॥ ভবতোষ কুমার সরকার ॥
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ
ক্যাম্পাস’র বহুমূখী কার্যক্রমের মধ্যে ‘বাৎসরিক ক্যাম্পেইন’ অন্যতম। সাধারণত ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে এই ক্যাম্পেইন শুরু হয়। এবছর আমিও সেই ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করি। প্রথম দিন আমরা গেলাম সেগুনবাগিচা ১২ তলা বিল্ডিংয়ে; আট জনের একটা টিম ছিল সেদিন। শুরুতে কাজ সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝছিলাম না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অজানা এক্সাইটমেন্ট বা উদ্দীপনা কাজ করছিল। তবে এর আগে একদিন ক্যালেন্ডার লাগানোর নিয়ম প্র্যাকটিস করেছিলাম অফিসের ভেতরেই। তাই কোথায় কোথায় ক্যালেন্ডার লাগাতে হবে, এটা অন্তত বুঝতে পারছিলাম। আমরা সাথে করে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওয়াল ক্যালেন্ডার, টেবিল ক্যালেন্ডার, গ্রিটিংস কার্ড, পকেট ক্যালেন্ডার, পত্রিকা, ডেস্কস্লিপ এবং স্কচটেপ ও টেপস্ট্যান্ড নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা দু’টি বড় ব্যাগ একেবারে ঠাসা ভর্তি করে এবং দুই বান্ডিল ক্যালেন্ডারসহ গিয়েছিলাম। প্রতি বান্ডেলে থাকে ৫০০ ক্যালেন্ডার। সেদিন আমরা ঐ এলাকার বড় বড় অফিসের প্রতিটি রুমে গিয়ে নতুন বছরের ক্যালেন্ডার লাগাই। শুধু তাই নয়, ডেজিগ্নেশন অনুযায়ী আমরা অফিসারদেরকে গ্রীটিংস কার্ড, টেবিল ক্যালেন্ডার, পকেট ক্যালেন্ডার আর ডেস্কস্লিপ দেই। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে আমরা একটা কানাকড়িও নেই না। আমার খুব অবাক লাগছিল- এত টাকা খরচ করে, এত পরিশ্রম করে প্রত্যেকটি অফিসে বিনামূল্যে এত্তসব দেয়া হচ্ছে; অথচ তাদের কাছ থেকে বিনিময়ে কিছুই নেয়া হচ্ছে না!
এভাবে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আমাদের ক্যাম্পেইন চলতে থাকলো। পুরো ঢাকা শহরের ও শহরের বাইরের প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে আমাদের ক্যাম্পেইন চললো। শুধু সরকারি নয়, আমরা অনেক বেসরকারি অফিসে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েও ক্যাম্পেইন করেছি। অনেকে অবাক হয়ে প্রশ্নও করতো, আমরা এত কিছু কেন বিনামূল্যে দিচ্ছি! এই প্রশ্নটা অবশ্য আমার মাথায়ও ঘুরপাক খেত। অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ক্যালেন্ডার তৈরি করে। কিন্তু এভাবে নিজেদের গাঁটের টাকা খরচ করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, প্রতিটি অফিসে ঘুরে ঘুরে এত নিখুঁত ও সুচারুভাবে এবং অতি যত্নসহকারে নিজেরাই ক্যালেন্ডার লাগিয়ে দেয় না। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাসই শুধু ব্যতিক্রম। বিশেষতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে দৈনিক পকেট মানি, যাতায়াত ভাড়া, আবাসিক হোটেল ভাড়া, তিনবেলা খাবার খরচসহ যাবতীয় ব্যয় বহন করে। এরূপ কার্য সম্পাদন শুধু ব্যতিক্রমই নয়, বিস্ময়করও বটে। কিছুদিন সচ্ছন্দে কাজ করার পর আমি আবিষ্কার করা শুরু করলাম- গত ৩০ বছর ধরে পরিচালিত ক্যাম্পাস’র এ কার্যক্রমের এত জনপ্রিয়তার হেতু কী। ক্যাম্পাস এ কাজ অত্যন্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সাথে এবং জনমানুষের কল্যাণে করে থাকে -তাই এত জনপ্রিয়তা।
এতো গেল ঢাকার ভেতরের ক্যাম্পেইন। ক্যাম্পাস’র এই কার্যক্রম শুধু ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকার বাইরের জেলা গুলোতেও সমানতালে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়। আমি ঢাকার বাইরের সবগুলো ক্যাম্পেইনে যাইনি। তারপরও আমি যে সমস্ত জেলাগুলোতে গিয়েছি, তার লিস্টও নেহাতই কম নয়। আমি ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলোর মধ্যে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ গিয়েছি। ঢাকা বিভাগের বাইরে প্রথমেই গিয়েছি সিলেটে। সেখানে তিন দিনে আমরা ৫ জেলাতে ক্যাম্পেইন করি। সিলেটে আমরা ৪ জনের একটা টিম গিয়েছিলাম। আগেরদিন রাত সাড়ে এগারটার দিকে ফকিরাপুল থেকে আমাদের বাস ছাড়ল। সিলেটে যখন পৌঁছাই, তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে। সকালেই আমরা বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা হোটেল ভাড়া নেই। তারপর ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই ক্যাম্পেইনে বেড়িয়ে পড়ি। প্রথমদিন সবাই মিলেই সিলেটে ক্যাম্পেইন করি। পরেরদিন সকাল ছয়টার বাসে দু’জন হবিগঞ্জ আর দু’জন মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। আমি এবং ক্যাম্পাস’র সিনিয়র এক্সিকিউটিভ রানা ভাই হবিগঞ্জে যাই। যাত্রাপথে আমি বাসের জানালা দিয়ে রাস্তার দু’পাশের অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখছিলাম। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ! কি মনোমুগ্ধকর সেই প্রাকৃতিক দৃশ্য! সৃষ্টিকর্তা কতই না সুন্দর করে এই পৃথিবীটাকে সৃষ্টি করেছেন আমাদের জন্য! সেদিন হবিগঞ্জ পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে যায়। তাই ব্রেকফাস্ট না করেই আমরা ক্যাম্পেপইন শুরু করে দেই। কারণ, ব্রেকফাস্ট করতে বসলে জজকোর্টের এজলাস বসে যাবে; তখন আর আদালত কক্ষে প্রবেশ করা যাবে না। তাই জজকোর্ট শেষ করে তারপর আমরা ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ একসাথেই সেরে ফেললাম। কাজ শেষ করে আবার বিকেলেই রওয়ানা হই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে। বাকি দু’জনও মৌলভীবাজারে তাদের কাজ শেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রওয়ানা দেয়। অপর দু’জনের আসতে একটু দেরি হওয়ায় সেদিন হোটেল পেতে পেতে রাত সাড়ে দশটা বেজে যায়। আবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে রেডি হয়ে কিশোরগঞ্জ চলে যাই। বাকি দু’জন সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ই কাজ করল। কিশোরগঞ্জে সারাদিন কাজ শেষে আবার সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। বাকি দু’জনও তাদের কাজ শেষে নিজেদের মতো করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। এভাবেই সিলেট ক্যাম্পেইন শেষ হলো।
পরের সপ্তাহে গেলাম খুলনা বিভাগ। সেখানে চারদিনে আমরা ছয় জেলাতে ক্যাম্পেইন করি। খুলনা, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর ও রাজবাড়ি। খুলনাতে কাজ শেষ করে বিকেলে যখন যশোর যাচ্ছিলাম, তখন পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্ত থেকে সূর্য উঁকি মারছিল। আমার মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল সেই দৃশ্য। কত বছর ধরে যে এমন দৃশ্য দেখিনি! শহরে থাকা অবস্থায় কবে শেষ আকাশ দেখেছি, তাইতো মনে করতে পারছিলাম না। যাহোক, খুলনা ট্যুর শেষ করে পরের সপ্তাহে আবার রাজশাহী। সেখানে পাঁচদিন ছিলাম আমরা। এই পাঁচদিনে আমরা রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্যাম্পেইন করি। রাজশাহীতে দুই দিনের ক্যাম্পেইন শেষে আমরা পদ্মার পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। তখন সূর্যের শেষ আভাটুকু দেখা যাচ্ছিল। পরিবেশটা এত মায়াময় লাগছিল যে, সেই দৃশ্যটাকে ক্যামেরাবন্দি করার লোভ সামলাতে পারলাম না। কী অপরূপ সেই দৃশ্য! আমার সারাদিনের ক্লান্তি একনিমেষে দূর হয়ে গেল।
শেষের দিন আমাদের কুষ্টিয়া থেকে দু’জনের যাওয়ার কথা ছিল সিরাজগঞ্জ আর দু’জনের বগুড়া। কিন্তু কুষ্টিয়া থেকে রাস্তা খারাপ হওয়ার কারণে সিরাজগঞ্জ বা বগুড়া যাওয়ার কোনো বাসই ছাড়ছিল না। উপায়ন্তর না দেখে ক্যাম্পেইনের প্রধান পরিকল্পনাকারী ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক ড. এম হেলাল স্যারকে ফোন দেয়া হলো। পরে স্যারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দু’জন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। আমি আর রানা ভাই থেকে গেলাম এবং তখনই আবার রওয়ানা হলাম চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে কাজ শেষ করে বিকেলে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সেদিন ঢাকা এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আড়াইটা বেজে গেল।
পরের দিন শুক্রবার ছুটি ছিল। শনিবারে আবার ট্যুর। এবার বরিশাল। লঞ্চে করে যেতে হবে। নদীপথের জার্নিগুলো আমার কাছে বরাবরই খুব রোমাঞ্চকর। তাই বরিশালের কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে এক্সাইটেড হয়ে গেলাম। যথাসময়ে আমরা তোপখানা রোডে অফিসের নীচ থেকে সিএনজি যোগে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। তখনো জানা ছিল না, সামনে আমার জন্য একটা চমক অপেক্ষা করছে। সদরঘাটে পৌঁছেতো আমার চোখ ছানাবড়া। চারদিকে শুধু লঞ্চ আর লঞ্চ! কোনোটা ছোট আবার কোনোটা বিশাল বড়। কোনোটা দোতলাতো কোনোটা আবার তিন তলা/চার তলা। আমাদেরটা ছিল তিন তলা বিশিষ্ট। নাম ছিল-সুরভী ৭। এত বড় লঞ্চ আমি সামনাসামনি এর আগে কখনো দেখিনি। আমার কেন জানি টাইটানিক মুভির কথা মনে পড়ে গেল। একটা কেবিন ভাড়া নিয়ে আমরা লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চের ছাদে ছিল নামাজের স্থান। তাই বাকী তিনজন যখন নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে ছাদে যাচ্ছিল, আমিও তাদের সাথে গেলাম। এতবড় লঞ্চে উঠে এমনিতেই আগে থেকে অনেক এক্সাইটেড ছিলাম, ছাদে উঠে তা দ্বিগুণ হয়ে গেল। ছাদে উঠে যখন চারদিকে তাকালাম, আমি আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলাম। রাতের অন্ধকার আর সারি সারি লঞ্চের ভেতরকার আলো মিলে আমার কাছে এক স্বর্গীয় পরিবেশ অনুভূত হচ্ছিল। সে সময়কার অনুভূতি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার ইচ্ছে করছিল, সারারাত ছাদে বসে রাতের সেই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করি। কিন্তু তা আর করা হলো না। কারণ, রাতে না ঘুমালে পরের দিন সকালে ঠিকমতো কাজ করতে পারব না। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাত জেগে সেইরাতের সৌন্দর্যটা উপভোগ করা হলো না। মনের সেই সুপ্ত ইচ্ছা বা বাসনা আমার মনে এখনো রয়ে গেছে। কোনো একদিন তা আমি পূরণ করবই। যাহোক, আমরা ভোরে গিয়ে বরিশাল পৌঁছালাম এবং নদীর ধারেই একটা হোটেলে উঠলাম। জানতে পারলাম ওটা কীর্তনখোলা নদী, যার নাম আমি বিভিন্ন সময় অসংখ্যবার শুনেছি বা বিভিন্ন বইতে পড়েছি। আমাদের হোটেল থেকে রাতে জানালা দিয়ে তাকালে নদীর এক আলাদা সৌন্দর্য্য দেখা যেত। মনোমুগ্ধকর সে সৌন্দর্য।
এভাবে টানা ৩ মাস ধরে ঢাকাসহ একে একে প্রায় ৩০টি জেলাতে আমি ক্যাম্পেইন করলাম। প্রতিটি ক্যাম্পেইনেই ক্যাম্পাস’র সহকারী পরিচালক কামাল ভাই, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ রানা ভাই এবং আমি থাকতাম আর সাথে শিক্ষানবিশ হিসেবে একেক সময় একেকজন থাকত। তবে শেষের ক্যাম্পেইনটা ছিল একটু অন্যরকম। সিরাজগঞ্জ, রংপুর এবং দিনাজপুর -এই তিন জেলাতে। এই ক্যাম্পেইনে দু’জন ছিলাম; আমি আর রানা ভাই। ২৬ মার্চ ছিল আমাদের ট্যুর। অফিস বন্ধ ছিল। পূর্বের কথা অনুযায়ী সেদিন সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে অফিসের নীচে এসে পৌঁছালাম। প্রথমে রিক্সাযোগে কমলাপুর বাসস্ট্যান্ড শ্যামলী কাউন্টারে গেলাম। সেখান থেকে কাউন্টারের নিজস্ব ছোটবাস এসে আমাদের নিয়ে গেল কল্যাণপুর তাদের মেইন কাউন্টারে। সেখান থেকে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে আমাদের বাস ছাড়ল রাত সাড়ে এগারটায়। আগে থেকেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা ছিল খাজা ইউনুস আলী ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার এম এ রশিদ স্যারের বাসায়। ওটা অবশ্য ইউনিভার্সিটির নিজস্ব কোয়ার্টার ছিল, খাজা ইউনুস মেডিকেল কলেজের বাউন্ডারীর ভেতরে। কথা ছিল, আমরা সিরাজগঞ্জ পৌঁছেই রশিদ স্যারকে ফোন দিব; উনি লোক পাঠাবেন। কিন্তু সিরাজগঞ্জ (কড্ডার মোর) যখন পৌঁছালাম, তখন ভোর চারটা বাজে। অত রাতে আর ফোন দিয়ে কাউকে ডিস্টার্ব করতে চাইলাম না। তাই এক ঘন্টার মতো রাস্তার পাশের একটা বন্ধ দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে থাকলাম। একঘন্টা পর আমরা একটা লোকাল টেম্পোতে করে নিয়ামতপুর (ট্রেজারার স্যারের বাসার কাছে) পৌঁছালাম। আমি বসেছিলাম চালকের ডান পাশের সীটে। সারাটা রাস্তা সকালের ঠান্ডা বাতাস আমার গায়ে হুল ফুটাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে আমার সঙ্গে থাকা লুঙ্গিটাকেই চাদর বানিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম। যাহোক, মেডিকেল কলেজের গেটের সামনে গিয়ে আমরা রশিদ স্যারকে ফোন দিয়ে আমাদের পৌঁছানোর খবর জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি একটি ছেলেকে পাঠিয়ে আমাদের নিয়ে গেলেন। দোতলায় ছিল উনার বাসা। বেশ বড়ই ছিল বাসাটা। ঢুকতে প্রথমেই বিশাল বড় একটা ড্রইংরুম, আর শেষের দিকে দুই পাশে দুইটা বেডরুম। ছেলেটি ইউনিভার্সিটিতেই পিয়ন হিসেবে কাজ করে। স্যার ছেলেটিকে নিয়ে একাই থাকেন ওখানে। ফ্যামিলি ঢাকায় থাকার কারণে উনাকে মেসে খেতে হয়। যাহোক, ফ্রেশ হয়ে স্যারের সাথেই আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম এবং নয়টার দিকে উনার সাথেই ভার্সিটির নিজস্ব বাসে করে ভার্সিটিতে গেলাম। ভার্সিটির কাজ শেষ করে সেখান থেকেই আমরা শহরে চলে গেলাম। কাজ শেষে আবার ফিরে এলাম তাঁর বাসায়। রাতে খুব ভালো একটা ডিনার করলাম। খাবারের মান খুব ভালো ছিল। মেসের খাবারের মান যে এত ভালো হতে পারে, তা আগে আমার ধারণা ছিল না। ডিনার শেষে উনি আমাদের পুরো এরিয়াটা ঘুরিয়ে দেখালেন। পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই আবার দৌড়। টিকেট আগেই কেটে রেখেছিলাম। সকাল ছয়টায় বাস ছাড়লো; গন্তব্য রংপুর। সিরাজগঞ্জ থেকে রংপুরের দুরত্ব যে এত বেশি তা আমাদের কারোরই জানা ছিল না। রংপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর পৌনে বারটা বেজে গেল। দু’জনে দৌড়ে দৌড়ে কাজ করলাম ব্রেকফাস্ট না করেই। যথারীতি এবারও সকাল ও দুপুরের খাবার একবারেই সেরে নিলাম। কাজ শেষে বিকেলেই আবার রওয়ানা হলাম দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে। পরেরদিন দিনাজপুর থেকে কাজ শেষ করে আবার ঢাকার বাসে উঠে পড়লাম। এবার ঢাকায় এসে পৌঁছালাম পরের দিন সকাল নয়টায়! এ বছরের ক্যাম্পেইন এভাবেই শেষ হলো।
আমরা এই ক্যাম্পেইনের সময়গুলোতে অনেক পরিশ্রম করেছি, রেস্টের কথা চিন্তা করিনি। কিন্তু তেমন কোনো ক্লান্তি অনুভব করিনি কখনো। তার কারণ হলো, এই কাজের ভেতরে কেমন যেন একটা আনন্দ ছিল। তাছাড়া আমার সিনিয়র কামাল ভাই এবং রানা ভাই খুবই আন্তরিক ছিলেন। রানা ভাইয়ের কাছেতো জোক্স আর গানের অফুরন্ত ভান্ডার ছিল। কাজ শেষে রানা ভাই কখনো মজার মজার কৌতুক শোনাতেন, আবার কখনো বা গান। এভাবে আনন্দে আনন্দে কেটে যেত সারাদিন। কখনো বোর ফিল হতো না। এটা আমার জন্য একটা দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। এক এক জেলার অভিজ্ঞতা ছিল এক এক রকম। তবে সব জেলাতেই একটা কমন ব্যাপার ছিল। সেটা হলো- একজন ছোট কর্মচারী থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক পর্যন্ত সবাই আমাদেরকে তথা ক্যাম্পাস’র কাজকে খুব আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করতো এবং তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে উদ্বেলিত হতো। আমাদেরকে এবং আমাদের কাজকে অনেক সম্মান করতো। এটা আমার খ্বুই ভালো লেগেছে।
ছোটবেলা থেকেই আমার একটা শখ ছিল- নতুন নতুন জায়গা ঘুরে বেড়ানো। গানের ভাষায় বলা যায়- আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ...। ক্যাম্পাস এ এসে আমার সেই শখের অনেকটাই পূরণ হয়ে গেছে। তাই ভ্রমণ পিয়াসুদের জন্য এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ। ক্যাম্পাস এ না আসলে আমার হয়তো কখনোই এত জেলা একসাথে ঘোরা হতো না, আর প্রকৃতির এত কাছেও যাওয়া হতো না। শুধু জেলাই নয়, ঢাকার ভেতরেও এমন কিছু হাইলি সিকিউরড প্লেসে গিয়েছি, যা অধিকাংশ মানুষের কাছেই সাধ্যের বাইরে। তার মধ্যে আছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ ভবনের মূল ইউনিট, যেখানে অধিবেশন বসে। এসমস্ত অফিসে প্রবেশ করা যে কারো জন্যই একটা স্বপ্ন পূরণের মতোই। অথচ প্রতিটি অফিসের অধিকাংশ রুমেই ছিল আমাদের পদচারণা। আর প্রতিটি অফিসেই এখন শোভা পাচ্ছে ক্যাম্পাস’র বাৎসরিক ওয়াল ক্যালেন্ডার, টেবিল ক্যালেন্ডার এবং নানা ধরনের জনসচেতনতামূলক এবং দেশপ্রেম ও জাতি জাগানিয়া শ্লোগান সম্বলিত স্টিকার। আর আমি এই অনন্য কাজের সাক্ষী হতে পেরে গর্ব অনুভব করছি। এটাও একটা দারুণ অভিজ্ঞতা আমার জন্য। আর এই অভিজ্ঞতা যারা এখানে ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের অনেকেরই হয়েছে।
শুধু অভিজ্ঞতাই নয়, ক্যাম্পাস’র বহুমুখী কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে একজন সাধারণ মানুষও নিজেকে আরও চৌকস, আরও স্মার্ট করে গড়ে তুলতে পারে। নিজেকে করে তুলতে পারে আরো কর্মক্ষম, আরো সময়োপযোগী ও দক্ষ। আর সেটা তারা কাজে লাগাতে পারে সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে, যা আমাদের দেশকে নিয়ে যেতে পারে আরও উন্নতির পথে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে চাইলে বা আমাদের দেশকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে আমাদের যুব সমাজকে আরো স্মার্ট, আরো দক্ষ ও কর্মপোযোগী হতে হবে। আর এজন্য ক্যাম্পাস’র মতো জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। তাই আমি বলব- কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্বে প্রত্যেকেরই ক্যাম্পাস’র এই ক্যাম্পেইন এবং বহুমুখী কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা উচিৎ, যাতে তারা কর্মজীবনে গিয়ে এটার সুফল ভোগ করতে পারে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)