ক্যাম্পাস’র পটভূমি ও ইতিহাস
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাস সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র এর মাতৃসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা; যার যাত্রা শুরু ১৯৮৪ সালে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কৌশলগত এক গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র, স্বাধীন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার দাবি ও লক্ষ্য নিয়ে এ পত্রিকার জন্ম, আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার এবং প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে।
১৯৮২ সালে সামরিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ছাত্রদের প্রতিবাদী প্ল্যাটফরম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং বিভিন্ন হল সংসদ ভেঙে দেয়। এতে একদিকে ছাত্রদের কল্যাণমূলক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র-আন্দোলন বন্ধ থাকে। তাই ডাকসু ও হল নেতাদের সাহচর্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র-সংসদের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক এম হেলাল উদ্যোগ নেন ছাত্র-যুবক ও শিক্ষাঙ্গনের মুখপত্র হিসেবে এ পত্রিকা প্রকাশের।
বিশেষ ধরনের এ পত্রিকা প্রকাশের জন্য সরকারি অনুমোদন তথা ডিক্লারেশন চাওয়ার পর এম হেলালকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব জানান এ পত্রিকায় সরকার বিরোধী কথা ছাপানো হবে, তাই প্রকাশের অনুমোদন দেয়া যাবে না। এরূপ অবস্থায় পত্রিকার প্রধান উপদেষ্টা ড. আশরাফ সিদ্দিকী এবং এম হেলাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিবের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করেন। সামরিক সরকার বিরোধী পত্রিকা হিসেবে এটি বের না করার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর এবং শিক্ষা ও যুব উন্নয়নে এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানের প্রেক্ষিতে সচিব সাহেব বঙ্গভবন থেকে বিশেষ বিবেচনাধীনে অনুমতি নেয়ার আশ্বাস দেন। কারণ তখন পত্রিকার ডিক্লারেশন নিতে বঙ্গভবনের তথা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমোদন লাগতো।
এভাবে বঙ্গভবনের গ্রীন সিগন্যাল মিললেও পত্রিকা প্রকাশনায় পুনরায় বাধা আসে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তথা ডিসি কার্যালয় থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে পত্রিকা বের করা যাবে না বলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জানালে এম হেলাল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বলেন, ছাত্র-যুবক-শিক্ষক ও শিক্ষার কল্যাণে তথা ভালো উদ্দেশ্যে আমরা পত্রিকা বের করবই। এমনকি ডিক্লারেশন প্রক্রিয়া চলাকালীন ২ সংখ্যা বের করার কথাও জানান এবং খোঁড়া যুক্তিতে ছাত্র-যুব ও শিক্ষা কল্যাণের এ উদ্যোগ ব্যর্থ করার চেষ্টা করা হলে তিনি জেল খেটে হলেও পত্রিকা বের করার দৃঢ়তার কথা জানিয়ে দেন। জেলা প্রশাসন কিছুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দেবে না বললে জনাব হেলাল জানতে চান যে ‘কলেজ সুজ’ নামে জুতা বিক্রির দোকানের বৈধতা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় নামে ছাত্র ও শিক্ষাঙ্গনের মুখপত্ররূপে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি কেন দেয়া যাবে না? এরূপ অকাট্য বাস্তব যুক্তি ও দৃঢ় মানসিকতার মুখে এক পর্যায়ে ডিক্লারেশন পাওয়া যায় এবং সেই থেকে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশনা।
সে সময়ে এম হেলালের উদ্যোগের সাথে যাঁরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হচ্ছেন প্রবীণ সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী, প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর ড. কে এম মহসিন, প্রফেসর ড. মাযহারুল ইসলাম, শিল্পপতি সৈয়দ বদরুল আলম প্রমুখ। ক্যাম্পাস’র জন্মলগ্নে এঁদের অবদান ও পৃষ্ঠপোষকতা চিরস্মরণীয়।
প্রথমদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল (SM Hall) এর ১৬৪ নং কক্ষ (এম হেলালের আবাসিক রুম) এবং তারপর ৩৯ আজিমপুর রোড, ঢাকা (ভাড়া করা বাড়ি) থেকে কয়েক সংখ্যা পত্রিকা বের করার পর প্রতিষ্ঠা করা হয় নিজস্ব প্রেস University Printing & Publications (UPP). এরপর ঐতিহাসিক সলিমুল্লাহ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট প্রফেসর ড. কে এম মহসিন এঁর সক্রিয় সহযোগিতায় মতিঝিলস্থ মডার্ন ম্যানসনের ১৫ তলায় ঠাঁই নেয় ক্যাম্পাস অফিস। এসময়ে নিজস্ব প্রেস UPP ছেড়ে দেয়া হয়, কারণ প্রেস পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা ব্যবসায়িক ধ্যান-ধারণা প্রসূত।
শুধু পত্রিকারূপে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের দাবিতে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও ছাত্র-যুব-শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে প্রসারিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এর কর্মপরিধি। অগ্রযাত্রার সেই পথ ধরে ক্যাম্পাস’র বহুমুখী কার্যক্রম সুসমন্বয়ের জন্য ২০০৪ সালে সরকারি অনুমোদনে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র।
লক্ষ্যাভিসারী উদ্যোগ নিয়ে ক্যাম্পাস এগিয়ে চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে কাজ শুরু করলেও ক্যাম্পাস’র বিস্তার দেশ ছাড়িয়ে এখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। ২০২০ সালের মধ্যে কল্যাণ-রাষ্ট্র ব্যবস্থার আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ক্যাম্পাস’র পরিসর বাড়ছে প্রতিনিয়ত; যুক্ত হচ্ছে মাল্টিডায়মেনশনাল কর্মসূচি। প্রকৃতপক্ষে ক্যাম্পাস হচ্ছে নিত্য-নতুন আইডিয়ার জেনারেটর তথা জ্ঞান অন্বেষন ও জ্ঞান উৎপাদনের কারখানা; অর্থাৎ নব নব জ্ঞান সৃষ্টি ও দেশান্তরে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছে ক্যাম্পাস। এসব ভ্যালু এডেড সোস্যাল সার্ভিসের নিত্যনতুন কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্যাম্পাস বেস্ট প্র্যাকটিসগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সমাজে-জাতিতে ও বিশ্ব পরিসরে এবং সবাইকে নিয়ে সত্য ও সুন্দরের পথে এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়ে গতিশীল রয়েছে অনুকরণীয় প্ল্যাটফরম হিসেবে।
যে উদ্যোগের মাধ্যমে এই বহুমুখী প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা গত ৩৪ বছর ধরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষাধীনে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। এছাড়াও এ প্রতিষ্ঠান শিক্ষা সহায়ক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃত, সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে রেজিস্ট্রিকৃত; অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত সরকারের জাতীয় রাজস্ব বাজেটেও ক্যাম্পাস অন্তর্ভুক্ত দীর্ঘদিন থেকে।