ক্যাম্পাস’র মিটিং অতুলনীয় শিক্ষায় ভরপুর

রিমেল বড়ুয়া
ডিএডি (আইটি)



অফিস এবং মিটিং একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আপনি চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী যাই হোন না কেন অফিসিয়াল কর্মকান্ডে গতি আনতে, শৃঙ্খলা আনতে, ভুলত্রুটি শোধরাতে সহকর্মীদের সাথে মিটিংয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এজন্যেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরব্যাপী প্রচুর মিটিং হয়ে থাকে। যদিও উন্নত বিশ্বে টেবিল-চেয়ারে, সশরীরে মিটিং করার রেওয়াজ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। কারণ একেকটি মিটিংয়ে প্রচুর সময় ও এনার্জি খরচ হয়ে যায়। তাই উন্নত দেশগুলোতে চেষ্টা চলছে ফিজিক্যাল এ্যাপিয়ারেন্স যত বেশি কমিয়ে আনা যায়। তার বদলে জায়গা করে নিচ্ছে স্কাইপ মিটিং, ভিডিও কনফারেন্সিং, মেইলিং, গ্রুপ চ্যাটসহ নানারকমের কমিউনিটি বেজড অনলাইন ডিসকাশন প্লাটফরম ও টেকনোলজি। আমাদের দেশে নানা কারণেই এই সংস্কৃতি পুরোপুরি চালু হয়নি। তবে পরষ্পরের সামনাসামনি বসে মিটিংয়ের আলাদা গুরুত্বও রয়েছে, যা অনলাইন মিটিংয়ে পাওয়া সম্ভব নয়।

ক্যাম্পাস অফিসও এসব অফিসিয়াল কর্মকান্ডে ভরপুর। ক্যাম্পাস’র বিভিন্ন কার্যক্রমের গতিবিধি পরিমাপ করতে, সবার ভুলত্রুটি ও সাফল্য পর্যবেক্ষণ করতে, সাম্প্রতিক হালহকিকত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতে বিভিন্ন সময় মিটিং হয়ে থাকে। এজেন্ডার ভিত্তিতে এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একেকটি মিটিং হয় একেকরকম। তবে যেসব ব্যতিক্রম জিনিস ক্যাম্পাস’র মিটিং থেকে উঠে আসে, সাধারণত অন্যান্য অফিসের মিটিংয়ে সেসব দেখা যায় না। ক্যাম্পাস’র মিটিংগুলোতে কাজের ক্ষেত্র বৃদ্ধি ছাড়াও সততা ও নৈতিক শিক্ষা এবং স্টাফদের আত্মোন্নয়নের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়া অন্যান্য যেসব বিষয় থাকে, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিজে কোনো কাজে অসুবিধা না করা, বাড়তি কথা না বলা, কোনোভাবেই নেগেটিভ না হওয়া, কাজকর্মে বসকে নিশ্চিন্ত রাখা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কমিউনিকেশন ঠিক রাখা, অন্যের সমালোচনা নম্রভাবে করা এবং গ্রহণ করা, তর্কের মানসিকতা পরিহার করা, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সংরক্ষণে আন্তরিকতা ও তৎপর হওয়া, কাজকর্মে স্বউদ্যোগী ও স্বপ্রণোদিত হওয়া, সত্য বলা ও কাজকর্মে সততার অভ্যাস, উর্ধ্বতনের অনুপস্থিতিতে বা আড়ালে সমালোচনায় নিরুৎসাহবোধ, একই ভুল বার বার করার প্রবণতা কমানো, কমিটমেন্ট ঠিক রাখা, হাস্যোজ্জ্বল সহজ-সরল অভ্যাস, কথাবার্তায় জটিলতা না করা, দ্রুততাঃ কাজেকর্মে-উত্তরদানে-নির্দেশপালনে, এক কাজে একাধিক জনকে অযথা না জড়ানোর অভ্যাস প্রভৃতি।

ক্যাম্পাস’র মিটিংগুলো সাধারণত দিনের শুরুতেই হয়, ফলে মিটিংগুলোর কার্যকারিতা বেশি থাকে। কারণ আপনি যে বিষয়টি নিয়ে মিটিংয়ে আলাপ করলেন, সিদ্ধান্ত নিলেন সেটি বাস্তবায়নের জন্য মিটিং শেষ হবার পর একটি পুরো দিন পেয়ে গেলেন। স্টাফদের একাগ্রতা বাড়াতে মিটিংয়ে মাঝেমধ্যে করানো হয় বিশেষ মেডিটেশন; যেই মেডিটেশনে রয়েছে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি অর্জন, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং সারাদিনের কর্মশক্তি অর্জনের অটোসাজেশন।

ক্যাম্পাস’র মিটিংয়ে আরেকটি ব্যতিক্রমী শিক্ষা হলো গণতন্ত্রের অনুশীলন, যা আমার ব্যক্তি-জীবনেও কাজে এসেছে। মিটিংয়ে ওপেন সেশনে সিনিয়র-জুনিয়র সবাই তাদের নিজনিজ মতামত ব্যক্ত করতে পারেন এবং সবার মতামতকেই সমান গুরুত্ব দেয়া হয়। ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিভিত্তিক হলেই সে কথা সবার আগে গুরুত্ব পায়, সেক্ষেত্রে বক্তা জুনিয়র স্টাফ হলেও তার যৌক্তিক কথাটি বেশি গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। আর সঠিক সাজেশন বা আইডিয়া প্রদান, কুইক রেসপন্স ইত্যাকার পজিটিভ কর্মকান্ডের জন্য তাৎক্ষণিক পুরস্কারের ব্যবস্থা যেমন আছে; তেমনি সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে, কথায় বা আচরণে বিশৃঙ্খলার জন্য আর্থিক তিরস্কার বা শর্তসাপেক্ষে তিরস্কারের ব্যবস্থাও রাখা হয়ে থাকে। পুরস্কারের ব্যাপারটা সবাই খুশিমনে নিলেও তিরস্কারের ব্যাপারটা হাসিমুখে নেয়া অনেকসময় অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে যায়। যদি কেউ ভুলের জন্য তিরস্কার হাসিমুখে নিতে পারেন, সেক্ষেত্রে তিরস্কার কমে যাওয়া বা মওকুফের মতো ঘটনাও হয়ে থাকে। এমনকি উল্টো পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারেন। আরো মজার বিষয় হচ্ছে পুরস্কারের অর্থ বেশি থাকে, অন্যদিকে তিরস্কারের অর্থ কম থাকে। তাছাড়া পুরস্কার দেয়া হয় অফিস তহবিল থেকে, অন্যদিকে তিরস্কার জমা হয় স্টাফদের রিক্রেয়শন তথা আপ্যায়ন খাতে।

ক্যাম্পাস’র মিটিংগুলো সাধারণত পরিচালনা করে থাকেন ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র এর মহাসচিব ড. এম হেলাল। তিনি মিটিংয়ের টপিকস্ এর বাইরেও সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে তাঁর সহকর্মী স্টাফদেরকে টিপস দিয়ে থাকেন, তাদের সহজ-সুন্দর জীবনযাপন ও কর্মদক্ষতার মান বাড়াতে। তবে সেসব টিপস সবসময় লিখে রাখা হয় না বলে আমার মতো ভুলোমনের মানুষ প্রায় সময়েই তা ভুলে যাই। ক্যাম্পাস পাবলিকেশন্স থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই বের হয়; তাই মিটিংয়ে যেসব বিশেষ টপিকস নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেসবকে সাধারণের উপযোগী করে পাবলিশ করলে বেশ ভালো একটি ক্যারিয়ারভিত্তিক বইও ছাত্র-যুবকরা পেয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। এতে তারা যেমন অফিস ইথিকস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবে, তেমনি অফিস পরিচালনার নতুন সৃজনশীল বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পাবে।

ক্যাম্পাস’র মিটিং টেবিলে যেসব খাবার পরিবেশিত হয়, তাতেও যথেষ্ট বৈচিত্র্য আছে। খাবারের মধ্যে বাদাম, পেপে, গাজর, কলা, খেজুর, দই, পুডিং এসব স্বাস্থ্যকর উপাদানতো থাকেই; মাঝেসাঝে দেশি-বিদেশি চকলেট বা মিষ্টান্নও পরিবেশন করা হয়ে থাকে। তবে ফাস্টফুড বা কোল্ড ড্রিংকসের মতো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাবারগুলো এড়ানো হয় অত্যন্ত সচেতনভাবেই। অনেকসময় শিক্ষানবীশরাও এসে মিটিংয়ে যোগ দেয়; তারা চুপচাপ বসে শোনে, বোঝার চেষ্টা করে ক্যাম্পাস’র কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হয়। এছাড়া মিটিং টেবিলগুলো কোন্ এঙ্গেলে থাকলে সবাই সুন্দরভাবে বসতে পারবে, কীভাবে খাবার পরিবেশন করতে হবে, কোন্ পদ্ধতিতে দিলে অন্যের ডিস্টার্ব না করেই খাবার প্রত্যেকের নাগালে পৌঁছে দেয়া যাবে এমন কিছু সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সার্ভিস টেকনিকও জেনে নিতে পারে তারা। অনেকে এমন অভিনব টেকনিক দেখে অবাকও হয়, কারণ দৈনন্দিন গৃহস্থালী কাজেও এগুলো খুব সহজেই এপ্লাই করা যায় এবং অনেক ঝঞ্জাট থেকে বাঁচা যায় এরকম পদ্ধতির প্রয়োগ করে।