স্যারের দোয়ায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে আমার মা’র ফিরে আসা

মোঃ ইউসুফ আলী রানা
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ



করোনা মহামারীতে ২ মাস লকডাউনে থাকার পর সম্পাদক স্যারকে ফোনে বললাম আমার মা দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ, তাঁকে দেখতে বাড়িতে যেতে চাই। ড. এম হেলাল স্যার (বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক) বললেন, তুমি চলে যাও; বাড়িতে গিয়ে মায়ের সেবাযত্ন করো। বাড়িতে যাওয়ার ১ সপ্তাহ পর স্যার ফোন দিয়ে আমার মায়ের অবস্থা জানতে চাইলেন। আমি বললাম মা কোনো খাবার-দাবার খান না, পানি মুখে দিলেও পড়ে যায়; কোনো কথা বলেন না, কাউকে চিনেন না; প্রস্র্রাব-পায়খানা বিছানায় করেন; মা মনে হয় বাঁচবেন না। স্যার বললেন, তুমি নিজেই বলছো তোমার মা বাঁচবেন না বা ভালো হবেন না। এরকম কথা বলবে না। বাঁচা-মরা এবং ভালো করার মালিক আল্লাহ। তুমি আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো, তিনি তোমার মাকে ভালো করবেন ইনশাআল্লাহ। এর ৯/১০ দিন পর স্যার আবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখন তোমার মা কেমন আছেন। আমি বললাম, আগের চেয়ে একটু ভালো। স্যার বললেন, তোমার মা ভালো হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ। তুমিও নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে বলতে থাকো।

মায়ের এ অবস্থায় আমাদের এলাকায় মসজিদে দোয়া পড়ানোর জন্য গেলাম। করোনার কারণে কোনো মসজিদে দোয়া পড়তে চাচ্ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন হুজুর রাজি হলেন দোয়া পড়ার জন্য। তিনি ৫ হাজার টাকা হাদিয়া চাইলেন। এ সংকটকালে ৫ হাজার টাকা দিয়ে দোয়া পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তারপরে অন্য এলাকায় মসজিদে ইমাম ও হাফেজ দ্বারা দোয়া পড়াই। তারা তেল ও পানি পড়ে দিলেন। পানি খাওয়াতে বললেন এবং মাথা ও শরীরে তেল মাখতে বললেন। ইমাম সাহেব বললেন, ৪১ দিনের মধ্যে ভালো-মন্দের রেজাল্ট আসবে। এদিকে দিন দশেক পর স্যার ফোন দিয়ে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন; আমি বললাম মা এখন খাবার খান, কথা বলেন, সবাইকে চিনেন। স্যার বললেন, এবার তুমি নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো। স্যার আরও বললেন, আমার পক্ষ থেকে তোমার মাকে ১ হাজার টাকার ফল কিনে খাওয়াবে। আমি তোমাকে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

এভাবে এবার হারানো মাকে পাওয়া ছাড়াও ইতিপূর্বে আরো কয়েকবার মা’র অসুস্থতায় বাড়ি যেতে চাই বললে প্রত্যেকবারই স্যার ছুটি দিয়ে বলেন আল্লাহর নাম নিয়ে যাও, সৎ ও পরিচ্ছন্ন মনে মায়ের জন্য দোয়া করো, দেখবে মা সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। সত্যি সত্যি বাড়ি গিয়ে মাকে সুস্থ করে রেখে আবার ফিরে আসতে পেরেছি, আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে এবং স্যারের গভীর পজিটিভ চিন্তার দোয়ার বরকতে। আমাদের অফিস-স্টাফদের বিপদের ক্ষেত্রে কিংবা নেগেটিভ চিন্তার ক্ষেত্রে স্যারের অনুরূপ পজিটিভ চিন্তা সবসময়েই দেখেছি।

আল্লাহ তাঁর প্রিয় নেক বান্দাদের ইমান পরীক্ষা করার জন্যে মাঝে মাঝে অসুবিধায় ও বিপদে ফেলে দেন। সেইরূপ অনেক কঠিন বিপদে পড়েও স্যার কখনো মনোবল হারাননি। যেকোনো পরিস্থিতিতেই তিনি পজিটিভ এটিচিউড লালন করেন। সেই ইতিবাচক এটিচিউডে সাহস ও ধৈর্য্যরে সহিত তিনি সকল নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন কিংবা যেকোনো বিপদে জয়ী হয়েছেন, যা আমি প্রত্যক্ষভাবে তাঁর সাথে দীর্ঘ ২১ বছর কাজ করে খুব কাছে থেকে দেখেছি। আমাদের অফিস-স্টাফদের বিপদ-আপদেও তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বউদ্যোগে সাড়া দিয়ে, উদার সহযোগিতায় এগিয়ে এসে আল্লাহর কৃপায় বহুজনকে বহুভাবে বিপদমুক্ত করেছেন। আমার জানা এরূপ একটি ঘটনা এখানে বলছি।

ডিআইইউতে এমবিএ ফাইনাল ইয়ারে অধ্যয়নরত মাহমুদ আল আইয়ুবী, দিনে ক্যাম্পাস অফিসে শিক্ষানবিশি কাজ করতো এবং সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতো। ক্যাম্পাস অফিসের সবাই নামাজ পড়লেও সে পড়ে না, পড়তে চায় না। নামাজ পড়ার জন্য স্যার তাকে বোঝালে মুচকি হেসে বলে স্যার, কাল থেকে পড়ব। তার ‘কাল’ আর আজ হয় না। একদিন সকালের দিকে স্যারের রুমে এসে বলে স্যার, আমার কিডনিতে স্টোন হয়েছে, ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। ডাক্তার বলেছে অপারেশন করাতে হবে; হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই, তাই কয়েকদিনের ছুটি প্রয়োজন। স্যার বললেন তুমি প্রচুর পানি খাও, ইউরিনের সাথে স্টোন বের হয়ে যাবে এমনিতেই, অপারেশন করানো লাগবে না। স্যারের কথায় সে অবাক হয়ে আবারও বলে, ডাক্তারতো বলেছে অপারেশন করানো লাগবে, অপারেশন ছাড়া এত বড় পাথর কিডনি থেকে বের হবে কীভাবে? তাছাড়া আপনার কথামতো এভাবে যদি পাথর বের হয়ও, তাহলেওতো আমি কষ্ট পাব। স্যার বললেন তুমি এভাবে চিন্তা করো যে, স্টোন ভেঙে বা গলে গিয়ে ইউরিনের সাথে অথবা শরীরের যেকোনো আউটলেট দিয়ে কষ্ট ছাড়াই বের হয়ে যাচ্ছে। যে স্টোন তৈরি হবার সময়ে তুমি টের পাওনি, সে স্টোন বের হবার সময়েও তুমি টের পাবে না। স্যারের কথায় সে কনফিউজড হয়ে তার ডেস্কে চলে যায়। স্যারও তার পেছনে পেছনে গিয়ে এক বোতল পানি ও গ্লাস তার টেবিলে রেখে বলেন তুমি এখন থেকে ওয়াটার থেরাপি করতে থাক; সৃষ্টিকর্তার রহমতে অপারেশন ছাড়াই পাথর বের হয়ে যাবে। অনবরত পানি পান করার পরামর্শ দিয়ে স্যার নিজ রুমে ফিরে কয়েক সেকেন্ড মানসিক শক্তি প্রয়োগ করলেন এরূপভাবে মাহমুদ ঐ পানি খাচ্ছে এবং স্টোন গলে বা ভেঙে শরীরের আউটলেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে...।

ঘন্টা দু’য়েক পর আবার সে স্যারের রুমে এসে বলে স্যার, আমার মনে হয় ডাক্তারের কথা না শুনলে বিপদ হতে পারে। আপনি অনুগ্রহ করে ৩/৪ দিন ছুটি দিলে আমি হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই। তার চেহারায় বিষণœতা এবং মুখে করুণ আর্তি দেখে তাকে ছুটি দিয়ে দিলেন স্যার। পরদিন দুপুরের দিকে সে খুশিতে এক্সাইটেড হয়ে কোনো অনুমতি ছাড়াই স্যারের রুমে প্রবেশ করে এবং মুখে সালাম দিয়ে বলে স্যার, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আপনাকে পা ছুঁয়ে সালাম করব। তার গতকালের করুণ আর্তি আর আজকের হাসিখুশির তফাৎ দেখে কোনো ব্যাখ্যার পূর্বেই স্যার যা বোঝার তাই বুঝে নিয়ে বললেন তোমার স্টোন যে চলে গিয়েছে তা কি তুমি টের পেয়েছ? সে বলে খুব একটা বুঝতে পারিনি, তবে আজ ভোরের দিকে প্রস্রাবের সময়ে অনুরূপ কিছু একটা টের পাচ্ছিলাম এবং তখন থেকে পেটে ব্যথা হচ্ছে না, বরং হাল্কাবোধ করছি।

মাহমুদ স্যারকে জানায়, গতকাল অফিস থেকে গিয়ে ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি হলাম। আজ দুপুরের পর অপারেশনের কথা। কিন্তু প্রি-অপারেটিভ চেক-আপে ডাক্তার আজ স্টোন দেখতে পাচ্ছে না বলে জানিয়েছে। তাই আজ অপারেশন না করে কাল করার তারিখ দিয়েছে। আপনার গতকালের দৃঢ় পরামর্শের কথা বুঝতে পেরে আপনার কাছে ছুটে এসেছি। একদিকে গতকাল আপনার কথা ডিঙিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বেয়াদবি করেছি, অন্যদিকে অপারেশনের কথা চিন্তা করে অনেক ভয়ও পেয়েছি, গাইবান্ধা থেকে আব্বা-আম্মা চলে এসেছেন। এখন ডাক্তার অপারেশন পিছিয়ে দিলে আমার আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। সবাইকে বললাম কাল পর্যন্ত আমি কিছুতেই হাসপাতালে থাকব না, বাসায় চলে যাব, তার আগে আমার স্যারের সাথে দেখা করতে যাব...।

এভাবে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে মাহমুদের একনাগাড়ে অনেক কথা। এরপর তাকে স্যার বললেন আমি তোমার সালাম পেয়েছি, কদমবুচি করা লাগবে না। পিতা-মাতা-শ্বশুর-শাশুড়ি বা অনুরূপ মুরুব্বী ছাড়া অন্যদেরকে কদমবুচি করতে হয় না। তাছাড়া মানুষের পায়ে সালাম করতে গিয়ে মাথা নিচু করা ঠিক নয়। এ মাথা অবনত করবে শুধু স্রষ্টার কাছে, মানুষের কাছে নয়। তুমি স্থির হও, বাসায় যাও, রেস্ট করো। সুস্থবোধ করলে কাল অফিসে আসতে পার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত হও, স্রষ্টাকে স্মরণ করো, মেডিটেশন করো, দেখবে তোমার সব সমস্যা প্রাকৃতিকভাবেই সমাধান হয়ে যাচ্ছে।

স্যারের এসব কথা শুনে সহজ-সরল মাহমুদ তার ইচ্ছার ব্যত্যয় না ঘটিয়ে ‘তবুও আজকের জন্য পায়ে সালাম করতে চাই’ বলে সালাম করে খুশিতে আটখানা হয়ে চলে গেল। এরকম আরও অনেক ঘটনা আমার জানা আছে, যা এ ছোট্ট পরিসরে এখানে বলা সম্ভব নয়। প্রাকৃতিক চর্চা ও চিকিৎসার প্রতি অন্যদের আস্থা আনয়নের লক্ষ্যে উপরোক্তরূপ কিছু কিছু বাস্তব ঘটনা স্যার লিখেছেন ‘সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি এবং সাফল্যের শীর্ষপথে’ বইয়ে। ক্যাম্পাস অফিস থেকে বইটি সংগ্রহ করে কিংবা http:/ww/w.helal.net.bd/bangla/book5.php লিংক থেকেও পড়তে পারেন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)