আমার গ্রামের বাড়ী বরিশাল জেলার বানারীপাড়া থানার মহিষাপোতা গ্রামে। ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে আমার চাচাতো ভাইয়ের সাথে ঢাকায় আসি। তিনি নীলক্ষেতে রিপন সাহেবের ফোন-ফ্যাক্স-ফটোকপির দোকানে চাকরি করতেন। চাচাতো ভাইকে বললাম, আমার যে কোন ধরনের একটা চাকরি খুব প্রয়োজন। রিপন সাহেবের কাছে চাচাত ভাই আমার কথা বললেন।
তারপর রিপন সাহেবের কথামতো একদিন চাচাতো ভাই আমাকে ক্যাম্পাস পত্রিকা অফিসে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পর পত্রিকার সম্পাদক এম হেলাল স্যার আমাকে বললেন, তুমি কি বাংলা-ইংরেজী পড়তে পার? বললাম- জ্বি-স্যার, পারি। স্যার বললেন, এই বাংলা পেপারটা পড়তো? আমি যখন পড়া শুরু করলাম তখন আমার মুখে কথা আটকে যাচ্ছিল। কারণ সে সময়ে আমার এরূপ তোতলামি ছিল।
স্যার বললেন, তুমি প্রতিদিন উচ্চস্বরে পত্রিকা পড়বে সংবাদ পাঠকদের মত করে, তাহলে তোমার মুখে কথা আর আটকাবে না। আরও বললেন, তুমি কি নামাজ পড়? এখানে চাকরি করতে হলে ধর্মকর্ম করতে হবে এবং সত্য কথা বলতে হবে।
এরপর ২০০০ সালের ১৪ জুলাই ক্যাম্পাস-এ শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করা শুরু করলাম, বেতন ১,৫০০ টাকা। এদিকে বাড়িতে আমার সংসারে অভাব অনটন। ছোট ভাই ক্লাস নাইনে পড়ে, তার পড়া-লেখা চালাতে হবে। পরিবারে মা-বাবা ও ২ ভাই আছে। এসব চিন্তা মাথায় রেখে উদ্যম নিয়ে কাজ শুরু করলাম। আমার কোন আবেদন-নিবেদন ছাড়াই ৬ মাসের মধ্যে স্যার নিজেই বেতন উন্নীত করলেন ৩,০০০ টাকায়।
মডার্ণ ম্যানসনে আমাদের তখনকার অফিসে দুপুরে রান্নার ব্যবস্থা ছিল। আমি সকালে অফিসে আসার আগে বাজার করতাম, রান্না করতাম; অফিস স্টাফরা সবাই আমার রান্না করা খাবার খেত। স্যার সারাদিন বাইরের কাজ সেরে দুপুরের পর বা সন্ধ্যার পূর্বে অফিসে আসতেন। তারপর আমার রান্না করা খাবার খেতেন। তিনি হয়তো বুঝলেন যে, আমার অর্থ-সাশ্রয় দরকার। তাই আমাকে বললেন- দুপুরে সবাই খাওয়ার পর যা থাকবে, তুমি তা রাতে খেয়ে যেতে পার। আমি রাতে খেতাম এবং তারপর আরও বেশি ভাত থাকলে পরদিন সকালে ১ টাকার আলু কিনে ভর্তা করে খেতাম। এ সুযোগে সকালের নাস্তাটাও নিখরচায় হয়ে যেত। এভাবে কাজ করে চললাম।
এদিকে আমার চাচাতো ভাই যেখানে থাকতেন, সেখানে মুদির দোকানে ৭০০ টাকা বাকি রেখে বাড়ি চলে গেলেন। দোকানদার আমাকে ধরলো চাচাতো ভাইয়ের বাকী খাওয়া টাকা পরিশোধের জন্য। আমার বাসা ছিল তখন আজিমপুরে। আমি মতিঝিলে নতুন বাসা নিয়েছি। দোকানদার বলল, টাকা না দিয়ে বাসা ছাড়া যাবে না। আমি বললাম- ভাই, ক্যাম্পাস পত্রিকা থেকে বেতন পেলে আপনার টাকা দিয়ে যাব। দোকানদার বিশ্বাস করল। আমি বেতন পেয়েই আজিমপুরে গেলাম দোকানদারকে টাকা দিতে। দোকানদারতো অবাক। আমাকে বলল- আমি অনেক লোক দেখেছি, আপনার মতো একজনকেও পাইনি। অন্যরা বাকি রেখে এখান থেকে চলে গেলে আর আসে না। অথচ আপনি অন্যের বাকী করা টাকা পরিশোধ করতে এসেছেন!
এরূপ সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা আমি ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক হেলাল স্যারের কাছ থেকে শিখেছি। স্যার বলতেন- কোনদিন মিথ্যা কথা বলবে না, অন্যের হক খাবেনা, কাউকে ঠকাবে না, অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল হবে, সৎ পথে চলবে, তাহলে তুমি সুখে থাকবে।
ক্যাম্পাস অফিস তখন ছিল ৫৩, মডার্ণ ম্যানসনের ১৫ তলায় অর্থাৎ ঐ ভবনের ছাদে। রোজার সময় স্যারসহ আমরা সবাই একত্রে সেই ছাদে বসে ইফতার করতাম। বিভিন্ন স্থানে বড়লোকি ও পাঁচতারকা হোটেলে ইফতারের দাওয়াত থাকা সত্বেও স্যার আমাদের ছেড়ে সেগুলোয় যেতেন না। প্রতিদিন যে রেস্টুরেন্ট থেকে ইফতারি আনতাম, একদিন সে নির্ধারিত দোকান থেকে আনা হয়নি। হয়ত স্যার তা বুঝে ফেলেছিলেন, তাই ইফতারির সময় জিজ্ঞেস করলেন- এই ইফতারি কোথা থেকে এনেছো, আমি সত্যি কথা না বলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উত্তর দিলাম। তাতে আমার নগদ ২০০ টাকা জরিমানা হলো। স্যার বললেন, জরিমানা না করলে বা কোন শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে তুমি শিক্ষা গ্রহণ করবে না। জরিমানা হওয়াতে আমি মন খারাপ করিনি, কিন্তু পরের মাসেই তিনি ৫০০ টাকা বেতন বাড়িয়ে দিলেন।
আমি প্রতিদিন স্যারকে অফিস শেষে বাসায় দিয়ে আসতাম। একদিন আমার কি যেন একটা কাজে মারাত্মক ভুল হলো। বাসায় যাবার পথে স্যার রিকসায় উঠতে উঠতে আমাকে বললেন- রানা, তুমি কি আজ ফজরের নামাজ পড়েছো? আমি বললাম- না স্যার, নামাজ পড়িনি। স্যার বললেন- তোমাকে রিকসা থেকে নামিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে, কারণ তোমার সাথে কথা ছিল, অন্ততঃ কাজা হলেও নামাজ না পড়ে দিনের কাজ ধরবে না। আজ তুমি নামাজ পড়ে অফিসে আসলে তোমার কাজে এরূপ ভুল হতো না।
চাকরির শুরুতে প্রতিদিন একই প্যান্ট পরে অফিস করতাম। টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় কাপড় কিনতে পারতাম না। এমনই এক সন্ধ্যায় স্যারকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময়ে স্যার আমাকে ৫০ টাকা দিয়ে বললেন- এই নাও, গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাসায় যাও। সে সময়ে আমার বাসায় যাওয়ার ভাড়া লাগত ৪/৫ টাকা, অনেক সময়ে হেঁটেও চলে যেতাম। তাই ভাড়া বাবদ ৫০ টাকা পেয়ে খুশীতে গুলিস্তান গিয়ে সেই ৫০ টাকায় একটি প্যান্ট কিনলাম। ঐ প্যান্ট ১১ মাস পরে সেটি আবার বিক্রি করে ২০ টাকা পেয়েছি। এভাবে স্যারের ছোট ছোট শুভেচ্ছায় আমার বড় বরকতময় উপকার হত।
স্যার একদিন মিটিংয়ে বললেন, আমরাতো এখন ভাড়া অফিসে আছি। নিজস্ব অফিস হলে কেমন হয়। আমরা সবাই বললাম- তাহলে’ত খুব ভাল হয়। এরপর স্যার অফিস কেনাতে টাকা-পয়সার খুব ক্রাইসিস দেখা দিল, স্টাফরা স্বেচ্ছায় ৩/৪ মাসের বেতন নিলো না। অল্প টাকা নিয়ে কোনরকমে চলেছি তখন। আমাদের বিশ্বাস ছিল টাকা এলে স্যার ১ সেকেন্ডও তার কাছে রাখবেন না। সত্যি যখন টাকা আসল, সাথে সাথেই তিনি ঈদের বোনাসসহ আমাদের সব টাকা শোধ করে দিলেন। লেনদেনে এত স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন মানুষ আমি জীবনে আর কাউকে দেখিনি।
২০০৩ সালের মে মাসে আমি বিয়ে করি। স্যার নিজের নামে লোন নিয়ে অফিস কেনার ফলে তখন স্যারের টাকা-পয়সার ক্রাইসিস চলছিল। তাই বিয়ের ৩ বছর পর স্যার একদিন মিটিংয়ে বললেন- রানাকে বিয়ের সময় কিছু দেয়া হয়নি, এখন ৫,০০০ টাকা ও একটি শাড়ি বিয়ের উপহার হিসেবে দিচ্ছি। এ কথায় আমি অবাক হয়ে গেলাম যে, স্যার তিন বছর পরও আমার বিয়ের উপহারের কথা মনে রেখেছেন!
ক্যাম্পাস অফিসে চাকরির সুবাদে ঢাকার এমন কোনো অফিস নেই, যা আমি চিনি না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংসদ ভবন, সুপ্রীম কোর্ট, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সচিবালয়ে যাওয়া সবার ভাগ্যে হয় না; কিন্তু ক্যাম্পাস’র বদৌলতে আমি এসব জায়গায় গিয়েছি বহুবার, এখনও যাই। হোটেল সোনারগাঁও, শেরাটন, পূর্বানী, এরিস্টোক্রেট, এফএস, টপকফি, সামারকান্দ, এরোমা ইত্যাকার নামী-দামী হোটেল-রেস্তোঁরায় খেয়েছি ক্যাম্পাস’র স্টাফ হিসেবে। পিয়ন-গার্ড-দারোয়ানসহ সকল সহকর্মীকে সাথে নিয়ে নামী-দামি রেস্টুরেন্টে বছরে কয়েকবার খাবার উপভোগে স্যার বেরিয়ে পড়েন। এসব অনুষ্ঠানে স্যার খাবার নেন সবার পরে এবং কোন কোন দিন খান না বা খেলেও আধা-কোয়াটার খেয়ে আমাদের খাবারের সন্তুষ্টিতে ব্যস্ত থাকেন। ক্যাম্পাস’র পরিচয়ে আমি ৪৫০টি কম্পিউটার ফার্ম, ৪৮টি এম্বেসি, বাংলাদেশের সকল ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে গিয়েছি।
ক্যাম্পাস মানুষ গড়ার কারিগর। ক্যাম্পাস অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে কম্পিউটার ট্রেনিং, মেডিটেশন, ইয়োগা বিনামূল্যে করানো হয়। শিক্ষানবিশ হিসেবে অফিস সহকারী পদে ১,৫০০ টাকার চাকরিতে ঢুকে এখন আমি সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হয়েছি, বেতন ৮,০০০ টাকা। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও বছরে দু’টি বোনাস পাই। এ কৃতিত্ব শুধুই ক্যাম্পাস’র।
আমি মহান আল্লাহ’র কাছে হেলাল স্যার ও ক্যাম্পাস স্টাফদের দীর্ঘায়ু কামনা করছি। ক্যাম্পাস দেশবাসীকে নিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি যেন গঠন করতে পারে –আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করে এখানেই শেষ করছি।
মোঃ ইউসুফ আলী রানা
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ