নিজেই বৃদ্ধি করতে পারেন নিজের মানসিক শক্তি

ভবঘুরে আমি; বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ৭/৮ বার ঘুরে এবং ১৪টি দেশ বিভিন্নবার ভ্রমণ করে বুঝেছি যে, বাঙালির বুদ্ধি ও কৌশল অন্য যে কোন জাতির তুলনায় ঢের বেশি। আরও লক্ষণীয় যে, অধিকাংশ বাঙালীর বুদ্ধিতে নেতিবাচক দিক ও জটিলতা বেশি কিন্তু উন্নত জাতির বুদ্ধিতে ইতিবাচক দিক ও সরলতা বেশি।
বাঙালির বুদ্ধিতে থাকা negative thoughts-ideas & suggestions-এর কারণে তাদের ‘জিঞ্জিরা মেইড প্রোডাক্টস’ -এ বাজার এমনই সয়লাব যে, কোনটি আসল আর কোনটি নকল সেটি ঠাহর করাও আরেক গবেষণা ও বিশেষ প্রতিভার ব্যাপার। আসল-নকলের এ ভুবনে থাকা যেন পাগলা গারদে বিচরণ। এখানে যেমনি রয়েছে ভেজাল বিরোধী অভিযানের সাফল্য, তেমনি রয়েছে অনুরূপ অভিযানকে প্রতিরোধের সাফল্যও! অর্থাৎ বাঙালির বুদ্ধি ও কৌশলে সৃষ্টি ও ধ্বংস দুই-ই রয়েছে।
বাঙালিদের অধিকাংশের মধ্যে negative thoughts & ideas বেশি বলে এদের কর্মকাণ্ডে সৃষ্টির তুলনায় ধ্বংস বেশি। ফলে অগ্রসরতা কম বা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে উন্নত দেশ ও জাতির মধ্যে positive thoughts & ideas বেশি বলে তাদের কর্মকাণ্ডে ধ্বংসের তুলনায় সৃষ্টি বেশি। ফলে অগ্রসরতা বা উন্নতিও বেশি। এসব কারণে বাঙালির ব-হু-কি-ছু থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতিভা ও সৌন্দর্য্য বিকশিত হতে পারছে না। যদি কোনভাবে বাঙালির এই তীক্ষ বুদ্ধি ও ধীশক্তি থেকে negative thoughts & ideas বাদ দিয়ে সে স্থলে positive thoughts & ideas-এর উন্মেষ ঘটানো যায় অর্থাৎ কম্পিউটারের ন্যায় মানুষের মস্তিষ্কে ভাল প্রোগ্রাম install করার মাধ্যমে খারাপ চিন্তা বা ইনফরমেশন inactive করা যায়, তাহলে বাঙালি শৌর্য্য-বীর্যে তেজোদ্দীপ্ত হয়ে পৃথিবীতে অনন্য শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে -এ আমার নিগূঢ়তম বিশ্বাস। কিভাবে সেই তেজোদ্দীপ্ত, সহজ-সরল, কল্যাণকামী, দেশপ্রেমী ও সৃজনী শক্তিসম্পন্ন বাঙালি জাতি গড়ে তোলা যায়, সে লক্ষ্যেই আজকের এ লেখা।
বাঙালি জাতির চিন্তাশক্তির অনুরূপ পরিবর্তন ঘটানো হাসিনা-খালেদা-এরশাদ বা কোন সরকার প্রধান তথা একক কোন সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রাথমিকভাবে এটি উপলব্ধির বিষয়, তারপর একে পরিণত করতে হবে সামাজিক বিপ্লবে। তবে এ বিষয়টির সম্যক উপলব্ধিসম্পন্ন কোন দেশপ্রেমী ও কল্যাণকামী সরকার এরূপ সামাজিক বিপ্লবের সূচনা ঘটানোয় বা প্রেক্ষাপট তৈরিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। তাই সরকার ও রাজনৈতিক দল অথবা জনকল্যাণে নিবেদিত সামাজিক সংগঠন যদি সমাজ পরিবর্তন করতে চায় তাহলে প্রথমেই জাতির মানস পরিবর্তন ঘটানোয় কাজ করতে হবে। আর সে লক্ষ্য অর্জন তথা মানুষের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি করতে হবে নিম্নোক্ত দর্শনে।
প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কমবেশি সৃজনীশক্তি থাকে। কিছু বিষয়ের নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে অন্তর্নিহিত এ সৃজনীশক্তিকে সহজেই সৃষ্টির কাজে লাগানো যায়; যেমন- মানবিক গুণাবলী অর্জন, প্রাকৃতিক ও প্রকৃত হওয়া, টেনশন-ফ্রি বা মানসিক চাপমুক্ত ও ভারমুক্ত থাকা, দায়িত্ববোধসম্পন্ন হওয়া ও অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা, হিংসা-ক্রোধ-লোভ-পরনিন্দা-পরচর্চা-অহংকার পরিহার, নিজের মধ্যে সত্য-ন্যায়-ভালবাসা ও প্রেম জাগ্রত করা, সর্বোপরি স্রষ্টার প্রতি সার্বক্ষণিক সুদৃঢ় ও সরল বিশ্বাস।
এসব গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে নিজের মধ্যে তৈরি হয় আস্থা বা আত্মবিশ্বাস, বিকশিত হয় ব্যতিক্রমী বিশেষ এক শক্তি, যা সৃজনীশক্তির চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী; ইংরেজিতে যাকে বলে aura, আরবিতে ‘নূর’, বাংলায় ‘জ্যোতি’ বা ‘আলো’। যে আলোয় আলোকিত হলে মানুষ পরিণত হয় বিশেষ মানুষে, ঐ মানুষের চিন্তার পরিধি প্রসারিত হয়ে যায় বলে সে নিজকে নিবেদিত করে দেয় আপামর মানুষের সেবায় তথা সৃষ্টির কল্যাণে। এতে একদিকে তার আত্মার প্রশান্তিলাভ ও জীবনের লক্ষ্য অর্জিত হয়, অন্যদিকে স্রষ্টা কর্তৃক পৃথিবীতে তাকে প্রেরণের উদ্দেশ্যও সার্থক হয়।
এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য অর্জন কারো কারো জন্য সহজ নাও হতে পারে। তবে নিয়মিত চর্চায় অভ্যাসে পরিণত করার মাধ্যমে একবার আয়ত্তে এসে গেলে জীবনটা এমনই ভারমুক্ত-সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে যায় যে, নিজের অন্তরে সর্বদাই একটা আনন্দানুভূতি বিরাজ করতে থাকে। সুস্থ-সহজ-সরল-সবল সেই মনোজগতে তখন সবই ভাল লাগে। সবকিছুর সাথে মনের Adjustment থাকার ফলে প্রতিকূল বা নেতিবাচক পরিস্থিতিতেও বিচলিত বা বিব্রত হতে হয় না। ধীর-স্থির, দৃঢ় ও সৃজনশীল চিন্তাশক্তির কাছে যে কোন প্রতিকূলতা শেষতক অনুকূল ও ইতিবাচক হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ইতিবাচক শক্তি ও মননের এ মানুষটি সব পরিবেশকে নিজের বশীভূত করে বলে ওঠে ‘আমার এ পৃথিবী, আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাব, যা ইচ্ছা তাই করব’।
দ্রুতগতির যানবাহনের জন্য যেমনি সোজা রাস্তা দরকার, তেমনি সৃজনশীলতার জন্য বা প্রাকৃতিক ও প্রকৃত হবার জন্য তথা স্রষ্টার আনুকূল্যের জন্য সরল মন দরকার। কারণ গভীর ও দূরের লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে আঁকা-বাঁকা পথ বা দ্বিধান্বিত চিন্তা-চেতনা বা মন-মানসিকতা বিরাট বাধাস্বরূপ। গভীর লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে নেগেটিভ বা নেতিবাচক চিন্তা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। দূরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছার জন্য গাড়িকে যেমনি সোজা রাস্তায় তেজী গতিতে চলতে হয়, মানবজীবনেও লক্ষ্য অর্জন বা লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তেমনি সরল চিন্তা ও সরল বিশ্বাস অত্যাবশ্যক। সরল চিন্তা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে প্রকৃতি ও স্রষ্টার মহাশক্তির সাথে নিজকে সংযোগ বা ধষরমহ করে আত্মশক্তি বৃদ্ধিতে সক্ষম হওয়া যায়। তাই ‘সরল চিন্তা’ জীবনযুদ্ধের জ্বালানীরূপে কাজ করে, যে ‘জ্বালানী’ সর্বদাই শক্তিতে পরিণত হয়ে লক্ষ্য অর্জনকে করে তোলে সহজ ও নিশ্চিত। এজন্যই বলা হয়, your thought is your energy and energy is the power. তাই positive idea বা positive thinking -এর মাধ্যমে নিজের মধ্যে প্রচুর energy তৈরি করা এবং সে energy দিয়ে নিজকে powerful তথা শক্তিশালী করে তুলতে পারলেই কবি নজরুলের মত চিৎকার করে বলা যায় মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’, চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’..., উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
নেতিবাচক চিন্তার পথভ্রষ্ট মানুষরা ইতিবাচক মানুষদের উড়ন্ত ডানার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে; ঈর্ষা-হিংসার বশবর্তী হয়ে তাকে টানতে চায় পেছনে। কিন্তু অন্যকে পেছনে টানতে গিয়ে সে নিজেই চলে যায় পশ্চাতে। রবি ঠাকুরের মতে পশ্চাতে টানিছ যারে, সে তোমারে ফেলিছে পশ্চাতে। তাছাড়া ইতিবাচক মানুষের সাথে বেড়ে যায় তার দূরত্ব। এ দূরত্বে গিয়েও স্বল্প সংখ্যক নেতিবাচক মানুষ পানি ঘোলাটে করে বা নাকানি-চুবানি খেয়ে অবশেষে বিজিতের বেশে ইতিবাচক মানুষের অনুসারী হয়ে ওঠে। কিন্তু অধিকাংশ নেতিবাচক মানুষ অনুরূপ বা কোনরূপ ইতিবাচক আলোর প্রজ্জ্বলন বা পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে ‘হতাশার কাফন জড়ানো জীবন্ত লাশ’ হয়ে বেঁচে থাকে এবং প্রাকৃতিক নিয়মেই ব্যর্থ, অশান্ত ও অতৃপ্ত মন নিয়ে দেহত্যাগ করে তথা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। এরূপ দেহত্যাগী অশান্ত আত্মা বা প্রেতাত্মা তথা অদৃশ্য খারাপ শক্তি পরবর্তী প্রজন্মের মানুষকে বিভ্রান্ত করায় লেগে থাকে, খারাপ জ্বীন-পরীর মত। অন্যদিকে ইতিবাচক মানুষের আত্মা দেহত্যাগের পরও শুভ শক্তিরূপে ভাল জ্বীন-পরীর মত মানবতার কল্যাণে ও মানুষের জয়গানে মুখরিত থাকে অনন্তকাল। অর্থাৎ মানুষের ইতিবাচক মন পৃথিবীর এপ্রান্তে-ওপ্রান্তে, একালে-ওকালে, ইহকালে-পরকালে, সর্বকালে ও সর্বস্থানে মানবতার কল্যাণে ও সৃষ্টির সেবায় উল্লসিত থাকে এবং উন্মুখ ও ব্যাপৃত থাকে স্রষ্টার নৈকট্যলাভে।
সত্য ও আধ্যাত্মিকতা একটি গভীর উপলব্ধি, যা বিশ্বাসের আয়তনে আকৃতিলাভ করে। বিশ্বাস যত দৃঢ় হয়, সত্যের উপলব্ধি হয় তত সহজ। কথায় বলে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। যারা সর্বদাই সন্দেহ ও সংশয়ে থাকেন, সত্য ও আধ্যাত্মিকতা তাদের থেকে দূরে অবস্থান করে। এক কথায় সত্য, প্রাকৃতিক শক্তি (সৃষ্টির শক্তি) ও আধ্যাত্মিকতা সর্বদাই সন্দেহ ও সংশয়কে এড়িয়ে চলে। তাই আধ্যাত্মিকতা অর্জনের প্রথম শর্তই হচ্ছে সন্দেহ দূর করে সহজ-সরল মনে desire, belief & expectation -এর মাধ্যমে কর্মে নিবিষ্ট থাকা।
এখন কথা হচ্ছে, সন্দেহ ও সংশয়ের বাতিক তাড়ানো যায় কিভাবে! সন্দেহের উৎপত্তি আত্মবিশ্বাসহীনতা থেকে। নিবন্ধের শুরুতেই আত্মবিশ্বাস তৈরির উপায় সম্পর্কে বলা হয়েছে। সে আলোকে আত্মবিশ্বাসহীনতার কারণ হচ্ছে দায়িত্বহীনতা, অন্যের অধিকারের প্রতি উদাসীনতা, হিংসা-ক্রোধ-লোভ-পরনিন্দা-পরচর্চা-অহংকার, নিজের মধ্যে সত্য-ন্যায় ও ভালবাসার ঘাটতি এবং স্রষ্টার প্রতি সার্বক্ষণিক সুদৃঢ় ও সরল বিশ্বাস স্থাপনে ব্যর্থতা। এক কথায় নিজের প্রতি আস্থার অভাব।
ধ্যান বা মেডিটেশনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ও মানবিক গুণাবলী অর্জন এবং সত্য ও ন্যায়ের পতাকা উড্ডীন তথা ইতিবাচক ও কল্যাণময় মানসিকতা অর্জন খুবই সহজ। কেউ চাইলে প্রতি শনিবার বিকালে ক্যাম্পাস পত্রিকার অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠেয় যৌথধ্যান, প্রাণায়াম ও ইয়োগা চর্চায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সহজেই এরূপ আত্মোন্নয়ন ঘটাতে পারেন। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও আলোকিত জাতি গঠনে ক্যাম্পাস বিনামূল্যে এসব সেবা দিয়ে আসছে। ছোটবেলা থেকে পড়ায় ও শোনায় যখনই ‘আধ্যাত্মিকতা ও সিদ্ধিলাভ’ -এর প্রসঙ্গ এসেছে, তখনই আমার মনোবীণায় ও মনোপর্দায় বেজে ও ভেসে উঠেছে যে এসব বিষয় মহামানবদের ব্যাপার; পীর-ফকির-আউলিয়া-ধর্মগুরু-ধর্মযাজক ও ধর্মপ্রচারকদের জগৎ এটি। এ জগতের প্রতি আমার কৌতুহল থাকলেও উপলব্ধির গভীরতার ঘাটতি ছিল। কিন্তু শৈশব থেকেই ন্যায়ভিত্তিক ও যুক্তিভিত্তিক আচার-আচরণে অভ্যস্ত আমি জীবনের একটি পর্যায়ে এসে উপলব্ধি করছি ‘ভাল ও মঙ্গল’ বা ‘সত্য ও ন্যায়’ -এর চর্চার মাধ্যমে প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতার কাছাকাছি যাওয়া খুব কঠিন নয়। আধ্যাত্মিকতা অর্জনের বিষয়ে আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যৎসামান্য; ‘সিদ্ধিলাভ’ বা লক্ষ্য অর্জনের বিষয়েও আমি জ্ঞানী নই, তবে মাঝে মধ্যে জ্ঞানের কাছাকাছি ঘুরপাক খাচ্ছি বলে মনে হয়। দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া তেমনই নানা অনুভূতির কিছু ঘটনা পাঠকের সাথে শেয়ার করব এ স্বল্প পরিসরেও। এর উদ্দেশ্য পাঠককে বিশেষতঃ ছাত্র-যুবকদেরকে মঙ্গল চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করা, যাতে তারা অনুরূপ কিছু বিষয় চর্চার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী হয়ে আত্মোন্নয়ন ঘটাতে পারে এবং সেইসাথে অন্যের কল্যাণেও নিজের এ শুভশক্তিকে ব্যবহার করতে পারে। এসবই আমার সতত-প্রকৃত ও প্রাকৃত আত্মবিশ্বাস। এ অনুভূতি আমার একান্ত নিজস্ব। এর ভুল-শুদ্ধ সবই আমার ভুবনে সংরক্ষিত। এতে কারো বিব্রতবোধের অবকাশ নেই। একান্ত ব্যক্তিগত এবং প্রাকৃতিক এসব অনুভূতির বিষয়ে সংশয় ও বিতর্কের সুযোগও অবারিত নয়।

কেস স্টাডি ॥ এক
একনাগাড়ে লেখা বা এক বসায় লেখার মত সময় ও সৌভাগ্য হয়ে ওঠে না। তাই যেখানেই যাই, অসমাপ্ত পান্ডুলিপি সাথে করে নিই; যদিবা ফুরসত পাওয়া যায়- লেখার প্লট নিয়ে চিন্তা করার বা লেখায় এগুবার।
একটি লেখা তৈরি করেছিলাম, এলাকাভিত্তিক স্কুলিং -এর ওপর। কিন্তু পান্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। কোথায় রেখেছি বা কোথায় ফেলে এসেছি, তা স্মরণ করতে পারছিলাম না। নিজ অফিসে ও বাসায় খুঁজে না পেয়ে মেডিটেশন করলাম যেন প্রিয় সে লেখাটি আমার হাতে চলে আসে। সমস্যা হচ্ছে সেটি ছিল হাতে লেখা খসড়া, সেখানে ছিল না লেখকের নাম-পরিচয় বা কারুর কোন ঠিকানা, যেরূপ ঠিকানা হারানো জিনিস ফেরত পাবার জন্য প্রয়োজন হয়।
মেডিটেশনে স্মরণ করলাম, ওই দু’তিন দিনে বাইরে কোথায় কোথায় গিয়েছি। আমি গিয়েছিলাম প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এনএসপিডিএল’র একটি সেমিনারে, চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক’র কনভোকেশনে এবং বেইলী রোড অফিসার্স ক্লাবের একটি মিটিংয়ে। মনের সাথে মস্তিস্ক যোগ করে (মনোযোগ দিয়ে) অস্পষ্ট ধারণা এলো প্রেসক্লাবেই রেখে এসেছি হয়ত। তাই মেডিটেশন থেকে বের হয়ে প্রেসক্লাবের দপ্তরে এবং সেমিনারের উদ্যোক্তাকে ফোন করে আমার পান্ডুলিপি হারানোর কথা বললাম এবং তাদের কাগজপত্রের সাথে পেয়ে থাকলে আমাকে জানানোর অনুরোধ করলাম। প্রাণ-প্রিয় লেখা ফেরত পাবার উদগ্রীবতায় ৫০টাকা মানতও করলাম।
অবশেষে ৮/১০ দিন পর মীরপুরের ভাষানটেক থেকে এনএসপিডিএল’র চেয়ারম্যান জানালেন এরূপ একটি লেখা তাদের কাগজপত্রের সাথে পাওয়া গেছে। লেখার প্রথম লাইন শুনিয়ে জানতে চাইলেন, তা আমার কিনা। আলহামদুলিল্লাহ্ বলায় তিনি খুশি হয়ে গেলেন, আর আমিতো খুশিতে আটখানা। তিনি বললেন, তাঁর স্টাফের মাধ্যমে লেখাটি আমার অফিসে পৌঁছিয়ে দেবেন।
লেখা হারানোর পর ফিজিক্যাল ডাইমেনশনে খুঁজে না পেয়ে নন-ফিজিক্যাল ডাইমেনশন থেকে ফেরত পাবার জন্য যে প্রোগ্রাম করেছিলাম, ‘আমার লেখা যেন আমার হাতে চলে আসে’ শেষতক তাই হয়েছে।
ধন্যবাদ স্রষ্টাকে। ধন্যবাদ এনএসপিডিএল’র চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

কেস স্টাডি ॥ দুই
শ্বশুর পক্ষের আত্মীয়া মিলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক এডমিনে মাস্টার্স করে এখন স্বামী ও নিজের এডমিন করছে। থাকে নারায়ণগঞ্জে। ক্যাম্পাস আয়োজিত যৌথ ধ্যানের কয়েকটি সেশনে অংশগ্রহণ করেছিল। রমজানের এক সন্ধ্যায় ফোন করে কুঁকড়িয়ে বলল কয়েকদিন থেকে আমার জ্বর, পেটে ভীষণ ব্যথা, গতকাল ডাক্তারী রিপোর্টে কিডনী-স্টোন ধরা পড়েছে; আমার জন্য মেডিটেশন করবেন। তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললাম এ মুহুর্ত থেকে আপনি ভাবতে থাকুন যে, আপনার কিডনীর স্টোন গুড়ো হয়ে বা গলে গিয়ে ইউরিনের সাথে বা শরীরের কোন আউটলেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। বেশি বেশি পানি খান, সৃষ্টিকর্তার রহমত কামনা করুন, আপনি নিজেও মেডিটেশন করুন এবং বলতে থাকুন আমি ভাল হয়ে যাচ্ছি, সুস্থ হয়ে যাচ্ছি...। সে রাতেই তারাবীর নামাজের পর তার অসুস্থতার কথা আমার মনে পড়ে। তাকে মেডিটেশনের মেন্টাল স্ক্রীনে আনলাম, অসুস্থতা বুঝলাম এবং দেখছিলাম- তার কিডনীর স্টোনগুলো গুড়ো হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে, মিলি সুস্থবোধ করছে...।
সেই মেন্টাল স্ক্রীনে মিলিকে দেখার স্থায়িত্ব ছিল কয়েক সেকেন্ড। এরপর মোনাজাত শেষে জায়নামাজ গুটিয়ে যথারীতি রিডিং টেবিলে কাজ করছিলাম। ঘন্টা দু’য়েক পর মিলির ফোন; এবার কুঁকড়িয়ে নয়, স্বাভাবিক স্বরে বলল আমার জ্বর চলে গেছে, ব্যথাও কমে গেছে। দৃঢ়তার সাথে বলল, দোয়া করবেন যেন অপারেশন করানো না লাগে।
দু’দিন পর আমিই তাকে ফোন করলাম। মিলি বলল অপারেশনের প্রস্তুতিতে ডাক্তার পুনঃপরীক্ষা করে জানিয়েছে, তার কিডনীতে স্টোন দেখা যাচ্ছে না। তাই আপাতত অপারেশন স্থগিত রেখেছে ডাক্তার। তাকে বললাম, ব্যথা না হলে আর ডাক্তারের কাছে যাবার দরকার নেই। তাকে আওড়াতে বললাম - Everyday and in everyway I’m getting better, better & better by the grace of Almighty (ক্রমান্বয়েই আমি ভাল হয়ে যাচ্ছি, ভাল আছি, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ...)।
এরপর মিলিকে আর অপারেশন করাতে হয়নি। স্রষ্টার কৃপায় মিলি ভাল আছে বলেই জানি। ধন্যবাদ স্রষ্টাকে, ধন্যবাদ মিলিকে নিজের সুস্থতায় নিজেই মানসিক কাজ করার জন্য।

কেস স্টাডি ॥ তিন
গুলশান শুটিং ক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি মেলায় গিয়ে প্রবেশ-টিকেটের পুরস্কারে জিতেছে আমার স্ত্রী। পুরস্কারটি হল কাপল (স্বামী-স্ত্রী) -এর সামারকান্দ বা লেমন গ্রাস রেস্টুরেন্টে কমপ্লিমেন্টারী ইফতার ও বুফে ডিনার। কথাচ্ছলে এ বিষয়টি স্ত্রী আমাকে জানানোর পর আমি উৎসাহ দেখালেও আগ্রহ দেখালাম না। কারণ দু’বাচ্চাকে বাসায় রেখে আমাদের ডিনার...!
সপ্তাহ দু’য়েক পর স্ত্রী আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে ভাবলাম, কুপনটি বিফলে যেতে দেয়ার চেয়ে রেস্টুরেন্টের সাথে কথা বলে এভাবে সেটেল করা যায় কিনা বাচ্চাদের ৫০% বা অনুরূপ ডিসকাউন্টে আমাদের সাথে নেয়া। কারণ বুফে খাবারে প্লেট হাতে নিলেই পুরো বিল, প্লেট প্রতি প্রায় ৭০০/৮০০ টাকা। বাচ্চারা খাবে কোয়ার্টার প্লেট আর বিল দিতে হবে পুরো প্লেটের। স্ত্রীকে আইডিয়াটি বলতেই তিনি রেস্টুরেন্টে ফোন করলেন। রেস্টুরেন্ট থেকে জানালো যে, ঐ কুপনে স্পষ্ট লেখা না থাকলেও সেটি ফ্যামিলি কুপন, যাতে মা-বাবার সাথে দু’বাচ্চা ফ্রি খেতে পারবে।
বাচ্চাদের নিয়ে ডিনারে যেতে ডিজায়ার, বিলিফ এন্ড এক্সপেকটেশন বাস্তবে প্রতিফলিত হয়ে গেল অনায়াসেই। ধন্যবাদ স্রষ্টাকে ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

কেস স্টাডি ॥ চার
৯ জুন ’০৯ ॥ ড. নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) -এর রিসার্চ ফেলো। এর পাশাপাশি প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে কনসালটেন্সিও করেন বিশ্বব্যাংকে। পেশায় অর্থনীতিবিদ, নেশার ঘুরপাকে আমার স্ত্রী।
গত পরশু সকালে অফিসে যাবার পূর্বে বলে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট জমা দিয়েছি ৪/৫ মাস হয়ে গেছে। এখনও তারা কণ্ট্রাক্ট পাঠাচ্ছে না। এটা না হলে আমার বুকিংকৃত ফ্ল্যাটের টাকা পরিশোধে অসুবিধা হবে, তাই টেনশনে আছি। আমাকে উইশ করে দাও, যেন কণ্ট্রাক্টটা চলে আসে..। স্ত্রী অফিসে চলে যায়।
টাকা-পয়সা সংক্রান্ত তার টেনশনের কথা শুনে বিষয়টি আমার নিকট গুরুত্ব পেল না। কিন্তু কাজা ফজরের নামাজ শেষে জায়নামাজ গুটানোর সময়ে স্ত্রীর উক্ত অনুনয় মনে পড়ায় সহানুভূতির সাথে তার সমস্যাটা অনুভব করার চেষ্টা করলাম। এরপর প্রোগ্রাম করলাম কয়েক সেকেন্ডে।
পরদিন সকালে অফিসে যাবার পূর্বে সে বলল ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশস্থ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক অফিসে কণ্ট্রাক্টটা এসেছে, কিন্তু তার কাছে আসেনি। আমি বললাম, এ বিষয়ে টেনশন করলে বা মানসিক চাপ রাখলে কন্ট্রাক্ট আসতে দেরি হবে, এমনকি নাও আসতে পারে। এ বিষয়ে আর টেনশন না করে মনকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করার চেষ্টা কর, দেখবে এটি হাতে চলে এসেছে। এ কথায় সে খুশি হয়ে তার অফিসে চলে যায়। আর আমিও আমার অফিসে। ঘন্টাখানেক পর তার ফোন। সে খুশিতে আটখানা হয়ে বলে আমি অফিসে এসে দেখি কণ্ট্রাক্টটা চলে এসেছে, তোমাকে ধন্যবাদ।
এর দু’তিন দিন পর স্ত্রী বলে ঐ কণ্ট্রাক্টে আমার স্বাক্ষর দিয়ে পাঠানোর পূর্বে বিআইডিএস’র অনুমোদন লাগবে; তুমি একটু উইশ করে দিও। এটি হয়ে গেলে ফ্ল্যাট কেনায় আমি বেশ কয়েক কিস্তির টাকা দিয়ে দিতে পারবো। উল্লেখ্য যে, সে যখনই টাকার কথা বলে তখনই সে প্রসঙ্গে আমার কেমন যেন উদাসীনতা চলে আসে। তাই তার কথাটা গুরুত্ব পেল না। দু’জন যার যার অফিসে চলে গেলাম। ঘন্টা তিনেক পর ১১-৫৩ মিনিটে তার ফোন। ফিসফিস করে বলে আমি প্রজেক্ট সংক্রান্ত মিটিং থেকে বলছি, আমার ঐ কণ্ট্রাক্ট নিয়ে আলাপ হচ্ছে, প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে প্রজেক্ট পাস হচ্ছে না। এটি পাওয়ার আর কোন সম্ভাবনাও দেখছি না। তুমি একটু উইশ করো।
আমার সম্মুখে তখন সহকর্মী রনি ও রাজু; একটি সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলাম। স্ত্রীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাদেরকে বললাম, তোমরা ২/৪ মিনিট পরে আস। তারপর রেডলাইট অন করে (যেন কেউ না আসে) কয়েক মিনিট মানসিক কাজ করলাম। দেখতে পেলাম, বিষয়টিতে তার অথরিটি খুবই নেগেটিভ এটিচিউডে রয়েছে এবং প্রজেক্টটি সে পাচ্ছে না। আমি ok, yes, 3 (right sign) দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তা কেমন যেন অস্পষ্ট। এরপর ঐ সভাকে নিয়ে গেলাম আমার মনোজগতের ‘আইডিয়াল প্লেস অব রিলাক্সেশন’ -এ। সেখানে নিয়ে তাদেরকে প্রশংসাসূচক কথার মধ্য দিয়ে ইতিবাচক ঐকমত্যে আনার চেষ্টা করলাম এবং অবশেষে পেলাম পজিটিভ এটিচিউড। তারপর দেখলাম ‘’; সভার সভাপতির এমন ধরনের কথা শুনলাম ‘ঠিক আছে, এবারের জন্য এটি দেয়া হল..’। আমার মেডিটেশনের সাবজেক্ট তথা স্ত্রীকে হাসিখুশিতে দেখলাম। এরপর মেডিটেশন লেভেল থেকে বেরিয়ে এলাম এবং রনি ও রাজুকে ডেকে তাদের সাথে অসমাপ্ত আলোচনায় মনোনিবেশ করলাম।
একটু পর মনে হল স্ত্রীকে একটা এসএমএস পাঠিয়ে আমার ফাইন্ডিংস জানিয়ে দেই এবং তাকে ভারমুক্ত ও আশ্বস্ত করি। তাই ১২টা ১৬ মিনিটে তাকে এরূপ এসএমএস করলাম - “? to yes”. প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে বুঝিয়েছি যে- এতে বাধা আছে, আর ুবং দিয়ে বুঝিয়েছি যে- তা সত্ত্বেও তুমি প্রজেক্ট পেয়ে যাচ্ছ। এরপর ১২টা ২৪ মিনিটে তার থেকে এসএমএস এলো ‘After long conflict it is yes... Thanks a lot for ur blessings. Love u’. আমার সম্মুখে থাকা রনি ও রাজুকে স্ত্রীর এসএমএস’র কথা জানিয়ে পরামর্শ দিলাম মেডিটেশনের মাধ্যমে ন্যাচারাল পাওয়ারের সাথে নিজকে ধষরমহ করে স্রষ্টার রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে, আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধির দ্বারা মানসিক শক্তি ও শান্তির পথ সুগম করতে। ধন্যবাদ স্রষ্টাকে, ধন্যবাদ ড. নাজনীনের প্রজেক্ট-সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

কেস স্টাডি ॥ পাঁচ
লুৎফুন নাহার। একদিকে ভাগ্নী, অন্যদিকে আমার অফিস-স্টাফ। সদ্য বিবাহিতা। তার বোন তিশি তার সাথে করে ফেলেছে লংকাকা-। একদিন সকালে আমার রুমে এসে অশ্রুসজল নাহার বলে স্যার, আমি বাসায় যেতে চাচ্ছি; বাসা থেকে আমার বোন মুন্নি ফোন করে এক্ষণই বাসায় যেতে বলেছে। তাকে অনুমতি দিয়ে বললাম, বাসায় গিয়ে অবস্থা জানিয়ো।
ঘন্টা তিনেক পর নাহার ফোন করে জানালো তার ছোটবোন তিশি কয়েকমাস আগে পারিবারিক অনুমতি ছাড়া নিজেই বিয়ে করে ফেলে। এরপর আর তার সাথে যোগাযোগ নেই। গত পরশু হঠাৎ ফোন করে বলে আপু, আমি এর সাথে (স্বামীর সাথে) আর থাকতে চাই না, তুমি আমাকে নিয়ে যাও।
ছোটবোনের কথামত নাহার তাকে বাসায় নিয়ে আসে। তারপর ৩য় দিন দু’বোনকে বাসায় রেখে নাহার ও তার হাজবেন্ড যথারীতি অফিসে যায়। এরপর মেঝবোন মুন্নি বাথরুমে গেলে ছোটবোন বাহির থেকে ছিটকিনি এঁটে দিয়ে তাকে বাথরুমে জিম্মি করে মূল্যবান জিনিসপত্র বিশেষতঃ নাহার’র বিয়ের স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায়। তারপর মুন্নি দরজায় সজোরে ধাক্কা দিয়ে ছিটকিনি ভেঙ্গে বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাহারকে ফোন করে। আমাকে ফোনে পুরো ঘটনা জানিয়ে নাহার কাঁদতে থাকে এবং ঐদিন আর অফিসে আসতে চাচ্ছে না বলে জানায়।
পরদিন সকালে নাহার যখন আমার রুমে প্রবেশ করে, তখন তার চেহারা ছিল বিধ্বস্ত। তার অশ্রুসজল উৎকন্ঠা শাশুড়ীর দেয়া গয়না নিয়ে ছোটবোন যে পালিয়েছে, একথা শাশুড়ীর কানে গেলে...। নাহারকে বোঝালাম তুমি ধৈর্য্য ধর, স্রষ্টার ওপর এবং নিজের সততার ওপর আস্থা নষ্ট করবে না, স্রষ্টা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এখন থেকে এরূপ নব উদ্যমে কাজ করো, যেন শাশুড়ীর দেয়া গয়না এক বছরের মধ্যে কেনার মত অর্থ উপার্জিত হয়ে যায়; সৃষ্টিকর্তার রহমত কামনা করো...। এরূপ আলোচনায় নাহার কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল।
তারপরের ৪র্থ দিন নাহার তার গয়না ফেরত পাবার বিষয়ে আরো হতাশাব্যঞ্জক কথা জানায় যে- তার ঐ বোন তাকে ফোন করেছে এবং দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে আপু, আমরা টাকার অভাবে এরূপ খারাপ কাজ করতে বাধ্য হয়েছি; তোমার গহনা বিক্রি করে দিয়েছি; কিছু মনে রেখ না...। অশ্রুসজল নাহার’র কথা শেষ না হতেই তাকে মেডিটেশন করতে বলে বিদায় দিলাম।
তারপর চোখ বুঁজে কয়েক সেকেন্ড মেডিটেশন করে নিজের কাজে ডুবে গেলাম। তার দু’দিন পর সকালে উজ্জ্বল-উচ্ছল হাসিমুখে নাহার এসে বলে ‘আমার হাজবেন্ড আমার ছোটবোনের হাজবেন্ডের গ্রামের বাড়ি বরিশাল গিয়েছে, সেখানে স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে আমার খোয়া যাওয়া অলঙ্কার উদ্ধার করতে পেরেছে...।
ধন্যবাদ স্রষ্টাকে, ধন্যবাদ নাহার ও তার হাজবেন্ডকে তাদের ধৈর্য্যরে জন্য। যে ধৈর্য্যগুণে ও আস্থাবলে তারা তাদের হারানো অলঙ্কার ফিরে পেয়েছে।

কেস স্টাডি ॥ ছয়
৩০-৫-’০৯ তারিখে অফিসে যাবার পর এডমিন অফিসার রনি জানায় স্যার, ডিজাইনার রাজু অসুস্থ; আজ অফিসে আসবে না। অফিস পরিচালনা-সংশ্লিষ্টদের নিকট এরূপ বার্তা খুবই নৈমিত্তিক। আবার যা নৈমিত্তিক তা রুটিন, যা রুটিন তা আকর্ষণহীন। বিশেষতঃ বাংলাদেশের অফিস আদালতে নানা ছুতায় অফিস থেকে ছুটি নেয়া বা ছুটি কাটানোর সংস্কৃতির কারণে এরূপ মেসেজ শুনলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতি সাধারণতঃ সমবেদনা আসতে চায় না। তবুও নিজকে সচেতন করে ভাবলাম, রাজুরা যেন জাপানীদের মত হয়ে ওঠে। জাপানীরা কর্মস্থল বা অফিস থেকে ছুটি নিতেই চায় না, তাই তাদেরকে ছুটি নিতে বাধ্য করা হয়।
এরপর দুপুরে রাজু আমাকে ফোন করে কুঁকড়িয়ে বলে ‘স্যার, আমার ভীষণ ডিসেন্ট্রি, অফিসে আসতে পারিনি। আমি বললাম ঠিক আছে, আজ অফিসে আসতে হবে না, রেস্ট কর।’
পরদিন গুলশানস্থ জিমে এক্সারসাইজ করাকালীন রাজুর ফোন ‘স্যার, আমার ডিসেন্ট্রি বেড়ে গেছে, ওদিকে পাইল্স সমস্যা; আমার বাবা, চাচা ও বোনের পাইল্স ছিল। সবারই অপারেশন করাতে হয়েছে। আমারও হয়তো করাতে হবে’। বললাম, ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরামর্শ নাও। সে বলল ডাক্তারের কাছে যাবার মত অবস্থা নেই, প্রচন্ড ডিসেন্ট্রিতে একটু পরপরই টয়লেটে যেতে হচ্ছে, শরীর খুবই দুর্বল। পাইল্সের কারণে বারংবার টয়লেটে গিয়েই বেশি কষ্ট পাচ্ছি। আমার জন্য একটু বিশেষভাবে দোয়া করবেন।
খুবই নিবেদিত ও সরল ভাষায় আমার কাছে রাজুর দোয়া কামনায় একটু বিব্রত ও লজ্জিত হলাম। কারণ গতকাল সে আমাকে অসুস্থতার কথা জানালেও বিভিন্ন কাজের চাপে তার কথা মনে করে কোন উইশ করতে পারিনি।
আমাদের অফিসে নিয়মিত জামাতে নামাজ হয় এবং কারো কোন সমস্যা থাকলে তার ওপর মাগরিব নামাজান্তে সমবেত দোয়া হয়। বিশেষতঃ প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব সংক্ষিপ্ত জেকের ও দোয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ক্যাম্পাস’র এসিসট্যান্ট ডাইরেক্টর কামাল হোসেন কোরআনে হাফেজ; খুব সহি-শুদ্ধ করে সুমধুর স্বরে ও সুরে তেলাওয়াত করতে পারে। আমাদের ওয়াক্ত নামাজের ইমাম। তাই গুলশান থেকে অফিসে ফিরে কামালকে বললাম, আজ বাদ মাগরিব আমরা সবাই রাজুর জন্য দোয়া করবো। একথা শুনেই সে বলে উঠে স্যার, আমরাও এরূপ চিন্তা করে রেখেছি...। তারপর মাগরিবের নামাজান্তে আমি সবাইকে রাজুর ক্রিটিক্যাল অবস্থার কথা উপস্থাপন করে তার জন্য বিশেষ দোয়া করতে বললাম এবং দোয়া হল। পরদিন সকালে ফজরের নামাজান্তে আমি কয়েক সেকেন্ড রাজুকে মেডিটেশনের মেন্টাল স্ক্রীনে দেখার চেষ্টা করলাম এবং এরূপ একটি ছবি আঁকলাম রাজু হাসিখুশি, স্ত্রীকে সাথে নিয়ে কোন একটি শপিংমলে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে...। তবে তার সংকটজনক অবস্থার কথা জানা থাকায় ২/১ দিনের মধ্যে অফিসে তার উপস্থিতির বিষয়ে চিন্তা করিনি। এর ঘন্টা দু’য়েক পর অফিসে গিয়ে দেখি রাজু তার ডেস্ক ও কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সাথে সাথে স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম, পাশাপাশি রাজুকেও শুভেচ্ছা। কেউ রেডিও অন করে আগারগাঁও রেডিও স্টেশনের ট্রান্সমিশন শুনলে যেমনি স্টেশন সার্থকতা লাভ করে, তেমনি আমার শুভেচ্ছা রাজুর ব্রেন-ফ্রিকোয়েন্সিতে রিসিভ হওয়ায় নিজেকে ধন্য মনে করেছি।

কেস স্টাডি ॥ সাত
মধু আর কালিজিরার বিস্ময়কর গুণ আমি লক্ষ্য করেছি। পবিত্র কোরআনেও বলা হয়েছে এগুলো সকল রোগের শেফা বা মহৌষধ। তাই সকালে ও রাতে কালিজিরার তেলের সাথে মধু পেস্ট করে খাওয়া আমার অভ্যাস।
২০ জুন ’০৯ সকালে যথারীতি কালিজিরার তেলের সাথে মধু নিতে গিয়ে দেখি মধু প্রায় শেষ। মাথায় ঢুকল খাঁটি মধু দ্রুত যোগাড়ের কথা। অফিসে এসে আমার সহকারী রানাকে বললাম, খাঁটি মধু বিক্রেতাদের কাউকে খবর দিতে। উল্লেখ্য, আমরা কার কার থেকে মধু কিনে থাকি, রানা তা জানে। ঘন্টা দু’য়েক পর সহকারী পরিচালক (এডমিন ও প্রোটোকল) উম্মে সালমা রনি এসে একটি প্যাকেট আমার টেবিলে রেখে বলে আপনি যখন মিটিংয়ে ছিলেন তখন এক লোক এসে এ প্যাকেটটি দিয়ে গিয়েছে এবং বলেছে যে, লন্ডন থেকে ড. এম এ আজিজ এ প্যাকেটটি আপনার জন্য পাঠিয়েছেন। নির্মোহের আবেশে রনি’র সামনেই বলে ফেললাম আজিজ ভাইকে বলেছিলাম, এত কষ্ট করে এত দূর থেকে আর কখনো কিছু না পাঠানোর জন্য। কিন্তু তিনি আবারো পাঠালেন। সে মুহুর্তে আমি ভেবেছিলাম, বাচ্চাদের জন্য চকলেট বা অনুরূপ কিছু হয়তো পাঠিয়েছেন। তারপর হাতের কাজ ও ব্যস্ততা শেষ হলে প্যাকেট খুলে দেখি দু’কৌটা মধু, লেখা Pure honey. রানাকে বললাম, খাঁটি মধু আর কেনা লাগবে না।
ধন্যবাদ স্রষ্টাকে। ধন্যবাদ ব্রিটিশ-বাঙালি আজিজ ভাইকে, যিনি বিলেতি পরিবেশে থেকেও এখনো ভবের হাটের ভবঘুরের মত বাঙালি আতিথেয়তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছেন।

কেস স্টাডি ॥ আট
ডিআইইউতে এমবিএ ফাইনাল ইয়ারে অধ্যয়নরত মাহমুদ আল আইয়ুবী, দিনে ক্যাম্পাস অফিসে শিক্ষানবিশি কাজ করে এবং সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করে। ক্যাম্পাস অফিসের সবাই নামাজ পড়লেও সে পড়ে না, পড়তে চায় না। নামাজ পড়ার জন্য তাকে বোঝালে মুচকি হেসে বলে স্যার, কাল থেকে পড়ব। তার ‘কাল’ আর আজ হয় না।
একদিন সকালের দিকে আমার রুমে এসে বলে স্যার, আমার কিডনীতে স্টোন হয়েছে, ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। ডাক্তার বলেছে অপারেশন করাতে হবে; হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই, তাই কয়েকদিনের ছুটি প্রয়োজন। আমি বললাম তুমি প্রচুর পানি খাও, ইউরিনের সাথে স্টোন বের হয়ে যাবে এমনিতেই, অপারেশন করানো লাগবে না। আমার কথায় সে অবাক হয়ে আবারও বলে, ডাক্তারতো বলেছে অপারেশন করানো লাগবে, অপারেশন ছাড়া এত বড় পাথর কিডনী থেকে বের হবে কিভাবে? তাছাড়া আপনার কথামত এভাবে যদি পাথর বের হয়ও, তাহলেওতো আমি কষ্ট পাব। বললাম তুমি এভাবে চিন্তা করো যে, স্টোন ভেঙ্গে বা গলে গিয়ে ইউরিনের সাথে অথবা শরীরের যেকোন আউটলেট দিয়ে কষ্ট ছাড়াই বের হয়ে যাচ্ছে। যে স্টোন তৈরি হবার সময়ে তুমি টের পাওনি, সে স্টোন বের হবার সময়েও তুমি টের পাবে না। আমার কথায় সে কনফিউজড হয়ে তার ডেস্কে চলে যায়। আমিও তার পেছনে পেছনে গিয়ে এক বোতল পানি ও গ্লাস তার টেবিলে রেখে বলি তুমি এখন থেকে ওয়াটার থেরাপি করতে থাক; সৃষ্টিকর্তার রহমতে অপারেশন ছাড়াই পাথর বের হয়ে যাবে। অনবরত পানি পান করার পরামর্শ দিয়ে আমি নিজ রুমে ফিরে কয়েক সেকেন্ড মানসিক শক্তি প্রয়োগ করলাম এরূপভাবে মাহমুদ ঐ পানি খাচ্ছে এবং স্টোন গলে বা ভেঙ্গে শরীরের আউটলেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে...। এরপর যথারীতি নিজের কাজে ডুবে গেলাম।
ঘন্টা দু’য়েক পর আবার সে আমার রুমে এসে বলে স্যার, আমার মনে হয় ডাক্তারের কথা না শুনলে বিপদ হতে পারে। আপনি অনুগ্রহ করে ৩/৪ দিন ছুটি দিলে আমি হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই। তার চেহারায় বিষন্নতা এবং মুখে করুণ আর্তি দেখে তাকে আর ধরে রাখার সাহস করলাম না। তাই স্টোন বের হয়ে যাবার বিষয়টি আমি বুঝতে পেরেও অগত্যা তাকে ছুটি দেবার জন্য এডমিন অফিসার রনিকে ইন্টারকমে বলে দিলাম। মাহমুদ চলে গেল।
পরদিন দুপুরের দিকে সে খুশীতে এক্সাইটেড হয়ে কোন অনুমতি ছাড়াই আমার রুমে প্রবেশ করে এবং মুখে সালাম দিয়ে বলে স্যার, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আপনাকে পা ছুঁয়ে সালাম করব। তার গতকালের করুণ আর্তি আর আজকের হাসিখুশির তফাৎ দেখে কোন ব্যাখ্যার পূর্বেই আমি যা বোঝার তাই বুঝে নিয়ে বললাম তোমার স্টোন যে চলে গিয়েছে তা কি তুমি টের পেয়েছ? সে বলে খুব একটা বুঝতে পারিনি, তবে আজ ভোরের দিকে প্রস্রাবের সময়ে অনুরূপ কিছু একটা টের পাচ্ছিলাম এবং তখন থেকে পেটে ব্যথা হচ্ছে না, বরং হাল্কাবোধ করছি। গতকাল অফিস থেকে গিয়ে ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি হলাম। আজ দুপুরের পর অপারেশনের কথা। কিন্তু প্রি-অপারেটিভ চেক-আপে ডাক্তার আজ স্টোন দেখতে পাচ্ছে না বলে জানিয়েছে। তাই আজ অপারেশন না করে কাল করার তারিখ দিয়েছে। আপনার গতকালের দৃঢ় পরামর্শের কথা বুঝতে পেরে আপনার কাছে ছুটে এসেছি। একদিকে গতকাল আপনার কথা ডিঙিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বেয়াদবি করেছি, অন্যদিকে অপারেশনের কথা চিন্তা করে অনেক ভয়ও পেয়েছি, গাইবান্ধা থেকে আব্বা-আম্মা চলে এসেছেন। এখন ডাক্তার অপারেশন পিছিয়ে দিলে আমার আর কিছু বুঝতে বাকী রইলো না। সবাইকে বললাম কাল পর্যন্ত আমি কিছুতেই হাসপাতালে থাকবো না, বাসায় চলে যাব, তার আগে আমার স্যারের সাথে দেখা করতে যাব...।
এভাবে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে মাহমুদের একনাগাড়ে অনেক কথা। তাকে বললাম আমি তোমার সালাম পেয়েছি, কদমবুচি করা লাগবে না। পিতা-মাতা-শ্বশুর-শাশুড়ি বা অনুরূপ মুরুব্বী ছাড়া অন্যদেরকে কদমবুচি করতে হয় না। তাছাড়া মানুষের পায়ে সালাম করতে গিয়ে মাথা নিচু করা ঠিক নয়। এ মাথা অবনত করবে শুধু স্রষ্টার কাছে, মানুষের কাছে নয়। তুমি স্থির হও, বাসায় যাও, রেস্ট কর। সুস্থবোধ করলে কাল অফিসে আসতে পার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত হও, স্রষ্টাকে স্মরণ কর, মেডিটেশন কর, দেখবে তোমার সব সমস্যা প্রাকৃতিকভাবেই সমাধান হয়ে যাচ্ছে। আমার এসব কথা শুনে সহজ-সরল মাহমুদ তার ইচ্ছার ব্যত্যয় না ঘটিয়ে “তবুও আজকের জন্য পায়ে সালাম করতে চাই” বলে যা করার তাই করে খুশিতে আটখানা হয়ে চলে গেল।
ভাবলাম আমাদের ছোটবেলাকার ধর্মশিক্ষা, প্রাইমারী শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন দীক্ষার কথা; আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির কথা। এসব শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতি আমাদেরকে যতটা না বিজ্ঞানমনস্ক করেছে, তার চেয়ে ঢের বেশি করেছে অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। যদি উচ্ছল-টগবগে যুবক ও এমবিএ’র স্টুডেন্ট মাহমুদেরই অবস্থা এমন হয়, তাহলে আরো কম পড়–য়া বা না পড়–য়াদের অথবা গ্রামের কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের কি অবস্থা হতে পারে! এসব ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতি যে কবে পাল্টাবে, তা ভেবে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম, মনের গহীনে ব্যথা অনুভব করলাম আমার সে আতঙ্ক-অনুভূতি মাহমুদের মেডিক্যাল-অপারেশন আতঙ্কের চেয়ে কম নয়। আমার মনের সে ব্যথা তার পাথর-ব্যথার চেয়েও অধিক অনুভব করতে করতে এক সময়ে সম্বিত ফিরলে বিনা অস্ত্রোপচারে মাহমুদের নিরাময়ের জন্য স্রষ্টার নিকট কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টি জানালাম।
হে দয়াময়, আমাদেরকে বোঝার সামর্থ্য দাও যে তুমি আমাদের অফুরন্ত মানসিক ও শারীরিক শক্তি দিয়ে রেখেছ, যে শক্তি না থাকলে শুধু ঔষধ সেবনে আমাদের রোগ-ব্যাধি কখনই ভাল হতো না। অসুস্থতা কাটাতে ঔষধ সহযোগিতা করে মাত্র। আমাদের শরীরে কাটা-ছেঁড়া হলে কোন ঔষধ ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে এমনই জোড়া লেগে যায় যে, অনেকক্ষেত্রে ঐ কাটা-ছেঁড়ার চিহ্নও দেখা যায় না পরবর্তীতে। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে এভাবে কাটা-ছেঁড়া ভাল করে দেয় কে! কিভাবে ঔষধ ছাড়াই কাটা-ছেঁড়াসহ নানা অসুখ যেমন- পেটের পীড়া, জ্বর-সর্দি-মাথাব্যথা ভাল হয়ে যায়! সে কেউ না, আমাদের শরীর নিজেই এ দায়িত্ব পালন করে। শরীরে অন্তর্নিহিত বিশেষ ক্ষমতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ দায়িত্ব পালন করে, যাকে আমরা অন্য কথায় বলি- ‘স্রষ্টা ভাল করে দেন’। প্রকৃতপক্ষে মানুষ সৃষ্টিকালীনই স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির সেরা জীবের দেহতন্ত্র ও দেহতত্ত্ব এমনভাবে সুবিন্যস্ত করেছেন যে, অসুখ-বিসুখ ও প্রতিকূলতার সাথে অহর্নিশ সংগ্রামে শরীরই স্বয়ংক্রিয় দিগিজয়ী যোদ্ধা।
আসলে শারীরিক প্রক্রিয়া বা ফিজিক্যাল সিস্টেম পারমিট না করলে ঔষধ বা সার্জারী কোন অসুখ ভাল করতে সক্ষম নয়। আমাদের শরীরে এমন সব রাসায়নিক উপাদান ও বিষয় রয়েছে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুস্থতার উৎস বা আধার হিসেবে কাজ করে। শরীরে এসব উপাদান প্রাকৃতিকভাবে না থাকলে এত্তসব ক্রিটিক্যাল জংশন, গ্রন্থি, নাড়িভূড়ি, শিরা-উপশিরা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমাহারে তথা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট শরীর এক মুহূর্তও ঠিক রাখা ঔষধ বা ডাক্তার দ্বারা সম্ভব হতো না।
এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, আমরা অলৌকিকভাবে বা এক্সিডেন্টালী বেঁচে আছি। দেহযন্ত্র এরূপ ক্রিটিক্যাল না হলে মানুষ হয়তো মৃত্যুর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে জয়ী হতো। আসলে আমরা বেঁচে আছি প্রাকৃতিক শক্তিবলে বা natural power -এ। তাই natural power বা natural justice কে যারা অস্বীকার করতে চায়, তারা মস্তবড় আহাম্মক ছাড়া আর কিছুই নয়।
সেই প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত ধর্মগুরু, সত্যের প্রচারক, দিগি¦জয়ী বা নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ তাঁদের চিন্তা ও গবেষণার শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে প্রকৃতির শক্তির কাছেই নতিস্বীকার করেছেন এবং প্রকৃতিকেই এ বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল শক্তির চূড়ান্ত (ultimate) আধার বা উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সর্বাধিক বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম হিসেবে গবেষকদের স্বীকৃত ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কোন পুঁথি-পুস্তক বা শিক্ষালয়ে না পড়ে এবং জাগতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাগারে গবেষণা না করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে হেরা পর্বতের গুহায় সুদীর্ঘ ১৩ বছর ধ্যানের মাধ্যমে প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে তথা প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে অবশেষে আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক শক্তিতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। প্রকৃতি-সৃষ্টি ও স্রষ্টা নিয়ে সুদীর্ঘ ও সুগভীর চিন্তা ও গবেষণার এক পর্যায়ে তিনি লাভ করেন ঐশীবাণী ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে...’।
এভাবে সব ধর্ম-নেতাই প্রাকৃতিক শক্তি ও স্রষ্টার পূজারী হয়ে সে শক্তির জয়গান করে গেছেন মানুষের কাছে। তাই আমাদেরও উচিত ধ্যান বা মেডিটেশন-চর্চায় মস্তিস্কে ভাল চিন্তা ইনপুটের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ঘটানো এবং প্রাকৃতিক শক্তির সাথে নিজকে সংযোগ বা ধষরমহ করার মাধ্যমে মানবতা ও সৃষ্টির সেবায় নিবেদিত হওয়া।
তাছাড়া দৈনন্দিন কর্মের সাফল্য অর্জনেও সৃষ্টিশক্তির আশীর্বাদ অপরিহার্য। বিশেষতঃ সৃজনশীল কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক শক্তির সাথে ধষরমহবসবহঃ ছাড়া সফল হওয়া কোনক্রমেই যে সম্ভব নয়, তা আর ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। সর্বোপরি, মেডিটেশন বা ধ্যান করলে দৈনন্দিন বিভিন্ন সাফল্যের পাশাপাশি মনোজগতে আসবে অপার আনন্দ, প্রশান্তিময় হবে জীবন ও জগৎ। সত্য-ন্যায় ও সুন্দরের সে জগতে সবাইকে স্বাগত।

লেখকঃ
এম হেলাল
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক
ফোনঃ ৯৫৫০০৫৫, ৯৫৬০২২৫
web: www.helal.net.bd
e-mail: m7helal@yahoo.com