ক্যাম্পাস পরিচালিত রেইকি সেমিনারে রেইকি মাস্টার ডাঃ ফজলুর রহমান বলেন

রেইকিতে মনের নেগেটিভ উপসর্গ দূর হয় বলে রোগ সেরে যায়

প্রাকৃতিক চর্চা ও চিকিৎসার অন্যতম প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাস সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (সিএসডিসি)। সুস্থ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত জাতি গড়ে তোলার প্রয়াসে ক্যাম্পাস নিয়মিত পরিচালনা করে চলেছে স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক নানা কর্মসূচি; আয়োজন করছে ওয়ার্কশপ ও সেমিনার। সে ধারাবাহিকতায় ৭ মে ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হল প্রাকৃতিক চিকিৎসার অন্যতম পদ্ধতি রেইকি বা স্পর্শ চিকিৎসা বিষয়ক সেমিনার। উক্ত সেমিনারে রেইকি বিষয়ে মূল বক্তব্য রাখেন রেইকি মাস্টার ডাঃ ফজলুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক এবং সিএসডিসি’র মহাসচিব এম হেলালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট মেডিটেটর এন্ড হিলার এম আনোয়ারুল হক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফ্যামিলি লাভ মুভমেন্টের চেয়ারপারসন তাজকেরা খায়ের, কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলার উপদেষ্টা মোহাম্মদ মোস্তফা প্রমুখ।

ডাঃ ফজলুর রহমান
রেইকি বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফজলুর রহমান বলেন, বিকল্প চিকিৎসা এখন সারা বিশ্বে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ইউনানি, হোমিও, হারবাল, আয়ুর্বেদ, হেকেমী প্রভৃতি প্রাকৃতিক চিকিৎসার দিকে পশ্চিমা বিশ্ব ঝুঁকে পড়ছে। এলোপ্যাথিতে গবেষণার জন্য গিনিপিগ, খরগোস, ইঁদুর প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। এগুলোর সাথে মানুষের কিছু মিল থাকলেও সম্পূর্ণ মিল নেই। মানুষের সাথে এসব প্রাণীর যেখানে মিল আছে সে ব্যাপারে ঔষধে কাজ হয়; যে বিষয়ে মিল নেই সে ঔষধ মানুষের ওপর কার্যকর হয় না। ফলে গবেষণা অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং এলোপ্যাথিতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এলোপ্যাথিক ঔষধের পার্শ¦ প্রতিক্রিয়ার জন্য বর্তমানে এটি বর্জনের সোচ্চার আন্দোলন হচ্ছে। আর তাই আজ মেডিটেশন, ইয়োগা আকুপ্রেশার, রিফ্লেক্সোলজি, রেইকি এসব প্রাকৃতিক থেরাপি বা চর্চাকে লুফে নিচ্ছে বিশ্ব।
রেইকি জাপানী শব্দ। ‘রেই’ শব্দের অর্থ বিশ্বব্রহ্মান্ড, ‘কি’ অর্থ জীবনীশক্তি তথা মহাজাগতিক শক্তি। এই পৃথিবীতে সুস্থ সবল দেহে বেঁচে থাকতে যে জীবনীশক্তি আমরা প্রতিনিয়ত বিনামূল্যে পাচ্ছি, তা আসছে প্রকৃতির তিনটি উৎস থেকে সূর্যরশ্মি, বায়ু ও মাটি। এ তিনটির মধ্যে প্রধান হল সূর্যরশ্মি। সূর্যের সেই তাপ শক্তিকে মানব দেহের অসুস্থ অঙ্গে প্রবেশ করিয়ে সুস্থ করে তোলার প্রক্রিয়া হচ্ছে রেইকি।
রেইকি চিকিৎসার প্রবর্তন সম্পর্কে ডাঃ রহমান বলেন জাপানের ফওকা শহরে খ্রীষ্টান মিশনারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন ড. মিকাও উসুই। একদিন দু’জন ছাত্র তাঁকে প্রশ্ন করল আপনিতো বাইবেল পড়েন, সেখানে যা আছে, তা কি বিশ্বাস করেন? তিনি জবাব দিলেন, অবশ্যই! ছাত্ররা বলল বাইবেলে আছে, যীশুখ্রীষ্ট একজন অন্ধকে হাত বুলিয়ে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কুষ্ঠরোগীকে হাত বুলিয়ে নিরাময় করে দিয়েছিলেন; আপনি কি এটি বিশ্বাস করেন? ড. মিকাও জবাব দিলেন, অবশ্যই করি! আমি যীশুর একজন ভক্ত। ছাত্ররা আবার জিজ্ঞাসা করল যীশুর সে ঘটনার পর থেকে আপনি কি অনুরূপ কোন ঘটনা দেখেছেন? তিনি চুপ করে গেলেন। আবার প্রশ্ন আপনি নিজে এ ধরনের নিরাময় করেছেন? তিনি নীরব। ছাত্ররা বলল যীশুখ্রীষ্ট রোগ নিরাময় করেছেন, আপনি তাঁর ভক্ত; আমরা আপনার ছাত্র, যেখানে আপনি আমাদের শেখাবেন সেখানে আপনি নিজেইতো জানেন না। মিকাও ভাবনায় পড়ে গেলেন; বললেন আমি খুব দুঃখিত, আমি কিছু জানি না; তবে চেষ্টা করে দেখব। পরদিন তিনি পদত্যাগ করলেন এবং আমেরিকা চলে গেলেন।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল লাইব্রেরীতে খ্রীষ্টান ধর্ম ও যীশুখ্রীষ্টের ওপর পড়াশোনা শুরু করলেন ড. মিকাও, গবেষণা করলেন। তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়া হল, তিনি তা নিলেন না; কারণ তিনি যা খুঁজছেন, তা তখনও পাননি। এলাকার পাদ্রীদের সাথে, খ্রীষ্টান নাগরিকদের সাথে আলাপ করলেন, কিন্তু জিজ্ঞাসার জবাব মিলল না। আবার জাপানে ফিরে আসলেন; বৌদ্ধ-পন্ডিতদের সাথে আলাপ করলেন; লাভ হল না। গেলেন চীনে, চীনা ভাষা শিখলেন। চীন অনেক প্রাচীন সভ্যতার দেশ, কিন্তু এখানেও কিছু পেলেন না। নতুন আশায় বুক বেঁধে গেলেন তিব্বত, পেলেন না কিছুই। আবার জাপানে এলেন। এরপর গেলেন ভারত। উত্তর ভারতে এসে পেলেন ৩-৪ হাজার বছরের পুরোনো বই, সংস্কৃতি ভাষায় লেখা। তিনি সংস্কৃতি ভাষা শিখলেন এবং সূত্র বা ফর্মূলা পেয়ে ফিরে এলেন জাপানে। কিন্তু শক্তি যে কিভাবে হাতে আসবে তা সেখানে লেখা নেই। তিনি হতাশ হলেন। বন্ধুরা বলল ধ্যান ছাড়াতো জ্ঞান অর্জন করা যায় না, তোমাকে ধ্যানে বসতে হবে। ঠিক করলেন ধ্যানে বসবেন। শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ে চলে গেলেন। ২১টি পাথর নিয়ে ২১টি প্রোগ্রাম করে বসলেন ধ্যানে। একটি দিন যায়, তিনি একটি পাথর সরিয়ে রাখেন। এভাবে চলতে থাকল। ২০ দিনের দিনও কোন আশার আলো দেখতে পেলেন না।
২১ দিন পর তিনি ধ্যান ভঙ্গ করলেন; মনে হল কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে, তিনি কিছু একটা পেয়েছেন। চোখ খুলে দেখলেন বড় উজ্জল আলো তার দিকে এগিয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করলেন। আবার চোখ খুললেন, দেখলেন সে আলো আরও বড় হচ্ছে। কিছুটা ভয়ও পেলেন; ভাবলেন, উঠে চলে যাবেন কিনা। পরমুহুর্তে ভাবলেন মৃত্যু নিশ্চিত জেনে এখানে এসেছি, তাহলে ভয় কিসের। হয়তো এর ভেতরে মহৎ কিছু আছে।
কপালের যে জায়গাটা সেজদাতে দেয়া হয়, সেই স্থানটাতেই আঘাত করলো জ্যোতি। তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরলে অনুভব করলেন, দেহে ক্ষুধা আর ক্লান্তি। তিনি উঠে দাড়িয়ে দেহ-মনে শক্তি অনুভব করলেন, ব্যথা-বেদনা সব যেন দূর হয়ে গেল। পাহাড় থেকে নামার সময় পা কেটে রক্তপাত হচ্ছিল। ক্ষতস্থানে হাত চলে গেল, সাথে সাথে রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেল।
পাহাড় থেকে নেমে এসে বললেন আমাকে ভাল খাবার দাও। লোকেরা তাকে সাধু-সন্ন্যাসী মনে করলো। একটি মেয়ে তার জন্য খাবার নিয়ে এল। তার ছিল দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা, মাড়ি ফুলে গেছে। তিনি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, ৫ মিনিটের মধ্যেই ব্যথা সেরে গেল। মেয়েটির মালিক এ ঘটনা শুনে ছুটে গেলে মিকাও’র কাছে। ড. মিকাও বুঝতে পারলেন যে, অবশেষে তিনি কিছু অর্জন করতে পেরেছেন। এভাবেই শুরু হল রেইকি চিকিৎসার পুনঃপ্রচলন।
রেইকি কিভাবে কাজ করে, তার ব্যাখ্যায় ডাঃ ফজলুর রহমান বলেন রোগের লক্ষণ সাধারণত শরীরে থাকলেও তার মূল উৎস কিন্তু মনে। রেইকি মনের নেগেটিভ উপসর্গ দূর করে। ফলে রোগ সেরে যায়।
রেইকির প্রধান সূত্র হল কুচিন্তা ত্যাগ করে নিরন্তর শুভচিন্তা নিয়ে জীবন যাপন। দীর্ঘদিনের নেগেটিভ চিন্তা আমাদের শরীরে এনার্জি গ্রহণের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়। নেগেটিভ চিন্তার বদলে পজিটিভ এনার্জির প্রতিনিয়ত ব্যবহারই খুলে দিতে পারে শরীরে কসমিক এনার্জি গ্রহণের সবক’টি দ্বার। রেইকি পজিটিভ এনার্জি বলে মনের ওপর এর প্রভাব অপরিসীম। এতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। সে সবকিছু পজিটিভ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। রেইকি চিকিৎসায় শেখানো হয়
১। আজকের জন্য আমি এই নিখিল বিশ্বের কাছ থেকে যা পেয়েছি, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকব;
২। আজকের জন্য আমি কোন দুঃশ্চিন্তা করব না;
৩। আজকের জন্য আমি মোটেই রাগ করব না;
৪। আজকের জন্য আমি প্রতিটি কাজ সৎভাবে করব;
৫। আজকের জন্য আমি প্রতিটি প্রাণীর প্রতি ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করব।
রেইকি থেরাপীতে রয়েছে ৩টি ধাপ। ১ম ধাপের চিকিৎসায় রোগ যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফিরে যাবে। এরপর ২য় ও ৩য় ধাপ বা ডিগ্রির চিকিৎসা নিতে হয়। সাধারণ সর্দি-কাশি থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত এমন কোন রোগ নেই, যা রেইকিতে ভাল হয় না। রেইকি করার ফলে মন থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা দূর হয়। চিন্তায় যে রিএকটিভ ইলিমেন্টসগুলো প্রবেশ করেছিল, সেগুলো বের হয়ে যায়। আসলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ছাড়া মহৎ কিছু সম্ভব নয়। কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় রেইকি হতে পারে ফার্স্ট এইড। সাধারণ অসুখের ক্ষেত্রে ৩ দিনের রেইকি চিকিৎসা যথেষ্ট। কঠিন রোগে চিকিৎসা করতে হয় ২১ দিন।
একজন রেইকি মাস্টার নিজের শরীরে কসমিক এনার্জি এবজর্ব করেন তার শরীরের বিভিন্ন এন্ডোক্রিন গ্রন্থির মাধ্যমে। এই এনার্জি হাতের মাধ্যমে বাহিত হয় অন্যের শরীরে বা বস্তুতে। রেইকি এনার্জি আপন গতিতে চলে। হয়তো শরীরের যে সমস্যার জন্য রেইকি করা হচ্ছে, তারচে’ বড় সমস্যা ঐ শরীরে আছে। তখন কসমিক এনার্জি বড় সমস্যার স্থানেই চলে যাবে। আগে সেটার সমাধান করে তারপর অন্য সমস্যার সমাধান করবে। এ কারণে রেইকিকে বলা হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি।

এম আনোয়ারুল হক
প্রাকৃতিক চিকিৎসার আরেক পদ্ধতি রিফ্লেক্সোলজির একনিষ্ঠ গবেষক এম আনোয়ারুল হক বলেন, যেকোন সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য রেইকি চিকিৎসার উপযোগিতা এবং কার্যকারিতা অতুলনীয়। মানসিক অবস্থা, ডিপ্রেশন, হাইপ্রেসার, টেনশন, ভয়-ভীতি, যাদু টোনা যেকোন সমস্যা থেকে উত্তরণের উত্তম চিকিৎসা রেইকি। এটি একটি unexplained পদ্ধতি, যার যোগ রয়েছে জীবনের সঙ্গে। মানব কল্যাণের জন্য স্রষ্টা যুগে যুগে কিছু মানুষ পাঠান, যারা সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত থেকে স্রষ্টার যোগ্য প্রতিনিধির মর্যাদা রক্ষা করেন। ডাঃ ফজলুর রহমান তেমনই একজন, যিনি একনিষ্ঠ সাধনা বলে এ পদ্ধতিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন।

ড. এম হেলাল
সভাপতির ভাষণে এম হেলাল বলেন সব কিছু আমার, এ মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। অন্যের কল্যাণের জন্য ভাবলে নিজের সব কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়ে যাবে। আমাদের আত্মাকে শুদ্ধ করতে হবে, আত্মশুদ্ধির পথ অবলম্বন করতে হবে। রেইকি সে আত্মশুদ্ধির পথেই আমাদেরকে নিয়ে যায়, আত্মশুদ্ধিই রেইকির মূল কথা। আমাদের আনন্দ অন্যকে দেয়ার মাঝে, নেয়ার মাঝে নয়। ২০২০ সালের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনে আমাদেরকে সফল হতে হবে এটিই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। তিনি ছাত্র তরুণদেরকে আত্মোন্নয়নের পথে দৃঢ়চিত্তে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসার আহবান জানান।