এপিথেরাপি বা মৌ-চিকিৎসা
চিকিৎসা ক্ষেত্রে মৌমাছি এবং মৌচাক থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ভেষজ উপাদান ব্যবহারের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। পবিত্র কোরআন শরীফে বলা হয়েছে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য জ্ঞানের নিদর্শন রয়েছে মধু ও মৌমাছির মধ্যে। বাইবেলে মৌমাছি ও মধু সম্পর্কে ৬০ বার উল্লেখ রয়েছে। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে মৌমাছিকে দেবতার সহচর বলা হয়েছে এবং দেবতা বিষ্ণুকে পদ্মফুলের ওপর বসা একটি ছোট মৌমাছি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মৌমাছি ও মৌচাক ব্যবহারের একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা পদ্ধতি বর্তমানে চালু হয়েছে, যা এপিথেরাপি নামে পরিচিত। অর্থাৎ এপিথেরাপি হলো মৌ-চিকিৎসা তথা মৌমাছি দিয়ে অসুস্থতা দূরীকরণ পদ্ধতি।
Apitherapy simply depends on the use of bee products to prevent, heal or recover somebody from one or more diseases. it is also the art & science of treatment and holistic healing through the honey bee & her products for the benefit of mankind and all the animal kingdom.
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে এপিথেরাপি চিকিৎসা চালু হয়েছে এবং এ সম্পর্কে গবেষণাও চলছে। এপিথেরাপির ইতিবাচক কার্যকারিতার কারণে এর প্রসার দিনদিন বাড়ছে এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যৌক্তিকভাবে উন্মোচিত হচ্ছে। বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় যে বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে, তার নিরাময়ের ক্ষেত্রে এপিথেরাপি একটি উৎকৃষ্ট চিকিৎসা হতে পারে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন। এপিথেরাপির মাধ্যমে মানব শরীরের ৫০০ রকমের রোগ-ব্যাধি থেকে নিরাময় সম্ভব।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এপিথেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি। কারণ এর মাধ্যমে স্বল্প খরচে অনেক জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে এই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তন করাও সহজ।
এপিথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতিতে মৌমাছির যেসব উপাদান ব্যবহৃত হয়, তা নিম্নরূপ।
১। মধুঃ রোগ প্রতিরোধের সকল উপাদান বিদ্যমান মধুতে। প্রতিফোঁটা মধুতে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ফসফেট, কপার, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন (এ, বি ১, বি ২, বি ৩, সি, ডি) ছাড়াও গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ বিদ্যমান।
সর্দি-কাশি, টাইফয়েড, জ্বর, নিউমোনিয়া, অম্ল, কোষ্ঠকাঠিন্য ও আমাশয়ে মধু উপকারী। মধুতে রয়েছে ত্বক ও চুলের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, ময়শ্চারাইজিং ও এন্টিবায়োটিক গুণাবলী যার কারণে সৌন্দর্য চর্চায়ও মধু ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক ও দার্শনিক ইবনে সিনা তাঁর ‘কানোন’ গ্রন্থে মধু দিয়ে অসংখ্য রোগের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন।
২। বী ভেনম বা মৌমাছির হুলের বিষঃ মৌমাছির হুলের বিষে বিভিন্ন ধরনের উপকারী এনজাইম, পেপটাইড্স, বায়োজেনিক এমাইডসহ ১৮ ধরনের উপাদান রয়েছে; যা মানবদেহের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। মানুষের হাঁটু ও বিভিন্ন জয়েন্টে আর্থ্রাইটিস ব্যথা, ক্যান্সার, টিউমার এবং ত্বকের দীর্ঘমেয়াদি রোগ নিরাময়ে এই বিষ সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে এ সকল রোগের চিকিৎসায় মৌমাছির হুলের বিষ সাফল্যজনকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সেখানে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ও অনুমোদিত।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনও এ চিকিৎসা শুরু হয়নি। তবে অভিজ্ঞ মৌচাষীগণ হাঁটুতে ব্যথা নিরাময়ে হুলের বিষ ব্যবহার করছেন। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে বিকীপার্স কোঅপারেটিভ্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও বিআইএ’র অভিজ্ঞ মৌচাষী নুরুল হক মাস্টার তার গ্রামের লোকজনের হাঁটুর ব্যথা নিরাময়ে জীবন্ত মৌমাছির হুল প্রয়োগ করেন। এতে অধিকাংশেরই হাঁটুর ব্যথা নিরাময় হচ্ছে।
৩। রয়েল জেলীঃ এটি রানী মৌমাছির নিয়মিত খাবার। রয়েল জেলী এতই পুষ্টিসমৃদ্ধ যে, মৌমাছির একটি সাধারণ ডিমে নার্স বী কর্তৃক তা নিয়মিত প্রয়োগের ফলে উক্ত ডিম থেকে একটি সাধারণ মৌমাছি না হয়ে রানী মৌমাছিতে পরিণত হয় বা জন্মলাভ করে। জন্মের ২৫-৩০ দিন পর থেকেই সে রানী মৌমাছি প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৫০০০টি ডিম পাড়ে।
মানবদেহের বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধি নিরাময়ে এবং পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে রয়েল জেলী ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শারীরিক দুর্বলতা, দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি রোধে; প্রজনন অক্ষমতা (ফার্টিলিটি) বৃদ্ধিকল্পে; ত্বক-চুল ও নখের রোগ নিরাময়ে; সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে; এজমা ও হরমোন নিয়ন্ত্রণে; কোলেস্টেরল, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হতাশা দূরীকরণে; লিভার ফাংশন নিয়ন্ত্রণে রয়েল জেলী প্রাচীন যুগ থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
৪। পোলেনঃ শ্রমিক মৌমাছি কর্তৃক সংগৃহীত পরাগরেণুর সমষ্টিকে পোলেন বলে। এটি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। পৃথকভাবে বা মধুর সঙ্গে মিশ্রিত করে বী-ব্রেড তৈরি করা হয়, যা ক্যান্সার ও এজমা রোগ চিকিৎসায় এবং কসমেটিক্স তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পোলেনকে বি কমপ্লেক্স সমৃদ্ধ মাল্টি ভিটামিন ও মাল্টি মিনারেল সাপ্লিমেন্ট বলা যায়। এলার্জিজাতীয় রোগের প্রতিষেধক টিকা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়।
৫। প্রপলিসঃ শ্রমিক মৌমাছি বিভিন্ন ফুলের কুঁড়ি, কচি ডাল ও গাছের আঠালো কষ থেকে প্রপলিস বা মৌআঠা সংগ্রহ করে তা মৌচাকের আশেপাশে সঞ্চয় করে রাখে। এর দ্বারা মৌমাছি মূলত চাকের ফাটল জোড়া লাগায়, মৌচাককে স্থায়ীভাবে কোনো কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখে এবং বায়ু চলাচল ও রোগজীবাণু থেকে কলোনী রক্ষা করে। এটি টারপিন, ভলাটাইল অয়েল, বালসাম ও মোমের সমন্বয়ে গঠিত বলে এর রোগজীবাণু বিধ্বংসী ক্ষমতা অনেক। সাধারণত ঠান্ডা, গলা ব্যথা, চর্ম ও দন্তরোগ, আগুনে পোড়া ঘা শুকাতে, এজমা ও পাকস্থলীর হজমশক্তি বৃদ্ধিতে প্রপলিস ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও এটি ছত্রাকনাশক ও জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৬। মোমঃ শ্রমিক মৌমাছির বিশেষ গ্রন্থির সাহায্যে মধু থেকে মোম তৈরি হয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদার্থ হওয়ার কারণে যেকোনো প্রসাধন সামগ্রী উৎপাদনে মোম ঔষধ ধারক ও বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৭। এপিনার্লিনঃ মৌমাছির ডিমের এক্সট্রেনাক্টকে এপিনার্লিন বলে। বর্তমানে এটি নিয়ে গবেষণা চলছে। আশা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে মৌমাছির বিভিন্ন উপাদানের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে এইড্স নিরাময়ের গুরুত্বপূর্ণ পথ্য আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।