ক্যাম্পাসঃ আমার স্বপ্নের অবিচ্ছেদ্য অংশ

ড. নাজনীন আহমেদ
অনারারী রিসার্চ ডিরেক্টর, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

পরিণয় সূত্রে আমার পরিচয় ক্যাম্পাস’র সাথে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এম হেলাল’র সাথে দাম্পত্য জীবন শুরুর পর থেকেই মূলত এ প্রতিষ্ঠানকে জানতে শুরু করি। এর আগে কেবল ক্যাম্পাস পত্রিকাটি পড়তাম, অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কে কিংবা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতাম না। ১৯৯৪ সালে যখন ক্যাম্পাস’র সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়, তখন এর অফিস ছিল মতিঝিল মডার্ন ম্যানসনের ১৫ তলায়; ভাড়া করা স্বল্প পরিসরের পত্রিকা অফিস। তবে কার্যক্রম ছিল পত্রিকা প্রকাশনার চেয়েও ঢের বেশি। মাদক ও ধূমপান বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি, ত্রাণ কার্যক্রম, দরিদ্র-মেধাবী ছাত্র-যুবকদের বৃত্তি প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম লেগেই থাকত। বিবাহিত জীবন শুরুর সে সময়েও স্বামী এম হেলালের কাছ থেকে তাঁর ব্যক্তি জীবনের পরিকল্পনার চেয়ে বেশি শুনতাম ক্যাম্পাস কার্যক্রমকে ঘিরে জাতীয় উন্নয়ন ও অত্যাধুনিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা এবং এরূপ সুদূরপ্রসারী বহু পরিকল্পনার কথা। তাঁর কেবলই ভাবনা, কীভাবে এই কল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলোর কলেবর বৃদ্ধি করা যায়।
১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল। আমি দেখেছি স্বপ্নের পেছনে হন্যে হয়ে ছোটা একজন এম হেলালকে। ঘুম নেই, খাওয়া নেই; ছুটছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। বারংবার ৬৪ জেলার আনাচে-কানাচে গিয়ে গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ ছাত্র-তরুণদের সাথে মিশে বোঝার চেষ্টা করেছেন তাদের আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের কথা। আবার তৃণমূল পর্যায়ে নিয়োজিত সরকারি আমলা ও স্থানীয় নেতাসহ নানা পেশার মানুষের সাথে মতবিনিময় করে অনুসন্ধান ও অনুধাবন করেছেন ছাত্র-তরুণদের সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপায়। পাশাপাশি চলছে ক্যাম্পাস’র পরিসর বৃদ্ধির প্রচেষ্টা। স্বপ্নের বাস্তবায়নে এক ধাপ এগিয়ে ২০০০ সালে ভাড়া অফিস ছেড়ে ক্যাম্পাস স্থানান্তরিত হলো তোপখানা রোডে মেহেরবা প্লাজার ১৩ তলায়। নিজস্ব স্থায়ী ঠিকানা হলো ক্যাম্পাস’র। নিজস্ব অফিস প্রতিষ্ঠার এ প্রক্রিয়ায় যতটা পেরেছি সহযাত্রী হয়েছি এম হেলাল’র। তাঁর কল্পনা ও স্বপ্নের বাস্তবায়নে অংশ নিয়েছি, মোকাবেলা করেছি নানা অভাব-অনটন আর টেনশন। আমি অনেক সময় হতাশ হয়ে পড়লেও কখনই হতাশ হতে দেখিনি তাঁকে। মঙ্গলকর্ম ও সুচিন্তা সফল হবেই এ মন্ত্রের দীক্ষাই তিনি দিয়েছেন অবিরত।
নিজস্ব স্থায়ী অফিসে ক্যাম্পাস স্থানান্তরিত হবার পর বোঝা গেল শুধু পত্রিকার ব্যানারে শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ন কিংবা ছাত্র-যুবকদের জন্য বড় পরিসরের কাজ করা সম্ভব নয়। তাই প্রতিষ্ঠিত হলো ক্যাম্পাস সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ঈঝউঈ)। এরপর থেকে শুধু এগিয়ে চলা..। এম হেলাল তাঁর সর্বস্ব দিয়ে টেনে নিয়ে চলেছেন ক্যাম্পাস’র চাকা, বাস্তবায়ন করে চলেছেন একের পর এক কর্মসূচি। শুরুর দিকে পথ ছিল কঠিন। নতুন অফিস ক্রয়ের জন্য নেয়া ব্যাংক লোন পরিশোধ, অফিস ও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার খরচ যোগাতে হিমশিম অবস্থা। আমি তখন স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে পিএইচডি করছি। ক্যাম্পাস’র কর্মসূচিতে সহযোগিতা করতে গিয়ে আমার সঞ্চয়ের সবটুকুই তখন শেষ। কিন্তু তাতে কী? ভালো লাগত, যখন দেখতাম ছাত্র-তরুণদের স্বপ্নের বাস্তবায়নে ক্যাম্পাস এ সূচিত হচ্ছে আধুনিক, যুগোপযোগী ও ডায়নামিক সব নিত্য-নতুন কার্যক্রম। ২০০৪ সালে যখন আমার নিজের ডেস্কটপ কম্পিউটার দিয়ে শুরু হলো ক্যাম্পাস’র ফ্রি কম্পিউটার ট্রেনিং, তখন তাতে অংশ নেয়া ৬ জন প্রশিক্ষণার্থীর চোখে-মুখে যে তৃপ্তি আর আশার আলো দেখেছি তাতে বুঝেছি আমাদের উদ্যোগ ছোট হতে পারে, কিন্তু তা অনেক তরুণের জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। আর তা হবেই না কেন, এম হেলাল’র নেতৃত্বে ক্যাম্পাসতো শুধু গতানুগতিক প্রশিক্ষণ দানকারী প্রতিষ্ঠান নয়; ক্যাম্পাস হলো পরিপূর্ণ মানুষ গড়ার এক কারখানা। সমৃদ্ধ জীবন যাপনের নানা বিষয়ে ক্যাম্পাস’র চর্চা ও প্রশিক্ষণ এমনই যে একেবারে সাধারণ মানুষও ক্যাম্পাস এ আসার কিছুদিনের মধ্যেই বিশেষ মানুষ হয়ে ওঠে; গড়ে ওঠে প্রোএকটিভ, পজিটিভ, আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীলরূপে। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাস স্টাফদের ব্যতিক্রমী কর্মকৌশল ও দক্ষতা এবং বিশেষ ধৈর্য ও সাহচর্যপূর্ণ আচরণ দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত এমনকি অনেক সময় ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ি। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয় তথা যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার সম্মিলিত মেধা তালিকায় সবসময় প্রথম হয়ে এবং সরকারি দপ্তরে উচ্চ পদে কাজ করে কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করে যে দক্ষতা আমি অর্জন করেছি, তার চেয়েও অনেক ক্ষেত্রেই ক্যাম্পাস স্টাফরা বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন ও কর্মকৌশলী বলে আমার মনে হয়েছে।
ক্যাম্পাস’র বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়ে ছাত্র-যুবকরা বড় স্বপ্ন দেখার প্রেরণা পায়, সাহস পায় সে স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, বৃদ্ধি পায় তাদের মনের জোর। ক্যাম্পাস ছাত্র-তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে ইতিবাচক চিন্তা লালনে; তারা শেখে কী করে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তির সদ্ব্যবহার করে সততার মধ্য দিয়ে জীবনে সফল ও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। ক্যাম্পাস’র দর্শন ছেঁড়া কাথায় শুয়েও লাখ টাকা নয় বরং কোটি টাকার স্বপ্ন দেখতে হবে এবং তা সৎ পথেই সম্ভব। ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলে এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে জীবন গড়ায় মনোযোগী হলে সবই সম্ভব। আর তাইতো প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখ্্ত ক্যাম্পাসকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে ক্যাম্পাস এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা মানব জীবনে সাফল্য অর্জনের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ছাত্র-তরুণদের প্রশিক্ষিত করে; আর এগুলো হলো শারীরিক সুস্থতা, মানসিক শক্তি অর্জন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা লাভ ও সোস্যাল নেটওয়ার্কিং। এরূপ ৪টি মৌলিক দিকের বিকাশকে ঘিরে পরিচালিত হচ্ছে ক্যাম্পাস কর্মসূচি, যা পূর্ণাঙ্গ মানুষ এবং কর্মযোগী ও প্রতিভাবান জাতি গড়ার জন্য জরুরি।
ক্যাম্পাস হলো নিত্য-নতুন আইডিয়া জেনারেশনের প্রতিষ্ঠান, যেখানে এসে ছাত্র-তরুণরা নতুনভাবে আবিষ্কার করে নিজেদের শক্তি ও সম্ভাবনা। এ প্রতিষ্ঠানের দর্শন ও কার্যক্রম ব্যতিক্রমধর্মী ও অনুকরণীয়। ক্যাম্পাস রিসার্চ সেল এর আওতায় এম হেলাল তাঁর ব্যতিক্রমী সৃজনশীলতা দিয়ে প্রবর্তন করেছেন দু’টি যুগোপযোগী অত্যাধুনিক মডেল বাংলাদেশের জাতীয় সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়ন মডেল এবং এলাকাভিত্তিক স্কুলিং মডেল। এছাড়াও ছাত্র-তরুণদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে এবং তাদেরকে সফল জীবনের দিকনির্দেশনা দিতে ক্যাম্পাস’র জ্ঞানমেলা সিরিজে প্রকাশিত হয়েছে ১২টি বই; প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে আরও ক’টি। এক কথায় হতাশাগ্রস্ত তরুণদের সঠিক পথনির্দেশনা দেয় ক্যাম্পাস, যেন তারা জীবনমুখী নানা প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদেরকে আধুনিক বিশ্বের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারে। পাশাপাশি তাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তির বিকাশেও রয়েছে ক্যাম্পাস হেলথ সার্ভিসের আওতায় নানা কার্যক্রম। ক্যাম্পাস’র সেমিনার-ওয়ার্কশপ বা অনুরূপ বিভিন্ন সেশনে ছাত্র-তরুণরা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বক্তৃতা করে, নিজেদের বড় বড় স্বপ্নের কথা শোনায়, তাদের চোখে-মুখে যখন ঝলমল করে ওঠে নতুন এক বাংলাদেশের ছবি তখন ভাবি, সারাদেশে যদি ছড়িয়ে দেয়া যেত এই উচ্ছ্বাস, এই ক্যাম্পাস..! পেশায় আমি অর্থনীতির গবেষক; তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গবেষণাকর্মে দেখেছি দেশকে এগিয়ে নেয়ার হাতিয়ার যে যুবসমাজ, সেই যুবকদেরকে উদ্যমী, আত্মবিশ্বাসী, প্রশিক্ষিত, দক্ষ করে গড়ে তোলা জরুরি। ক্যাম্পাস’র উন্নয়ন-দর্শনগুলো দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দেয়া গেলে উন্নয়নের গতি বহুগুণ বেড়ে যাবে।
তাইতো এবার অনেক বড় স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছেন এম হেলাল, পরিকল্পনা করেছেন ক্যাম্পাস’র কার্যপরিধি বহুগুণে সম্প্রসারণের। এবার তিনি ক্যাম্পাস’র নিজস্ব ভবন (Campus Study Centre : A Center of Excellence) নির্মাণ করে সেখান থেকে ক্যাম্পাস কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান, দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চান ক্যাম্পাস’র দিগ্্দর্শন। দেশ ও জাতির উন্নয়নে যুবসমাজকে ঘিরে এম হেলাল’র এই কল্যাণ-চিন্তা ও স্বপ্নের অংশীদার হতে পেরে আমি নিজকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। তাঁর পাশে থেকে এ স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন করতে চাই যেকোনো মূল্যে। আগামীর বাংলাদেশকে দেখতে চাই আত্মশক্তিতে বলীয়ান দক্ষ, সৃজনশীল ও প্রতিভাবান মানুষের দেশ হিসেবে। সে বাংলাদেশ গড়ায় ক্যাম্পাস’র উদ্যোগগুলো যেন রাতারাতি ডালপালা মেলে সারা দেশে, এম হেলাল’র সাথে সে প্রত্যাশাই করি আমি। আর তাই আমার স্বপ্নের অবিচ্ছেদ্য অংশ ক্যাম্পাস’র পাশে আজীবন আছি, এই আমি..।
প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০১৫