অধ্যায় ৫
॥পর্ব ১॥
রোগ-ব্যাধির মূল কারণ ও প্রকৃত প্রতিকার
বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী প্রফেসর কার্টটেপার বলেছেন মানবদেহ হচ্ছে অশরীরী আধ্যাত্মিক চেতনার দৃশ্যমান প্রকাশ; আর রোগ হচ্ছে মানসিক আবেগের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার দৃশ্যমান প্রকাশ।
মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে মন ও মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বের ফলে রোগের উৎপত্তি হয়। মানব শরীর এমনভাবে নির্মিত যে মানুষ প্রশান্ত ও প্রাণবন্ত থাকলে, স্বাস্থ্যসম্মত-প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করলে নিরোগ ও দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হতে পারে। তখন দেহ ও মন নিজেই ঔষধ সৃষ্টি করতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ করতে পারে।
মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও নবী-রাসূলগণের মতে রোগ হচ্ছে আশীর্বাদ; ত্রুটি সংশোধনের সংকেতধ্বনি। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “মানুষের রোগবালাই তার আপন ত্রুটিগুলোর প্রতিকারের জন্যই ভবিষ্যতের সতর্ক সংকেত হিসেবে আবির্ভূত হয়।”
ইউরোপের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডাক্তার এডওয়ার্ড বেস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিল দাই সেলফ’ এ বলেছেন রোগকে আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ঠুর ও ভোগান্তির কারণ বলে মনে হলেও আসলে রোগ কল্যাণের বার্তা নিয়ে আসে; ভোগান্তিটা হচ্ছে সংশোধনের একটি শিক্ষা, যে শিক্ষা ইতিপূর্বে গ্রহণ করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
ঘাতক ব্যাধিসমূহের কারণঃ হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, আলসার, কনজেসটিভ হার্ট ফেইলিওর, করোনারী আর্টারী ব্লক, কোলাইটিস এনজাইনা, আর্থ্রাইটিস, অবিসিটি, গ্যাস্ট্রিক ইত্যাকার ঘাতক ব্যাধির কারণ কোনো জীবাণু বা ভাইরাস নয়; ভিটামিনের ঘাটতি নয়, অঙ্গ বৈকল্যও নয়। এসব রোগের মূল কারণ আর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক ঝামেলায় সৃষ্ট মানসিক চাপ, টেনশন, আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, ভয়, রাগ, হতাশা, ঘৃণা, প্রতিহিংসা ইত্যাকার মানসিক অবস্থা। তাই প্রায় সবক্ষেত্রেই মনোজগতের গোলযোগে দেহে রোগ প্রকাশ পায়। ডাক্তারি পরিভাষায় এসব রোগের নাম সাইকোসোমাটিক ডিজিজ বা মনোদৈহিক রোগ।
মাটি, আকাশ, বায়ু, আগুন ও পানি এই পঞ্চতত্ত্বে সৃষ্ট আমাদের স্থূূল দেহের চারদিকে ৩ থেকে ৮ ইঞ্চি ক্ষেত্রের মধ্যে আমাদের সূক্ষ্ম শরীর (এনার্জি বা অরিক বডি) এর অবস্থান; যাকে নূর, জ্যোতি বা আলোর বর্ডার তথা অঁৎধ ৎধহমব বলা হয়। এই অঁৎধ ৎধহমব বা সূক্ষ্ম শরীর আমাদের স্থূল শরীরের রক্ষাকবচ। এই সূক্ষ্ম শরীরে আছে ৭টি অদৃশ্য শক্তি চক্র সহস্র চক্র, আজ্ঞা চক্র, বিশুদ্ধ চক্র, অনাহুত চক্র, মনিপুর চক্র, স্বাধিষ্ঠান চক্র ও মূলধারার চক্র। রাশিয়ান বিজ্ঞানী সেমিয়ন ক্রিলিয়ন তাঁর ক্রিলিয়ন ফটোগ্রাফি দিয়ে এই সূক্ষ্ম শরীর ও ৭টি শক্তি চক্রের ফটো তুলে তা প্রমাণ করেছেন। কসমস বা মহাজগৎ থেকে এই ৭টি চক্রে সর্বদা প্রাণশক্তি আহরণ করে মানব শরীরে চক্রের সম অবস্থানে দৃশ্যমান ৭টি এন্ডোক্রিন গ্ল্যান্ডে (অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি) প্রাণশক্তি সরবরাহ করে চলছে। এন্ডোক্রিন গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হরমোন রক্তের সঙ্গে মিশে এই প্রাণশক্তিকে ছড়িয়ে দেয় সারা শরীরে। এই প্রাণশক্তির ওপরই আমাদের শরীর এবং মন ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সজীবতা ও বিকাশ পুরোপুরি নির্ভরশীল। রাগ, ক্ষোভ, টেনশন, ভয়, আতঙ্ক ইত্যাদি নেতিবাচক চিন্তার চাপ ব্যক্তির সূক্ষ্ম শরীরের ওপরই প্রথমে পড়ে। অতিরিক্ত মানসিক চাপে সূক্ষ্ম দেহের সুরক্ষা ছাকনি বা ফিল্টার ছিঁড়ে যায়। ফলে ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে গিয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। প্রাণশক্তি চক্র থেকে এন্ডোক্রিন গ্ল্যান্ডে পৌঁছাতে না পারার দরুন হরমোন ক্ষরণে তারতম্য ঘটে। ফলে রক্ত ও প্রাণশক্তির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয় এবং সেই বিশেষ গ্ল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে। রোগ সৃষ্টির মূল কারণ এটিই।
এরূপ বা অনুরূপ বিভিন্ন বিষয়ের বিবেচনায় দেখা যায় যে, সব অসুস্থতাই মনের রোগ; এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতিটি রোগ সৃষ্টির নেপথ্য কারণ রোগী নিজেই এবং রোগের দায়ও তারই।
সাধারণ রোগে করণীয়
অসুখ-বিসুখ হলে অস্থির ও হতাশ হতে নেই। এতে অসুখের প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে বা এক অসুখের সাথে আরেক অসুখ তৈরি হতে পারে।
যেমন মামুলি জ্বর বা সর্দি হলে আপনি যদি অস্থির ও হতাশ হয়ে পড়েন, তাহলে আপনার ব্রেন ও শরীরে তা এমন প্রভাব বা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যার কারণে বর্তমানের অসুখ কাটিয়ে ওঠা আপনার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়তে পারে এবং অসুখের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তৎপরিবর্তে আপনি অটোসাজেশন দিন অর্থাৎ বিভিন্ন ইতিবাচক কথা নিজকে বলতে থাকুন। যেমন, জ্বরের ক্ষেত্রে নিজকে প্রবোধ দিয়ে বলুন সাধারণ জ্বর হওয়া খারাপ নয়; জ্বরতো রোগ নয়...।
জ্বর সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) এর বাণী জ্বর পাপরাশিকে দূর করে; কামারের দোকানে মরচে পড়া লোহা পুড়িয়ে যেমনি ঝকঝকে পরিষ্কার করা হয়, তেমনি জ্বরের প্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেহ হয় পবিত্র। জ্বর হলে তিন দিনের মধ্যে ঔষধ সেবন করা উচিত নয়। তবে প্রাকৃতিক ঔষধ প্রয়োগ করা যেতে পারে। জ্বরের সময়ে বারংবার মাথায় পানি ঢালা, শরীর স্পঞ্জ করা, প্রচুর পানীয় পান অত্যাবশ্যক।
সর্দি হলে অটোসাজেশন দিয়ে নিজকে বলুন সর্দি হওয়া খারাপ নয়। সর্দি হচ্ছে ড্রেনেজ সিস্টেম। এতে আমাদের শরীরের রোগজীবাণু, ব্যাকটেরিয়া তরল আকারে বের হয়ে যায়।
উপরে বর্ণিত জ্বর ও সর্দির ন্যায় এমন অনেক রোগ আছে, যার দমন বা প্রতিরোধে অন্যকোনো মারাত্মক বা দুরারোগ্য ব্যাধি হতে পারে। যেমন কেমিক্যাল ঔষধ প্রয়োগে চর্মরোগ দমন বা প্রতিরোধ করলে ডায়াবেটিস এবং এজমা হতে পারে।
সাধারণ অসুখ-বিসুখে বিচলিত না হয়ে নিজকে বলবেন আমারতো দুরারোগ্য কোনো অসুখ হয়নি; তাই আমার অধৈর্য বা চিন্তিত হবার কারণ নেই; বরং স্রষ্টাকে ধন্যবাদ যে তিনি আমাকে দুরারোগ্য ব্যাধি দেননি, ...এভাবে পজিটিভ কথাবার্তা বলতে থাকলে অসন্তোষ বা হতাশা দূর হয়ে দ্রুত আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর নেগেটিভ কথা ও চিন্তা আরোগ্য লাভকে বিলম্বিত করতে থাকে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসুখ সহ্য করবেন ধৈর্য ধরে, যেমন আক্কেল দাঁত (ডরংফড়স ঃববঃয) ওঠার সময়ে ব্যথা হয় শরীরে পরিবর্তনের কারণে, এটি প্রাকৃতিক। কিন্তু আমরা ঔষধ খেয়ে ব্যথা থামিয়ে দেই, যা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কাজ।
আমার স্ত্রী ড. নাজনীন নেদারল্যান্ডে অধ্যয়নকালীন একবার তার আক্কেল দাঁতের প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়। এতে মাড়ি ও গাল ফুলে নীল হয়ে যায়। ব্যথায় অস্থির হয়ে ডাচ্ (উঁঃপয) ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার বললেন আক্কেল দাঁত মাড়ির ভেতর আটকে থাকায় ইনফেকশন হয়েছে। চিকিৎসা হিসেবে প্রেসক্রিপশনে লিখে দিলেন, ফোলা না কমা পর্যন্ত স্যালাইন ওয়াটার দিয়ে দিনে ৩ বার কুলকুচো করতে হবে। রোগী একদিকে ব্যাথায় কাতর, অন্যদিকে ডাক্তারের কর্মকা-ে হতবাক। কারণ, প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে দেখে ডাক্তার স্যালাইন ওয়াটার ছাড়া আর কোনো ঔষধ লিখেননি। তাই ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করল, ব্যথা কমার জন্য কোনো পেইন কিলার লিখেননি কেন। জবাবে ডাক্তার বললেন ব্যথা সহ্য করতে না পারলে আপনি পেইন কিলার খাবেন, কিন্তু আমি তা প্রেসক্রাইব করতে পারব না।
বিদেশ-বিভূঁইয়ের নিয়ম ও সংস্কৃতিতে পড়ে এবং ডাক্তারের এরূপ কথার অর্থ বুঝতে না পেরে পরদিন স্ত্রী তার ডাচ্ কলিগদের সাথে এ বিষয়টি নিয়ে আলাপ করল এবং জানতে চাইল, রোগীকে ব্যথায় এতটা কাতর দেখার পরও ডাক্তার কেন কোনো ঔষধ বিশেষত পেইন কিলার দিলেন না। জবাবে তারা বলল পেইন কিলার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, বিশেষত কিডনি ধ্বংস করে দেয়। তাই এরূপ ক্ষতিকর ঔষধ সে দেশের ডাক্তাররা সহজে প্রেসক্রাইব করেন না। সামান্য ব্যথাতে তারা পেইন কিলার না দিয়ে বরং ব্যথা সহ্য করার পরামর্শ দেন।
ইউরোপ বা উন্নত বিশ্বের ডাক্তাররা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঔষধ এড়িয়ে চলেন। ব্যথা-জ্বর-ঠান্ডা প্রভৃতিতে তারা শুধু বিভিন্ন পথ্যের পরামর্শ দেন। সেখানকার সমাজ-সংস্কৃতিতে মনে করা হয় যে ছোটবেলা থেকে মামুলি অসুখজনিত বিভিন্ন কষ্ট সহ্য করতে শিখলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, শরীর-মন শক্ত ও সুগঠিত হয়, সামান্যতে মুষড়ে পড়ে না।
বিকল্প চিকিৎসা বা প্রাকৃতিক চিকিৎসা
মানুষ প্রকৃতি থেকে তৈরি। প্রকৃতির সাথেই তার বসবাস, আবার জীবনাবসানে তাকে প্রকৃতিতেই বিলীন হতে হয়। তাই জৈবিক জীবনের সাথে অপ্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপাদানের মিশ্রণ সর্বদাই প্রতিক্রিয়াশীল। এ প্রতিক্রিয়ার ফলে মানুষের জীবন যখন বিপর্যস্ত, তখন বিশ্বব্যাপী চিন্তাশীলদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য, প্রকৃতিতে মিশে হও ধন্য।
মানব কল্যাণে নিবেদিত গবেষক ও চিন্তাশীলদের চেতনার লালনে বিশেষ মানুষরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে কেমিক্যাল ঔষধের বিকল্প চিকিৎসায় তথা প্রাকৃতিক চিকিৎসায়।
বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতার ল্যাবরেটরি ডায়াগনসিস, কেমিক্যাল ঔষধ আর অপারেশনের স্থান দখল করেছে অলটারনেটিভ মেডিসিন বা বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানী, ফ্রান্স, রাশিয়া তথা গোটা পাশ্চাত্য সভ্যতায় এলোপ্যাথিক ঔষধের ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ব্যর্থতার হাত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে মেডিটেশন, ইয়োগা, রেইকিসহ প্রাকৃতিক ও হারবালভিত্তিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন আধুনিক ধারা; যা বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে সমধিক পরিচিত।
আমেরিকার বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হার্বাট বেনসন তাঁর বিখ্যাত বেষ্টসেলার গ্রন্থ ‘রিলাক্সেশন রেসপন্স’ এ বলেছেন বিশ্বব্যাপী ডাক্তারদের কাছে যেসব রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন, তাদের ৮০ শতাংশই টেনশন ও মানসিক চাপগ্রস্ত; ঔষধ বা অপারেশনে এসব রোগ সারে না; বরং মনোদৈহিক চিকিৎসা যেমন মেডিটেশন, সাইকো থেরাপি, ইয়োগা, রেইকি ইত্যাদিই হচ্ছে এসব উপশমের একমাত্র ঔষধ।
বিশ্ববিখ্যাত কার্ডিওলজিষ্ট ডিন অর্নিশ বলেছেন ঔষধ বা কার্ডিও ভাসকুলার সার্জারী নয়; কেবল ইয়োগা, মেডিটেশন, লো-ফ্যাট ডায়েট ও স্ট্রেস ফ্রি লাইফ-স্টাইল হৃদরোগসহ সমস্ত ঘাতক ব্যাধি নিরাময়ের জন্য যথেষ্ট।
তাই রোগ প্রতিরোধ (চৎবাবহঃরড়হ) এবং রোগকে সমূলে ধ্বংস (ঈঁৎব) করার জন্য চাই নিয়মিত ব্যায়াম, প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও বিকল্প চিকিৎসা; যার প্রত্যেকটি বিষয় ক্রমান্বয়ে উপস্থাপিত হবে।
চলবে।