ক্যাম্পাস আয়োজিত প্রাকৃতিক চিকিৎসা বিষয়ক সেমিনারে বিশিষ্ট আকুপ্রেশারিস্ট আলাউদ্দিন বিশ্বাস বলেন

মন যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে অনেক অসাধ্য সাধন করা যায়

সুস্থতা ও শতায়ুলাভে প্রাকৃতিক চর্চার বিকল্প নেই। ক্যাম্পাস’র রয়েছে প্রাকৃতিক চর্চার বিভিন্ন দিক নিয়ে নিয়মিত কর্মসূচি যেমন আকুপ্রেশার, ইয়োগা, রিফ্লেক্সোলজি প্রভৃতি। সে ধারাবাহিকতায় ১২ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে আকুপ্রেশারের ওপর সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট আকুপ্রেশারিস্ট আলাউদ্দিন বিশ্বাস। ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এবং ক্যাম্পাস সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (সিএসডিসি) এর মহাসচিব এম হেলাল এতে সভাপতিত্ব করেন।
আধুনিক প্রাকৃতিক চিকিৎসায় আকুপ্রেশারের গুরুত্ব তুলে ধরে আলাউদ্দিন বিশ্বাস বলেন আকুপ্রেশার প্রাকৃতিক চিকিৎসা, প্রকৃতির সাথে এর সম্পর্ক। হাত-পায়ের পয়েন্টগুলোতে আঙ্গুল বা ভোঁতা কাঠির সাহায্যে চাপ প্রয়োগ করে চিকিৎসা করা যেকোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আকুপ্রেশারের মাধ্যমে শরীরের রোগ নির্ণয় সহজ এবং রোগের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করাও সম্ভব। এজন্যই এটি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শরীরে প্রয়োজনীয় তাপ উৎপাদন করতে পারলে রক্ত সঞ্চালন (blood circulation) নিশ্চিত হবে। রক্ত সঞ্চালন না থাকলে তাপ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, মানুষের মৃত্যু হয়। শরীরে তাপ উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যায়ামের সাহায্য নিতে হবে। পুরো শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য আকুপ্রেশার একটি অপরিহার্য প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে সক্রিয় রাখতে পারলে শারীরিক বৈকল্য থাকবে না, মানুষ সুস্থ-সবল এবং দীর্ঘায়ুলাভ করবে।
তিনি বলেন মানবদেহে ৩৮টি আকুপয়েন্ট রয়েছে, যার অন্যতম মস্তিষ্ক। এটি মানবদেহের এক বিস্ময়কর অঙ্গ। মস্তিষ্কে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, জ্ঞান সংরক্ষিত হয়। কম্পিউটারের মেমরিতে যেমন তথ্য সংরক্ষণ করা যায়, তেমনি মানুষের মস্তিষ্করূপী সুপার কম্পিউটারেও তথ্য ধারণ করে রাখা যায়। মস্তিষ্ক হল মানব দেহের টেলিযোগাযোগ কেন্দ্র শরীরের কোথায় কি ঘটছে, কোথায় কি প্রয়োজন, কি প্রতিকার বা প্রতিরোধ করতে হবে, মস্তিষ্কের মাধ্যমে মানুষ তা জানতে পারে।
স্রষ্টা বলেছেন আমি ব্যক্তি, জাতি বা গোষ্ঠীকে সর্তকবাণী না পাঠিয়ে ধ্বংস করিনি। আমাদের মস্তিষ্কও দেহকে বিভিন্ন সতর্কবাণী দিচ্ছে, যাতে আমরা পূর্বেই সচেতন হতে পারি, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি।
মানুষের মস্তিষ্কে প্রতি সেকেন্ডে ৩ হাজার কোষ জন্মলাভ করছে, প্রতি সেকেন্ডে অনুরূপ কোষের মৃত্যু হচ্ছে। মন নিয়ন্ত্রণ করলে বা ধ্যান করলে ঐ সময়ে অসংখ্য কোষের জন্ম হয়, ফলে মস্তিষ্ককে ভালভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয়। এসময় মস্তিষ্ক যদি ভাল চিন্তা করে তাহলে ভাল কাজের দিকে তার চিন্তা-চেতনা ধাবিত হবে, আর খারাপ চিন্তা করলে ধাবিত হবে খারাপ কাজের দিকে। কেউ যদি বৈজ্ঞানিক হবার চিন্তায় সেরূপ কাজ করে, মস্তিষ্কে সেরকম তথ্য জমা করতে থাকে, একদিন সে সত্যি বিজ্ঞানী হিসেবে সমাজে ঠাঁই করে নিবে।
মানুষের জ্ঞানের বাহক হয়ে পৃথিবীতে যে পীর-আউলিয়া, মুনি-ঋষী, গাউস-কুতুব, ফকির-দরবেশ, ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার, কবি-সাহিত্যিক জন্মলাভ করেছেন ধ্যান বা মন নিয়ন্ত্রণ তাদের জীবনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
আলাউদ্দিন বিশ্বাস আরও বলেন, মস্তিষ্ক হল অফুরন্ত জ্ঞানভান্ডার। যিনি যত ব্যাপকভাবে চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটাতে পারবেন, তার ব্রেনের ধারণ ক্ষমতাও তত বৃদ্ধি পাবে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন নেই, অথচ তাঁর লেখা প্রাইমারী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্য বইতে স্থান পেয়েছে। লালনের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু তাঁর রচিত গান নিয়ে বাংলা একাডেমীতে গবেষণা হচ্ছে।
মানুষের মধ্যে যারা ভাল চিন্তা করবে, তাদের ব্রেন সেভাবেই গড়ে উঠবে, বিকশিত হবে। খারাপ চিন্তা করলে খারাপ কাজই হবে। যিনি মস্তিষ্কের কোষগুলোকে যত বেশি কাজে লাগাতে পারবেন, তিনি তত ব্রেইনী হবেন। এজন্য ব্রেন-কন্ট্রোল সারা বিশ্বেই একটি জরুরি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাই আমাদের চিন্তা-চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। ক্রমাগত চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এভাবে আমাদের দেহ-মনের বিকাশ ঘটিয়ে নিজেদেরকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সুচিন্তায় কাজে লাগাতে হবে আমাদের মস্তিষ্ককে। তাহলে আমাদের জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করবে। মন যদি নিয়ন্ত্রণ থাকে, তাহলে একে দিয়ে অনেক অসাধ্য সাধন করা যায়। ব্রেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে কু-চিন্তা ব্রেনে স্থান করে নেয়, মানুষ মস্তিষ্ককে খারাপ চিন্তার ডিপোতে পরিণত করে। মানুষকে সাধনার মাধ্যমে মস্তিষ্ক থেকে কু-চিন্তা দূর করে দিয়ে সেস্থলে স্থাপন করতে হবে সুচিন্তা। এভাবে মানুষ নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগলাভ করবে।
বাস্তব উদাহরণ দিয়ে জনাব আলাউদ্দিন বলেন আকুপ্রেশার নিয়ে যতক্ষণ চিন্তা করা হবে ততক্ষণ মস্তিষ্কে আকুপ্রেশার জ্ঞানের সন্নিবেশ ঘটবে। আজ সকাল থেকে আমি ৩ জন রোগীর দীর্ঘসময় ধরে আকুপ্রেশার চিকিৎসা করেছি, এ সময়টায় আমার ব্রেনে আকুপ্রেশার ছাড়া অন্য কিছু আসেনি। এখন আকুপ্রেশার সেমিনারে ব্রেন থেকে সেসব তথ্য বেরুচ্ছে। বক্তৃতাশেষে জনাব আলাউদ্দিন উপস্থিতদের প্র্যাকটিকেল চিকিৎসা করে রোগ নিরাময়ের পরামর্শ দেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

বিশিষ্ট আকুপ্রেশারিস্ট আলাউদ্দিন বিশ্বাস বলেন

আকুপ্রেশার শিক্ষা পদ্ধতির প্রচার ও প্রসারে
ক্যাম্পাস যে ভূমিকা নিয়েছে তা অসাধারণ

বাংলাদেশে মাত্র কয়েক বছর আগে চালু হয়েছে আকুপ্রেশার নামক প্রাকৃতিক চিকিৎসা। হাত-পায়ের বিভিন্ন পয়েন্টে হাতের বুড়ো আঙ্গুল অথবা গোলমুখ মোটা কাঠির সাহায্যে চাপ দিয়ে করতে হয় রোগের চিকিৎসা। এখনও দেশের সব অঞ্চলে এ চিকিৎসা পদ্ধতি পৌঁছায়নি। তবে এর প্রসার হচ্ছে দ্রুতগতিতে। যারা একবার এ চিকিৎসার সংস্পর্শে এসেছেন, তারা আর একে ছাড়ছেন না।
গত ৮ জানুয়ারি ক্যাম্পাস আয়োজিত আকুপ্রেশার সেমিনারে আকুপ্রেশার চিকিৎসা পদ্ধতির অগ্রণী ব্যক্তিত্ব আলাউদ্দিন বিশ্বাস এসব কথা বলেন। রোগী হিসেবে ভারতে আকুপ্রেশারিস্টের চেম্বারে গিয়ে অভাবনীয় ফল লাভ করে এ চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর তাঁর গভীর আস্থা স্থাপিত হয়। পরে তিনি নিজেই প্রশিক্ষণ নেন এবং চর্চা শুরু করেন। ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এবং ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র (সিএসডিসি) -এর মহাসচিব এম হেলালের সঞ্চালনে আয়োজিত সেমিনারে জনাব আলাউদ্দিন বিশ্বাস বলেন মানব মস্তিস্ক সারা শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে, পরিচালনা করে। সারাজীবন দেহকে রোগমুক্ত রাখার জন্য আকুপ্রেশার অত্যন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে এখনও ব্যাপকভাবে চালু হয়নি এ চিকিৎসা। আকুপ্রেশার চিকিৎসাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনপ্রিয় করে তোলার ব্যবস্থা করা উচিত। গ্রামের অবহেলিত, হতদরিদ্র মানুষ যাতে অপচিকিৎসার হাত থেকে বাঁচতে পারে, সুচিকিৎসা লাভ করে সুস্থ জীবন লাভ করতে পারে, সেজন্য সমাজ সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন আমাদের সমাজে প্রায় লোককে দেখি শুধু বলেন টেনশনে আছি। আসলে হাইপার টেনশনের জন্য স্নায়ু সমস্যাই দায়ী। আকুপ্রেশার দ্বারা এ হাইপার টেনশন সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মানুষের ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন নিয়ম পদ্ধতির কথা উল্লেখ করে জনাব আলাউদ্দিন বলেন, বেশি খেলে কেন বদহজম হয়? কারণ পাকস্থলীর নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার হজম করার একটা ক্ষমতা থাকে, এর বাইরে গেলে ঘটে বিপত্তি। আমাদেরকে খাবার চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হবে, কারণ চিবিয়ে চিবিয়ে খেলে মুখে যে এনজাইম তৈরি হয়, তা পেটে গিয়ে হজমি শক্তি বৃদ্ধি করে। এজন্য কিছুটা পানি খেতে হবে খাবারের আগে আর খাবারের আধ ঘন্টা পর খেতে হবে বেশি পরিমাণ পানি। ঘুম থেকে উঠে কুলি না করে অথবা থুথু না ফেলে আধা গ্লাস কুসুম কুসুম গরম পানি নিয়মিত খেলে পেটের অসুখ থাকে না; লাংস, সাইনাস সমস্যাও দূর হয়।
তিনি বলেন, অনেকের শরীরে ব্লাড সার্কুলেশনের সমস্যা হয়। ব্লাড সার্কুলেশন কমে গেলে কোলেস্টরল কমে। শরীরে জৈব-বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ব্লাড সার্কুলেশন সচল রাখা যায়। এক্সারসাইজ বা ব্যায়ামের মাধ্যমে সেই জৈব-বিদুৎ উৎপাদন করা যায়। অন্যদিকে ব্লাড সার্কুলেশন ঠিকমত না হলে শরীরে ক্যালসিয়াম সৃষ্টি হয় না। আমরা কত রকমের বাত রোগের কথা শুনি। আসলে বাত রোগ বলে কোন রোগ নেই। ব্লাড সার্কুলেশন ঠিকমত হলে বাত জাতীয় কোন সমস্যা থাকে না। পায়ে উৎপাদিত তাপ বা জৈব-বিদ্যুতের ধাক্কায় শরীরের রক্ত সঞ্চালন লাইনগুলো ক্লিয়ার হয়ে গেলে ব্লাড সার্কুলেশনও গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে। জনাব বিশ্বাস আরও বলেন যারা কায়িক পরিশ্রম করে, তাদের দেহে কোলেস্টরেল জমে না, কারণ তাদের শরীরে জৈব-বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। হাসপাতালে হার্টের রোগীদের ৯৯.৫ ভাগই দেখা যায় মুসলমান। গরুর মাংসই এর কারণ। এ মাংসে প্রচুর চর্বি থাকে, যা হার্টে কোলেস্টরল তৈরি করে সহজে। এজন্য আমাদেরকে পরিমিত খাবার খেতে হবে। বর্তমানে ৬০% লোকের হাইপারটেনশন হয়। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে আকুপ্রেশার অপরিহার্য। নার্ভে যদি রক্ত সঞ্চালন সহজ ও স্বাভাবিকভাবে হয়, তাহলে প্রেসার থাকবে না, হাইপারটেনশনও হবে না।
জনাব আলাউদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠান আকুপ্রেশার শিক্ষা পদ্ধতির প্রচার ও প্রসারে যে ভূমিকা নিয়েছে, তা অসাধারণ। ক্যাম্পাস আকুপ্রেশারকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবেও গড়ে তুলতে পারে। কারণ তাদের রয়েছে নিবেদিত কর্মীবাহিনী এবং নিঃস্বার্থ সমাজসেবার অদম্য প্রয়াস। জনাব বিশ্বাস আরও বলেন, শরীরে রোগ-শোকের অন্ধকার দূর করার জন্য মানুষের দু’হাত ও দু’পায়ে রয়েছে চিকিৎসার সুইচ। সে সুইচ টিপে বাতি জ্বালানোর কৌশল আমাদের শিখতে হবে। পাক-কালামের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, আল্লাহ এরশাদ করেছেন আমি কোন জাতি, সম্প্রদায় বা ব্যক্তিকে ধ্বংস করি না, তাদের কর্মফলই তাদের পরিণতির জন্য দায়ী। আকুপ্রেশার মূলত পীর-সন্ন্যাসীদের উদ্ভাবিত চিকিৎসা; মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ধর্ম-কর্ম সম্পাদন, স্রষ্টার কাছে চাওয়া-পাওয়া আধ্যাত্মিক শক্তি লাভের উপায়। এ জন্যই বলা হয়, সৃষ্টির মূল হল Concentration of mind.
সেমিনারের সঞ্চালক এম হেলাল বলেন আমরা যখন সুস্থ থাকি, তখন অসুখের কথা চিন্তা করি না, আক্রান্ত হলে ছুটে যাই ডাক্তারের কাছে। আমাদের এ ধারা বদলাতে হবে, সুস্থ থাকতেই রোগ প্রতিরোধের জন্য ঢাল তৈরি করতে হবে। রোগ যাতে অংকুরেই চিহ্নিত হতে পারে, জটিল হবার সুযোগ না পায় সেজন্য আকুপ্রেসারের মত প্রাকৃতিক চিকিৎসার ওপর আমাদেরকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে। উল্লেখ্য, ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে প্রতি মাসের ২য় শনিবার বিকাল ৪টায় ফ্রি আকুপ্রেশার চর্চা করানো হয়।