অন্যান্য অনেক কিছুর মত আমার প্রোএকটিভ হওয়ার শুরু কিন্তু ক্যাম্পাস থেকেই। সত্যি কথা বলতে কি ‘প্রোএকটিভ’ শব্দটির সাথে আমি পরিচিতই ছিলাম না। ২০০৯ সালে হঠাৎ একদিন আমাদের স্যার অর্থাৎ ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক জনাব এম হেলাল বললেন- ৫ জুলাই প্রোএকটিভ সেমিনার হবে; এ সেমিনার তোমাদের অনেক উপকারে আসবে।
অন্য সবার মত আমিও খুব উৎসাহী ছিলাম এবং উপকারী সেমিনারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে ৫ জুলাই এল এবং একসময় সেমিনার শেষও হয়ে গেল। সেমিনারের ঘন্টা দেড়েক সময় কোথা দিয়ে কিভাবে পার হল, তা টেরই পেলাম না। ক্যাম্পাস-এ কাজ করতে এসে কেবল শিখছি আর শিখছি। একইভাবে প্রোএকটিভ সেমিনার শেষেও মনে হতে লাগল- এতক্ষণ কি শুনলাম? জীবন এত সহজ? মানবতার এত কদর? সেক্রিফাইসের এত মূল্য?
সবকিছুকেই যে ইজি বা সহজভাবে নেয়া যায় -এটাই আমি জানতাম না। ঝগড়া-ঝাঁটি বা সমালোচনার অভ্যাস না থাকায় এবং পড়াশোনায় ভাল হওয়ায় মনে করতাম- এই যথেষ্ট, গুড গার্ল হওয়ার জন্য আর কি লাগে? কিন্তু ‘গুড’র যে অনেক প্রকারভেদ আছে, তা জানলাম ক্যাম্পাস’র সুবাদে। ক্যাম্পাস আমাকে এত সূক্ষ সূক্ষ বিষয়গুলোতে গাইড করেছে যে, হাজারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও, তা কম হবে।
এমনিতে আমার বেশি সংখ্যক সমস্যা নেই। তবে যে ২/১ টা আছে তা খুব গভীর, বলা চলে রীতিমত ভয়াবহ। আমার সাথে কেউ একবার কোন অন্যায় আচরণ বা খারাপ ব্যবহার করলে অর্থাৎ অযৌক্তিক আচরণ করলেই হল- বাকি জীবনের জন্য সে আমার মন থেকে বাদ। আমি হয়ত তাকে মুখে কিছু বলব না, এমনকি তার সাথে কোন খারাপ আচরণও করব না, হয়তবা তার সাথে হাসিমুখে চলব-ফিরব, কিন্তু আমার মনে তার জন্য আর কোন স্থান থাকবে না।
ছোটবেলা থেকে এই আমার রোগ। আমি নিজে এ রোগের ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, রোগ তাড়ানোর যে চেষ্টা করিনি, তাও নয়। কিন্তু পেরে উঠিনি। আমি বুঝতাম- এ সমস্যা আমারই ক্ষতি করছে, তবু কেন যেন কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
তাছাড়া আমি একটু অভিমানী আর জেদও সাংঘাতিক। তবে এটা আমার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে না মিশলে অর্থাৎ আমার কাছের লোক না হলে বোঝা মুশকিল। আমার চিন্তায় যদি একবার কিছু ঢুকে যায়, আমি সেটা করেই ছাড়ি; তার ফলাফল যাই হোক না কেন। আর আমার কাছের মানুষরা আমাকে এতটুকু ভুল বুঝলেই হল, কে পায় আমাকে। আমার অভিমান তখন তুঙ্গে উঠে। রাগ করে ৩দিন না খেয়ে থাকার রেকর্ডও আমার আছে। আসলে কি যে হয়ে যায়, ঐ মুহূর্তে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারি না।
ক্যাম্পাস’র প্রোএকটিভ সেমিনারে অংশগ্রহণের পর থেকে আমার সেই অভিমান আর জেদ কোথায় চলে গেছে! এখন আমি যেকোন পরিবেশে অনেক সহজ থাকতে পারি, সবার সব ধরনের কথা অনেকটাই হজম করতে পারি। কষ্ট যে হয় না, রিএকশন যে আসে না -তা কিন্তু নয়। কষ্ট ঠিকই হয়, কিন্তু ভাল ভাল কথা মনে করে সেটা দ্রুত ভুলে যেতে চেষ্টা করি। রিএকশন আসতে চাইলে নিজেই নিজেকে অনবরত বলতে থাকি- আমি প্রোএকটিভ, ওর কথায় আমার রিএক্ট করার কি আছে? ওতো এমনই, ওর কথার মূল্য কি? এসব বলে নিজেকে বুঝ দিই।
এখন এমন হয়েছে যে, কেউ অযৌক্তিক আচরণ করলে বা কাউকে কোন বিষয়ে বার বার বলার পরও আশানুরূপ আচরণ না পেলে নিজেকেই কাউন্সেলিং করতে থাকি এই বলে যে- ওকে বললেও যা, না বললেও তা। আর এই বাণীটিও প্রোএকটিভ সেমিনার থেকে পাওয়া। সত্যিইতো, যাকে বললে কোন কাজ হয় না, তার থেকে ভাল কিছু আশা করার কোন মানে হয়? এক্ষেত্রে আর একটি কথা আমাকে খুব শক্তি দেয়। সেটি আমাদের সম্পাদক স্যারের কাছ থেকে পাওয়া একটি বাক্য। স্যার একদিন বলেছিলেন- যার যা আছে সেতো তাই দিবে, যা নেই তা কি করে দিবে? স্যারের এ দর্শন জানার পর থেকে যখনই কারও কথায় বা কাজে কষ্ট পাই, তখন নিজেকে বলি- ওর আছেই খারাপ ব্যবহারটা, ও কি করে ভাল ব্যবহার করবে; এতে আমার মন কিছুটা হলেও সান্তনা পায়।
আমাদের গত প্রোএকটিভ সেমিনারে উপস্থাপক ড. আলমাসুর রহমান একটি চমৎকার কথা বলেছেন। প্রত্যেক ব্যক্তি চায় পৃথিবীর সবকিছু তার মনের মত হোক; অথচ কোনকিছুর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। তবুও সে এটা চায়, এটা নিয়ে নানাজনের সাথে তার নানারকম ভুল বোঝাবুঝি হয়। যেখানে আমার কোন নিয়ন্ত্রণই নেই সেখানে মনমত কিছু আশা করা বোকামী নয় কি? প্রত্যেক মানুষের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে একমাত্র তার নিজের ওপর। এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার যথার্থ ব্যবহার আমরা কতটুকু করি? আমরা নিজেকে সংশোধন করি কি? যে মানুষ নিজেকেই সংশোধন করে না, সে কিভাবে আশা করে- অন্য একজন তার মনের মত হবে?
আমারও এ সমস্যা ছিল। আমি চাইতাম সবকিছু আমার মনের মত হোক, সবাই আমাকে বুঝুক...। যদিও গত কয়েকটি সেমিনারের পর থেকেই আমি একটু একটু করে প্রোএকটিভ হচ্ছি; তবে গত সেমিনারের উক্ত বিষয়টি আমাকে এক ধাক্কায় অনেকখানি প্রোএকটিভ করে দিয়েছে। আমি নিজেকে সংশোধন না করে অন্যের কাছে কিছু আশা করি কিভাবে -এটা মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে। এরপর থেকেই আমি অনেক ইজি হয়ে গেছি। আর সত্যি কথা বলতে কি, এ পরিবর্তনের পর থেকে আমি অনেক ভালও আছি।
জীবনে কষ্ট থাকতেই পারে, ব্যর্থতা আসতেই পারে, সবকিছু মনের মত না হতেই পারে- তার জন্য হা-হুতাশ করতে নেই। খারাপের মধ্যেও ভাল খুঁজে নিতে হয়। আগে যেকোন বিষয়ের নেগেটিভটাই চোখে পড়ত, গ্লাসে যে অর্ধেক পানিও আছে -এটা বুঝতে চাইতাম না। এখন এত সহজ হয়েছি যে, মাঝেমাঝে নিজের ব্যবহারে নিজেই অবাক হয়ে যাই। এটা আমাকে অবাক করে যে, একজন মানুষের কতখানি হিম্মত থাকলে সে একটা প্রতিকূল পরিবেশকে নিজের অনুকূল করে নিতে পারে? কত বড় মন হলে বার বার ক্ষমা করা যায়? কত বড় আত্মা হলে নিজের belongings অন্যকে দেয়া যায়? এসবই প্রোএকটিভ মানুষের লক্ষণ।
প্রোএকটিভ সেমিনারের মাধ্যমে ক্যাম্পাস আমাকে শিখিয়েছে সফল ও জনপ্রিয় হওয়ার গুণ। যেমন- উদার হওয়া, ক্ষমা করা, অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা, টিম ওয়ার্ক, টিম স্পিরিট, কাজের প্রাইওরিটি ইত্যাকার সব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ গুণ; যা পালন করতে না পারার প্রশ্নই ওঠে না।
আমার অনেক কষ্টের মুহূর্তে, অনেক রাগ-বিরক্তি বা রিএকশনের মুহূর্তে ‘প্রোএকটিভ’ শব্দটি আমার ভেতরে জাদুর মত কাজ করে। অনবরত ‘প্রোএকটিভ’ শব্দ আওড়ে আমি নিজেকে সহজ রাখি। প্রোএকটিভ ওয়ার্ল্ডে আমাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ক্যাম্পাস এবং প্রোএকটিভ সেমিনার সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
অনেক প্রোএকটিভ হয়েছি, আরও হব, আমাকে হতেই হবে; কারণ, আই এম দ্যা কুইন অব মাই ওয়ার্ল্ড।
-usrony@yahoo.com
উম্মে সালমা রনি
উপ-পরিচালক