॥ পূর্ব প্রকাশিতের পর -৫॥
অধ্যায় ২
বিগত অধ্যায়ে স্পষ্ট হয়েছে যে, চিকিৎসা বিজ্ঞান মানবজাতির জন্য তখনই আশীর্বাদস্বরূপ যখন এর প্রয়োগ হয় যথাসময়ে, যথাস্থানে ও যথোপযুক্তভাবে। অন্যথায় এর অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মারাত্মক অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতার বিশেষ সংকটে রাসায়নিক ঔষধ ও অস্ত্রোপচার হয়ত দরকার। কিন্তু সাধারণ অসুস্থতায় তথা দৈনন্দিন জীবনযাপনে যখন তখন কেমিক্যাল ঔষধ গ্রহণ অথবা কথায় কথায় শরীরে অস্ত্রোপচার বা কাটাছেঁড়া করা সুস্থতা বা স্বাভাবিকতাতো নয়ই বরং দীর্ঘমেয়াদে ও দীর্ঘজীবনে তা ডেকে আনে দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা-গ্লানি ও মারাত্মক বিপর্যয়। তাছাড়া এটি প্রাকৃতিক বা সুষ্ঠু-স্বাভাবিক চর্চাও নয়। এজন্যইতো প্রাচীন প্রচলিত কথা এখনো গ্রামে-গঞ্জে উচ্চারিত, ‘কুইনাইনে জ্বর সারাবে কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’ ইংরেজি প্রবাদেও রয়েছে, Diet is better than Doctor.
মানুষের শরীরে মাথা থেকে হাত ও পায়ের তালু পর্যন্ত শিরা-উপশিরার পাশাপাশি রয়েছে এনার্জি চ্যানেল বা মেরিডিয়ান লাইন। শরীরে কাটাছেঁড়া করলে এই মেরিডিয়ান লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে কাটা অংশে এনার্জি চলাচল ব্যাহত হয়। তাই অতীব জরুরি ও অত্যাবশ্যক না হলে অপারেশন বা অস্ত্রোপচার না করাই শ্রেয়। আবার জৈব উপাদানে তৈরি মানুষের শরীরে কেমিক্যাল বা কৃত্রিম ঔষধ বা অনুরূপ খাদ্যদ্রব্য ঢোকালে তাতেও কিন্তু একশন-রিএকশন অবধারিত।
রান্না বা বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা তেল ও পানি একত্র করি ঠিকই, কিন্তু তেল-পানি কখনোই মেশে না। সেরূপ কেমিক্যাল ঔষধ বা কেমিক্যালযুক্ত যে খাদ্য আমরা গ্রহণ করি, তা শরীরে আপাত কাজ দিলেও দীর্ঘমেয়াদে এবং সার্বিকভাবে নিরাপদ নয়; এমনকি তা শরীরের সাথে Match করে না বা খাপ খায় না, মানিয়ে নেয় না; বরং Unmatched বা অমিশ্রিত অবস্থায় থেকে যায়। তেল ও জলের মতোই কেমিক্যাল ও অর্গানিক শক্তি মানবদেহে ক্রিয়া করে স্ব স্ব রূপে। এককথায়, কেমিক্যাল ঔষধ-পথ্য সর্বদাই ফরেন সাবস্টেন্স হিসেবে ক্রিয়া করতে থাকে জৈব বা অর্গানিক শরীরে। এ কারণেই তা স্বল্প বা দীর্ঘ সময়ে শরীরের ক্ষতি করে। একটি কোক বা পেপসি অর্থাৎ কেমিক্যাল মেশানো রঙিন পানি খেলে এর ক্ষতির প্রভাব হয়ত সাথে সাথেই দেখা যায় না; কিন্তু এই কৃত্রিম খাবারের নির্যাস (Substance) শরীরে থেকেই যায়, যা দীর্ঘদিন পর হলেও অবশ্যম্ভাবী ক্ষতির পাশাপাশি ক্যান্সার বা অনুরূপ দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে। সেরূপ কেমিক্যাল জুস, চকলেট, আইসক্রিম, চিপস, আচার-চাটনি, ফাস্ট ফুড, মিষ্টি এবং এরূপ বা অনুরূপ খাদ্যদ্রব্য শরীরের যতটা না উপকার করে, তারচে’ অপকার করে ঢের বেশি।
তাই এ ধরনের কৃত্রিম খাবার বিশেষত কেমিক্যাল ও রং মিশ্রিত খাবার এবং কেমিক্যাল ঔষধ-পথ্য শরীরে পারতপক্ষে না ঢোকানোই শ্রেয়। অধিকন্তু এসব বর্জন করে প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণ এবং নিয়মিত প্রাকৃতিক চর্চা ও চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা নিরোগ, সুস্থ ও শতায়ু লাভ করতে পারি অনায়াসে; ..And thus we can be our own Doctor.
॥পর্ব ১॥
প্রাকৃতিক চর্চার বিভিন্ন ধরন
স্বাস্থ্যকর ও বিজ্ঞানসম্মত খাদ্যাভ্যাস এবং সুষম খাদ্যতালিকা
খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যতালিকা শুধু সুস্থতা ও শতায়ু লাভের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শিক্ষা এবং সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশও বটে। খাদ্যাভ্যাস হচ্ছে ‘এক দেশের বুলি, অন্যদেশের গালি’ এর ন্যায়; অর্থাৎ যে খাবার এক অঞ্চলের মানুষের জন্য নিষিদ্ধ, সেই খাবারই আবার অন্য অঞ্চলে প্রসিদ্ধ।
খাদ্যাভ্যাস সাধারণত জন্মের পর পারিবারিকভাবে তৈরি হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে পরিবারে একরকম খাদ্যাভ্যাস তৈরি হলেও পরবর্তীতে শিক্ষা-দীক্ষা ও পরিবেশের কারণে অথবা বিদেশ-বিভূঁইয়ে থাকতে থাকতে ছোটবেলাকার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হয়ে যায়। ছোটবেলায় ভালো খাদ্যাভ্যাস তৈরির দায়-দায়িত্ব মা-বাবা বা অভিভাবকদের এবং পরবর্তীতে উন্নততর খাদ্যাভ্যাস তৈরির দায়িত্ব নিজের। ভালো খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে অথবা মন্দ খাদ্যাভ্যাস বর্জন করতে নিজের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।
ইচ্ছাশক্তির সাথে ভালো বা মন্দ খাদ্য সম্পর্কে যুক্তি দিয়ে ব্রেনকে বললে এবং একটু মেডিটেশন করে নিলে ঐ প্রোগ্রামড ব্রেন সারাজীবন স্বয়ংক্রিয়ভাবে একদিকে ভালো খাদ্য সম্পর্কে আপনার আসক্তি তৈরি ও বজায় রাখবে, অন্যদিকে খারাপ খাদ্য প্রত্যাখ্যান করতে থাকবে। যেমন, মিষ্টি বেশি খাওয়ার বদভ্যাসে পড়লে আপনি চোখ বন্ধ করে দেখবেন বা Imagine করবেন যে মিষ্টির ভেতর কেঁচো, সাপ ইত্যাদি রয়েছে; মিষ্টির ভেতর থেকে গোখরো সাপ ফণা তুলে আপনাকে ছোবল মারার চেষ্টা করছে...। এর অর্থ হচ্ছে, অতিরিক্ত মিষ্টি আপনাকে অসুখ বা বৈরী আক্রমণের মুখোমুখি করতে পারে।
একবার এরূপ Visualize দৃশ্য তৈরি করার পর মিষ্টি সামনে এলেই আপনি ঐ দৃশ্যটি Imaginary impression করবেন, দেখবেন মিষ্টির প্রতি আপনার আর আসক্তি নেই। অনুরূপভাবে কোক-ফান্টা-পিৎজা-বার্গার-হটডগ-কাবাব-বিরিয়ানি-আইসক্রিম-চকলেট-চিপস ইত্যাকার অস্বাস্থ্যকর খাবার আপনার ব্রেন দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রত্যাখ্যান করার অভ্যাস তৈরি করতে পারেন। আবার স্বাস্থ্যকর যে ভালো খাদ্যটি আপনার খেতে রুচি হয় না বা ইচ্ছা করে না, সেই খাদ্য সম্পর্কে আপনার মনোরাজ্যে Imaginary impression তৈরি করবেন যে এ খাদ্যের মধ্যে আপনার জন্য বহুল উপকারী খাদ্যপ্রাণ, শক্তি ও শৌর্য-বীর্য রয়েছে। যেমন, তেতো করলা খেতে অসুবিধাবোধ করলে বা অনুরূপ অরুচিকর সব্জি ও ফল খেতে আপনার ইচ্ছা কম হলে সেক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে ব্রেনকে বলবেন এটি খেলে আমি সুস্থ থাকব, আমাকে আর ঔষধ খেতে হবে না, ঔষধের তেতো বা বিস্বাদের চেয়ে তেতো করলা বহুগুণে ভালো... ইত্যাদি। এরপর ঐ খাদ্যটি সামনে পড়লেই পূর্বেকার ইমাজিনারি দৃশ্যটির ভিজ্যুয়ালাইজ করবেন বা উক্ত কথাগুলো আওড়াবেন। দেখবেন, এই আপনিই এক বাটি করলা সাবাড় করে ফেলেছেন এক চামচ ভাতের সাথে। তখন আপনার কাছে বিরিয়ানি বা পোলাও-কোরমার চেয়ে করলা বা অনুরূপ শাক-সব্জি বেশি বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। এভাবে কচু, পেঁপে (কাঁচা-পাকা-রান্না), কুমড়া, লাউ প্রভৃতি সহজলভ্য ও সুলভ মূল্যের সব্জিও নিয়মিত বেশি বেশি খাবেন।
অভ্যাস-অনভ্যাসের ওপরেই খাদ্যের ভক্তি ও অভক্তি নির্ভর করে। যেমন চিংড়ি মাছ একদিকে রুচিকর বা মজার খাবার, অন্যদিকে এ মাছটি অনেক রোগ সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বে¡ও ছোটবেলায় চিংড়ি মাছ খাওয়ার অভ্যাস তৈরির কারণে আপনি চিংড়ি খান; কিন্তু একই প্রজাতির কাঁকড়া, কচ্ছপ যা চিংড়ির চেয়ে উপাদেয়, অথচ সেগুলো খাওয়া সম্পর্কে আপনার ব্রেনে তথ্য নেই বলে বা খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়নি বলে কাঁকড়া আপনিতো খানই না, বরং অন্যকে খেতে দেখলেও বমি আসে। আমরা যেমনি বোয়াল-লইট্যা-বাইন মাছ খাই, তেমনি সাপজাতীয় প্রাণি চীনারা সাগ্রহে খায়। বাইন, বাউশ ও লইট্যা মাছে আমাদের আপত্তি নেই, অথচ সাপ খাওয়ার কথা শুনলেই আমাদের বমি আসে। এর কারণ আর কিছুই নয়, আসলে সাপ খাওয়ার তথ্যটি ছোটবেলায় ব্রেনে গাঁথা হয়নি বলে অন্যকথায় সাপ-কচ্ছপ-কাঁকড়া-ব্যাঙ-বিচ্ছু খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়নি বলে তা খেতে আমাদের অরুচি হয় বা বমি আসে। তার মানে ব্রেনে প্রোগ্রামড থাকা খাবার দেখলে জিহ্বায় লালা আসে; অন্যদিকে অনভ্যস্ত বা ব্রেনের অজ্ঞাত খাবার খেলে বমি আসে।
সুতরাং একদিকে আপনার শরীরের জন্য উপকারী খাবারসমূহের সুঅভ্যাস তৈরি এবং অন্যদিকে অপকারী খাবারের কুঅভ্যাস বর্জন আপনার একান্ত নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও উপরোক্তরূপ সাধারণ কৌশলের ব্যাপার মাত্র। আপনার প্রিয় শরীরে যেকোনো খাদ্য ঢোকানোর সময়ে তথা খাদ্য গ্রহণের সময়ে ভাববেন ও আওড়াবেন যে আমরা বাঁচার জন্য খাই, খাওয়ার জন্য বাঁচি না।? তাই সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা যা খাওয়া প্রয়োজন, শুধু সেসবই আমি খাব; শরীরের জন্য ক্ষতিকর কিছু খাব না। ক্ষতিকর কোনো খাবার শরীরে ঢোকানোর উপক্রম হলে নিজে নিজে এরূপ বলব এ খারাপ খাবারের জন্য আমাকে মাশুল গুনতে হবে, তাই খাবারটি আমার প্রিয় শরীরে ঢোকাতে চাই না...। তাতে ঐ খারাপ খাবারের প্রতি মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে সেই খাবার গ্রহণের ইচ্ছা, রুচি বা লোভ নষ্ট হয়ে যাবে; অথবা সামান্য খেলেই চাহিদা মিটে যাবে। অর্থাৎ খাবারটি হয়ত আপনি খাবেনই না, অথবা খেলেও যৎসামান্য খেয়েই তুষ্ট থাকবেন।
আপনার নিজ মস্তিষ্ক বা সুপার কম্পিউটারটি মহাবিস্ময়কর ও অফুরন্ত শক্তিধর; যাকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস তৈরি ও উন্নত জীবনযাপনসহ পৃথিবীর ও মানবতার কত যে কল্যাণকর কর্মযজ্ঞ এই আপনিই করে যেতে পারেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ব্রেন বা মস্তিষ্কের এ ক্ষমতা খাটিয়ে আপনি নিজে প্রাকৃতিকভাবে সুস্থ ও শতায়ুলাভ করতে পারেন, আপনার পরিবার-পরিজন-সহকর্মী-বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদেরও এরূপ প্রাকৃতিক চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। এভাবে মানবতার কল্যাণে প্রভূত ভূমিকা রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতে দেশ ও জাতির অর্থ সাশ্রয়েও রাখতে পারেন অনন্য অবদান। এরূপ অত্যাধুনিক মানুষ বা Superior human being হতে চাইলে ব্রেন-প্রোগ্রামিং অতীব জরুরি। তা করতে চাইলে প্রতি শনিবার বিকেলে ক্যাম্পাস কার্যালয়ে আসুন (www.campus.org.bd)।
ব্রেনকে যদি প্রোগ্রামিং করে নেন যে আপনি যেকোনো ভালো, যৌক্তিক, সত্য ও সুন্দর বিষয়কে সর্বদাই ‘হ্যাঁ’ বলবেন বা সমর্থন ও সহযোগিতা করবেন; অন্যদিকে সকল মন্দ-অযৌক্তিক-অসত্য ও অসুন্দরকে ‘না’ বলবেন তাহলে দেখবেন, ব্রেনই আপনাকে যেকোনো ভালো কাজে ধাবিত করছে এবং মন্দ কাজে বাধা দিচ্ছে। দেখবেন স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রতি আপনার আসক্তি জন্মাচ্ছে, অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যকে আপনার জিহ্বাই ফিরিয়ে দিচ্ছে।
এভাবে ব্রেনকে প্রোগ্রামিং করে নিয়ে উন্নত জীবন চর্চায় একবার অভ্যস্ত হয়ে উঠলে বাকি জীবনে দেখতে থাকবেন রেল লাইনের ওপর ইঞ্জিনরূপী আপনি শুধু সম্মুখে ছুটে চলছেন, আর বগী বা কোচরূপী বহু মানুষ আপনার পিছু ছুটছে। আপনার অনুসারীদের অনুরণন ও মিছিল দেখে নিজকে ধন্যবাদ দিন, স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানান।
-চলবে
সুস্থতা ও শতায়ুলাভে
প্রাকৃতিক চর্চা ও চিকিৎসা Be your own Doctor -এ বইটির
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৩৪৬, মূল্যঃ ৩৫০ টাকা
প্রাপ্তিস্থানঃ ক্যাম্পাস পত্রিকা অফিস