কেন স্কুল ও স্কুলশিশুরা হত্যাপ্রিয় ইসলামপন্থী জঙ্গিদের হামলার লক্ষ্য হয়ে উঠেছে? সোমালিয়ার সীমান্তঘেঁষা কেনিয়ার একটি কলেজে হামলা চালিয়ে ১৪৭ জনকে হত্যার ঘটনাটি এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ এবং হামলাটি চালায় আল-শাবাব। গত ডিসেম্বরে সাত তালেবান জঙ্গি পাকিস্তানের পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে ঢুকে পড়ে এবং শ্রেণিকক্ষের পর শ্রেণিকক্ষে হানা দিয়ে ১৪৫ জন শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে খুন করে। অতি সম্প্রতি দক্ষিণ সুদানে ছাত্রছাত্রীরা যখন পরীক্ষাদানে ব্যস্ত তখন জঙ্গিরা অভিযান চালায় এবং ৮০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে। শিশু মিলিশিয়া হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আগে তুলে নেয়া আনুমানিক ১২ হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গেই সম্ভবত তাদের ঠাঁই হবে।
প্রতিদিন সিরিয়ার কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বোমা পড়ছে কিংবা করা হচ্ছে সামরিকীকরণ। এ ছাড়া ২০ লাখ শিশু হয় শরণার্থী শিবিরে রয়েছে কিংবা দেশ থেকে পালিয়ে কোথাও তাঁবু বা কুঁড়েঘরে মাথা গুঁজেছে। আর নাইজেরিয়ার ২৭৬ ছাত্রীকে বোকো হারামের অপহরণ করার ঘটনাটির এক বছর পূর্তি এই সপ্তাহেই। নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম শিক্ষার বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধকে আরো সাঁড়াশি করেছে। তাদের কারণে গত দুই বছর দেশটির শিশু অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে চরমভাবে।
গত পাঁচ বছরে বিশ্বে স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ১০ হাজার হামলার ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে হবে স্বর্গ, কেন তাদের হামলার লক্ষ্য বানানো হবে? কেন স্কুলশিশুদের হাতে তুলে দেয়া হবে চরমপন্থিদের প্রাণঘাতী অস্ত্র? এ ধরনের হামলার ঘটনায় আমাদের দায়সারা ভাবটিও দুঃখজনক। দক্ষিণ সুদানের ফেব্রুয়ারির অপহরণের খবরটিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তেমন সাড়াই দেয়নি, অথচ অপরাধটি ছিল মানবতাবিরোধী। সন্ত্রাসবাদীদের বিকৃত মস্তিষ্ক প্রতিটি হামলার ঘটনায়ই তাদের নিজস্ব মনগড়া যুক্তি তুলে ধরে; যেমন সর্বশেষ হামলাটির পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আল শাবাব বলেছে- কেনিয়া কেন সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধে মাথা গলাবে? এদিকে সাম্প্রতিক হামলাগুলোর প্রতিটিরই রয়েছে একটি নতুন কৌশল ঃ ভয়াল পরিস্থিতি তৈরির জন্য বর্বরতার সেই সীমাটিও লঙ্ঘন করা হচ্ছে, যা এত দিন সব সন্ত্রাসবাদীর বিবেচনারই অতীত ছিল। মানুষ ক্ষোভে-ঘৃণায় ফেটে পড়বে, আর এই সুবাদে জিহাদি গোষ্ঠীটির বার্তাটি ছড়িয়ে পড়বে- এই সস্তা প্রচারণাটিই যেন তারা চাইছে।
এর চেয়েও শক্তিশালী যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে তারা শিশুদের ওপর হামলার যুক্তি হিসেবে। নতুন ও সাধারণ যে দাবিটি চরমপন্থিরা এখন করছে তা হচ্ছে শিক্ষার মাধ্যমেই আফ্রিকা ও এশিয়ার শিশুরা পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার সংস্পর্শে চলে আসছে। স্থানীয় হাউসা পরিভাষায় বোকো হারাম কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘পশ্চিমা শিক্ষা পাপ’। এ যুক্তিতে অন্ধ হয়ে বোকো হারাম ও আল-শাবাব স্কুল-কলেজে হামলাকে পাপকর্ম বলেও গণ্য করে না।
এ তুলনায় হাসপাতালগুলো বেশি নিরাপদ, কারণ জেনেভা কনভেনশন স্বাস্থ্য অবকাঠামোগুলোকে ‘সেফ হেভেন’ হিসেবে বিশেষ প্রতিরক্ষা মর্যাদা দিয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি খুনে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও এ বিষয়টিকে প্রায়ই স্বীকার করে নেয়। কিন্তু স্কুল-কলেজের সুরক্ষাদান এবং সংঘাতকালে এগুলোকে সামরিককাজে ব্যবহার করা থেকে ঠেকাতে আমরা এত দিন খুব কমই ভূমিকা রেখেছি।
দেরিতে হলেও বিশ্ব এখন সাড়া দিচ্ছে। লুসেন্স তথা ‘সেফ স্কুল’ নির্দেশমালায় সম্প্রতি স্বাক্ষর করেছে ৩০টি দেশ। নির্দেশমালায় সেনা কর্তৃপক্ষকে বলে দেয়া হয়েছে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করা রুখতে কী কী করতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের শিশু ও সশস্ত্র সংঘাতবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি লেইলা জেরুগুই বলেছেন, জাতিসংঘ মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদে যে বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করবেন তাতে স্কুলশিশুদের অপহরণের ঘটনাটিকে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর নাম যেন উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়া জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), গ্লোবাল কোয়াশিলন টু প্রটেক্ট এডুকেশন ফ্রম অ্যাটাক, গ্লোবাল বিজনেস কোয়ালিশন ফর এডুকেশন এবং নাইজেরিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী এনগোজি অকোনজো-ইওয়েলার অবদানে ভর করে নাইজেরিয়া নিরাপদ স্কুলের একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছে। এতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ও পাহারাব্যবস্থা জোরদারকরণে তহবিল জোগান দিতে হবে।
গত এক বছরে বিভিন্ন দেশে স্থানীয়ভাবে সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং শিশুদেরই প্রথম এই সহিংসতার শিকার হওয়ার (যা আমরা ভুলেও গেছি) ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমাদের এখন উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা বন্ধের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া। অন্ধকার যুগেও শিশুরা এবং তাদের বাবা-মায়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিরাপদ ও পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য করেছেন। আর যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে তখন মানুষের খাদ্য, আশ্রয় ও স্বাস্থ্যসেবার মতো বস্তুগত সহায়তার পাশাপাশি তাদের আশাও জোগাতে হয়। আর আমরা যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি সেটিকে সহিংসতামুক্ত রাখার কাজে স্কুুলগুলো সচল রাখার চেয়ে বড় আর কোনো শক্তিশালী অস্ত্র কি আমাদের আছে?
-লেখক ঃ সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের বিশেষ দূত (শিক্ষা)