পদ সৃষ্টি ছাড়াই একাদশ শ্রেণি বা কলেজ চালু করায় সঙ্কটের মুখে পড়েছে অনেক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। একাদশ শ্রেণি চালু করার পর প্রায় আট বছর চলে গেলেও আজ পর্যন্ত এসব বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণির জন্য শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সঙ্কট নিরসনে দফায় দফায় পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করলেও ফলাফল শূন্য। ফলে ইতোমধ্যেই তিনটি বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠান জোড়াতালি দিয়ে অর্থাৎ স্কুল শিক্ষক ও খ-কালীন বেসরকারি কলেজ শিক্ষক দিয়েই চলছে সরকারি কলেজ!
মাউশি’র পরিচালক (বিদ্যালয়) অধ্যাপক এলিয়াস হোসেন সঙ্কটের চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, আমরা পদ সৃষ্টির জন্য যে প্রস্তাব করেছিলাম তা সেভাবেই পড়ে আছে। পদ সৃষ্টি হয়নি। তিনি জানান, আমরা কয়েকজন শিক্ষককে সংযুক্ত হিসেবে পদায়ন করেছিলাম এসব প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তারাও সেখান থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেছেন। এখন সমস্যা আরও বেড়েছে। স্কুল শাখায় যোগ্যতম শিক্ষকদের দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বড় ও মানসম্পন্ন সরকারি বিদ্যালয়েই চালু করা হয়েছিল একাদশ শ্রেণি। ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ ও ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে দেশের সবচেয়ে বড় ১১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়।
প্রথমে স্কুলগুলোতে দু’তিন জন করে সরকারি কলেজের প্রভাষক পদায়ন বা পদায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও পরবর্তীতে আর শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। স্কুলগুলোতে দু’একজন কলেজ শিক্ষক পদায়ন হলেও তারা স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে চাকরি করতে স্বস্তিবোধ করছে না। আবার স্কুল শিক্ষকরাও কলেজ শিক্ষকদের মেনে নিতে পারছেন না। কলেজ শাখার জন্য পৃথক শিক্ষক না থাকায় প্রাইভেট টিউশনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের।
প্রাইভেট টিউশনির লোভে পার্শ্ববর্তী বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা সম্মানী ভাতা ছাড়াই সরকারি স্কুলের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন। এ বিষয়ে মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ হাফিজুল ইসলাম বলেন, আমার স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে দুই শিফটে ১৫০ জন করে ৩০০ জন ছাত্র আছে। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষক নেই। স্কুল শাখার শিক্ষক দিয়েই ছাত্রদের পাঠদান করা হচ্ছে। বারবার দাবি জানালেও কলেজ শাখার জন্য পদ সৃষ্টি হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সরকারি কলেজগুলোতে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সঙ্কুলান না হওয়া ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে প্রথমে রাজধানীর দু’টি স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে পাঠদান চালু করা হয়।
প্রতিষ্ঠান দু’টি হলো গভর্ণমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল এবং শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। পরবর্তীতে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে সাতটি প্রতিষ্ঠানে একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হয়।
স্কুলগুলো হলো- রাজধানীর শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল, খুলনা জিলা স্কুল এবং বরিশাল জিলা স্কুল।
পরে সুনামগঞ্জের সরকারি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং সিলেটের সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েও একাদশ শ্রেণিতে পাঠদান চালু করা হয়। শিক্ষকের পদ সৃষ্টি না হওয়ায় দু’তিন বছর পর খুলনা জিলা স্কুল, বরিশাল জিলা স্কুল ও সুনামগঞ্জ এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ১১টি প্রতিষ্ঠানে একাদশ শ্রেণিতে কেবল বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়া হয়। এর মধ্যে একাদশ শ্রেণি অর্থাৎ প্রথম বর্ষে ১৬০ জন এবং দ্বিতীয় বর্ষে ১৬০ জন করে মোট ৩২০ জন শিক্ষার্থী আছে।
একাদশ শ্রেণির একাডেমিক কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব পালনের কথা মাউশি’র আঞ্চলিক উপ-পরিচালকদের (ডিডি)। তবে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, ১১টি স্কুলের একাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি হচ্ছে না বললেই চলে। কারণ মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি করতেই ডিডি’দের হিমশিম খেতে হয়। মাউশি সূত্রে জানা গেছে, সরকারি স্কুলে এমনিতেই শিক্ষক সঙ্কট ভয়াবহ।
বর্তমানে দেশের ৩৩৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের পদ আছে দশ হাজার ছয়টি। এর মধ্যে এক হাজার ৬৯১টি পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীর পদও শূন্য রয়েছে প্রায় দুই হাজার। প্রধান শিক্ষক নেই প্রায় ১০০ বিদ্যালয়ে। এই তীব্র শিক্ষক স্বল্পতার মধ্যেই সহকারী শিক্ষক দিয়ে স্কুলে কলেজ শাখার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে নামকাওয়াস্তে।