা ঝেড়ে উঠতে পারছে না, নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সামাজিক অস্থিরতা। তাই এ মডেল অনুযায়ী সকল নাগরিকের জন্য স্থায়ী ও আধুনিক আবাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠার ফলে দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পের মত নানা দুর্যোগ থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী; সামাজিক ভারসাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ফলে ধনীরাও পাবে সামাজিক স্বস্তি ও শান্তি।

শিক্ষাঃ স্কুল শিক্ষা ও ধর্ম শিক্ষা থাকবে বাধ্যতামূলক। কলেজ শিক্ষা ও ধর্মচর্চায় থাকবে স্বাধীনতা। স্কুল শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে বৈষম্যহীন ও একমুখী। স্কুলিং হবে অবশ্যই এলাকাভিত্তিক (Areawise Schooling), যার ফলে অভিভাবকের শ্রম-সময় ও অর্থের অপচয় হবে না, থাকবে না সন্তান নিয়ে টেনশন। এক্ষেত্রে গাড়ি ব্যবহারের দরকার পড়বে না; ফলে জ্বালানির সাশ্রয় হবে, রাস্তায় যানজট থাকবে না। একেক শিক্ষক একেক ভবন বা মহল্লা থেকে একেক গ্রুপ ছাত্র-ছাত্রীকে লাইন ধরিয়ে দেশের গান ও জীবনের গান গাইতে গাইতে স্কুলে নিয়ে যাবেন; স্কুলশেষে অনুরূপভাবে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। ছাত্র-ছাত্রীরা শিশুবেলায়ই শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও আবদ্ধ হবে। এলাকাভিত্তিক এ আধুনিক স্কুলিং ব্যবস্থা আমাদের জাতীয় বহু সমস্যার সমাধানও এনে দেবে; আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হয়ে যাবে অর্থনৈতিক নানা সমস্যার; গড়ে তুলবে গুণগত শিক্ষার প্রাথমিক শক্ত ভিত, সহায়ক হবে উন্নততর ও কার্যকর উচ্চশিক্ষা কাঠামো নির্মাণ; বর্তমান বিভাজিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে যে বিভক্ত করে ফেলছে, তা থেকেও রক্ষা পাবে জাতি; হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মত জেএমবি তৈরির সুযোগ থাকবে না শিক্ষাঙ্গনে।

এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ের সুবিধাসমূহ
১। স্কুলে যাতায়াতের জন্য যানবাহনের দরকার হবে না; ফলে যানজট থাকবে না, সড়ক দুর্ঘটনাও হ্রাস পাবে;
২। জাতীয় ক্ষেত্রে জ্বালানি তেল আমদানি ও গ্যাসের অপচয় রোধ হবে; বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং জাতীয় অর্থের অপচয় কমবে;
৩। যাতায়াত সঙ্কট ও যাতায়াত ব্যয় থাকবে না বলে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর পেছনে অভিভাবকের টেনশন থাকবে না এবং অর্থব্যয় হবে না;
৪। সন্তানের জন্য বাবা-মা’র অফিসের গাড়ি বরাদ্দের দুর্নীতি বন্ধ হবে;
৫। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শ্রম ও সময়ের অপচয় রোধ হবে;
৬। সন্তানের স্বার্থেই অভিভাবকগণ নিজ এলাকার স্কুলের উন্নয়নে তৎপর হবেন; সন্তানকে অন্য শহরে বা বিদেশে পাঠাতে হবে না;
৭। ভর্তি-প্রতিযোগিতা না থাকায় ভর্তি-দুর্নীতি দানা বাঁধবে না;
৮। স্কুল পর্যায়ে কোচিং-ব্যবসা ও শিক্ষা-বাণিজ্য বন্ধ হবে;
৯। কোচিং দরকার হবে না বিধায় এক্ষেত্রেও যাতায়াত বন্ধ হবে এবং যানজট থাকবে না;
১০। ড্রপ-আউট থাকবে না; ফলে টিজিং ও মাদকসহ কিশোর অপরাধ হ্রাস পাবে;
১১। মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে; শিশু-কিশোর বয়সেই শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, টিম-স্পিরিট, শেয়ারিং, স্মার্টনেস ইত্যাকার শিক্ষালাভ সহজ হবে;
১২। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভাজন হ্রাসের ফলে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য হ্রাস পাবে;
১৩। সামগ্রিকভাবে স্কুলে শিক্ষার মান ও পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে;
১৪। শিশুর জন্ম ও ক্রমবৃদ্ধির সঠিক ও যথাযথ পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব হবে;
১৫। মেধাবী ও প্রতিভাবান জাতি এবং জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন সহজ হবে।

এলাকাভিত্তিক স্কুলিং হলে প্রাথমিক শিক্ষার মজবুত ভিতের ওপর তৈরি হবে উচ্চ শিক্ষার কাঠামো, যে কাঠামোতে প্রবেশাধিকার থাকবে শুধু মেধাবীদের। শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত এই মেধাবী শ্রেণীই তৈরি হবে দেশের শিক্ষা, গবেষণা, সরকার ও রাজনীতি পরিচালনার জন্য। এক কথায় মেধাবী এ শিক্ষার্থীরাই একদিন মেধাবী ও প্রতিভাময় জাতিতে পরিণত হবে। একটি মেধাবী প্রজন্ম সহজেই বদলে দিতে পারে সমাজ, দেশ কিংবা সমগ্র বিশ্বকে। তাই বাংলাদেশে ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়নের এ মডেল বাস্তবায়িত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই গড়ে উঠবে মেধাবী প্রজন্ম এবং সর্বক্ষেত্রে তৈরি হবে যোগ্য নেতৃত্ব।

কর্মসংস্থানঃ একদিকে বেকারত্ব বৃদ্ধি ও আয় হ্রাস, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া; ফলে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধিষ্ণু হচ্ছে দারিদ্র্যের হার। এ মডেল বাস্তবায়ন হলে ইউনিয়ন সমিতির বিভিন্ন অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাকেন্দ্র, কারখানা, খামার ইত্যাকার কর্মমুখর ক্ষেত্রসমূহে ব্যাপক কর্মসংস্থানের স্বাভাবিক সুযোগ থাকবে। তাছাড়া ইউনিয়ন কেন্দ্রে থাকবে সাইবার ক্যাফে, কল সেন্টার ও ট্রেনিং সেন্টার।

যে ইউনিয়নে ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি, সেখানকার ইউনিয়ন কেন্দ্রে অধিক কম্পিউটার সেন্টার, কল সেন্টার এবং বর্তমান গার্মেন্টস’র মত শ্রমভিত্তিক (labor intensive) শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হবে। ইউনিয়ন সমিতি পরিচালিত এসব সেন্টারে ব্যাপক কর্মসংস্থান হওয়ার ফলে একদিকে বেকার সমস্যার সমাধান হবে, অন্যদিকে ইউনিয়ন সমিতিরও প্রচুর আয় হবে; তদুপরি বৃদ্ধি পাবে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব আয়।

আসলে জনসংখ্যা সে দেশেই সমস্যা, যে দেশের জননেতারা জনগণের কর্মসংস্থান ব্যবস্থায় দুর্বল। অন্যদিকে জন-কর্মসংস্থানে সক্ষম ও দক্ষ নেতার হাতে পড়লে সে জনসংখ্যাই হয়ে ওঠে জনসম্পদ। বাংলাদেশের মত জন-সম্পদশালী দেশ বিশ্ব দরবারে ঈর্ষণীয় শক্তিরূপে আবির্ভূত হওয়া বহুপূর্বেই ছিল স্বাভাবিক; যেরূপ ঘটেছে চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে। জনসংখ্যার বিপুলতায় সর্বদাই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা অদক্ষতা ও অদূরদর্শীতার বিষয়ও বটে। দক্ষ নেতৃত্বের হাতে পড়লে আমাদের এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ইতিবাচক দিকগুলোই ভেসে উঠতো। বিশাল জনগোষ্ঠী মানে বিশাল মার্কেট, বিশাল বিনিয়োগের সুযোগ, বিশাল উৎপাদন, বিশাল বিক্রয়, বিশাল লাভ, বিশ্ব-পরিসরে বিশাল শক্তিও বটে।

বিচারঃ সামাজিক অনাচার ও হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জন্য বর্তমানে থানা বা কোর্ট-কাচারীতে আশ্রয় নিতে গেলে সেখানেও হয়রানির শিকার হয় সাধারণ মানুষ। তাই এ মডেল অনুযায়ী সালিশ ও বিচার ব্যবস্থা থাকবে মানুষের দোরগোড়ায়। যেকোন দ্বন্দ্ব বা বিরোধ প্রথমে গ্রাম সমিতিতে উত্থাপিত হবে। সেখানে সমাধান না হলে ইউনিয়ন সমিতির সালিশ ও নিরাপত্তা উপ-পরিষদে যাবে। গ্রাম সমিতি না থাকলে ইউনিয়ন সমিতিতে দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তির সুযোগ থাকবে। ইউনিয়ন সমিতিতে সমাধান না হলে তা উপজেলাস্থ আদালতে যাবে। এরপর প্রয়োজনে দেশের প্রচলিত আইনে জজকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্তও তা গড়াতে পারে।

পাবলিক ট্রেনিং এন্ড মিডিয়া সেন্টারঃ ইউনিয়নবাসীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, আত্মোন্নয়ন ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, ঐক্যবদ্ধতা, নীতি-নৈতিকতাসহ বিভিন্ন মানবিক গুণাবলী উন্নয়নের প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশনের জন্য প্রত্যেক ইউনিয়নে চালু থাকবে পাবলিক ট্রেনিং এন্ড মিডিয়া সেন্টার। অর্থাৎ জীবনকে যাপনযোগ্য করার যাবতীয় প্রোগ্রামিং বা হিউম্যান ওয়ারিংয়ের পাশাপাশি কৃষি, স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস, খাদ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নিয়মিত নিবিড় প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা থাকবে। যেমন- হারবাল খাদ্য ও পথ্য গ্রহণের মাধ্যমে রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা বজায় রাখার বিষয়ে অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মানুষকে প্রশিক্ষিত করা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে উন্নত, আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত জীবন যাপনে জনগণকে প্রশিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা থাকবে এরূপ ট্রেনিং সেন্টারে। ইউনিয়নবাসীর প্রয়োজনীয় বিভিন্ন তথ্যের সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হবে এটি।

ইউনিয়নভিত্তিক এ মডেল বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত বলে কেউ মনে করলে সেক্ষেত্রেও সরকারি নেতৃত্বে এনজিওসমূহের মাধ্যমে এরূপ ট্রেনিং এন্ড মিডিয়া সেন্টার এমূহুর্তেই বাস্তবায়ন শুরু করা যায় এবং দেশব্যাপী এ যুগোপযোগী কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক আলোকিত জাতি অচিরেই গড়ে তোলা সম্ভব। উচ্ছল-উজ্জ্বল আলোকিত জাতি গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের বিকল্প নেই, যা বাস্তবায়নে প্রয়োজন শুধু আলোকিত সরকার।

চিকিৎসা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য সুবিধাঃ প্রত্যেক ইউনিয়নে আধুনিক হাসপাতাল ও উন্নত স্বাস্থ্য সুবিধা থাকবে সবার জন্য। তাছাড়া ইউনিয়ন হেল্থ সেন্টারে সমিতির সকল সদস্যের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষিত হবে এবং কম্পিউটারে বাটন টিপেই প্রত্যেকের স্বাস্থ্যগত তথ্য বা হিস্ট্রি জানা যাবে, তাছাড়া প্রত্যেক অধিবাসীর নিকট থাকবে হেল্থ কার্ড। তার কখন কি অসুখ হয়েছে, কখন কি চিকিৎসা করিয়েছেন বা কি কি ঔষধ খেয়েছেন সেসব তথ্য থাকবে এ কার্ডে। কোন ব্যক্তি ইউনিয়ন পরিবর্তন করলে তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ডাটাবেজ স্থানান্তরিত হবে পরিবর্তিত ইউনিয়নে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে পরিবারপ্রতি অনধিক ২ সন্তান গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। তবে ৩ এর বেশি সন্তান জন্ম দিলে সে পরিবারের সুযোগ-সুবিধা হ্রাস অথবা অধিক করের আওতায় আনার ব্যবস্থা থাকতে পারে।

ইউনিয়ন কেন্দ্রে বা শহরে পার্ক, খেলার মাঠ ও বৃদ্ধ নিবাসসহ বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে। এসব সুযোগ-সুবিধা এমন হবে যে, ঢাকা-চট্টগ্রামের দুর্বিষহ কোলাহল ছেড়ে তখন ব-ড় লোকরাও ইউনিয়ন সেন্টারে থাকতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম বা বড় নগরীর রাস্তায় থাকবে না নাগরিক ভোগান্তি।

‘ইউনিয়নভিত্তিক শহর’ মডেল বাস্তবায়ন শুরু করা যায় যেভাবে
দ্রুততার সাথে দেশ ও জাতির বৈপ্লবিক সমৃদ্ধিতে এ মডেল উপযোগী বলে নীতি নির্ধারকগণ যদি গ্রহণ করেন, তাহলে বাস্তবায়ন কোন ব্যাপারই নয়। বহু বিকল্প পদ্ধতিতে এটি বাস্তবায়ন করা যায়। তবে এ মডেল বাস্তবায়নে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি যে, ‘প্রয়োগের ভুল বা বিভ্রান্তির জন্যে উদ্দেশ্যের সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও ভুল হবে’।

ইউনিয়ন সমিতির গঠন প্রক্রিয়ায় এ মডেল বাস্তবায়নের স্বচ্ছ নির্দেশনা রয়েছে। তদনুযায়ী এ মডেল বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগ অথবা সহযোগিতা প্রয়োজন। শুরুতেই ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় এ মডেলের বাস্তবায়ন করতে গেলে ভূমি-মালিকদের আপত্তি আসতে পারে। যেহেতু তাদের কেউ কেউ লাভ-ক্ষতির দোলাচলে থাকবে, সেহেতু তারা এতে উৎসাহিত নাও হতে পারে। তাই প্রাথমিকভাবে সাগরের উপকূলে জেগে ওঠা চরে তথা সরকারি মালিকানাধীন খাস জমির কয়েকটি ইউনিয়নে এ মডেল বাস্তবায়ন শুরু করা উচিৎ। তাছাড়া উপকূলীয় জেলাসমূহের সবচেয়ে কম বসতিপূর্ণ দু’টি ইউনিয়ন অথবা দেশের চারপ্রান্তে ৪টি ইউনিয়ন নির্বাচন করে এ প্রস্তাবের পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন করা যায়। পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়িত মডেল ইউনিয়নের উন্নয়ন-সাফল্যে অভিভূত হয়ে অন্যান্য ইউনিয়নের সকল জমির মালিকই স্বেচ্ছায় এরূপ ইউনিয়ন সমিতি গঠনে এগিয়ে আসবে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা এবং বিদেশীরাও এগিয়ে আসবে অর্থ-সাহায্য নিয়ে। এক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বড় বড় রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররাও ইউনিয়নভিত্তিক এ মডেল বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে পারে। এমনকি সরকার যদি বিদেশী দাতা সংস্থা বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এরূপ ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়নে এগিয়ে আসে -তাহলেও মাত্র ৫/৬ বছর পর থেকে ইউনিয়ন তহবিলের লভ্যাংশ দিয়ে সে ঋণ পরিশোধ সম্ভব।

নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলার মধ্যবর্তী মেঘনা নদীর মোহনা এবং বঙ্গোপসাগরে প্রায় ৬০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে জেগে ওঠা নতুন ভূমিতে এবং যশোরের কেশবপুরে সাগরের থেকে জেগে ওঠা ১০ বর্গ কিঃ মিঃ ভূমিতে এখনই এ মডেলের পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন একেবারে সহজ। আগামী ২০ বছরে আরও নতুন ৬০০ বর্গ কিঃমিঃ ভূমি বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হবার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সে ভূমিকেও এ মডেলের আওতায় এনে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের শক্তিশালী অঞ্চল হিসেবে কাজে লাগাতে পারে সরকার। নোয়াখালীর সীমানায় জেগে ওঠা চর জিয়াউদ্দিন, চর ক্লার্ক ও চর বাটায় তিনতলা ভবনসহ নানা স্থাপনা এখনই তৈরি করে ফেলেছে অবৈধ দখলদাররা, বেশ ক’টি খামারে তারা মাছের চাষও করছে। তবে বেশিরভাগ জমি এখনও ফাঁকা পড়ে আছে। জেগে ওঠা, পরিত্যক্ত ও বিরাণ এসব চরাঞ্চলে এরূপ উন্নয়ন মডেল এখনই বাস্তবায়ন অতীব জরুরি। তাতে জলদস্যু, ভূমিদস্যু ও অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে সকল বাংলাদেশীর অধিকারের এসব ভূমি যেমনি রক্ষিত হবে, তেমনি এরূপ ভূমির যথাযথ ব্যবহার আমাদের অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং রাজনৈতিক অনেক সমস্যার সমাধানও এনে দেবে।

তাই জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এ মডেল বাস্তবায়নে ভূমি-মালিকদের আগ্রহ নিয়ে যদি সরকারের শংকা থাকে, তাহলেও সাগর বা নদী থেকে জেগে ওঠা চরসমূহে এ মডেল বাস্তবায়ন এক্ষণই শুরু করতে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।

ইউনিয়নভিত্তিক শহর গড়ে তোলা হলে সর্বপ্রথম যে সুবিধা হবে, তা হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরের ওপর চাপ কমবে এবং দুর্বিষহ যানজট হ্রাস পাবে। জনগণ নিজের এলাকায় স্কুল-বাজার-চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধা পেতে থাকবে। ফলে দুর্বিষহ যানজটে আক্রান্ত বর্তমানের অচল ও স্থবির শহরগুলো সচল ও গতিসম্পন্ন হবে।

সাগর ও নদীবক্ষে জেগে ওঠা সুবিশাল চরসমূহকে নিবিড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শক্তিশালী পশ্চাৎভূমি (Hinterland) হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়ে নীতি-নির্ধারকদের বোধোদয় হলে এবং এসব বেহাত জমির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বাঙালি অবশ্যই খেয়ে-পরে সুখে থাকতে পারবে।

সরকারের মালিকানাধীন চরাঞ্চল এবং সাগর ও নদীতীরের ভূমিতে এ মডেলের পরীক্ষামূলক বাস্তবায়নের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ ও প্রলুব্ধ হয়ে জনগণই এগিয়ে আসবে সারাদেশে সবার জন্য লাভজনক এ মডেল বাস্তবায়নে। সে পর্যায়ে প্রথমে উপকূলীয় ইউনিয়নসমূহে এবং পর্যায়ক্রমে সমগ্র দেশে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যাবে। তবে উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষত চরাঞ্চলসম্পন্ন জেলাগুলোতে এরূপ পরিকল্পনা যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, তত দ্রুতই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে উপকূলবাসী; তাছাড়া ভূমিদস্যু ও লুটেরাদের আগ্রাসন থেকে রেহাই পাবে দেশ ও জনগণের সার্বভৌম ভূমি। ইউনিয়নভিত্তিক মডেল বাস্তবায়ন করলে নিম্নোক্ত লক্ষ্যসমূহ অর্জনের মাধ্যমে দেশ ও জাতির বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হবে।

এ মডেলে অর্জিতব্য লক্ষ্যসমূহ
১। গ্রামীণ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং শ্রেণী-বৈষম্য হ্রাস;
২। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানিতে স্থায়ী স্বয়ম্ভরতা ও রপ্তানি;
৩। বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা;
৪। সবার জন্য সুশিক্ষা এবং স্বাস্থ্য-সুবিধা;
৫। সাগর ও নদীবক্ষে জেগে ওঠা চরসমূহকে নিবিড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শক্তিশালী পশ্চাৎভূমি হিসেবে গড়ে তোলা;
৬। কৃষি জমির আইল হ্রাস, ভূ-মানচিত্র রক্ষা, চাষযোগ্য জমি বৃদ্ধি এবং আধুনিক পদ্ধতিতে পরিকল্পিত চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি;
৭। ইউনিয়নভিত্তিক শহরে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ফলে রাজধানীমুখী মানুষের চাপ হ্রাস; দুর্বিষহ যানজট থেকে মুক্তি এবং সুষম ও সুউন্নত বাংলাদেশ;
৮। বেকার সমস্যার সমাধান এবং জনসংখ্যাকে জনশক্তি ও সম্পদে রূপান্তর; প্রান্তিক অধিবাসীসহ সকল নাগরিকের জন্য উন্নত ও আধুনিক জীবন-ব্যবস্থা; হতাশামুক্ত উচ্ছল-উজ্জ্বল জাতি;
৯। পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত উন্নয়ন পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন, শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, ন্যায়-নিষ্ঠা ও মানবতা প্রতিষ্ঠা; ন্যায়ভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠন;
১০। পনের বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তর।

১৫ বছরের মধ্যে প্রকৃত তিলোত্তমা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশের উর্বর জমি এবং নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তাই কৃষকদের জন্য টেকসই প্রযুক্তি ও স্থায়ী বসবাসের নিশ্চয়তা বিধানসহ সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপক কৃষি উৎপাদনের উক্ত সুযোগ কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি। বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদ করলে চাষযোগ্য বর্তমান জমির মাত্র অর্ধেক ব্যবহার করেও যে ফলন পাওয়া যাবে, তার সাথে উপরোক্ত গবাদিপশু খামারের উৎপাদন দিয়ে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ খাদ্য-চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব। সেসাথে বর্তমান জনসংখ্যাকে জনসম্পদ ও শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশকে খুব সহজেই বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশে উন্নীত করা যায়।

অযত্ন ও অবহেলায় এবং সনাতন চাষাবাদের কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষিজমি থেকে এখন আর পূর্বের ন্যায় ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। তাই জমির সে উৎপাদন ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে এবং অধিক ফলন পেতে আমাদেরকে সমন্বিতভাবে ও সমিতিভুক্ত হয়ে আধুনিক চাষাবাদের জন্য উদ্যোগী হতে হবে।

এ উদ্যোগে আমরা যত কালক্ষেপণ করব, ততই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকব। শুধু কৃষিই নয়, শিল্প প্রতিষ্ঠা ও শিল্পায়নের জন্য ভূমি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। সে ভূমি যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বা বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাতে কৃষিই নয়, শিল্প প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও হ্রাস পাচ্ছে। এ ধারা চলতে থাকলে দু’দশক পর সমগ্র দেশই হ-য-ব-র-ল -এর করুণ অবস্থায় নিপতিত হবে; ঔপন্যাসিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভাষায় ‘বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর আস্তাকুঁড়?’।

কৃষি জমির বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন করে গবেষণা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া সময়ের অপচয় মাত্র। সরকার উদার হলে এবং আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য হ্রাস পেলে দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তারাই উন্নত দেশের চাষাবাদ পদ্ধতি ও প্রযুক্তি অনুসরণে ফসলে ফসলে ভরে দেবে মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। কাজী বাবুর কাজী পেয়ারায় যদি ঢাকার রাজপথ সয়লাব হতে পারে, তাহলে সরকারি বাধার পরিবর্তে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হলে সে নিশ্চিন্ত ও নির্ভরশীল সহযোগিতায়ই বাংলার প্রতিভাবান সন্তানরা নিজ দেশকে বিশ্বের বুকে সুউন্নত দেশে পরিণত করে তুলবে। এক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনে অগ্রগামী থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইতালি প্রভৃতি দেশকে অনুসরণ করা যেতে পারে।

আগামীর ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ সাহায্য করতে প্রস্তুত। সেজন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে চায় এতদসংক্রান্ত স্থায়ী ও টেকসই প্রকল্প-পরিকল্পনা। অন্যদিকে সরকারের কাছে দুর্যোগ মোকাবেলার অনুরূপ কোন সমন্বিত প্রস্তাব বা পরিকল্পনা আছে কিনা জানি না, যাতে দুর্যোগ মোকাবেলার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নসহ জাতীয় সমস্যাসমূহের সহজ ও প্রাকৃতিক সমাধান সম্ভব। তাই ইউনিয়নভিত্তিক শহর প্রতিষ্ঠার এ মডেল সরকারের সেই কল্যাণ-উদ্যোগে সহায়ক হবে বলে বিশ্বাস।

নরসিংদিতে আবিষ্কৃত উয়ারী বটেশ্বর সভ্যতা বেশ আলোচিত হয়েছে। এ এলাকার সাথে রোমান সাম্রাজ্যের সম্পৃক্ততা ছিল বলে যে দাবি উঠেছে, তা অবশ্যই আমাদের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধির একটি দিগন্ত। উয়ারী বটেশ্বরে সভ্যতা আবিষ্কারের পূর্বেও বাঙালি ও বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সুষমার কথা আমরা অনেক শুনেছি। আমাদের পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহ যে ছিলেন রাজা-বাদশা-মহারাজা, সে অতীত কথার ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে আমাদের বর্তমান শেষ, আর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। When we remain busy with the past, future is lost.

আমাদের সব বাঙালিরই কমবেশি জানা রয়েছে যে, সংস্কৃতি ও সভ্যতার দিক থেকে পৃথিবীর বহু জাতি বা দেশ অতীতে আমাদের অনেক পেছনে থেকেও এখন অনেক বেশি অগ্রসর। উন্নয়নের দিক থেকে আমাদের সাথে তাদের তুলনা এখন পাতাল আর আকাশসম। আমরা কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি, যাচ্ছি কোথায় -এ তিনটি বিষয় বহুল আলোচিত। তাই এখন অধিক আলোচনার ও ভাববার বিষয় হচ্ছে কোথায় যেতে হবে এবং কিভাবে যেতে হবে। সভ্যতা খনন করার চেয়ে সভ্যতা নির্মাণ, অন্যকথায় অতীত ঐতিহ্য আবিষ্কারের চেয়ে পুনরুদ্ধার ও পুনঃনির্মাণ অথবা নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন এখন অতীব জরুরি। ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু’ -এর অতীত কাহিনী ও বাহাদুরীর কথা জাহির করতে করতে আর ক’দিন পরই ভাতের হাঁড়িতে চাল জুটবে না, চুলায় গ্যাস থাকবে না, পেট্রোলহীন পেট্রোল পাম্প, বিদ্যুৎহীন বৈদ্যুতিক পাখা, ফসলহীন জমি খা-খা মরু; অভাগা যেদিকে চায়, শুধু সাগর শুকায় -অবস্থার দিকে যাচ্ছি আমরা।

বাংলাদেশের সকল দুর্নীতিকে খাঁচায় আবদ্ধের তর্জন-গর্জন, আবার দুর্নীতিকে উন্মুক্ত করার শশব্যস্ততার মত স্ববিরোধী সংস্কৃতি অথবা মীরজাফরী রাজনীতি এবং সিরাজ উদ-দৌলার পতন সংস্কৃতি বাঙালির ভাগ্য পরিবর্তনে বরাবরই প্রতিবন্ধক ছিল ও রয়েছে। বাঙালির ভাগ্য বিধাতা বা ত্রাণকর্তাদের অবস্থা এরূপ, যে-ই যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ। গণতন্ত্র এখানে রূপ নিয়েছে দলতন্ত্র, ফায়দাতন্ত্র ও ইজারাতন্ত্রে। রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষ ক্ষমতায় থাকেন শুধু একজন এবং তিনি যে কাউকে নিয়েই তাঁর ‘জ্বি হুজুর, জাঁহাপনা’ পর্ষদ গঠন করতে পারেন। এ পর্ষদ-সদস্যরা তাদের নির্ধারিত দায়িত্বের কর্মযজ্ঞ ও জন-উন্নয়নের চেয়ে নেতার তাবেদারীতেই বেশি তটস্থ থাকেন। দল, গণতন্ত্র, রাষ্ট্র -এ ৩টি ধারণা যেন এক হয়ে গেছে এদেশে। তাই জন-উন্নয়নের নামে কোন কোন রাজনৈতিক দলের ভন্ডামী থাকায় দল চলছে, রাজনীতি চলছে, কিন্তু দেশটা চলছে না; দেশ চলতে হলে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট উন্নয়নের লক্ষ্যভিত্তিক মডেল।

একদিকে মূলধনহীন ও লাভজনক রাজনীতি-ব্যবসা, অন্যদিকে নেতৃত্বের সর্বক্ষেত্রে দক্ষতা-শূন্যের নির্মম পরিহাসের কারণে বাঙালিকে এখন খুঁজতে হবে ভাগ্যের বিকল্প রশি। ভাগ্যের রশি একটি নয়, বহু; চিনে নিতে পারলেই হয়। তাই এইতো সুযোগ নড়ে-চড়ে বসার, এখনই সময় জেগে ওঠার। প্রকৃতির ক্রীড়নক হয়ে বসে না থেকে প্রকৃতির লীলাখেলাকে বৌদ্ধিক শক্তিতে মানব কল্যাণে কাজে লাগানো সম্ভব। আর এ দর্শনের মাধ্যমেই জ্ঞানের আলোয় বিদূরিত করতে হবে দেশ ও জাতির সকল অন্ধকার। দেশপ্রেমী মেধাবী সন্তানরা একত্রিত হলে এখনই এরূপ সৃজনশীল ও মানব কল্যাণকর কর্মযজ্ঞ চালু করা যায়।

দু’হাজার বছর পূর্বেকার গ্রীস বা রোমান সভ্যতা পর্যন্ত যাবার দরকার কি? আমাদের কাছাকাছি দেশ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিংবা দক্ষিণ কোরিয়া -যারা মাত্র তিন দশক পূর্বেও ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধিতে আমাদের চাইতে ঢের পিছিয়ে ছিল, তাদের উন্নতির উদাহরণ বিবেচনায় নিয়ে এখনই আমরা ১৫ বছরের পরিকল্পনায় উপরোক্ত মডেল বাস্তবায়ন শুরু করতে পারি। ১৫ বছর পর এ উন্নয়ন মডেলই বাংলাদেশকে বিশ্ব-দরবারে অত্যাধুনিক মডেল-রাষ্ট্রে পরিণত করবে -এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ সমগ্র জাতি ও দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানী ও যানজটসহ মহা সমস্যাসমূহের সহজ ও আলটিমেট সমাধানে অত্যন্ত কার্যকর এ মডেল।

দেশপ্রেমী বাঙালিগণ, যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, এগিয়ে আসুন; এ মডেল বাস্তবায়নে সোচ্চার হোন; সহযোগী ও সমর্থক হোন। হতাশামুক্ত উচ্ছল-উজ্জ্বল-আলোকিত জাতি গঠনে এগিয়ে আসুন। শুভ হোক সকল মঙ্গল প্রয়াস।