ইউনেস্কোর হিসাব মতে বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সি নিরক্ষর লোকের সংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখ। সরকারের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ম্যাপিং রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সি নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৩ লাখ। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। সাক্ষরতার হার ৬১ শতাংশ হলে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৫ কোটির বেশি। তবে বহু পুরনো এক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, সাক্ষরতা অর্জনের যোগ্য আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ এখনও নিরক্ষর। সাক্ষরতার হার নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্যে কিছুটা গরমিল থাকলেও দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী যে আজও নিরক্ষর প্রতিটি গবেষণাতেই সেটি স্পষ্ট। ঠিক এমনই এক বাস্তবতায় ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস।
এবারের আন্তর্জাতিক এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ‘সাক্ষরতা আর দক্ষতা, টেকসই সমাজের মূল কথা’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সরকারের গৃহীত সকল কর্মসূচিকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রযুক্তি নির্ভর একটি জাতি বিনির্মাণে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্যই বর্তমান সরকার শিক্ষার প্রসারসহ নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচিকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সকলের নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে দেশের শতভাগ মানুষকে সম্পদে পরিণত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সুশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ অপরিহার্য। একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার সরকার দেশের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষর ও জীবন দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি আধুনিক ও কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ঝরে পড়ার হার ও বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী আশা করেন, সম্মেলন আয়োজন ও দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতা ও জীবন দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে আরও সচেতন করে তোলা সম্ভব হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাক্ষরতা বিস্তারে সকলকে উদ্বুদ্ধ করা, বিগত বছরের সাক্ষরতা কার্যক্রমের মূল্যায়ন করা এবং পরবর্তী বছরে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করাই এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের অঙ্গীকার ছিল গেল বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের মধ্যেই দেশ হবে সম্পূর্ণ নিরক্ষরতামুক্ত। কিন্তু নানা প্রকল্পসহ বহু উদ্যোগের পরও লক্ষ্য পূরণ থেকে বহু দূরে আছে দেশ।
বয়স্ক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন শিক্ষাবিদসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছরের উদ্যোগের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে সত্য। কিন্তু সাক্ষরতার বাইরে থাকা কোটি কোটি মানুষকে বয়স্ক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনতে না পারলে শতভাগ সাক্ষরতা কখানোই অর্জিত হবে না। সারাবিশ্ব থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ঘোষণা করে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো সাক্ষরতা দিবস উদযাপিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার সাক্ষরতা বিস্তারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করে আসছে। সবার জন্য শিক্ষা এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্যসমূহ অর্জনে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব পাঁচ বছর মেয়াদী গ্লোবাল এডুকেশন ফার্স্ট ইনিশিয়েটিভ (জিইএফআই) চালু করেন। এ উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সারাবিশ্বের ১৪টি দেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ সাফল্যের ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালে ইউনেস্কো মহাসচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘শান্তি বৃক্ষ’ পদক প্রদান করেন।
এদিকে ইউনেস্কোর হিসাব মতে বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সি নিরক্ষর লোকের সংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখ। বয়স্ক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের সফলতার অভাবে দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী যে সাক্ষরতার বাইরেই রয়ে গেছে তা এখন পরিষ্কার। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য, শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা উদ্যোগ প্রকাশ করে বলছেন, দেশের সাধারণ শিক্ষা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও বয়স্ক শিক্ষা নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে নেই কোন মাথাব্যথা। বয়স্কদের শিক্ষা এবং সাক্ষরতা নিয়ে কোনো তৎপরতা নেই। অতীতের কিছু কার্যক্রম চলমান থাকলেও প্রচার-প্রচারণার অভাব এবং প্রশাসনের সমন্বয়হীনতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে শিক্ষাবিমুখ হয়েছেন বয়স্করা। ক্ষুব্ধ দাতাগোষ্ঠীও।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমের সফলতার প্রধান কারণ হচ্ছে- এটা থেকে যেমন দাতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তেমনি এনজিওগুলোকেও সরকার এ খাতে টাকা দেয় না। ১৯৯৭ সালে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এ নিয়ে এনজিওগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। তিনি জানান, তবে এর পরও বেশকিছু এনজিও লাইভলিহুড এবং মাইক্রোফিন্যান্স কার্যক্রমের মাধ্যমে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এটা বয়স্ক শিক্ষাকে লক্ষ্য করে নয়, উল্লেখিত কর্মসূচির সফলতার জন্য এনজিওগুলো মানুষকে সাক্ষর করছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তি হচ্ছে একথা সত্য। তবে যে এইজ গ্রুপটি স্কুলিংয়ের সুযোগ পায়নি তাদের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জন্য বয়স্ক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে পারলেই কেবল শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে করেন এ শিক্ষাবিদ। কারণ বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষর রেখেতো শতভাগ সাক্ষরতা হবে না।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ণ কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর বলছিলেন, শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের জন্য বয়স্ক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর বিশেষভাবে নজর দেয়া হয়েছিল শিক্ষানীতিতে। কারণ ন্যূনতম সাক্ষরতা অর্জন দেশের জন্যই জরুরি। সেজন্য বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতার আওতায় আনতেই হবে। এক প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষাবিদ বলছিলেন, গত কয়েক বছরে সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে সত্য। কিন্তু সাক্ষরতার বাইরে থাকা কোটি কোটি মানুষকে বয়স্ক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনতে না পারলে শতভাগ সাক্ষরতা কখানোই অর্জিত হবে না।