॥ পূর্ব প্রকাশিতের পর -৩৮ ॥
॥পর্ব ২॥
কেমিক্যাল ঔষধের প্রভাব
নিম্নমানের ঔষধঃ জীবন নিয়ে জুয়া
কোনো ঔষধের পরিমাণ ও গুণগত মান যা থাকার কথা, তার চেয়ে কম থাকলে তাকে নিম্নমানের ঔষধ বলা হয়। নিম্নমানের ঔষধ সেবন করলে একজন রোগী বহুবিধ ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।
ঔষধের পরিবর্তে কোনো ট্যাবলেট শুধু চক বা চুনাপাথর দিয়ে প্রস্তুত করা হলে রোগীর কী অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কোনো এন্টিবায়োটিক নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম পরিমাণের ঔষধ দিয়ে প্রস্তুত করা হলে জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং একসময় এন্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়বে। জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর এন্টিবায়োটিকের অভাবে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও মৃত্যুবরণ করতে পারে। ফলে দরিদ্র, অসহায়, নিরীহ মানুষ তথা জাতি আর্থিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের শতকরা ৮৫ ভাগ ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ম মানছে না। তাদের মতে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ঔষধ যেকোনো সময় দেশে ভয়াবহ স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কিন্তু দুর্বল নজরদারির কারণে নিম্নমানের ঔষধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করা যাচ্ছে না। এদের উৎপাদিত যে ঔষধে ৫০০ মিলিগ্রাম লেখা থাকে, সে ঔষধে আদতে কতটুকু কী আছে, তাও প্রতিষ্ঠানগুলো পরিমাপ করতে পারছে না।
কমিটির প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন ঔষধ উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠানই নিয়ম-কানুন মানছে না। এ প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ঔষধ উৎপাদন করছে, সেগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। হয়ত এসব ঔষধের কারণে মারাও যাচ্ছে অনেকে। খতিয়ে দেখা না হওয়ায় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় এর প্রতিকারও হচ্ছে না।
আর তাইতো ২০০৩ সাল থেকে ঢাকার শান্তিনগরে একটি আবাসিক ভবনের ছোট ঘরে নোংরা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ট্যালকম পাউডার আর আটা দিয়ে তৈরি হচ্ছে ক্যাপসুল। দেশের অভ্যন্তরীণ মার্কেটে প্রতিবছর প্রায় ৬০০ কোটি টাকার ভেজাল ঔষধ বিক্রি হচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে জানা গেছে।
এন্টিবায়োটিকে ভ্রান্ত বিশ্বাস
ঠান্ডাজনিত সর্দি-কাশি সারাতে এন্টিবায়োটিক বেশ কার্যকর ঔষধ এমন ধারণা ও বিশ্বাস মোটামুটি সবারই। তাই অনেক সময় ঠান্ডা লাগলেই অনেকে ডাক্তার না দেখিয়েই পরিচিত কিছু এন্টিবায়োটিক ঔষধ খেয়ে থাকে। সম্প্রতি গবেষকরা বলছেন এন্টিবায়োটিকের ওপর এমন বিশ্বাস অহেতুক, কেননা এ ধরনের ঔষধ অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর নয়।
দি ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল এর গবেষকরা জানিয়েছেন, কিছু ভাইরাস রয়েছে যেগুলো শ্বাসনালিতে সংক্রমণ ঘটায়। এদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ঔষধের তেমন কোনো কার্যকারিতা নেই। আরো অনেক এন্টিবায়োটিক আছে, যেগুলোর অনিয়মিত ও ভুল প্রয়োগ রোগীর শরীরে ঐ ঔষধকে পরে অকার্যকর করে তোলে।
ড. ক্লিওডনা ম্যাকনালটি জানিয়েছেন, রোগের প্রভাব ও সুস্থ দেহের গুরুত্ব অনুধাবন করে রোগীদের উচিত নিজে নিজেই ঔষধ খাওয়ার অভ্যাস পরিহার করা। কেননা এন্টিবায়োটিক ঔষধ সম্পর্কে যেসব ধারণা প্রচলিত আছে, সেগুলোর বেশিরভাগই ভুল। এক্ষেত্রে উচিত হবে, কোনো সমস্যা অনুভব করলে ঔষধ খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
পেইন কিলার
ক্যান্সারসহ বহু রোগের জন্মদাতা
শরীরের কোথাও ব্যথা অনুভূত হলে সচরাচর অনেকেই ব্যথানাশক ঔষধ অর্থাৎ পেইন কিলার খান ব্যথা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে। অথচ ব্যথা বা যন্ত্রণা উপশমের জন্য পেইন কিলার গ্রহণ মোটেই নিরাপদ নয়।
অতিরিক্ত যন্ত্রণা লাঘবের জন্য পেইন কিলার গ্রহণের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা; যাতে রোগী যন্ত্রণা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি পেতে পারে। অথচ এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে (৪ থেকে ২০ বছর) পেইন কিলার গ্রহণ করতে অভ্যস্ত তাদের রেনাল গ্রন্থিতে (বৃক্ক গ্রন্থি) ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
পায়ের তালুর গ্রন্থিতে মটন নিউরোমা নামে পেশি ফুলে ওঠার কারণে তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হয় বলে জানান কেয়ার বালডার (৪০) নামে এক নারী। চিকিৎসকরা তাকে ব্যথা নিরসনের জন্য পেইন কিলার খাওয়ার পরামর্শ দেন। পরপর ৬ দিন কেয়ার উল্লিখিত ঔষধ সেবন করেন। ব্যথা সারলেও তিনি পেটে যন্ত্রণা অনুভব করেন। পরীক্ষা করে দেখা যায় তার পাকস্থলীর আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাত মাস পরও তিনি একই রকম ব্যথা অনুভব করছেন। অর্থাৎ যে ঔষধ সেবন করে কেউ একদিকে এক ব্যথা থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে, অন্যদিকে সেই ঔষধই তাকে নতুন আরেকটি রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটি সাইড এফেক্ট বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বিষয়টা যে গুরুতর তাতে সন্দেহ নেই। পেইন কিলার সেবন করে রোগীর দেহে আলসারের মতো নানা জটিল রোগের জন্ম হতে পারে। অতএব, পেইন কিলারকে গুডবাই জানানোই শ্রেয়।
এসপিরিনে অন্ধত্বের ঝুঁকি
হৃদরোগে আক্রান্তদের এসপিরিন জাতীয় ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন ডাক্তাররা। কেননা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট মাত্রার এসপিরিন সেবনে স্ট্রোক অথবা হার্ট এটাকের ঝুঁকি কমে। এতে ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমে বলে বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে। কিন্তু নতুন এক গবেষণার ফল বলছে, দীর্ঘদিন এসপিরিন সেবনে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে; এমনকি অন্ধত্বেরও ঝুঁকি রয়েছে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। ষাটোর্ধ্ব ২ হাজার ৩৮৯ জনের ওপর পর্যবেক্ষণ করে তারা জানান, এসপিরিন সেবনকারীদের মধ্যে দৃষ্টিশক্তির সমস্যা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ।
ক্যালসিয়াম ঔষধ প্রাণঘাতী
শরীরের অপরিহার্য রাসায়নিক উপাদান ক্যালসিয়াম। বিভিন্ন খাদ্যের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে আমরা এ উপাদান পেয়ে থাকি। তবে অনেকের শরীরে এটি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়। তখন চিকিৎসকরা ক্যালসিয়াম সাপলিমেন্ট বা ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেন। এভাবে যারা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সেবন করেন, তাদের মৃত্যুঝুঁকি সাধারণদের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি।
কিডনি রোগীদের শরীরে ফসফরাসের মাত্রা কমাতে দীর্ঘমেয়াদে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট গ্রহণের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এতে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। গবেষকরা জানিয়েছেন, কিছু ক্যালসিয়াম রক্তধারায় শোষিত হয়। ফলে ধমনীর কাজে বিঘœ ঘটে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়; এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এ কারণেই কিডনি রোগীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হৃদযন্ত্র বিকল হওয়া।
ঘুমের ঔষধে মৃত্যুঝুঁকি
শরীর সুস্থ ও সতেজ রাখতে ঘুমের বিকল্প নেই। ডাক্তাররা বলেন, প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। তবে ঔষধ খেয়ে ঘুমাতে যাওয়া মোটেই উচিত নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের ঔষধের কারণে অকালমৃত্যুর ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় চালানো গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যারা উচ্চমাত্রায় ঘুমের বড়ি খায়, তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি থাকে।
ঔষধে বুদ্ধি বাড়াতে মানা
সব মানুষই চায় তার মেধাশক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও মনোযোগ খুব প্রখর হোক। কিন্তু মানুষের বুদ্ধিমত্তার (আইকিউ) একটা সর্বোচ্চ সীমা আছে। এই সীমা সবার জন্য একই নয়। কারও আইকিউ খুব বেশি, কারও মধ্যম মানের, আবার কারও একেবারেই দুর্বল। সে কারণেই সমাজে উত্তম, মধ্যম ও নিম্ন বুদ্ধিমত্তার লোক দেখা যায়। এই যখন বাস্তবতা, তখন অনেকেই মেধাশক্তি বাড়ানোর জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়; রিটানিল ট্যাবলেট ও এমফিটামিন জাতীয় ঔষধ সেবন করে। ব্রেনের শক্তি বাড়ানোর এসব ঔষধে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানী টমাস হিলস এবং সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণাকারী রালফ থার্টউইগ সম্প্রতি যৌথভাবে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। দু’জনেরই অভিমত, মায়ের পেটে থাকতেই শিশুর মস্তিষ্কের মূল কাঠামোর প্রায় পুরোটাই গঠন হয়ে যায়। এর সঙ্গে যোগ হয় গর্ভস্থ সন্তানের বাবা-মায়ের বংশগতির জিন-বৈশিষ্ট্য। এরপর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরিবেশ, পুষ্টিমান, সুস্থতা ও শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও স্মরণশক্তির বিকাশ। এক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে মেধাশক্তি বাড়ানোর তেমন কোনো গ্রহণযোগ্য উপায় নেই। বরং এক্ষেত্রে ডাক্তারি ঔষধে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই থাকে বেশি।
মাল্টি ভিটামিন ফর নাথিং
মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বিজ্ঞানীদের গবেষণার কমতি নেই। তারা ইতোমধ্যেই উদ্ভাবন করেছেন নানা রকমের বড়ি, যা মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজতর করে তুলেছে। তেমনি একটি হচ্ছে ‘মাল্টি ভিটামিন’ বড়ি। এটি মানুষের শরীরে পুষ্টির মাত্রা দ্রুত বাড়াতে সক্ষম। পুষ্টির মাত্রা বাড়াতে সহজ পথ হিসেবে এতদিন এ বড়িই ব্যবহার হয়ে আসছিল। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ভিটামিন ঔষধ গ্রহণ এবং ভিটামিনের সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ মানুষের আয়ু কমিয়ে দেয়। মাল্টি ভিটামিন বড়ি শরীরের আদৌ কোনো কাজে আসে না; এ বড়ি যারা খায় তারা শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে বা জলে ফেলে।
ফ্রান্সের ন্যান্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ৮ হাজার মানুষের ওপর ৬ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে মাল্টি ভিটামিন বড়ির কার্যকারিতার এমনই চিত্র দেখতে পেয়েছেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষণায় অংশ নেয়া ব্যক্তিদের প্রথমে দু’দলে ভাগ করা হয়। একদলকে বাজারে পাওয়া মাল্টি ভিটামিন এবং অন্যদলকে ‘নকল’ (প্রতিরূপ) বড়ি খেতে দেয়া হয়। দেখা যায় যারা প্রকৃত বড়ি সেবন করেনি, তাদের কারো কারো যেমন হার্টের অসুখ ও ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা দিয়েছে; তেমনি যারা মাল্টি ভিটামিন বড়ি সেবন করেছে তারাও এ ধরনের রোগ থেকে রেহাই পায়নি। আর সুস্থতার ব্যাপারে দু’দলের ফলাফলে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না।
যুক্তরাজ্যের সেন্ট জর্জ হাসপাতালের ক্যাথেরিন কলিন্স বলেন আলঝেইমার, হার্ট এটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে যারা মাল্টি ভিটামিন সেবন করে তাদের জন্য এটি বেশ উদ্বিগ্ন হওয়ার মতোই খবর।
কার্যকর ঔষধের যুগ শেষ
বিশ্ব এমন এক যুগে প্রবেশ করছে, যেখানে আহত হওয়ার ঘটনা অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে এখন সামান্য হাঁটুর ব্যথা থেকেই শিশুর মৃত্যু হতে পারে। বেঁচে থাকার জন্য হাসপাতালে জীবন বাজি রাখতে হচ্ছে রোগীদের। নিয়মিত অস্ত্রোপচারগুলোও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান মার্গারেট চান এ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে মার্গারেট চান বলেন, প্রচলিত এন্টিবায়োটিক ঔষধ এখন সাধারণ সংক্রমণের জন্য দায়ী জীবাণুও ধ্বংস করতে পারছে না। এ কারণে বিশ্বব্যাপী এন্টিবায়োটিক সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে সাধারণ সংক্রমণও এখন সারানোর অযোগ্য হয়ে উঠছে।
তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত উদ্ভাবন করা প্রতিটি এন্টিবায়োটিক এখন অকার্যকর হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। পোস্ট-এন্টিবায়োটিক যুগ মানে হচ্ছে আমরা যেসব আধুনিক ঔষধের কথা জানি, সেগুলোর যুগ শেষ হয়ে আসা। বিষয় এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, গলার ঘা কিংবা হাঁটুর আঘাত থেকেও মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
জনপ্রিয় ঔষধে মারাত্মক ঝুঁকি
অসুখ হলেই অনেকে নামিদামি এন্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষধ খেতে থাকেন। শুধু রোগী নয়, অনেক চিকিৎসকও এসব ঔষধ সেবনে রোগীকে পরামর্শ দেন। কিন্তু নামিদামি দুর্লভ এসব এন্টিবায়োটিক সেবন মানুষের হৃদযন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা।
হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায় এজিথ্রোমাইসিন
বহু ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক ঔষধ এজিথ্রোমাইসিন হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এ দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বাজারেও দেশি-বিদেশি ৬৭টি প্রতিষ্ঠানের ১৩৭টি ব্র্যান্ডের এজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক ঔষধ আছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায় এসব ঔষধ ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা সিরাপরূপে তৈরি, যা বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায় ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, কানের সংক্রমণ ও যৌন রোগের চিকিৎসায় এজিথ্রোমাইসিন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আশির দশকে বিশ্বব্যাপী এর বাজারজাত শুরু হয়। এটি মানবদেহে বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধ করে। কয়েক দশক ধরে ঔষধটি ব্যবহৃত হয়ে এলেও রোগীদের ওপর এর মারাত্মক প্রভাবের বিষয়টি এই প্রথমবারের মতো নজরে আনলেন গবেষকরা। পরীক্ষায় দেখা যায়, অন্য এন্টিবায়োটিকের চেয়ে বা যারা কোনো এন্টিবায়োটিক নেয়নি এমন রোগীদের তুলনায় এজিথ্রোমাইসিন ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে প্রথম ৫ দিনে হৃদরোগের ঝুঁকি আড়াই গুণ বেশি।
গবেষণাটি চালান যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এ গ্রুপের আরেকটি বিকল্প এন্টিবায়োটিক হচ্ছে এমোক্সিসিলিন। এমোক্সিসিলিন গ্রহণকারী রোগীদের চেয়ে এজিথ্রোমাইসিন গ্রহণকারীদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি, প্রতি ১০ লাখে ৪৭ জন। অন্যদিকে হৃদরোগ আছে এমন রোগীদের মধ্যে যারা এমোক্সিসিলিন গ্রুপের ঔষধ নিয়েছে, তাদের তুলনায় এজিথ্রোমাইসিন নেয়া রোগীদের মৃত্যুর ঘটনা প্রতি ১০ লাখে ২৪৫ জন পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ১৯৯২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় টেনেসি অঙ্গরাজ্যে এজিথ্রোমাইসিন গ্রহণকারী ৩ লাখ ৪৮ হাজার রোগীর প্রেসক্রিপশন সংগ্রহ করে এ গবেষণা চালান। তারা ঔষধটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও রোগীদের এর ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
দীর্ঘায়ু হতে শিশুরাও কি ঔষধ নির্ভর হবে?
গত একশ’ বছরে মানুষের গড় আয়ুর ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে মানুষের মৃত্যুহার কমেছে, মানুষ দীর্ঘজীবন লাভ করছে। কিন্তু সেই দীর্ঘজীবন কেমন হচ্ছে? বেশিদিন বেঁচে থাকার জন্য কি আরো বেশি মূল্য দিতে হবে, ঔষধের ওপর আরো বেশি নির্ভরতা তৈরি হবে মানুষের?
গবেষকরা বলছেন মানুষের জীবন যত দীর্ঘ হবে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ও ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে। তবে ঔষধের মাধ্যমে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। পাশাপাশি তাদের উপসর্গও কমানো সম্ভব। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হলো, বেশিদিন বাঁচতে হলে ঔষধের ওপর মানুষের নির্ভরতা অনেক বেড়ে যাবে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন এজিংয়ের পরিচালক সারাহ হারপার বলেন মানুষকে দীর্ঘ আয়ু দিতে চাইলে তার পেছনে খরচও বাড়াতে হবে। আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে যে আমরা এমন ভবিষ্যৎ চাই কিনা যেখানে অল্প বয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা ঔষধের ওপর নির্ভরতা ক্রমেই বাড়াবে; আর স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, ধূমপান বর্জন, এলকোহল কমানো এবং নিয়মিত শরীরচর্চার মতো অভ্যাসগুলো থেকে দূরে থাকবে। তিনি প্রশ্ন করেন, আমরা কি চাইব যে দীর্ঘ আয়ুর জন্য ১০ বছর বয়সি ছেলেমেয়েরাও ঔষধমুখী হোক? বিষয়টি ভেবে দেখবার মতো।
চলবে।