ক্যাম্পাস’র জ্ঞান-সমুদ্র থেকে আমার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা

উম্মে মাহবুবা সোমা
এক্সিকিউটিভ

একটি প্রতিষ্ঠানে আমি ছোটখাট পদে চাকরি করছিলাম। কিন্তু ঐ প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরনের সাথে মানসিকভাবে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। সেরূপ অবস্থায় এক ঘনিষ্ঠজনকে চাকরি পরিবর্তনের ইচ্ছার কথা জানাই। তিনি আমাকে বললেন ‘ক্যাম্পাস’ নামে একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান ও পত্রিকা অফিস আছে, সেখানে সিভি নিয়ে যাও। সততা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবেদন করলে একটা কিছু হয়ে যেতেও পারে। সম্ভবত তিনি আমার চাকরির জন্য সুপারিশ করে ক্যাম্পাস অফিসে ফোনও করে রেখেছিলেন। তার কথামতো আমি ক্যাম্পাস অফিসে আসি। গেটে নাম এন্ট্রি করলাম, গার্ড আমাকে ভেতরে বসতে বললেন। ভেতরের পরিবেশ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত সুন্দর পরিবেশ! আমি ভেতরে বসে সম্পাদক মহোদয়ের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমার ডাক এল।
সম্পাদক মহোদয়ের সাথে কথা বলার পর আমার মন হালকা হলো, অনেক ভালো লাগলো। তিনি আমাকে পরের দিন আসতে বললেন। পরদিন আসার পরে আমাকে ২টি বই ও কিছু আর্টিকেল পড়তে দেয়া হলো, যাতে ক্যাম্পাস ও এর কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। বেশ কিছু আর্টিকেল পড়ে যা বুঝতে পারলাম, তা হলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শুধু একটি পত্রিকাই নয়, এটি জ্ঞানভিত্তিক-ন্যায়ভিত্তিক ও যুক্তিভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনে নিবেদিত একটি সেবা ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। আর্টিকেল পড়ার পর বিকালে আমাকে সম্পাদকের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সম্পাদক মহোদয় কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারপর বললেন, তুমি আগামীকাল থেকেই যোগদান করতে পারো। তখন আমি খুবই খুশি হলাম। সেই অনুযায়ী অফিসিয়াল নিয়ম-নীতি ও পদ্ধতি মেনে ও অনুসরণ করে আমি যোগদান করি ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র (সিএসডিসি) এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা অফিসে।
ইন্টারভিউ দিতে এসে আর্টিকেল পড়ে ক্যাম্পাস’র কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিয়েছিলাম; কিন্তু যোগদান করার পর জানলাম, এই প্রতিষ্ঠানের আরও বহুমুখী কর্মকান্ড সম্পর্কে। প্রথমে আমার কাজ ছিল কম্পোজ করা। আমি কম্পিউটারের ‘ক’ জানতাম না। কম্পিউটার শেখার বিষয়ে সম্পাদক মহোদয়সহ সবাই সবসময় উৎসাহিত করতেন। এমনকি কম্পিউটারে কাজ শেখানোয় সহযোগিতা করার জন্য সিনিয়র ডেপুটি এসিসট্যান্ট ডিরেক্টর মনিরুজ্জামানকে বলে দিলেন সম্পাদক মহোদয়। সেই থেকেই আমার পথচলা। এরপর ধীরে ধীরে আমি ক্যাম্পাস পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় কম্পোজ করা রপ্ত করে ফেললাম। এখন আমি ঘন্টায় ১ পৃষ্ঠা কম্পোজ করতে পারি। এই ১ পৃষ্ঠা কিন্তু পত্রিকার গাদা গাদা ১ পৃষ্ঠা, যা কিনা চিঠিপত্রের ৩ পৃষ্ঠা। এককথায় এখন দৈনিক আমি ৬/৭ পৃষ্ঠা কম্পোজ ও মেকআপ করতে পারি।
ক্যাম্পাস’র অন্যতম কার্যক্রম ডায়নামিক কম্পিউটার ট্রেনিং। আমি এই ট্রেনিংয়ের ব্যবহারিক ক্লাস নিই। যে আমি কম্পিউটারের ‘ক’ জানতাম না, সেই আমিই এখন ব্যবহারিক ক্লাস নিই। এটি ভাবতেই অবাক লাগে এবং পাশাপাশি আনন্দিতও হই। কম্পিউটার কোর্সে ছাত্র-ছাত্রী ও বেকারদের অগ্রাধিকার থাকলেও চাকরিজীবীসহ সব বয়সের মানুষই অংশগ্রহণ করতে পারে। কোর্সের মেয়াদ দেড় মাস। আমি এই দেড় মাস ধরে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাস নিই। ক্লাস শেষে ওরা পরীক্ষা দেয়ার পর যখন অ+ পায়, তখন আমার কী যে ভালো লাগে তা বলে বোঝাতে পারব না। আসলে এসবই সম্ভব হয়েছে সম্পাদক মহোদয়ের দেয়া সুযোগ ও উৎসাহের কারণে। এসবে অবহেলা ও ঢিলেমীর কারণে আমি দু-তিন বার বকাও খেয়েছি। সম্পাদক মহোদয় বলতেন পারবে না কেন, সেটা বল। তাই এখন আমার মনে হয়, আমিও পারি। কেননা আমি কম্পিউটার ট্রেইনীদের কিছুটা হলেও শিখাতে পারছি।
কিছুই না জানা আমি ক্যাম্পাস থেকে কম্পিউটার শেখা ছাড়াও শিখেছি টেলিফোন অপারেট, ডাটাবেজের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ইমেইল পাঠানো, কোর্স কো-অর্ডিনেট, অনুষ্ঠান অর্গানাইজ, বিভিন্ন সেমিনার আয়োজন, অনুষ্ঠানের পূর্বে অডিটোরিয়াম সাজানো এবং অনুষ্ঠানের পর মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও সাউন্ড সিস্টেম অফ করে পুরো অডিটোরিয়াম গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি। আমাদের এই ক্যাম্পাস অফিস সবসময়ই সাজানো-গোছানো থাকে সবুজ গাছ ও ফুল দিয়ে। এখানকার পরিবেশ অত্যন্ত প্রাকৃতিক ও মনোরম। একদিন একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক আমাদের ক্যাম্পাস অফিস পরিদর্শনে আসেন। এসে তিনি অনেকক্ষণ ধরে টেবিলে সাজানো লতাগুল্ম ও গাছের টবের দিকে তাকিয়ে থাকেন। পরে তিনি কৌতূহল মেটাতে গাছের ভেতরের ফুলটা হাত দিয়ে ধরেই ফেললেন; আমাকে বললেন, আপা আমি বুঝতে পারছিলাম না এগুলো আসল না নকল! এত সুন্দর লাগছিলো তাই ধরে দেখছিলাম। আমাদের ক্যাম্পাস অফিসে আসা অতিথিরা যখন এই রকম সবুজ গাছ-গাছালি, সাজানো-গোছানো পরিবেশের প্রশংসা করেন তখন আমার খুব ভালো লাগে। কেননা এসব গাছের পরিচর্যা এবং সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার কাজ আমি করে থাকি। তবে এজন্য আমি সম্পাদক মহোদয়ের নিকট কৃতজ্ঞ, কারণ তিনিই আমাকে এ কাজগুলো দিয়েছেন এবং গাইড করে শিখিয়েছেন। অন্য কোনো অফিসের ‘বস’ এইভাবে শেখান না, যা আমাদের সম্পাদক মহোদয় সর্বদা সবার ক্ষেত্রেই করে থাকেন; সে কাজ ছোট হোক অথবা বড়ই হোক না কেন।
ক্যাম্পাস’র আরেকটি দিক সম্পর্কে না বললেই নয়; তা হলো আপ্যায়ন সম্পর্কিত। এ অফিসে সবসময় ন্যাচারাল বা হারবাল খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করা হয়। ক্যাম্পাস অফিসে প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন হয় এবং সকল অনুষ্ঠানেই চা-নাস্তার ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে স্টাফ ও শিক্ষানবিশদের জন্য ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ কিংবা ডিনারের ব্যবস্থা থাকে; খাবারের ধরনটাও থাকে আলাদা। বাসা কিংবা অন্যান্য অফিসের আপ্যায়নে সাধারণত দুধ-চা, কোক-ফান্টা পরিবেশিত হয়। কিন্তু ক্যাম্পাস’র স্টাফদের আপ্যায়নে কিংবা অডিটোরিয়ামের অনুষ্ঠানে চায়ের সাথে দুধ পরিবেশন করা হয় না। তাছাড়া কোক-ফান্টা বা অনুরূপ কোনো অস্বাস্থ্যকর কিংবা ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য কখনোই পরিবেশিত হয় না। এখানকার খাবারে থাকে আদা-চা, বাদাম, খেজুর, শসা, সেদ্ধ গাজর, কাঁচা/পাকা পেপে, কাঁচা ছোলা ইত্যাদি। শীতের সময় পরিবেশন করা হয় ড্রিমপটে রান্না করা গরম গরম ভেজিটেবল-চিকেন স্যুপ, সেদ্ধ শাক-সব্জি ও ভাপা পিঠাসহ বিভিন্ন পিঠাপুলি ও পায়েস। মৌসুমী ফলের সময় আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, তরমুজ ইত্যাদি ফল পরিবেশন করা হয়। ক্যাম্পাস অফিসের আম-উৎসবের কথা শুনলে অনেকেই অবাক হবেন। এটা একটা মজার কান্ড। প্রত্যেককে ১টা ছুরি ও ১টা করে প্লেট দেয়া হয়। আর সামনে থাকে অনেক আম। তারপর শুরু হয় অবিরাম আম ভক্ষণ প্রতিযোগিতা।
আর কাঁঠাল! আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকতের কারণে ক্যাম্পাস অফিসে খুব একটা কাঁঠাল কিনতে হয় না। যেসব স্টাফ কিংবা শিক্ষানবিশ এমনকি ট্রেইনীদের বাড়িতে কাঁঠাল গাছ আছে, তারা বাড়ি থেকে কাঁঠাল নিয়ে আসেন কলিগদের খাওয়ানোর জন্য। প্রিয় পাঠক, ক্যাম্পাস এ যোগদানের পর আমার মধ্যকার পরিবর্তনের উদাহারণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। যে আমি একসময়ে প্রায়ই কোক-ফান্টা খেতাম, সেই আমিই এখন বাইরে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে ক্যামিকেল পানীয় কিংবা কোনো অস্বাস্থ্যকর বা ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য মুখে নিতে ভক্তিই আসে না। ক্যাম্পাস এ পরিবেশিত স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার তৈরির আয়োজন ও ব্যবস্থা বেশিরভাগই ক্যাম্পাস কিচেনে করা হয়ে থাকে; অনেক সময় আমিও এর দায়িত্বে থাকি। ক্যাম্পাস’র আরেকটি বিশেষ কর্মসূচি হচ্ছে বাৎসরিক ক্যাম্পেইন। এই ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করলে নিজেকে যাচাই করা যায়। ক্যাম্পেইনের প্রতিটি পদক্ষেপেই রয়েছে নতুন নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ। এতে অংশ নিলে বিভিন্ন অফিস-আদালত পরিদর্শন, অফিস আচরণ, নিয়মানুবর্তিতা, শৃংখলা, টিম স্পিরিট, দৈনন্দিন কাজের রিপোর্টিং ইত্যাদি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যায়। ক্যাম্পাস’র এ ক্যাম্পেইনের মূল লক্ষ্য হলো আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এ বছর আমিও ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করেছি। ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণের সুবাদে অনেক প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার যেমন সংসদ ভবন, বাংলাদেশ সচিবালয়, বন ভবন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকসমূহ, ঢাকা জজ কোর্ট ও সিএমএম কোর্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আবাসিক হলে গিয়েছি। এছাড়াও আরো অনেক জায়গায় গিয়েছি।
ক্যাম্পেইনে কাজ করতে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। যেমন শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সকল পরিবেশে নিজেকে Adjust করার মানসিকতা, দক্ষতা অর্জনের কৌশল, বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে এবং প্রতিকূল পরিবেশেও Proactive and Positive attitude এ কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং গতিশীল বিশ্বের সাথে নিজেকে Adjust করার কৌশলসহ আরও কত্ত কী! ক্যাম্পাস পরিচালিত ফ্রি প্রোএকটিভ এন্ড পজিটিভ এটিচিউড সেমিনার অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই সেমিনারের তারিখ পড়লেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে যায়। এমনকি আমার ভেতরেও এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। ইতিবাচক চিন্তা-চেতনার পজিটিভ জাতি গড়ে তোলাই এই সেমিনারের মূল উদ্দেশ্য। সেমিনারের আলোচনার বিষয় থাকে How to Create Positive Thought, How to Develop Relationship, How to Control Anger, Know Thyself, Key to Success ইত্যাদি। এ থেকে অনেক কিছুই শেখা যায় এবং জ্ঞান অর্জন করা যায়। নিজের মধ্যকার নিজকে জাগিয়ে তোলা যায়। এগুলো ছাড়াও ক্যাম্পাস’র আরো অনেক কার্যক্রম রয়েছে, যা লিখে এ স্বল্প পরিসরে শেষ করা যাবে না।
এখন আমি যেখানেই যাই, যদি বলি ক্যাম্পাস থেকে এসেছি তখন একটা অন্যরকম মূল্যায়ন পাই। আমার মনে হয়, ক্যাম্পাসকে চেনে না এমন লোক বা প্রতিষ্ঠান খুব কমই আছে। ক্যাম্পাস অন্যের সেবায় সর্বদাই নিয়োজিত একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান। এটি ন্যায়ভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। ছাত্র-যুবক তথা শিক্ষার্থীদের সর্বদা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা এবং দেশ ও জাতির চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলাই ক্যাম্পাস’র মূল উদ্দেশ্য। জ্ঞান-সমুদ্রের এ প্রতিষ্ঠান তথা ক্যাম্পাস’র সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি।
প্রথম প্রকাশঃ আগস্ট ২০১৫