দুর্বিষহ যানজট, অর্থ শ্রম ও সময়ের অপচয়, মৌলিক শিক্ষায় ত্রুটি
ড্রপআউট, শ্রেণি বৈষম্যসহ জাতীয় বহু সমস্যার একক সমাধান

এলাকাভিত্তিক স্কুলিং
॥ এম হেলাল, সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা ॥
বাংলাদেশের স্কুলিং ব্যবস্থা লক্ষ্যহীন, অগোছালো ও বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। ফলে স্কুলগুলো একদিকে দেশ ও জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না, অন্যদিকে শিক্ষার ভিত্তিমূলেই থেকে যাচ্ছে ব্যাপক গলদ। বাংলাদেশের শিশুদের ৯১% প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তন্মধ্যে ৪১% প্রাথমিক স্তরে এবং ৪২% মাধ্যমিক স্তরে তথা এসএসসি’র পূর্বেই ঝরে পড়ে। শত চেষ্টা সত্ত্বেও এ ঝরে পড়া রোধ করা যাচ্ছে না।

শিক্ষা পদ্ধতি ও ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে এদেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্ত নেই। স্কুল-শিক্ষার পদ্ধতি ও কারিকুলামে বিভিন্নতা থাকায় শ্রেণিবৈষম্য ও সামাজিক অবিচার-অনাচার প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষার কান্ডারিদের অভিযোগ কোমলমতি শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে মৌলিক শিক্ষা না পাওয়ার কারণে তাদেরকে অপরিপক্ক অবস্থায় প্রবেশ করতে হয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ কারণে মানসম্পন্ন ও মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি সম্ভব হয় না। ফলে জাতীয় জীবনে বৃদ্ধি পাচ্ছে মেধা সংকট, প্রকটতর হচ্ছে জাতীয় নানা সমস্যা। তাই প্রতিভাময় জাতি গঠনে এবং জাতীয় বহু সমস্যার সমাধানে স্কুলিং ব্যবস্থার সংস্কার তথা একে ঢেলে সাজানো জরুরি হয়ে পড়েছে এবং তা ‘এলাকাভিত্তিক স্কুলিং’ পদ্ধতির মাধ্যমেই সম্ভব।

এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ের রূপরেখা বা মডেল
এলাকাভিত্তিক স্কুলিং (Areawise Schooling) ব্যবস্থায় স্কুলশিক্ষার শুরু ও বিকাশ পুরোটাই হবে এলাকাভিত্তিক। অর্থাৎ স্কুলিংকে এলাকাভিত্তিক ঢেলে সাজানোর মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং স্কুলসমূহের গুণগত সামঞ্জস্য ও সুবিন্যাস নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষার মানোন্নয়নে এবং দেশ ও জাতির সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় রোধে শিক্ষক সমাজ সহজেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।

এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ে শিক্ষার্থীকে স্কুলে নেয়া-আনার দায়িত্ব নেবেন শিক্ষক। একটি স্কুলে যদি ১০ জন শিক্ষক ও ২০০ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকে, তাহলে প্রত্যেক শিক্ষক ২০/২৫ জন শিক্ষার্থীকে স্কুলে আনা-নেয়ার দায়িত্ব নিতে পারেন অনায়াসে। প্রত্যেক শিক্ষক নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট ভবন, গলি বা মহল্লার শিক্ষার্থীকে তার ফ্ল্যাট বা বাড়ি থেকে জাতীয় সংগীতের সুরে-ছন্দে স্কুলে নিয়ে যাবেন। স্কুলশেষে আবার দেশের গান ও জীবনের গান গাইতে গাইতে শিক্ষার্থীদের বাড়ি পৌঁছে দেবেন। এতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যেমনি মধুর হবে; তেমনি শিশু বয়সেই শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম ও ন্যায়-নীতিবোধ জাগ্রত হবে।

schooling ফলে টিজিং, মাদকসহ কিশোর অপরাধ হ্রাস পাবে। অন্যদিকে স্কুল যদি বাসস্থানের নিকটে হয়, তাহলে হাই স্কুলগামী শিক্ষার্থী নিজেও মহল্লার অন্য শিক্ষার্থীদের সাথে একত্রে যাওয়া-আসা করতে পারবে। এতে অযথা গাড়ি নিয়ে হৈ-হুল্লোড় থাকবে না, বাবা-মায়ের সময়-শ্রম ও অর্থের অপচয় হবে না এবং তাদের টেনশনও থাকবে না, শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানীকৃত জ্বালানি অথবা স্বদেশের সীমিত জ্বালানি সম্পদ নষ্ট হবে না, ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত থাকবে, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে। সর্বোপরি, শিক্ষার্থীর মা-বাবার সে সময়টুকু নিশ্চিন্তে সাংসারিক বা সমাজের উন্নয়নমূলক কাজ-কর্মে কিংবা পেশায় ব্যয় করা সহজ হবে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল জাতির এটি বিরাট সুযোগ, বিশাল পাওয়া। তাছাড়া শিশুদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তাদের জীবনমানও উন্নত হবে; বিশ্ব-পরিসরে বৃদ্ধি পাবে জাতির মর্যাদা।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি এ দু’ধরনের স্কুল ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি উদ্যোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বর্তমানের স্কুলগুলোকে সুবিন্যস্ত ও মানসম্পন্ন করা প্রয়োজন। বাড়ি বা বসতির কাছাকাছি স্কুলিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করে শিশু-কিশোরদেরকে বিদ্যা অর্জনে উৎসাহিত করতে হবে এবং সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য অসচ্ছল অভিভাবকদেরকে সুযোগ করে দিতে হবে। এতে বর্তমানের ড্রপআউট থাকবে না বললেই চলে। শিক্ষাদান ছাড়াও ছাত্রদেরকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও বাড়ি পৌঁছে দেয়া; কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে ম্যানার, বিহেভিয়ার, এটিকেট ইত্যাকার মানবীয় ও শিষ্টাচার সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী শেখানোর দায়িত্ব হবে স্কুলের। ছাত্রদের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ ভার নেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

এলাকাভিত্তিক স্কুলিং গড়ে উঠলে সন্তানের জন্ম সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব বাড়বে এবং এ প্রক্রিয়া সহজতর হবে। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে শিশু-জন্মের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। কোন্ এলাকায় কত শিশু জন্মগ্রহণ করল, কত শিশু স্কুলে গেল বা কতজন গেল না, ড্রপআউটের হার ও এর কারণ, বাসস্থান থেকে স্কুল কত দূরে, স্কুলে যেতে-আসতে কত সময় লাগে... ইত্যাকার বিষয় জানার নিমিত্তে জন্মের সাথে সাথেই প্রতিটি শিশুর নাম নিবন্ধন করাতে হবে এবং কত শিশুর অকাল মৃত্যু হয় তারও হিসাব রাখতে হবে।

শিশুর জন্মের ৩ বছর পর থেকে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৎপূর্বেই ব্রেইনওয়ার্ক শুরু হয়ে যায়। সুতরাং ৩ বছর বয়স থেকেই খেলাধুলার পাশাপাশি তাকে শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করে তুলতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন শুধু স্কুল বা মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করে সার্টিফিকেট অর্জনই মূল শিক্ষা নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ জীবনযাপনের জন্য মাছ বা পাখি শিকার শিখত, পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাত, কোন্টা কীভাবে করলে কী হয়, তা হাতে-কলমে শিখত। তেমনিভাবে শিশুদেরও প্রাকৃতিক ও মৌলিক শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। অতঃপর মস্তিষ্কের বিকাশের সাথে সাথে তার বিচরণ ক্ষেত্রের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে এবং সেটা হবে এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ের মাধ্যমে।

এলাকাভিত্তিক স্কুলিং নিশ্চিত হলে নির্দিষ্ট এলাকার স্কুলসমূহের শিক্ষার পরিবেশ ও গুণগতমান নিয়ন্ত্রিত হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। সন্তানের সুশিক্ষার জন্য অভিভাবকগণ নিজ স্বার্থেই স্থানীয় স্কুলের উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। সে সময়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্কুলসমূহের কোয়ালিটি কন্ট্রোলের জন্য কমিটি গঠিত হতে পারে। সরকারি-বেসরকারি সব শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত ঐ কমিটি এলাকার স্কুল তদারক করবে এবং শিশু-কিশোরদের মৌলিক শিক্ষার উন্নয়নে যাবতীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা দেবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে নিয়মিত মতবিনিময়ের ব্যবস্থাও থাকবে। এ পদ্ধতি কার্যকর করা হলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হবে সহজেই। ফলে কোচিংয়ের প্রয়োজন হবে না, কোচিং-ব্যবসা বন্ধ হবে, সাশ্রয় হবে অর্থ-শ্রম-সময়। কোচিংয়ের জন্য বাইরে যাতায়াত করতে না হওয়ায় এ বিষয়ে রাস্তায় যান চলাচল প্রয়োজন হবে না, ফলে যানজট হ্রাস পাবে।
schooling1

স্কুলের সময় নির্ধারণ, নারীশ্রম ও সময়ের অপচয়রোধঃ স্কুলের সময়টাকে এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিৎ, যাতে ঐ সময়কে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যায়। যেমন, আর্লি-মর্নিংকে কাজে লাগানো সম্ভব। এক্ষেত্রে সকাল ৭টায় স্কুল শুরু হয়ে ১০ টা বা ১১ টায় শেষ হতে পারে। এ সময়ে ছাত্র ও শিক্ষক ঠান্ডা মাথায় মর্নিং ওয়াক করতে করতে স্কুলে যাবে। সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়েই বাবা-মা নিজের কাজ করতে পারবেন। তাই আর্লি-মর্নিং স্কুলিং পদ্ধতি সবার জন্য উত্তম পন্থা হতে পারে। স্কুলে যদি দু’শিফ্ট করতে হয়, তাহলে আর্লি-মর্নিং শিফ্ট (৭টা থেকে ১০টা/১১টা) এবং ইভিনিং শিফ্ট (সন্ধ্যা ৫টা/৬টা থেকে রাত ৯টা) করা যেতে পারে। এভাবে এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ের ক্ষেত্রে ইচ্ছে করলে দুপুরের স্কুল-ব্যবস্থা এড়ানো যায়; যাতে বাবা-মা’র চাকরি বা পেশাগত কার্যক্রমে বিঘ্ন না ঘটে, অফিস-সময়ে যানজট না হয়, দিবা-ট্রাফিক হ্রাস পায়। সে সময়ে স্কুল শিক্ষকগণও প্রয়োজনে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ে দেশ ও জাতি লাভবান হবে যেভাবে-
১। স্কুলে যাতায়াতের জন্য যানবাহনের প্রয়োজন হবে না; ফলে যানজট থাকবে না, সড়ক দুর্ঘটনাও হ্রাস পাবে;
২। জাতীয় ক্ষেত্রে জ্বালানি তেল আমদানি ও গ্যাসের অপচয় রোধ হবে; বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং জাতীয় অর্থের অপচয় কমবে;
৩। যাতায়াত সঙ্কট ও যাতায়াত ব্যয় থাকবে না বলে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর পেছনে অভিভাবকের টেনশন থাকবে না এবং অর্থব্যয় হবে না;
৪। সন্তানের জন্য বাবা-মা’র অফিসের গাড়ি বরাদ্দের দুর্নীতি বন্ধ হবে;
৫। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শ্রম ও সময়ের অপচয় রোধ হবে;
৬। সন্তানের স্বার্থেই অভিভাবকগণ নিজ এলাকার স্কুলের উন্নয়নে তৎপর হবেন; সন্তানকে অন্য শহরে বা বিদেশে পাঠাতে হবে না;
৭। ভর্তি-প্রতিযোগিতা না থাকায় ভর্তি-দুর্নীতি দানা বাঁধবে না;
৮। স্কুল পর্যায়ে কোচিং-ব্যবসা ও শিক্ষা-বাণিজ্য বন্ধ হবে;
৯। কোচিং দরকার হবে না বিধায় এক্ষেত্রেও যাতায়াত বন্ধ হবে এবং যানজট থাকবে না;
১০। ড্রপআউট থাকবে না; ফলে টিজিং ও মাদকসহ কিশোর অপরাধ হ্রাস পাবে;
১১। মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে; শিশু-কিশোর বয়সেই শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, টিম-স্পিরিট, শেয়ারিং, স্মার্টনেস ইত্যাকার শিক্ষালাভ সহজ হবে;
১২। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভাজন হ্রাসের ফলে সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য হ্রাস পাবে;
১৩। সামগ্রিকভাবে স্কুলে শিক্ষার মান ও পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে;
১৪। শিশুর জন্ম ও ক্রমবৃদ্ধির সঠিক ও যথাযথ পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব হবে;
১৫। মেধাবী ও প্রতিভাবান জাতি এবং জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন সহজ হবে।

তাই এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। পাড়া-মহল্লায় অবস্থিত বর্তমানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে মানোন্নয়নের মাধ্যমে পুনর্গঠন করতে হবে। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, যা প্রতিটি মানুষের সুন্দর জীবনের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ বা জাতিই সমৃদ্ধ হয়নি। তাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আধুনিক ও গুণগত শিক্ষা এবং জীবনমান উন্নয়নে সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা থাকা বাঞ্ছনীয়। আর সে দিকনির্দেশনার প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপই হল ‘এলাকাভিত্তিক স্কুলিং’। schooling

বাস্তবায়ন শুরু করা যায় যেভাবে
সরকার ইচ্ছা করলেই যেকোনো সময়ে এলাকাভিত্তিক স্কুলিং বাস্তবায়ন করতে পারে। এজন্য বড় ধরনের পরিকল্পনা বা পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না। প্রয়োজন শুধু সরকার ও নীতি-নির্ধারকগণের সদিচ্ছা।

আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এক এলাকার শিশু অন্য এলাকার স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না, এরূপ জনবিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে সরকার অনায়াসে এ পদ্ধতি চালু করতে পারে। স্কুল কর্তৃপক্ষকেও নির্দেশ দিতে হবে, যেন তারা কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট মহল্লা বা ওয়ার্ডে বসবাসকারী শিশু-কিশোরদেরকেই স্কুলে ভর্তি করে। যেসব শিশু-কিশোর বর্তমানে নিজ মহল্লা বা ওয়ার্ডের বাইরের স্কুলে পড়াশোনা করছে, তাদেরকে ১/২ বছরের মধ্যে নিজ এলাকার স্কুলে ফিরে আসতে হবে।

এরূপ বা অনুরূপ ঘোষণার মাধ্যমে বর্তমানের দুর্বিষহ যানজট থেকে পরিত্রাণের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নসহ বহুবিধ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সরকারের এরূপ ঘোষণায় অভিভাবকগণ তৎপর হয়ে উঠবেন নিজ এলাকার স্কুলের অধিকতর উন্নয়নে। তাই উপরোল্লিখিত ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ সুবিধার কথা বিবেচনা করে সরকার এখনই এলাকাভিত্তিক স্কুলিং বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবেন বলে বিশ্বাস।

সরকার বা নীতিনির্ধারকগণ আমার এ প্রস্তাবনার সাথে দ্বিমত না হলে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এটি খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়। বাস্তবায়ন শুরুর বর্ষকে target বা লক্ষ্য করে তার কয়েক বছর পূর্বে তথা এখনই এ বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত জারি করতে হবে। যেমনঃ ২০১৮ সাল থেকে সকল স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি এলাকাভিত্তিক হবে বাস্তবায়নের এরূপ লক্ষ্য স্থির করলে ২০১৪ সালের মধ্যে তা ঘোষণা বা জারি করা যায়।

জারি করার পর বাবা-মা, স্কুল শিক্ষক ও তৎসংশ্লিষ্ট সকলের আগাম জানা থাকল যে, ২০১৮ সাল থেকে আর কোনো শিশু দূরবর্তী স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না এবং ভর্তি করানোও যাচ্ছে না। এতে স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায়, মনে নিয়ে, মেনে নিয়ে অথবা বাধ্য হয়ে সংশ্লিষ্টরা নিম্নরূপভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করবেন।

অভিভাবক যেহেতু জানেন যে, ২০১৮ সাল থেকে তার সন্তানকে পার্শ্ববর্তী স্কুলেই ভর্তি করাতে হবে, সেহেতু প্রতিটি স্কুলের ওপর নজরদারি শুরু করে দেবেন পার্শ্ববর্তী অভিভাবকরাই; এমনকি স্কুলের উন্নয়নে তারা মরিয়া হয়ে উঠবেন। আপন বাসা-বাড়ির ন্যায় পার্শ্ববর্তী স্কুলকে নিজ সন্তানের লালনকেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করে সে শিক্ষালয়কে ভালোবাসতে ও কদর করতে শুরু করবেন। সরকারের আগাম ঘোষণার ফলে কেউই অসুবিধায় পড়ার বা ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকবে না। পদ্ধতিগত পরিবর্তনের অসুবিধা কাটাতে ৩ থেকে ৫ বছর সময়ই যথেষ্ট।

আগাম নোটিশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের এ কৌশলের ফলে এতদসংক্রান্ত বহু কাজ সরকারের করার দরকার হবে না। জনতা নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের মতো করে পার্শ্ববর্তী স্কুলের উন্নয়নে মনোযোগী, চিন্তিত ও সম্পৃক্ত হয়ে উঠবে। কমিউনিটি অভিভাবকরাই স্কুলের মান উন্নত করে ফেলবে। এ জন-মনোযোগের সাথে সরকারের সহযোগিতা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ স্বরূপ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়/বিভাগ তার অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে আরও কার্যকর ও আধুনিকায়ন করবে এবং থানা শিক্ষা অফিসারের কর্তব্য ও দায়িত্ব বাড়াবে।

থানা শিক্ষা অফিসারের প্রাথমিক কাজ হবে তার থানাধীন কোন্ ওয়ার্ডে বর্তমানে কত স্কুল এবং কত শিক্ষার্থী আছে, ভবিষ্যতে ঐ ওয়ার্ডে শিক্ষার্থী হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাবনা ও হার কেমন হতে পারে এসব সরেজমিন জরিপ রিপোর্ট তৈরি করা। ভবিষ্যত শিক্ষার্থী হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাবনা জরিপকে কেউ কেউ কঠিন মনে করতে পারেন এবং তা Accurate নাও হতে পারে বলে হয়ত মন্তব্য করবেন। তবে সংশ্লিষ্ট এলাকার উন্নয়ন, উপযোগিতা ও সম্ভাব্য জনচাপকে বিবেচনা করলে এ বিষয়ে সম্যক উপলব্ধি কঠিন কিছু নয়। যেমন ঢাকার লালবাগ বা টিকাটুলীতে আগামীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়বে না বরং কমবে। সদরঘাটের লঞ্চ ঘাটের অত্যাবশ্যকীয়তার কারণে সে এলাকার শিক্ষার্থীর হ্রাস-বৃদ্ধি হবার তেমন সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে আগামীতে উত্তরা, বারিধারা বা মিরপুরে শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বাড়বে। কারণ পুরাতন ঢাকা যেমনি ক্রমান্বয়ে পরিত্যক্ত হচ্ছে, তেমনি আধুনিক ঢাকা হিসেবে উত্তরা বা বারিধারা জোন দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে বিধায় সেখানে জনবসতি ও জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংগত কারণেই উত্তরায় প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করতে হবে। এসব স্কুল সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
schooling

সরকার উদার ও কৌশলী হলে এবং আমলাতান্ত্রিকতা হ্রাস করলে জনগণই প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে তাদের কাক্সিক্ষত সুউন্নত স্কুল। সরকারের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের চেয়ে জনতার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের মান-গুণ-জনপ্রিয়তা সবই ভালো হবে বলে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। কারণ সরকার প্রতিষ্ঠিত বা নিয়ন্ত্রিত স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, হাসপাতাল বা শিল্প-কারখানার চেয়ে জনতার (বেসরকারিভাবে) প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ফলাফল, গুণগত মান, লাভ বা Output সবই ভালো হচ্ছে বলে প্রমাণিত।

ভালো স্কুল বা শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ৯০% একক শর্ত হচ্ছে ভালো শিক্ষক নিয়োগ। অধিক বেতনে ভালো শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে বহু বেসরকারি স্কুল বা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের ফলাফলের শীর্ষত্বের কারণে ছাত্র-অভিভাবকরা সেখানে ভিড় জমাচ্ছে। সে ভিড় সামাল দিতে না পেরে এসব স্কুল কলেজের শাখা-প্রশাখা বেড়েই চলেছে। সাফল্যের শীর্ষের সেসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদেরকে আকর্ষণীয় বেতন ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েও ছাত্রদের স্টাডি ট্যুরসহ নানারূপ রিক্রিয়েশন ও শিক্ষামূলক আয়োজন করে থাকে। সরকারি স্কুল কলেজের তুলনায় এত্তসব আধুনিক ও যুগোপযোগী সুযোগ-সুবিধা প্রবর্তন করেও এসব বেসরকারি শিক্ষালয় ব্যাংক একাউন্টে জমা করছে কোটি কোটি টাকা; নির্মাণ করছে নিজস্ব বহুতল ভবন, অত্যাধুনিক লিফট্, জেনারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুম, ল্যাব, অটোমেশন সিস্টেমসহ নানাকিছু। তাই যথোপযুক্ত বেতন দিয়ে মেধাবীদেরকে স্কুল শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করলে বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষার দুর্বলতা কেটে ১৫ বছরের মধ্যে তৈরি হবে প্রতিভাবান, আধুনিক ও উচ্ছল-উজ্জ্বল জাতি। এসবের পাশাপাশি সরকারিভাবেও পাঠ্য-পুস্তকের মান উন্নয়নে বিনিয়োগ ঘটিয়ে এবং স্কুলে পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন খুবই জরুরি।

থানা শিক্ষা অফিসারকে সমন্বয়ক করে প্রতি ওয়ার্ডে ৭ বা ১১ সদস্যের শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি বা ফোরাম গঠন করা যেতে পারে, যেরূপ শহর সমাজসেবা প্রকল্পের অধীন ঢাকায় আঞ্চলিক সমাজসেবা কমিটি কাজ করছে এরূপ বা অনুরূপ কমিটি করা যেতে পারে। এতে সরকারের কাজের চাপ কমে যাবে, সাশ্রয় হওয়া সময় অন্য গঠনমূলক কাজে লাগাতে পারবে। প্রতি এক বা দু’বছরে পরিবর্তনীয় এ কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের না থাকাই ভালো। তাতে একদিকে ওয়ার্ড বা মহল্লার বিদ্যোৎসাহী ও কল্যাণকামী সকলেই বাই রোটেশন বা পর্যায়ক্রমে নিজ এলাকার শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখার সুযোগ পাবেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক মতদ্বৈধতাও এড়ানো সম্ভব হবে। এদের নিয়মিত ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে ৩ বা ৫ বছর অন্তর সংশ্লিষ্ট এলাকার স্কুল শিক্ষার্থীর হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাব্য হার নির্ধারণ করা এবং তদনুযায়ী হয় স্কুল প্রতিষ্ঠায় নিজেদের উদ্যোগ নেয়া, নতুবা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়া। বর্তমান অনুন্নত স্কুলের মানোন্নয়ন, যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক ও স্টাফ নিয়োগ, অতিরিক্ত শিক্ষক বা স্টাফ বাদ দেয়া, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে এমনকি প্রয়োজনে বার্ষিক নাগরিক সভা করে তাদের মতামত ও পরামর্শক্রমে নিজ এলাকার শিক্ষা-উন্নয়ন নিশ্চিত করা।

এ ব্যবস্থায় স্কুল শিক্ষার্থীর আবাসন বা বাসা পরিবর্তন করতে হলে তাকে বা অভিভাবককে বিদায়ি এলাকার শিক্ষা ফোরামের ছাড়পত্র এবং আগমনি এলাকার ফোরামের অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া ঐ পরিবারের সদস্যদের জন্ম এবং স্বাস্থ্যগত তথ্যও পূর্ববর্তী ওয়ার্ড থেকে স্থানান্তরিত ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করতে বা করাতে হবে।

এভাবে বা অনুরূপ যেকোনোভাবে এলাকাভিত্তিক স্কুলিং বাস্তবায়ন কঠিনতো নয়ই; একেবারেই সহজ। এ বিষয়ে প্রয়োজনে উন্নত বিশ্ব বিশেষত ব্রিটেনে প্রচলিত এলাকাভিত্তিক স্কুলিং পদ্ধতি অনুসৃত হতে পারে। নেতিবাচক ধ্যান-ধারণার দু’চারজন হয়ত এ প্রস্তাবনার সমালোচনায় প্রয়াসী হবেন। তবে এ বিশ্বাসে আমি নিশ্চিত যে, কল্যাণ উদ্যেশ্যের যেকোনো সমালোচনা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি স্থানীয় অভিভাবক ফোরামে উত্থাপিত হলে তার সমাধান হবেই।

আমাদের দেশে একই দিনে যে জাতীয় নির্বাচন হয়, তা স্বচ্ছ ও অবারিত বলে জনগণ গ্রহণ করে থাকে। অথচ সেক্ষেত্রে ২/৪টা জাল ভোট কি পড়ছে না? সেই ২/৪টি জাল ভোট সমগ্র ভোট ব্যবস্থাকে বানচাল করতে পারে কী? যদি না পারে, তাহলে এলাকাভিত্তিক স্কুলিং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নগণ্য অসুবিধার ধুয়া আমাদের জাতীয় মেধা উন্নয়ন বা মেধা লালনের এই সহজ সমাধানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে কেন?

বর্তমান স্কুলিং ব্যবস্থায় নানা সমস্যা ও ত্রুটি
বর্তমান স্কুলিং ব্যবস্থায় নানা সমস্যার মূলে রয়েছে এক এলাকার শিক্ষার্থী অন্য এলাকার স্কুলে অবাধে ভর্তি হওয়া। জনবহুল দেশে বা শহরে বাসিন্দারা যত বেশি বাইরে চলাচল করবে, তত বেশি যানজট সৃষ্টি হবে এবং সময় ও শ্রম নষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। ঢাকা মহানগরীর গুলশান, মিরপুর বা বনানীতে বসবাসকারী অনেকেই তাদের শিশু-সন্তানকে সিদ্ধেশ্বরী বা মতিঝিলের স্কুলে ভর্তি করান। আবার সিদ্ধেশ্বরী-সেগুনবাগিচা বা মতিঝিলের অনেকের সন্তান ভর্তি হয় গুলশান, বারিধারা বা মিরপুরের স্কুলে। ফলে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিতে এবং স্কুল ছুটির পর তাকে ফিরিয়ে আনতে অভিভাবকদের প্রচুর সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় হয় যে অপচয়ের ক্ষতি সামষ্টিক ও জাতীয় হিসাবে ব্যাপক ও অপূরণীয়।

তাছাড়া পাহাড়ি অঞ্চল, চরাঞ্চল, হাওড়-বাওড়, চা-বাগান বা মঙ্গাপ্রবণ এলাকার শিশুদেরকে দুর্গম-দূরবর্তী স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে হয় বলে অনেক শিশু স্কুলে যেতে পারে না বা গেলেও অল্পদিনেই ঝরে পড়ে। সরকারের জোর প্রয়াস থাকা সত্ত্বেও এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মঙ্গা ও দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন কারণে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন এ যাবৎকালে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

দূরবর্তী স্কুলে যাওয়া-আসায় প্রতিদিন প্রতি শিক্ষার্থীর অপচয় হয় ২ থেকে ৪ ঘন্টা। প্রতি শিক্ষার্থীকে স্কুলে নেয়া-আনা করতে মা/বাবা ও ড্রাইভার প্রত্যেকের দৈনিক ২ থেকে ৪ ঘন্টা করে সময়ের অপচয় হয়। ফলে প্রতিদিন প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে একটি পরিবারের অপচয় হয় ৬ থেকে ১২ ঘন্টা। এভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে প্রতিবছর সময়ের অপচয় হয় ২১৯০ থেকে ৪৩৮০ ঘন্টা অর্থাৎ ৯১ থেকে ১৮২ দিন। তাছাড়া আর্থিক ক্ষতি, শ্রমের অপচয় ও সড়ক দুর্ঘটনাতো রয়েছেই।

স্কুলগামী প্রতি সন্তানের মাকে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে সন্তানকে স্কুলে আনা-নেয়ায় এবং স্কুল প্রাঙ্গণে সন্তানের অপেক্ষায়। এভাবে অপচয় হচ্ছে মায়ের প্রাণশক্তিও; তাকে প্রতিদিন সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা। এতে করে ঐ মা অন্য সন্তানদের বা পরিবারের অন্য সদস্যদের দেখভালের ক্ষেত্রে অথবা সংসার জীবনের অন্যান্য বিষয়ে পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারছেন না এবং পারিবারিক জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মারাত্মকভাবে। এটি শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অপচয়ই নয়, এ অপচয় সমাজ বা রাষ্ট্রেরও। তাই দেশ ও জাতির এ বিপুল সময়, শ্রম ও অর্থের অনাকাক্সিক্ষত অপচয় এখনই বন্ধ করা জরুরি।

স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক যে লটারি-পদ্ধতির উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে তাতে ভর্তি সমস্যা, শিক্ষা সমস্যা ও যানজট সমস্যাসহ বহুবিধ সমস্যার কোনোটিই বাড়বে বৈ কমবে না। স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে তথা জীবনের শুরুতেই শিশুদেরকে মেধা ও সৃজনশীলতার খেলা শেখার পথ থেকে সরিয়ে কী কারণে যে লটারি বা প্রকারান্তরে জুয়াবাজি শেখানো হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। লটারির খেলাতো স্বাভাবিক বা সাধারণ খেলা নয়। অনন্যোপায় হয়ে তথা অন্য কোনো উপায় না থাকলে সেক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে বেছে নিতে হয় লটারির খেলা। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে জীবনের শুরুতেই লটারির মতো অস্বাভাবিক খেলা শিখতে বাধ্য করে দেয়া একেবারেই অনুচিত। এমনকি মেধা বাদ দিয়ে যদি লটারির খেলা কোমলমতি শিশুদেরকে শিখতেই হয়, তাহলেও তা স্ব স্ব এলাকার শিশুদের সাথেই তারা খেলবে এবং তা খেলবে সন্নিকটস্থ স্কুল ক্যাম্পাসেই; দূরবর্তী স্কুলে গিয়ে নয়। বারিধারার শিশুরা ধানমন্ডির স্কুলের লটারিতে যাবে না অথবা ধানমন্ডির শিশুরা বারিধারা বা সিদ্ধেশ্বরীর স্কুলে লটারি খেলবে না। অর্থাৎ যার বাসা-বাড়ি স্কুলের যত কাছে, ভর্তির ক্ষেত্রেও নিকটস্থ স্কুলে তার তত অগ্রাধিকার থাকা উচিত।
schooling
স্কুল শিক্ষকদের শিক্ষা-বহির্ভূত কাজঃ বর্তমান স্কুলিং ব্যবস্থায় শিক্ষকগণকে প্রায় সারাদিনই স্কুলে থাকতে হয়। স্কুলে পাঠদানের বাইরে কোনো সময় না থাকলেও সরকারি স্কুলের শিক্ষকগণকে করতে হয় নানা সরকারি কাজ। যেমন ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভোট গ্রহণ, টিকা খাওয়ানো, ওএমএস’র চাল বন্টন, বিভিন্ন জরিপ ও সুপারভিশন ইত্যাকার সরকার নির্দেশিত কাজ, যা শিক্ষা-বহির্ভূত। এসব সরকারি কাজের চাপ এত জরুরি, অত্যাবশ্যক ও স্পর্শকাতর যে শিক্ষকগণ অগত্যা দায়সারাভাবে স্কুলে পাঠদানের কাজ করেন; কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঠদান ফেলে রেখেই অনুরূপ জরুরি সরকারি কাজ করতে বাধ্য হন।

এভাবে সরকারের সরকারি করতে গিয়ে স্কুলে পাঠদানের দায়িত্বেও চলে আসে সরকারিভাব, যে ভাব পরবর্তীতে স্বভাবে ও সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। অর্থাৎ শিক্ষার কারিগরদের হাতেই শিক্ষার মূল কাজের ব্যাঘাত ঘটে, প্রকারান্তরে সর্বকাজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে দেশে স্বয়ং সরকারই শিক্ষা-ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে থাকে, রাজনীতিবিদরা শিক্ষকগণকে রাজনীতির আওতাভুক্ত করেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক-শ্রমিক হিসেবে, শিক্ষা নিয়ে যে দেশে চলে রকমারি বাণিজ্য, সে দেশের শিক্ষার মান এবং দেশ ও জাতির ভবিষ্যত যে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

শিক্ষকদের দিয়ে যদি কোনো সরকারি বা সামাজিক কাজ করাতেই হয়, তাহলে বিদ্যালয়ে তাঁর দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে সে সুযোগ তৈরির মাধ্যমে ঐ কাজ করাতে হবে। অর্থাৎ ক্লাস নেয়ার দায়িত্বকে তাঁর মুখ্য ও অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে রেখে তারপর তাঁকে অন্য কাজ দিতে হবে। এক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত মর্নিং ও ইভিনিং শিফ্ট চালুর মাধ্যমে শিক্ষকদের দিয়ে দুপুরে অন্য কাজ করানো সম্ভব। সর্বোপরি শিক্ষকদের দিয়ে বিদ্যালয়ের কাজ ছাড়া অন্য কাজ করালে পেশাগত কাজে বিঘ্ন ঘটা স্বাভাবিক। সে বিঘ্নের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করাও ঠিক হবে না।

বর্তমান স্কুলিং পদ্ধতিতে যেসব সমস্যা প্রকট হচ্ছে
১. মৌলিক শিক্ষায় মারাত্মক ত্রুটি ও গলদ;
২. শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়ের সময়, শ্রম, প্রাণশক্তি ও অর্থের ব্যাপক অপচয়;
৩. শহরে দূরবর্তী স্কুলে যাতায়াতের কারণে গাড়ি ও জ্বালানির অপচয়;
৪. গ্রামে ও দুর্গম অঞ্চলের দূরবর্তী স্কুলে যাতায়াত সম্ভব হয়ে ওঠে না;
৫. রাস্তায় দুর্বিষহ যানজটে চরম জনদুর্ভোগ;
৬. স্কুলের সামনে ও রাস্তায় অভিভাবকদের জটলা এবং কষ্টদায়ক সুদীর্ঘ অবস্থান;
৭. সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায়শ শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যু;
৮. স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকদের অনেকের সন্তান অন্য এলাকার ভালো স্কুলে পড়াশোনা করে বলে নিজ এলাকার স্কুলের মানোন্নয়ন ও শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে তাদের অনাগ্রহ ও উদাসীনতা;
৯. হাতে গোনা দু’একটি স্কুল মানসম্মত হলেও অধিকাংশের মান ভালো নয়;
১০. কোচিং-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা;
১১. ড্রপআউট বৃদ্ধির ফলে মাদক, টিজিংসহ কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি;
১২. ক্রমবর্ধমান শিক্ষাবৈষম্য;
১৩. দেশ ও জাতির যোগ্য নাগরিক তৈরিতে স্কুলের ব্যর্থতা;
১৪. অত্যাধুনিক বিশ্ব-ব্যবস্থা ও উন্নত দেশের সাথে তাল মেলাতে বাংলাদেশের ব্যর্থতা, অনগ্রসরতা এবং নানা ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা।

বহু সমস্যার একক সমাধান এলাকাভিত্তিক স্কুলিং
উপরোল্লিখিত বহুবিধ সমস্যার একক সমাধান হচ্ছে এলাকাভিত্তিক স্কুলিং। স্কুল-শিক্ষার শুরু ও বিকাশ পুরোটাই এলাকাভিত্তিক হলে এর মাধ্যমে একটি গ্রামের সন্তান যেমনি ঐ গ্রামেই শিক্ষালাভের সুযোগ পাবে, তেমনি শহরের ক্ষেত্রেও মহল্লার সন্তান নিজ মহল্লায় বা পাড়ায় বিকশিত হয়ে উঠবে। ভালো স্কুলে পড়ানোর আকাঙ্ক্ষায় অভিভাবকগণ সন্তানকে দূরবর্তী এলাকার স্কুলে ভর্তি করে থাকেন। এতে স্থানীয় সাধারণ স্কুলে ভর্তি সংকট দেখা দেয়, যার সমাধানে তৈরি হয় বহুমুখী জটিলতা।

অথচ নিজ এলাকার স্কুলের মানোন্নয়নের মাধ্যমে সে আকাঙ্ক্ষা পূরণের পাশাপাশি বহু সমস্যার সমাধান যে সম্ভব তা অনেকের বোধে আসে না অথবা বোধে এলেও সরকার ও কর্তৃপক্ষীয় সহযোগিতার অভাবে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

এলাকাভিত্তিক স্কুলিং আলোকিত জাতির প্রাথমিক ও প্রধান সোপান
বিত্তের প্রতি আমাদের উন্মত্ত আসক্তি এবং বিত্তের কাছে সব নৈতিকতার পরাজয় আমাদের সন্তানদের মাঝে জাগিয়েছে লোভের আগুন। বিত্ত অর্জনে আমরা মরিয়া হয়ে উঠেছি। নীতি-আদর্শ-বিবেক কোনো কিছুর স্থান নেই এ অন্ধ নেশার কাছে। সেসাথে অসৎ ও অন্যায় উপার্জনে গড়ে তুলছি সন্তানদের, তাদের পেছনে ঢালছি অঢেল টাকা। তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে হার মানছি, নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছি অন্যায় আবদার।

পরিণামহীন এক সর্বনাশী প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি আমরা। কি আত্মীয়, কি বন্ধু, কি স্বজন; সবার সঙ্গেই আমাদের অঘোষিত যুদ্ধ, নিত্য প্রতিযোগিতা সমানে সমান হতে হবে; অর্জন করতে হবে লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, ফ্যাশনের বাড়ি। আর এই প্রতিযোগিতার যুদ্ধংদেহী ডামাডোলে জড়িয়ে পড়েছে আমাদের শিশুরাও। তারা জানে না একসঙ্গে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার কী আনন্দ, মাঠে খেলার আনন্দতো উবেই গেছে কবে। সহপাঠী-বন্ধুর সঙ্গে পারস্পরিক ভাগাভাগির যে সম্পর্ক, তাও তারা জানে না। একজনের সঙ্গে অন্যজনের বইয়ের আদান-প্রদান নেই, নেই ভালো লেখা বা নোটের দেয়া-নেয়া, সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি তারা জানে না। অভিভাবকরাও বাচ্চাদের এ ধরনের আদান-প্রদানে নিরুৎসাহিত করেন। ‘শুধু আমার সন্তান শ্রেষ্ঠ হোক’ এ ব্যক্তিক বা ক্ষুদ্র চিন্তায় সংকীর্ণ করে ফেলেছি আমাদের সমষ্টিগত বিশাল স্বার্থকে। ফলে স্বার্থপরতা, হীনম্মন্যতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার শিক্ষালাভ করছে আমাদের সন্তানরা। তাই কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মাথায় পড়ার বিষয় কিঞ্চিৎ খেলা করলেও কল্যাণকর জ্ঞানের বিষয় কাজ করে না মোটেও। সৃজনশীল বিষয় নিয়ে কথা বলে না তারা সহপাঠীর সাথে, এমনকি পিতা-মাতার সাথেও। পাঠের ভালো নোট তৈরির চেয়ে কড়কড়ে টাকার নোটের গন্ধ তাদের বেশি প্রিয়। ফলে সন্তানের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত আচরণ পাওয়া যাচ্ছে না।

আমাদের সন্তানরা এখন কথা বলে অদ্ভুত ভাষায়; আধো বাংলা, আধো ইংরেজি, কিঞ্চিৎ হিন্দী। জগাখিচুড়ির এই ভাষা তাদের স্মার্টনেসের প্রকাশ বলে তারা মনে করে। কিন্তু পরখ করলে দেখা যায় যে তারা না জানে শুদ্ধ বাংলা, না জানে ইংরেজি, না জানে হিন্দী। কোন্ ভাষা বা কোন্ পরিচয় তাকে সম্মান দেবে বা সমৃদ্ধ করবে; কোন্ আচরণ-চালচলন তাকে করবে স্মার্ট বা সম্ভ্রান্ত, পরিবার-সমাজ ও বিশ্ব পরিসরে কার জন্য কি করণীয় এসবের কোনো কিছুই তারা জানে না।

কড়কড়ে টাকার নোট, বিলাসী রঙিন গাড়ি, জগাখিচুড়ির ভাষা সব মিলিয়ে শিশু-কিশোর-তরুণ-যুব সমাজ আজ চরম বিভ্রান্ত। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে চাতুর্যপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর ধারণায় তারা ভুগছে মূল্যবোধ সংকট ও পরিচয় সংকটে। এরূপ নানা বিভ্রান্তি ও অশিক্ষায় আমরা সন্তানদের সঠিক পথ চেনাতে ব্যর্থ হচ্ছি, তারাও ব্যর্থ হচ্ছে জীবন ও জগতের কাঙ্খিত পাঠ নিতে। বঞ্চিত হচ্ছে মমতা ও ভালোবাসার আনন্দ থেকে; মানব সেবার তৃপ্তি ও সুখ থেকে।

ছাত্র-তরুণদের এ অবক্ষয়ের কারণ কিন্তু আমরা এই বড়রা; অভিভাবক-সমাজপতি-রাজনীতিকরা। আমাদের নীতি-সিদ্ধান্ত ও নৈতিকতার অপরিপক্কতা বা ছেলেমানুষী কিশোর-তরুণ সমাজকে বিপথগামী করে তুলছে; আসক্ত করে ফেলছে ইভটিজিং, মাদক ও বিভিন্ন নেগেটিভ বিষয়ের প্রতি। আমি এখনো বিশ্বাস করি যে, টিজিং ও মাদকের মতো নেগেটিভ বিষয়কে স্লোগানে-বক্তৃতায় বা প্রচার-প্রপাগান্ডায় না এনে তৎপরিবর্তে পারিবারিক ভালোবাসা আন্দোলনে জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও জাগ্রত করলে দ্রুত সুফল মিলত। যে চিন্তা-চেতনা থেকে টিজিং, মাদক বা অনুরূপ অন্যায়ের উৎপত্তি, সেই চিন্তার সূত্রপাত তথা Primary brain programming হয় পরিবারে; যে প্রোগ্রামিংয়ের এডভান্সড্ লার্নিং হয় শিক্ষায়তনে এবং শেষতক তা বদ্ধমূল হয় তার আশপাশের সামাজিক ও রাজনৈতিক আচার-আচরণের প্রভাবে। তাই পরিবারে-ক্লাসে-ক্লাবে-পাড়ায়-মহল্লায়, অফিস-আদালতে নেতিবাচক কথা-চিন্তা-কর্ম পরিহার এবং তদস্থলে ইতিবাচক চিন্তা ও কর্মের উদ্যোগ যত দ্রুত গৃহীত হবে, তত দ্রুতই টিজিংসহ সকল শিশু-কিশোর অপরাধ হ্রাস পাবে। আর সে উদ্যোগের বাস্তবায়ন যতদিন পর নিশ্চিত হবে, ততদিন পরই বন্ধ হবে টিজিংসহ সকল সামাজিক ব্যাধি।

১৬ কোটি জনসংখ্যার এদেশ থেকে ১৬ জন ভালো মানুষ খুঁজে বের করতে হিমশিম খাচ্ছে যে ছাত্র-যুবক, যার সম্মুখে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বা চরিত্রের বড় অভাব, অভাব রোল মডেল বা আদর্শ ব্যক্তিত্বের সেই ছাত্র-তরুণদের কাছ থেকে টিজিং ছাড়া আর কী মহত্ব আশা করা যায়? schooling

মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি, সন্ত্রাস, টিজিং, মাদক, ঘুষ-দুর্নীতি, ছিনতাই ও চুরিসহ সকল অপকর্ম, অপশক্তি ও কুচিন্তার অবসানে প্রয়োজন সুস্থ মনন ও প্রোএকটিভ এটিচিউড যা কেবল সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থেকেই আসে। মৌলিক শিক্ষা তথা প্রাথমিক স্কুলিংই সকল শিক্ষা ও জ্ঞানের মূল ভিত্তি। শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন নির্মাণ যেমনি পাগলামির সামিল, তেমনি সঠিক প্রাইমারি শিক্ষা ছাড়া উন্নত ও আদর্শ জাতির প্রত্যাশা নির্বুদ্ধিতা মাত্র। দুর্বল ও ঘুণে ধরা প্রাথমিক শিক্ষার ভিত থেকে জাতির কোনো সুফল আশা করা যায় না। তাই দেশ উন্নয়ন ও জাতি জাগরণে প্রথম প্রয়োজন স্কুলিং ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং এলাকাভিত্তিক স্কুলিং বাস্তবায়ন।

আমাদের ফিরে আসতে হবে সৌন্দর্যের কাছে, মানবিক মূল্যবোধগুলোর কাছে। সন্তানদেরকে দিতে হবে অনন্ত সৌন্দর্যময় জগতের সন্ধান; দেখাতে হবে আনন্দের জগৎ, নিয়ে যেতে হবে আনন্দালোকে, শেখাতে হবে দেশপ্রেম, ভালোবাসার মাধুর্য ও ত্যাগের আনন্দ। তবেই তারা জ্বলে উঠবে আপন শক্তিতে এবং হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ মানুষ; দেশ যাদের নিয়ে গর্ব করবে এবং যারা গর্ব করবে দেশ ও জাতিকে নিয়ে। এরূপ সৃজনশীল মানব সম্পদ এবং জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ তথা আলোকিত জাতি গড়ে তোলার প্রথম ও প্রধান সোপান ‘এলাকাভিত্তিক স্কুলিং’।

মুরগির খাঁচার ন্যায় কাভার্ড ভ্যানে বা রিক্সা-ভ্যানে করে শিশুকে স্কুলে নেয়া-আনা করালে সে শিশুর কাছ থেকে Chicken Heart ছাড়া উদার বা বড় কিছু আশা করা যায় না। শিশু-মেধার বিকাশকে রাস্তার যানজটে আটকে রেখে এবং শিশুকে গাড়ির ধোঁয়া ও ধুলোবালি খাইয়ে যেভাবে তার স্বাস্থ্য ও মেধা ধ্বংসের পাশাপাশি জাতির সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি করা হচ্ছে, তা রক্ষার্থে এখনই প্রয়োজন এলাকাভিত্তিক স্কুলিং ব্যবস্থার বাস্তবায়ন।

মেধাবী জাতির জন্য চাই মেধাবী শিক্ষার্থী
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় স্কুল শিক্ষা ও ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক রাখলেও কলেজ শিক্ষা ও ধর্মচর্চা রাখা উচিত ঐচ্ছিক। স্কুল শিক্ষাব্যবস্থা হবে অবশ্যই একমুখী ও বৈষম্যহীন। ছাত্র-ছাত্রীরা শিশুবেলায়ই শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও আবদ্ধ হবে। এলাকাভিত্তিক ও আধুনিক এরূপ স্কুলিং ব্যবস্থা আমাদের জাতীয় বহু সমস্যার সমাধান এনে দেবে; আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হয়ে যাবে অর্থনৈতিক নানা সমস্যার; শক্তভাবে গড়ে উঠবে গুণগত শিক্ষার প্রাথমিক ভিত, সহায়ক হবে উন্নততর ও কার্যকর উচ্চশিক্ষা কাঠামো নির্মাণে; বর্তমান বিভাজিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে যে বিভক্ত করে ফেলছে, তা থেকেও রক্ষা পাবে জাতি; হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মতো জেএমবি তৈরির সুযোগ থাকবে না শিক্ষাঙ্গনে।

এলাকাভিত্তিক স্কুলিং প্রবর্তিত হলে প্রাথমিক শিক্ষার মজবুত ভিতের ওপর তৈরি হবে উচ্চশিক্ষার কাঠামো, যে কাঠামোতে প্রবেশাধিকার থাকবে শুধু মেধাবীদের। শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত এ মেধাবী শ্রেণিই দেশের শিক্ষা-গবেষণা-সরকার ও রাজনীতি পরিচালনার জন্য তৈরি হবে। বাকি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার পেছনে সময় ও অর্থের অপচয় না করে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের মধ্য দিয়ে দক্ষ ও সুযোগ্য নাগরিকে পরিণত হবে। এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ের মাধ্যমে এরূপ পরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা মেধাবী ছাত্র ও দক্ষ নাগরিকরাই পরিণত হবে প্রতিভাময় ও আলোকিত জাতিতে। এভাবে গড়ে ওঠা একটি মেধাবী প্রজন্মই সহজে বদলে দেবে সমাজ, দেশ কিংবা সমগ্র বিশ্ব।