ক্যাম্পাস আয়োজিত ফ্রি ওয়ার্কশপ অন ডিজিটাল বাংলাদেশ
এর ৩য় পর্বে মোস্তাফা জব্বার

আইটি কর্মীরাই হবে দেশের চালিকা শক্তি


ডিজিটাল বাংলাদেশ বা ডিজিটাল সোসাইটি কী, কেন, কিভাবে, কার কি করণীয় এ সকল বিষয় সাধারণ জনগণের নিকট সহজ করে তুলতে ক্যাম্পাস’র রয়েছে ফ্রি ওয়ার্কশপ অন ডিজিটাল সোসাইটি। তারই ৩য় পর্ব অনুষ্ঠিত হল ১২ মে ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে।
ওয়ার্কশপে মূল বক্তা ছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ আন্দোলনের পথিকৃৎ, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার ১ মোস্তাফা জব্বার। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এবং ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র (সিএসডিসি) -এর মহাসচিব এম হেলালের সঞ্চালনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কশপে ক্যাম্পাস’র বিভিন্ন কোর্স ও কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-যুবকসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
চমৎকার উপস্থাপনার ফাঁকে ফাঁকে আইটি সমৃদ্ধ দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কিছু ভিডিও চিত্র দেখিয়ে এ ওয়ার্কশপকে বেশ আকর্ষণীয় করে তোলেন মোস্তাফা জব্বার। বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ -এর গান ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবে...। ওয়ার্কশপের সমাপ্তিও হয় উদ্দীপক গানের মধ্য দিয়ে আমরা করব জয় একদিন...( We shall overcome someday...)।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কে আগে মানুষের ধারণাই ছিল না। কিন্তু কেউ কেউ আজ ডিজিটাল শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহার করছেন। হয়ত অজ্ঞতা বশতঃ বা হিংসার বশবর্তী হয়ে, কিন্তু তারা জানেন না জীবনের শেষ ২০ বছর তাদের বাস করতে হবে ডিজিটাল বাংলাদেশেই। আমরা সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চাই, দেখতে চাই দ্রুত অগ্রসরমান বাংলাদেশ যেখানে থাকবে না দুর্ভিক্ষ আর দারিদ্র্য। বর্তমান বিশ্বে যার অর্থ আর অস্ত্রের জোর আছে তাকে শক্তিমান বলা হয়, সে শক্তিকে সকলে সমীহ করে চলে। কিন্তু সামনের বিশ্ব হবে জ্ঞানের বিশ্ব। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা আরও বেগমান হবে। জ্ঞান দখল করে নেবে অর্থ ও অস্ত্রের স্থান।
ক্যারিশমেটিক উপস্থাপনায় মোস্তাফা জব্বার আলোকপাত করেন সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ওপর। তিনি বলেন মানব সভ্যতার প্রথম যুগ হলো কৃষি যুগ, সে যুগের হাতিয়ার শ্রমিক। উন্নত বিশ্ব কৃষি যুগ অতিক্রম করে ঘটিয়েছে শিল্প বিপ্লব। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশ কৃষি যুগেই রয়ে গেছে, শিল্পযুগে প্রবেশ করতে পারেনি। শিল্পযুগের হাতিয়ার শিল্প শ্রমিক। অন্যদিকে তথ্য-প্রযুক্তির যুগে আইটি কর্মীরা হবেই দেশের চালিকাশক্তি। মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছানোর গুরু দায়িত্ব থাকবে আইটি কর্মীদের, তারা হবে সভ্যতার বাহন।
আজকের এশিয়ায় ইকোনোমিক জায়েন্ট এবং বিশ্বসেরা দশ -এর অন্যতম কোরিয়ার উদাহরণ টেনে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ১৯৫৭ সালে কোরিয়া বাংলাদেশের অগ্রগতির তুলনায় অনেক পেছনে থাকলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দৌড়ে দ্রুত এগিয়ে গেছে। কৃষিযুগে কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ মার্কিন ডলার আর বর্তমানে শিল্পযুগে তার আয় ৩০ হাজার ডলার। কোনদিন যে তারা খারাপ অবস্থায় ছিল তা বোঝার উপায় নেই। ৩০ হাজার না হোক, ২/৩ হাজার মার্কিন ডলার হলেও আমরা বেঁচে যেতাম মত এমন জীর্ণদশায় থাকতে হত না।
তিনি বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতি কোরিয়ার জনজীবনে এনে দিয়েছে অভাবনীয় পরিবর্তন। সেখানে এমন কোন লোক নেই যে ইন্টারনেট ব্যবহার জানে না। বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল সম্পর্কে সিরিয়াস, কিন্তু কিছু কিছু রাজনৈতিক ও অন্যান্য পেশার ব্যক্তিত্ব আছেন যারা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সম্পর্কে উটপাখী নীতি অবলম্বন করছেন। ডিজিটাল শব্দটির অপব্যবহার করে বলা হচ্ছে ডিজিটাল যানজট, ডিজিটাল টাইম, ডিজিটাল লোডশেডিং ইত্যাদি। কোরিয়া প্রসঙ্গে তিনি সেখানকার একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করেন। চিত্রে দেখা গেল- একজন কিশোরী তার মায়ের জন্মদিনে গিফ্ট কিনবে, মোবাইলে সে দোকানের অবস্থান এবং গিফ্টের রকম ও মূল্য সম্পর্কে জেনে নিল; তার আগে জেনে নিল গাড়ি কোথায় পার্কিং করবে। তার ছোট ভাই স্কুলের পড়ালেখার জন্য চিড়িয়াখানায় গিয়ে অনেক জীব-জন্তু-পাখির ছবি তুললো। ফিরে এসে নিজের রুমটাকে তার তোলা ছবি দিয়ে এমনভাবে সাজালো যে, সেটি হয়ে উঠল একটি মিনি চিড়িয়াখানা। অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহার কিভাবে জীবনকে সহজ করে দিচ্ছে তারই প্রমাণ কোরিয়া। ২০১৪ সালের অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব আইটি -এর যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে, তাহল - The world economy is rapidly changing overcoming the economic crisis. The world is best in IT today. The IT today is excellent in energy, health-care, IT services, IT technology.
মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, আজ আমরা এশিয়ার অন্যতম নবোত্থিত শক্তি মালয়েশিয়ার কথা জানি। একসময় মালয় আর সিঙ্গাপুর মিলে ফেডারেশন গঠন করেছিল; সিঙ্গাপুরের নিজস্ব সম্পদ না থাকায় সিঙ্গাপুরকে মালয় ফেডারেশন থেকে বের করে দেয়া হয়। কিন্তু সিঙ্গাপুর হতাশ হয়নি, ভেঙ্গে পড়েনি; ভিক্ষা করেনি ধনী ও শক্তিধর দেশগুলোর কাছে। নিজেদের বুদ্ধি, সাহস আর দৃঢ়চিত্ততা দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৬ সালের দিকে পরিবর্তন শুরু হয় সিঙ্গাপুরের। তারা পর্যটনকে জাতীয় আয়ের প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছে। পর্যটন-নির্ভর আকাশ-ছোঁয়া ভবনরাজির দেশ সিঙ্গাপুর সারা দেশটাকে ডিজিটালাইজড্ করে নিয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ২০২১ সালের আগেই আমরা কোরিয়ার মত এমন একটি দেশে বাস করবো যখন আমাদের কাজকর্ম মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এসে ডিজিটালাইজড্ হয়ে যাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সচিবালয়ে কাগজপত্র থাকবে না। তখন জনসংযোগ না হলে ভোট পাওয়া যাবে না। সুধা সদন থেকে শেখ হাসিনা আর হাওয়া ভবন থেকে খালেদা জিয়া বক্তব্য রাখবেন, দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে মানুষ তা দেখতে ও শুনতে পাবে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সব ধরনের বিল পরিশোধ করা যাবে।
১৯৮৭ সালে কম্পিউটারের ব্যবস্থা করে পত্রিকা বের করার জন্য আমাকে পাগল আখ্যায়িত করা হয়েছিল, আর এখন যারা কম্পিউটার ছাড়া পত্রিকা বের করে তাদেরই নাম উঠবে পাগলের খাতায়। তিনি গভীর আস্থার সাথে বলেন, ধীরে ধীরে চাকরির সব পদ্ধতি ডিজিটাল হয়ে যাবে। পৃথিবীটা একটা পাঠশালা এটিই আমাদের শিক্ষানীতি হওয়া উচিত। একটি শিশু হাত-পা নাড়ানো শিখলেই তার হাতে একটা মাউস ধরিয়ে দেয়ার যুগ এসেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কে তরুণ সমাজের প্রচ- আগ্রহের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের ৯৮% মানুষ মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এসে গেছে। ৯২% ভূমি নেটওয়ার্কের আওতায় এসে যাচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তিতে কানেকটিভিটি তৈরি হচ্ছে। এখন মোবাইল ফোনে ছবি দেখা যায় এটি ডিজিটাল হয়েছে, ক্যাবল অপারেটরের প্রয়োজন হয় না। বিদ্যুৎ থাকলে কি করবো সে চিন্তা না করে বিদ্যুৎ না থাকলে কি করবো তা ভাবতে হবে। সম্প্রতি মফস্বল অঞ্চলে ফসলের ক্ষেতে পোকার আক্রমণ হলে কৃষকরা পোকার ছবি তুলে কৃষি দপ্তরে এক্সপার্টদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। কৃষি দপ্তরের পরামর্শ নিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সে পোকা দমন করে কৃষকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এটিই ডিজিটাল বাংলাদেশের চিত্র।
দূরদর্শী বিজ্ঞানমনষ্ক সমাজকর্মী মোস্তাফা জব্বার তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন পদ্ধতি চালু করেছেন। সেখানে নার্সারি, কেজি, কেজি-১ -এ কোন বই নেই। তিনি বলেন আমরা চাই একটি শিক্ষিত, দুর্নীতিমুক্ত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নয়নমুখী বাংলাদেশ যেখানে বুড়োরা নয়, তরুণরাই সিদ্ধান্ত নেবে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। দেশে আড়াই কোটি লোক বেকার এটি একটি পিলে চমকানো ঘটনা। তাহলে আমাদের শিক্ষার মান কী? এটি কেরানী সৃষ্টির কারখানা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন কি উন্নয়নের চালিকাশক্তি কম্পিউটারের সিলেবাস পর্যন্ত ২০ বছরের পুরোনো। ফলে চলছে মুখস্থ বিদ্যা, বইয়ের পাতা কেটে নকলের কসরৎ।
প্রশ্নোত্তর পর্বে মোস্তাফা জব্বার বলেন কল সেন্টারের জন্য প্রচুর ইংরেজী জানা লোকের প্রয়োজন, কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত লোক পাওয়া দুঃসাধ্য। এখাতে huge possibility আছে ঠিকই, কিন্তু কাজ করার মত লোক কোথায়! অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গরীব মানুষকে ধনী করার শক্তি আমার নেই। তবে এটা বলতে পারি মোটিভেশন পিরিয়ড অতিক্রম করে গেছে, এখন হবে কাজের বাস্তবায়ন, দরকার ব্রডব্যান্ড কানেকটিভিটি। আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে জানলে অসাধ্য কিছু নেই পৃথিবীতে।

এম হেলালঃ
সেমিনারের সঞ্চালক এম হেলাল বলেন, আজকের ওয়ার্কশপের পিন-পতন নিরবতাই প্রমাণ করেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ কতটুকু। আজকের ছাত্র-যুবকরা এক-একজন ডিজিটাল ইয়াং-স্টার হয়ে ডিজিটাল সোসাইটি গড়ে তুলবে এটি আস্থার সাথে বলা যায়। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ থাকবে হাতের মুঠোয়।

ডিজিটাল বাংলাদেশঃ উদ্বুদ্ধকরণ কর্মশালা

ছাত্র-যুবকদের মাঝে ব্যাপক জাগরণ

গত ৫ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হলো ‘ডিজিটাল বাংলাদেশঃ উদ্বুদ্ধকরণ কর্মশালা’। ডিজিটাল বাংলাদেশ -এর স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তাফা জব্বারের বর্ণাঢ্য উপস্থাপনা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক ও ক্যাম্পাস সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার -এর মহাসচিব এম হেলালের সঞ্চালনে উক্ত অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রী এবং তরুণ-যুবকরা অংশগ্রহণ করে।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে মানুষের আগ্রহ আছে। এ সম্পর্কে প্রচুর আলোচনা প্রয়োজন। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কনসেপ্ট এখন সরকার ও জনগণের প্রধান আলোচ্য বিষয়।
মোস্তাফা জব্বার দৃঢ়তার সাথে বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে হতে হবে ডিজিটাল সরকার। তা না হলে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগুতে পারবে না। বর্তমান সরকারি ব্যবস্থায় কাগজপত্রে লিখে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে অন্ততঃ ৪২টি স্বাক্ষরের প্রয়োজন হয়। কেরানীর লিখিত নোট ওপরে উঠতে উঠতে সচিব-মন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছায়, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কাছেও ফাইল যায়। সিদ্ধান্ত হয়ে ফাইল ওপর থেকে আবার নিচে নেমে আসতে ঐসব ধাপ অতিক্রম করতে হয়। সরকারের সব তথ্য থাকে কাগজে। ফাইল হারিয়ে গেলে মহাসমস্যা হয়। এ প্রক্রিয়ায় ফাইল আটকাতে পারলে ঘুষ খাওয়া সহজ হয়। ‘ফুয়েল’ ছাড়া ফাইল নড়েনা কথাটি বেশ প্রচলিত। এ অবস্থায় দুদক কিংবা টিআইবি -এর চেয়ারম্যান প্রফেসর মোজাফফ্র’র পক্ষেও দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে না।
মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, ডিজিটাল সরকার হলে ফাইল আটকানোর সুযোগ থাকবে না, দেখা যাবে না লাল ফিতার দৌরাত্ম। সরকারের সকল তথ্য থাকবে কাগজবিহীন। সরকারের নিজস্ব নেটওয়ার্ক থাকবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শ্রীলংকাও এ পদ্ধতিতে কাজ করছে। এ ধারার সাথে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যুক্ত হয়ে গেছে। আমাদের সরকারকেও মেইন স্ট্রিমের সাথে যুক্ত হতে হবে। শ্রীলংকায় দেখেছি সেখানে জন্ম-মৃত্যু, বিবাহের সার্টিফিকেট পাওয়া যায় ৫ মিনিটে। বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু হলে উপজেলা প্রকৌশলীর কোন কর্মসূচির প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগবে ১০ মিনিট। ডিজিটাল বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রবক্তা মোস্তাফা জব্বার বলেন, বর্তমানে signature বা স্বাক্ষরের বেশ দাম। কিন্তু ডিজিটাল ব্যবস্থায় এ স্বাক্ষর মূল্যহীন হয়ে পড়বে। ২০০৯ সালের মধ্যে এক ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংকে ভাঙ্গানো যাবে। আপনারা সরকারকে ট্যাক্স দেবেন, অফিসারের চেহারা দেখার প্রয়োজন নেই। ডিজিটাল হলে জনপ্রতিনিধি এমপিকে পাওয়া যাবে, নেটওয়ার্কে তার কাজের সমালোচনাও করা যাবে। ভোটের পর আর নেতার দেখা পাওয়া যায় না বলে মানুষের মনে এখন যে ক্ষোভ রয়েছে তা আর থাকবে না।
কম্পিউটার প্রযুক্তি বিকাশের পথিকৃৎ মোস্তাফা জব্বার বলেন, ডিজিটাল ব্যবস্থায় ঘরে বসেই একদিকে যেমনি হজ্ব মৌসুমে হাজীদের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা যাবে, পরীক্ষার ফলাফল জানা যাবে, তেমনি বিদ্যুৎ বিলও পরিশোধ করা যাবে। টেন্ডারগুলোকে ইন্টারনেটে নিয়ে আসতে পারলে টেন্ডার নিয়ে আর ঘাপলা সৃষ্টি করতে পারবে না কেউ।
ত্র“টিপূর্ণ ভূমিব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করে তিনি বলেন, সরকারের এ মন্ত্রণালয় দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দেশে শতকরা ৮৫ ভাগ মামলা হয়ে থাকে ভূমি নিয়ে। মামলা শেষ হতে লাগে ১০/১১ বছর। কোন কোন মামলা কয়েক যুগেও নিষ্পত্তি হয় না। আর আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের কলকাতায় দলিল পেতে লাগে মাত্র ৭ দিন।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে ডিজিটাল পদ্ধতির উপযোগিতার কথা তুলে ধরে মোস্তাফা জব্বার বলেন একজন অপরাধী এক থানা বা এলাকায় অপরাধ করে, মামলা হয়; কিন্তু অপরাধী ধরা পরে অন্য থানায়। অথচ এসব থানার রেকর্ডপত্রের সমন্বয় নেই। এজন্য দেখা যায় এক অপরাধী এ থানা থেকে জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসছে, অন্যদিকে অন্য থানায় সে মার্ডার কেসের আসামী। সে দিব্যি ছাড়া পেয়ে গেল রেকর্ডপত্র ঠিক না রাখার কারণে। ডিজিটাল পদ্ধতি শুরু হলে এসব ফাঁক-ফোকর বন্ধ হয়ে যাবে। আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, দুর্নীতি শুধু ভূমি ব্যবস্থাতে নয়, বাংলাদেশের সকল দফতরেই তার উপস্থিতি সুস্পষ্ট। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা এয়ারপোর্ট, স্থল বন্দর এগুলোর দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হবে।
আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ-এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে প্রবল আশাবাদী মোস্তাফা জব্বার Juistice delayed, Justice denied এ প্রবচনের পরিবর্তন চান। তিনি বলেন, আদালতে মামলার ¯তুপ দেখে আতংকিত হতে হয়। কোন কোন মামলা বংশানুক্রমে চলতে থাকে। হন্ডুরাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে একজন বিচারক বাড়িতে বসেই বিচারকাজ করতে পারেন। জনগণের কল্যাণে আমাদেরও বিচার ব্যবস্থা ডিজিটাল না করে উপায় নেই।
মোস্তাফা জব্বার এরপর শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে ২শ’ বছর পেছনে ফেলে দেয়া উচিত। শিক্ষার বিষয়বস্তু যুগোপযোগী নয়। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু হয়েছে। আমাদের শিক্ষার বিষয়বস্তু পরিবর্তন হয়নি বলে এদেশের অগ্রগতিতে যে ছাত্রের প্রয়োজন সে ছাত্র বেরুচ্ছেনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুখস্থ বিদ্যা খাতায় লেখার রীতি বদলাতে হবে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন এ বছর ১০ম শ্রেণীর বই অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে পড়া যাবে। পঞ্চম শ্রেণীতে সফ্টওয়ার পাঠ্যপুস্তক দেয়া হয়েছে। তাঁর মতে, প্রত্যেক ছাত্রের হাতে কম্পিউটার পৌঁছানো যায়, এতে খরচ হবে মাত্র ৫০ টাকা।
তথ্য-প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেন, আগামী ৫ বছরে দেশের সব অফিস ডিজিটালাইজ্ড হয়ে যাবে। ২০১৩ থেকে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে ২৮ হাজার শিক্ষকের। বর্তমানে ৫ হাজার শিক্ষক আছে, আরও লাগবে ২৩ হাজার শিক্ষক। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালের মধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ডিজিটাল হবে। এর ফলে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই কম্পিউটার জ্ঞানের ওপর দিতে হবে বিশেষ জোর। মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, আমাদের operating system জানতে হবে, ংশরষষ বাড়াতে হবে। যিনি ইন্টারনেট ব্যবহার জানেন না, তার নিবাস হবে গারো পাহাড়ে বাঘের সঙ্গে। মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, রহঃবৎহবঃ-এ টিভি-শোসহ সবকিছুই পাওয়া যায়। বর্তমানে কেবল অপারেটিং ছাড়া টিভি দেখা যায়, এর জন্য ইন্টারনেট কানেকশনই যথেষ্ট। আমরা যে সভ্যতার ওপর ভর করে আছি তা হলো ইন্টারনেট সভ্যতা।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে মোস্তাফা জব্বার বলেন, গারো এলাকার ছেলে সোল আমার ফার্মে চাকরি করতো মাসিক সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে। আমার এখান থেকে চলে গিয়ে স্কিল ডেভেলপ করে এখন সে ৭৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে। অহরসধঃরড়হ করে প্রতি মিনিটে তার উপার্জন হয় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। সে ছোটদের উপযোগী কার্টুন ছবি তৈরি করে। আমাদের ছাত্র-যুবকদের স্কিল ডেভেলপ করা অপরিহার্য। কম্পিউটার প্রযুক্তির বিকাশে নিবেদিত মেধাবী পুরুষ মোস্তাফা জব্বার তাঁর ট্রেনিং প্রদান খাত থেকে প্রাপ্ত আয় দক্ষ মানুষ তৈরির কাজে ব্যয় করেন। তিনি বলেন, আমাদের পৎবধঃরাব চিন্তা-ভাবনা থাকতে হবে। ২০/২৫ জন ছাত্র নিয়ে একটা বিশেষ কোর্স করা যায়। এ ব্যাপারে তিনি ক্যাম্পাস’র সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি ২০১২ সালের মধ্যে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপনের চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে উল্লেখ করেন।
অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফা জব্বার বলেন সুখী, সমৃদ্ধ জাতি গঠনের আন্দোলনই ডিজিটাল বাংলাদেশ। পৃথিবী যেখানে থাকবে, আমিও সেখানে থাকবো এ হবে আমাদের চেতনা। ট্রেইনীদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, আপনারাই ডিজিটাল বাংলাদেশ। তিনি ংশরষষ ফবাবষড়ঢ়- এর আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিদেশে আমাদের একজন অদক্ষ শ্রমিক (ঝাড়–দার) বেতন পায় ৬০০ রিয়াল, আর কম্পিউটার জ্ঞান সমৃদ্ধ একজন টেকনিক্যাল হ্যান্ড পাবে ৬০ হাজার রিয়াল। এজন্য উপযুক্ত মানুষ তৈরি করা ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই। ক্যাম্পাস সমাজে উপযুক্ত মানুষ তৈরি করছে। যেখানে উপযুক্ত মানুূষ তৈরির প্রচেষ্টা থাকে আমি তার সাথে যুক্ত হই। পরিশ্রমী ছাত্র-তরুণদের নিয়ে আমি একটি টিম গড়তে চাই। ক্যাম্পাস এটি অর্গানাইজ করতে পারে অথবা এ কাজে আমাকে সহায়তা করতে পারে। ময়মনসিংহের ফুলপুর গ্রামে সাব্বির নামের এক কিশোর গিফ্ট হিসেবে একটি কম্পিউটার পায়। সে ঐ কম্পিউটার দিয়ে গ্রামের ছেলেদের কম্পিউটার শেখাচ্ছে।

এম হেলাল
অনুষ্ঠানের মডারেটর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এম হেলাল বলেন, মোস্তাফা জব্বার তথ্য-প্রযুক্তিগত আধুুনিকতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এক নম্বর ব্যক্তি। বিজয় কি-বোর্ডের জনক ষাটোর্ধ যুবক মোস্তাফা জব্বার ছাত্র-যুব সমাজের প্রেরণার উৎস। ক্যাম্পাস কর্মসূচিতে নিজকে সহযোগী করে মোস্তাফা জব্বার তাঁর পেশার প্রতি দায়িত্বশীলতা ও আন্ত—রিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
এম হেলাল বলেন কম্পিউটার ও Internet জীবন বদলে দিতে পারে। তাই ছাত্র-যুবকদেরকে আধুনিক বাংলাদেশের সৈনিক হিসেবে উল্লেখ করে তাদেরকে জনাব মোস্তাফা জব্বারের পরামর্শ মত শিক্ষিত ও আলোকিত হবার আহ্বান জানান।
বিপুল করতালির মাধ্যমে মোস্তাফা জব্বারকে অভিনন্দিত করা হয়। সমগ্র অনুষ্ঠানে ছিল পিনপতন নিরবতা। শুভেচ্ছার নির্দেশনাস্বরূপ ক্যাম্পাস’র পক্ষ থেকে জনাব মোস্তাফা জব্বারের হাতে গিফ্ট তুলে দেন সহকারী পরিচালক উম্মে সালমা রনি।
ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কিত পরবর্তী কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে ৮ নভেম্বর ’০৯ বিকাল ৫ টায় ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে।

ক্যাম্পাস পত্রিকা আয়োজিত ওয়ার্কশপ অন ডিজিটাল বাংলাদেশ

ফ্রি কম্পিউটার ট্রেনিং কর্মসূচিকে আরও গতিশীল ও ব্যাপকতর করার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর ওপর নিয়মিত ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্যাম্পাস পত্রিকা। ক্যাম্পাস কর্মীবাহিনী, ফ্রি কম্পিউটারের ৯৩টি ব্যাচের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২২৫০ ট্রেইনী, শিক্ষানবীশ ছাত্র-ছাত্রী এবং মেডিটেশনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য উক্ত ওয়ার্কশপ চালু করা হয়েছে।
গত ১৯ আগষ্ট ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হল উক্ত ওয়ার্কশপের প্রথম পর্ব। ওয়ার্কশপ কনডাক্ট করেন ডিজিটাল বাংলাদেশ -এর স্বপ্নদ্রষ্টা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সভাপতি মোস্তাফা জব্বার এবং মডারেটর ছিলেন ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক ও ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র -এর মহাসচিব এম হেলাল।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে জরুরী মিটিং থাকায় মোস্তাফা জব্বারকে সোয়া এক ঘন্টা বিলম্বে আসতে হয়। কিন্তু ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারীরা অসীম ধৈর্যসহকারে তাঁর অপেক্ষায় থাকেন। অবশ্য এ সময়ে ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারীরা পেয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী ও আত্ম-উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদকের উপস্থাপনায় ছাত্র-যুবকরা জানতে পারে কিভাবে নিজের মধ্যে স্মার্টনেস, ম্যানার, এটিকেসি, লিডারশীপ প্রভৃতি ডেভেলপ করতে হয়। অবশেষে ৬০’র যুবক সদা প্রাণবন্ত ও হাস্যোজ্জ্বল মোস্তাফা জব্বার বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এবং সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমি বোঝাতে পেরেছি যে, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’এ কনসেপ্ট গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের ১ কোটি লোক বিদেশে কর্মরত। তারা যা আয় করে সেই পরিমাণ অর্থ কম্পিউটার জানা ১০ হাজার লোকই আয় করতে পারে।
মোস্তাফা জব্বার তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এই চেতনা ও অনুভূতি প্রভাব বিস্তার করেছে। এক কোটিরও ওপর নতুন ভোটার, যাদের সবাই তরুণ, তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ -এই ধারণাকে গ্রহণ করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং বিপুলভাবে ভোট দিয়ে দেশ পরিচালনার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছে।
তাঁর বক্তব্যশেষে ছাত্র-যুবকরা কম্পিউটার সম্পর্কে ও তাঁর কর্মজীবন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। ৬০ বছর বয়সেও তাঁর এত সজীবতার রহস্য সম্পর্কে উপস্থিত ছাত্র-যুবকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৮ ঘন্টা পরিশ্রম ও নিত্য-নতুন চিন্তা।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সম্পর্কিত ক্যাম্পাস আয়োজিত পরবর্তী ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হবে ৫ সেপ্টেম্বর, শনিবার দুপুর দেড়টায় ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে। তৎপূর্বে দুপুর ১২টায় ফ্রি জয়েন্ট মেডিটেশন অনুষ্ঠিত হবে।