॥ পূর্ব প্রকাশিতের পর -২০ ॥
অধ্যায় ৩
খাদ্যে ভেজাল ও জিঞ্জিরা-সংস্কৃতির ভয়াবহতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন
আমি যখন প্রথম প্রথম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে যেতাম, তখন কৌতূহল ও ঔৎসুক্য কাজ করত, কিন্তু আবেগ কাজ করত না। কারণ ছোটবেলা থেকেই শুনেছি বা বইপত্রে পড়েছি যে, ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের মাধ্যমে ইউরোপ-আমেরিকা নিজেদের সম্পদ বাড়িয়েছে; সেজন্য এরা আমাদের চেয়ে ঢের এগিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক; এতে আফসোস বা আবেগের কী আছে! কিন্তু পরবর্তীতে যখন আমাদের কাছাকাছি দেশ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীন, শ্রীলংকা বা দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করি এবং তাদের উন্নয়ন-অগ্রগতি-সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা ও মানবিকতার সাথে আমাদের তুলনা করি; দেশ ও জাতিগত উন্নয়নে তাদের সেক্রিফাইস দেখি; তখনই চোখে জল এসে যায়, মনটা ডুকরে কেঁদে ওঠে।
আমাদের প্রিয় এদেশ শুধু দুর্নীতিতেই চ্যাম্পিয়ন নয়; আরো বহু নেতিবাচক, অসুস্থ ও অস্বাস্থ্যকর বিষয়েও চ্যাম্পিয়ন। যেমন ভেজাল ও বিষমিশ্রিত খাদ্য এবং কেমিক্যাল ঔষধের বাণিজ্যেও বাংলাদেশ শীর্ষে। এখানে সর্বক্ষেত্রে ভেজাল খাদ্যের রমরমা ব্যবসার পাশাপাশি কেমিক্যাল চিনির তৈরি মিষ্টির সারি সারি দোকান জন-অসুস্থতা তৈরি করছে, অন্যদিকে সেই অসুস্থতার আপাত উপশমে কেমিক্যাল ঔষধের শিল্প-বাণিজ্যেও ব্যাপক প্রসার ঘটছে। কেমিক্যাল ঔষধের এত সহজলভ্যতা, ব্যবহার ও ব্যবসা অন্য কোনো দেশে আমি দেখিনি।
আমাদের দেশে সর্বত্র চলছে ভেজাল, জিঞ্জিরা সংস্কৃতি ও সিন্ডিকেট বাণিজ্য। বহু ব্যবসায়ী মানবতা বিরোধী, জাতি বিধ্বংসী, আত্মহনন ও হত্যাসম কর্মকান্ডে লিপ্ত। ফল বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, সব্জি বিক্রেতা সবাই ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল ও বিষাক্ত জিনিস দিয়ে বিষিয়ে দিচ্ছে মানুষের জীবন-প্রাণ; অন্যদিকে অধিকাংশ সমাজপতি ও রাজনীতিক বিষাক্ত করে তুলছেন সমাজকে, জাতিকে।
মানবদেহে রোগ-ব্যাধির প্রায় ৮০ শতাংশ হয় অনিরাপদ খাদ্য ও পানির কারণে। এসব থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্য এবং পানীয় নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, পানীয় জল থেকে শুরু করে শিল্পোৎপাদিত খাদ্যপণ্য ও জীবন রক্ষাকারী ঔষধ কিছুই এখন আর ভেজালমুক্ত নয়। অতি মুনাফালোভী অধিকাংশ অসাধু ব্যবসায়ী এ কাজে তৎপর ও সিদ্ধহস্ত। নগরীর বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গাঁও-গেরামের ক্ষুদ্র দুধ-বিক্রেতাসহ সব ব্যবসায়ীই এখন ভেজাল-অপরাধের সাথে কমবেশি সম্পৃক্ত।
মাছ ব্যবসায়ী ফরমালিন মিশ্রিত মাছ বিক্রি করে সেই পয়সা দিয়ে কেনে ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা ইথেফেন বিষ দিয়ে পাকানো ফল; বিষাক্ত সেই ফলের ব্যবসায়ী কেনে ইউরিয়া সারে উৎপাদিত সব্জি। ইউরিয়া ব্যবহারকারী চাষী তার অর্জিত টাকায় কেনে ইউরিয়া সারে ভাজা মুড়ি এবং জিঞ্জিরা মেইড যন্ত্রপাতি।
২০০৯ সালে ভিয়েতনাম সফরকালে এক ফল বিক্রেতার সাথে খাজুরে আলাপকালীন বলেছিলাম, আমাদের দেশের ফলমূল প্রাকৃতিকভাবে ও গুণগতভাবে তোমার দেশের মতোই; কিন্তু ওগুলো কিনতে ভয় হয়। কারণ সে ফল পাকানো হয় কেমিক্যাল দিয়ে; মাছ কিনতে ভয়, কারণ মাছে দেয়া হয় ফরমালিন; মুরগি কিনতেও ভয়, কারণ মুরগি পালিত হয় ক্রোমিয়ামযুক্ত ট্যানারি-বর্জ্যরে বিষাক্ত খাবারে, যে মুরগি খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হয় ক্যান্সারে।
ভিয়েতনামী সে ফল বিক্রেতা অবাক হয়ে বলে, তাহলে তোমরা বাঙালিরা একে অপরকে বিষ খাওয়াচ্ছো? এটাতো হত্যার মতো অপরাধ! তাছাড়া বিষাক্ত ফলের বিক্রেতা তার অর্জিত মুনাফা দিয়ে যে মাছ-মুরগি কিনছে, তাওতো বিষাক্ত। অর্থাৎ সে একজনের কাছে বিষ বিক্রি করে আরেকজনের কাছ থেকে বিষই কিনছে! তাহলে লাভটা কোথায়? তোমরা কি একে অপরের ক্ষতিতে লিপ্ত হয়ে সবাই আত্মঘাতি ও আত্মহননের প্রতিযোগিতা করছ না?
ব্যবসা-বাণিজ্য একটি পবিত্র পেশা। কিন্তু এ সুস্থ-পবিত্র কাজটি চলছে অসুস্থ, অপবিত্র, অমানবিক ও খুন-খারাবির মাধ্যমে। দেদারছে এমন সব পণ্যেরও ব্যবসা চলছে, যেগুলো বিএসটিআই’র তালিকাতেই নেই। ব্যবসায়ীদেরই ভাষ্য, তারা জেনে-শুনে ভেজাল খাদ্য বিক্রি করে। এভাবে আমরা কি আসলে অন্যকে ঠকাচ্ছি, না নিজেকে ঠকাচ্ছি? আমরা কি এগুচ্ছি, নাকি পিছাচ্ছি? আমরা কি বুদ্ধিমান, নাকি চালাক-বোকা? এরূপ নানা প্রশ্নে নিজে নিজেই জর্জরিত হয়ে চোখের জলে আওড়াতে থাকি ...কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি।
ভেজালের কিছু বাস্তব চিত্র
সম্প্রতি ঢাকা সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের পরীক্ষায় উঠে এসেছে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহ চিত্র। ভেজাল সম্পর্কিত সেই পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী পণ্যের যে খাদ্যমান প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে, ভেতরে সেই মান থাকে না। আইসক্রিম ও মিষ্টিজাত কোনো পণ্যেই দুধ কিংবা পুষ্টিকর উপাদান পাওয়া যায়নি। নামিদামি ব্র্যান্ডের সরিষার তেলে শুধু ঝাঁঝই পাওয়া গেছে, সরিষার কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি; পাওয়া গেছে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ। কোনো পণ্যেই প্যাকেটের গায়ের বর্ণনা অনুযায়ী উপাদান পাওয়া যায়নি; বিশেষ করে বাজারে পাওয়া কোনো ব্র্যান্ডের আইসক্রিমে। নিবিড় পরীক্ষায় দেখা গেছে, দুধ কিংবা পুষ্টি আছে এমন কোনো উপাদানই এগুলোতে নেই। বরং সুগন্ধি, রং ও রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়েছে। অতি দামি ব্র্যান্ডসহ সব আইসক্রিমে একই চিত্র।
একই ধরনের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে নামিদামি ব্র্যান্ডের মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যে। দামি ব্র্যান্ডের মিষ্টির ভেতরে বালু, কাঁকর পর্যন্ত পাওয়া গেছে! মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানে প্রথমে দুধ পাওয়া গেলেও বিভাজনের পর দেখা গেছে সেগুলো দুধের মতোই এক ধরনের রাসায়নিক, যা দুধের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে। ভোজ্যতেলের মধ্যে একশ’ ভাগ ভেজাল পাওয়া গেছে সরিষার তেলে। নামিদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সরিষার তেল পরীক্ষা করে সরিষার কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। এগুলোতে পাওয়া গেছে সয়াবিন তেল, পাম অয়েলের উপাদান ও রাসায়নিক। সরিষার তেলে পাওয়া রাসায়নিক খুবই ঝাঁঝালো ধরনের এবং আলাদাভাবে স্বাদ নিলে তা খুবই বিস্বাদ। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এ তেল ‘খাঁটি সরিষার তেল’ হিসেবে বাজারে বিপুল পরিমাণে বিক্রি হচ্ছে।
পাউরুটি, কেক, বিস্কুট, ড্রাইকেকসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে পঁচা ডিম দিয়ে। দেশব্যাপী মুরগির খামারের সাথে বিভিন্ন নামিদামি বেকারির যোগাযোগ রয়েছে। এসব খামার থেকে মাত্র ১ টাকায় পঁচা ডিম কিনে নেয় বেকারিগুলো। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আবদুল বারি বলেন ডিম পঁচে গেলে স্বাভাবিকভাবে তার মধ্যে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। এই ডিম দিয়ে তৈরি যেকোনো খাবার খেলে ডায়রিয়া-আমাশয়সহ পেটের পীড়া হয়। দীর্ঘদিন খেলে বড় ধরনের পেটের সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া এর দীর্ঘমেয়াদি বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাবতো আছেই।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার উলুসারা গ্রামের একটি বাড়িতে ‘জব্বার ফুড প্রোডাক্টস’ নামের খাদ্য ও কোমল পানীয় তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে ইটের গুঁড়া ও ছাই মিশিয়ে এখানে উত্তেজক পানীয়, ম্যাংগো জুস, তেলসহ ১২টি খাদ্যপণ্য তৈরি করা হয়; যার মধ্যে শিশুদের জন্য তৈরি কোমল পানীয়ও রয়েছে। স্থানীয় বাজারে এসব খাবার ও পানীয় বিক্রি হচ্ছে দেদারছে।
জানা গেছে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিএসটিআইএ’র অনুমোদন ছাড়াই এসব খাদ্যপণ্য তৈরি হচ্ছে। কারখানার শ্রমিকরা জানায় ইটের গুঁড়া, ছাই, নোংরা পানি ও রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে এসব পণ্য তৈরি করা হয়। রাতে একজন ‘কেমিস্ট’ এসে কাজটি করেন। ‘কেমিস্ট’ যখন কারখানায় ঢোকেন, তখন শ্রমিকদের ভেতরে থাকতে দেয়া হয় না।
দেশে বছরে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকার গুঁড়া মসলা বিক্রি হয়। অতি মুনাফার লোভে গুঁড়া মসলায় মেশানো হয় নিম্নমানের কাঁচামাল, ইট-কাঠ-ভুট্টা ও চালের গুঁড়াসহ ক্রোমাটেড, মেটালিন ইয়েলো, টেক্সটাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরি জাতীয় ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ; এসব ক্ষতিকর উপাদান ধ্বংস হয় না আগুনের তাপেও। এভাবে ভেজাল ও কীটনাশকের দাপটে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বছরে ৮৪ হাজার।
প্রিয় পাটালি গুড়ও রেহাই পায়নি ভেজালের হাত থেকে। গুড়ের কারখানা পরিদর্শনে বোঝা যায় পাটালি গুড় তৈরির রহস্য। ৬০ কেজি চিনি, ১৫ কেজি ময়দা, ১০ কেজি দুর্গন্ধযুক্ত ঝোলা গুড়, ১০ কেজি চিটা গুড়, ৫ কেজি খেজুরের রস, ৫০০ গ্রাম সালফেট, হাইড্রোজ ও বিশেষ ধরনের রাসায়নিক মিশিয়ে বড় কড়াইতে জাল দিয়ে তৈরি হয় পাটালি গুড়। অথচ খাদ্যজাতীয় দ্রব্যে বিষাক্ত রাসায়নিক ও সালফেট ব্যবহার করলে তা শরীরে নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করে। এগুলো মানবদেহের কিডনি ও লিভারের জন্য ক্ষতিকর।
মাছ-মাংসের মধ্য দিয়ে ট্যানারির বিষ ঢুকছে মাছে-ভাতে বাঙালির প্রিয় শরীরে। ট্যানারি-বর্র্জ্যরে খাদ্য খাইয়ে মোটা-তাজা করে বাড়িয়ে তোলা মুরগির মাংসেই মানব দেহের সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ১৩৬ গুণ বেশি ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। এরূপ মুরগির মাংস ও ডিম এবং মাছ খাওয়ায় অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম ঢুকছে মানুষের শরীরে। শরীরে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এতে কিডনি ও লিভারের রোগসহ নানা রোগের সৃষ্টি হয়, অনেক সময় ক্যান্সারও হয়। ক্রোমিয়াম ছাড়াও সীসা, সোডিয়াম ইত্যাদি উপাদানও শরীরে যাচ্ছে। এসব উপাদানের বেশি মাত্রায় উপস্থিতি মানুষের বিভিন্ন জটিল ও দুরারোগ্য রোগের কারণ।
মানুষের শরীরে প্রতি গ্রাম রক্তে ০.২ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত জৈব যৌগ সহনীয়, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের শরীরে তা বহু বহু গুণ বেশি রয়েছে। মূলত দূষিত খাবার ও পানীয় গ্রহণের কারণেই শরীরে জমা হচ্ছে এ বিষ। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসল, ক্ষতিকারক রাসায়নিক বস্তুর মিশ্রণে তৈরি মসলা, জুস ও পশুখাদ্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রহণ করছে মানুষ। প্রতিনিয়ত নিম্নমানের ও ভেজালযুক্ত এসব খাবার মানুষের দেহে বিষ আকারে জমাট বাঁধছে; পেটে ঢুকে পড়ছে ঘাতক জীবাণু হেলিকোব্যাক্টর পাইলরি। এ ব্যাকটেরিয়া প্রাথমিকভাবে মানুষের পাকস্থলীতে বাসা বেঁধে সেখানে ঘা তৈরি করে; তারপর পাকস্থলীর গা ছিদ্র করে ছড়িয়ে পড়ে পেটজুড়ে। একপর্যায়ে রূপ নেয় ক্যান্সারে।
কৃত্রিম ও ভেজাল শিশুখাদ্যে
রোগাক্রান্ত আগামী প্রজন্ম
আমাদের দেশে মায়েদের জ্ঞানের অভাবে এবং কোনো কোনো মায়ের উচ্ছৃঙ্খল-বিশৃঙ্খল আচরণের সুযোগে কৃত্রিম শিশুখাদ্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে; পরিণামে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে কৃত্রিম শিশুখাদ্যে। ফলে অপুষ্টির শিকার হচ্ছে শিশুরা; অসুস্থ-রুগ্ন ও পুষ্টিহীনতায় বেড়ে উঠছে এ দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক ও কর্ণধার। তারা কি জাতির সম্পদ না বোঝা হিসেবে বেড়ে উঠছে, তা নিরূপণের সময় এখনই।
কৃত্রিম শিশুখাদ্য উৎপাদন ও বন্টন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী বিপণন নীতির কারণে গুঁড়ো দুধের বিক্রি বেড়েই চলেছে। ব্যাপক শিশু-অপুষ্টির অন্যতম কারণও এটি। গুঁড়ো দুধ আমদানিতে বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। আমদানি করা গুঁড়ো দুধের ৬০% ব্যবহৃত হয় দু’বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য।
আইনে বলা আছে, মাতৃদুগ্ধের বিকল্প হিসেবে কোনো পণ্যের প্রচার করা যাবে না। বিজ্ঞাপন, উপহার সামগ্রী বা কোনো বস্তু বিনামূল্যে দিয়ে বিকল্প শিশু-খাদ্যের প্রচার করা যাবে না। অথচ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তা মানছে না এবং কেউ তাদেরকে তা মানতে বাধ্যও করছে না। আইনগত নির্দেশনা রয়েছে যে, খাদ্যে কী কী উপাদান আছে তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে কৌটার গায়ে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা থাকে না। বরং কৌশলে এমনভাবে প্রচার করা হয়, যেন কৃত্রিম খাদ্য মায়ের দুধের সমতুল্য। এমন লোভনীয় ছবিও ছাপানো হয়, যাতে শিশু বা মা সহজেই ঐ কৃত্রিম খাদ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। অথচ শিশুখাদ্য বিপণন নীতিমালায় বলা আছে শিশু বা মাকে আকৃষ্ট করতে পারে, এমন ছবি শিশু-খাদ্যের কৌটায় বা পাত্রের গায়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এগুলো দেখবেই বা কে?
আমরা যদি সুস্থ-স্বাস্থ্যবান ও আলোকিত জাতি গড়ে তুলতে চাই, তাহলে এখন থেকেই ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে কৃত্রিম ও ভেজাল শিশুখাদ্য পরিহার করতে হবে এবং সরকার ও জাতীয় পর্যায়ে এসব ভেজালের বিরুদ্ধে নির্ভেজাল প্রতিরোধ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
রকমারি বিষ-খাওয়া জাতির উন্নতি
কোনোকালেই সম্ভব নয়
বিভিন্ন ভাষণ, বিবৃতি বা বাণীতে প্রায়ই শোনা যায় আমরা উন্নত হচ্ছি, ধনী হচ্ছি... ইত্যাদি। আমার কাছে এসবই কথার ফুলঝুরি বা মিথ্যে আত্মপ্রসাদ বলে মনে হয়। কারণ সর্বক্ষণ শরীরে বিষ ঢুকিয়ে অথবা বিষ বহন করে কোনো জাতির উন্নতি কি সম্ভব?
দেশ উন্নয়নের পূর্বশর্ত সুস্থ সমাজ ও স্বাস্থ্যবান জাতি। কিন্তু অবিরাম দূষিত পানি ও বাতাস গ্রহণ করে, ভেজাল ও বিষ মিশ্রিত খাবার খেয়ে, কথায় কথায় শরীরে এন্টিবায়োটিক ঢুকিয়ে, ফ্রি স্টাইলে ফার্মেসি থেকে কেনা মুষ্টিভর্তি ঔষধ খেয়ে, সন্তান প্রসবকালে মাকে অযথাই অস্ত্রোপচার করে, জন্ম থেকেই সামাজিক অনাচার ও অসুস্থতা ব্রেনে ধারণ করে সুস্থ সমাজ ও স্বাস্থ্যবান জাতি গড়ার আশা শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া আর কিছু নয়। নিশ্চিত এ অসুস্থ জাতিকে দিয়ে উন্নত ও আধুনিক দেশ গড়ার কথা আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র।
পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশে খাদ্যে বিষ-ব্যবসার সুযোগ নেই; কোনো ডাক্তার রোগীকে সহজে দেয় না এন্টিবায়োটিক; এমনকি সহজে প্রেসক্রাইব করে না ঔষধ। সেখানকার নাগরিকদের আক্রান্ত হতে হয় না গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়ায়। শুধু খাবার পানিতেই নয়, কোনো খাবারে কোনোরূপ দোষ-ত্রুটি পাওয়া গেলে সেই ব্যবসা সেখানেই শেষ এবং সে ব্যবসায়ীকে পেতে হয় জনমের শিক্ষা; যে শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ বা সংস্কৃতি বাংলাদেশে এখনও গড়ে ওঠেনি বলে এখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ বরাবরই অসুস্থ, দূষিত।
নেতৃত্ব ও রাজনীতিতে
ভেজাল খাদ্য বা জিঞ্জিরার প্রভাব
ভেজাল ও জিঞ্জিরা-পাবলিকরা প্রাকৃতিক হবার চেয়ে অপ্রাকৃতিক অথবা অতি প্রাকৃতিকে অভ্যস্ত বিধায় তারা বিবেক-বুদ্ধি খরচ বা বিচার-বিবেচনা করে ভোটাভুটিতে যেতে পারে না। তারা নজরানা নিয়ে তথা স্বার্থ সিদ্ধিতে ভোট কেন্দ্রে যায়।
জাল ভোটে পাস করার প্রবণতা, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য, রাসায়নিক ঔষধ-পথ্য এবং কুচিন্তা ও বদভ্যাস আমাদেরকে এতই অসুস্থ, অস্বাভাবিক, অপ্রাকৃতিক, অপ্রকৃতিস্থ ও আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে যে আমরা প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই দিশেহারা। দেশ, সমাজ, মানবতা, মুনিবতা, নীতি-নৈতিকতা এসব থোড়াই কেয়ার। সবাই নেতা, সবাই মাস্তান, সবাই স্বাধীন। ড্রাইভার-সুইপার থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পর্যন্ত সবাই এত অতিরিক্ত স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার বদভ্যাসে পড়েছি যে রাস্তাঘাটে, ঘরে-বাইরে, অফিসে বা কারখানায় ডিউটি পালনে নিয়ম, আইন-কানুন, অন্যের অধিকার বা অপরের ক্ষয়ক্ষতিতেও নেই কোনো তোয়াক্কা। অফিস-কারখানায় আগুন জ্বালিয়ে, গাড়ি পুড়িয়ে, অন্যকে বিষ খাইয়ে পগাড়পার হওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। এই অতিরিক্ত স্বাধীনতা সমাজ জীবনে তৈরি করছে বিশৃঙ্খলা-অশান্তি-নৈরাজ্য এবং ব্যক্তি জীবনে তৈরি করছে অসুস্থতা, হতাশা ও মানসিক বিকারগ্রস্ততা। এসবের ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করার সময় এখনও কি হয়নি?
বিষ মিশ্রিত ও ভেজাল খাদ্য এবং
জিঞ্জিরা-সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসুন
বাঙালি জাতির অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে আমরা চালাক-বোকা। এই চালাকির বোকামিতে পড়ে আমরা একে অন্যকে অবিরাম বিষ খাইয়ে চলেছি। দেশজুড়ে ভেজালের জাল যেভাবে বিস্তৃত, তাতে ফলমূল-শাক-সব্জি-মাছ কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতার নিজের সাবধানতা জরুরি।
তবে অবিরাম এই অমনুষ্যোচিত অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতাও রয়েছে বাঙালির। ক্যালাস বা উদাসীন হবার কারণে বিষ খেয়েও কেউ কারো অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে তেমন একটা দেখা যায় না। সবাই যেন জেনে-শুনেই বিষ পান করে আত্মাহুতি দিয়ে যাচ্ছে। এ যেন রবী ঠাকুরের বিখ্যাত গানের বাস্তব রূপ
আমি জেনে-শুনে বিষ করেছি পান,
প্রাণেরও আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।
পত্রিকান্তরে দেখলাম এক বিপরীত চিত্র; একদিকে যুক্তরাজ্যে মানুষের আয়ু ক্রমেই বাড়ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশে ভেজালের কারণে আয়ু হ্রাস পাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে নাগরিকদের প্রতি পাঁচজনে একজন ১০০ বছরের বেশি বাঁচে। তাদের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটির এক কোটিরও বেশি নাগরিক ১০০ বছর বাঁচবে। উন্নত খাদ্যমান, জীবনযাত্রা ও কল্যাণ চিকিৎসার কারণেই উন্নত দেশে শতায়ু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দিনদিন। অন্যদিকে সর্বক্ষেত্রে ভেজালের দৌরাত্ম্য, নিম্নমানের খাদ্য, অনুন্নত জীবন-পদ্ধতি এবং ঔষধসর্বস্ব চিকিৎসার কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু তেমন বাড়ছে না। এমনকি দেশের ভবিষ্যৎ যে শিশুরা, তাদের নানা রোগের জন্য ভেজাল ও বিষবাহী রাসায়নিক খাবারকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের শরীর স্পর্শকাতর বিধায় রাসায়নিক মেশানো খাবারে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হয় তাদের শরীরে।
উন্নত দেশগুলো যেখানে মনুষ্যত্ব ও মানবতার উৎকর্ষে নিবেদিত, সেখানে অমনুষ্যোচিত কর্মকান্ড তথা বিষ ও ভেজালে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশ। তাই পাঠকের প্রতি অনুরোধ ভেজাল ও বিষাক্ত খাবার কম খান এবং ঘরে সেদ্ধ বা ভাপ দেয়া খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। ভেজালরোধ-সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নির্লিপ্ততা ও ব্যর্থতার কারণে এখন ভোক্তাদের সচেতনতা ও প্রতিবাদী ভূমিকা বাড়িয়ে দেয়া উচিত এবং ভেজাল পণ্য বর্জনে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কঠোর হওয়া উচিত; যা করছে আমার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র (www.campus.org.bd).
সদাশয় সরকার, নীতি নির্ধারক এবং সকল স্তরের জনগণের প্রতি সবিনয় অনুরোধ জাতির নিশ্চিত অসুস্থতা ও রুগ্নতা কাটাতে ভেজাল খাদ্য ও জিঞ্জিরা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং পরস্পরকে বিষ খাওয়ানোর আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ও সোচ্চার হোন। এ অমনুষ্যোচিত ও হত্যাসম অপরাধ জিইয়ে রেখে দেশ ও জাতির কোনো উন্নয়ন প্রচেষ্টাই সফল হবে না, হতে পারে না।
ভেজালরোধে এখনই যা করণীয়
উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও যে ভেজালমুক্ত পরিবেশ, সুস্থ জাতি গড়ে তোলা যাবে না তা নয়। তজ্জন্য দেশ ও জাতির অভিভাবকদের ঐকান্তিক ইচ্ছাই যথেষ্ট। যে ইচ্ছার মাধ্যমে প্রোএকটিভ ও পজিটিভ এটিচিউডের আলোকিত ও দেশপ্রেমী নাগরিক গড়ে তুলে এক দশকের মধ্যে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান জাতি উপহার দেয়া একেবারেই সহজ।
এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে ক্যাম্পাস গবেষণা সেলের প্রকাশনা ‘জাতীয় সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান, বাংলাদেশ উন্নয়নের অত্যাধুনিক মডেল’ এ (www.helal.net.bd/model)। মডেলটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের বিষয়ে কারো কোনোরূপ সংশয় থাকলেও উচ্ছল-উজ্জ্বল আলোকিত জাতি গড়তে মডেলের অংশবিশেষ, বিশেষত প্রতিটি ইউনিয়নে ‘পাবলিক ট্রেনিং এন্ড মিডিয়া সেন্টার’ কনসেপ্টটি বাস্তবায়নে বাধা কোথায়?
জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির নীতি নির্ধারণে সরকারের দায়িত্ব ও ভূমিকা অনেক। তাই সরকার ও নীতি নির্ধারকদের এতটুকু সুদৃষ্টি খাদ্যে ভেজাল ও বিষ-সংস্কৃতির ভয়াবহতা থেকে জনগণকে রক্ষা করতে পারে। কঠোর আইনের মাধ্যমেও তা অনায়াসে করা যায়।
খাদ্যে ভেজাল ও বিষ প্রয়োগ হত্যাসম অপরাধ বিধায় এর শাস্তি মৃত্যুদন্ড হওয়া সমীচীন। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুযায়ী খাদ্যে ভেজাল দেয়া, ভেজাল খাদ্য বিক্রি এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে ফল পাকানো ও বাজারজাতকরণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এছাড়া অপরাধের ধরন অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা জরিমানার বিধান থাকলেও প্রয়োগের নজির নেই। ভেজালকারীদের মাঝেমধ্যে জরিমানা হয়, কিন্তু তা গুরু অপরাধে লঘু দন্ড হওয়ায় একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সাজা পেয়েও লিপ্ত হয় ভেজালকর্মে। এ সম্পর্কিত কঠিন আইন বাস্তবে প্রয়োগের উদ্যোগ নিতে পারে সরকারই। বিশেষত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক নির্দেশনার মাধ্যমে জরুরিভিত্তিতে প্রয়োগ হতে পারে এরূপ আইন। অনুরূপ কঠোর শাস্তির দু’একটি উদাহরণে এ ঘৃণ্য সংস্কৃতি বন্ধ হবে বলে বিশ্বাস।
মানব বিধ্বংসী বিষ ও ভেজাল প্রতিরোধে অনুরূপ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ একদিকে সরকারের জন্য প্রশংসনীয় হবে, অন্যদিকে দেশ ও জাতি একে তাদের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকর উদ্যোগ হিসেবে স্মরণে রাখবে।
চলবে।