বিশেষ খবর



Upcoming Event

বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং কেন হতাশাজনক!

ক্যাম্পাস ডেস্ক মতামত

আমরা খুব সহজে বলি, দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এ দুই হাজারের মধ্যে নেই। বলবেন, কারণ তো একটাই, শিক্ষকরা তো ক্লাসই নেন না। গবেষণা আবার কি জিনিস? কে করাবেন? প্রশ্ন সহজ, উত্তরও তাই। কিছুক্ষণ শিক্ষকদের প্রতি আপনার নেতিবাচক বিরক্তিকর তর্ক-বিতর্ক। তারপর শেষে বলবেন, দেশটা আসলেই ধ্বংসের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং এ সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ ক’টি নির্দেশক গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করা হয়। তা হলো এর ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক সংখ্যা, গবেষণা সংখ্যা, গবেষণা প্রকল্প, গবেষণার সাইটেশান সংখ্যা, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালনা, পুরান ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থান প্রভৃতি।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাংকিং এ পিছিয়ে পড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল গবেষণা। কিন্তু কারণ হিসেবে সব দায় কি শিক্ষকদের? মনে হয়, শিক্ষকরা নিজের ভিটে বিক্রি করে গবেষণা করাবেন। আবার অনেকে জানেই না গবেষণা কী জিনিস? শিক্ষকের ভিটে বিক্রি করে গবেষণা কি সম্ভব?
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত ৩৭টি পাবলিক, ১টি সরকারি ও ৮৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এর কোনোটিই বিশ্বের সেরা ২০০০ এর মধ্যে নেই। এমনকি এশিয়ার ৭শ’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতেও নেই। এতে অনেকে দেখছি, আবার অবাকও হচ্ছেন। বলছেন এবং ভাবছেন এ আবার নতুন কি? কিন্তু গভীরে গিয়ে দেখুন, এই অবাক হওয়াটাই তো অবাককর বিষয়। আপনি এতে অবাক হওয়ার কি দেখছেন? এটাই তো স্বাভাবিক। কেন নয়?
সহজ ভাষায় বলি, দেখুন আপনার হাতে যে প্রযুক্তি- মোবাইল, কম্পিউটার , ইন্টারনেট যা ব্যবহার করে আপনি প্রতিদিন নিত্য নতুন আনন্দ পাচ্ছেন, কত প্রয়োজনীয় জিনিস না চাইতে আপনার কাছে চলে আসছে, কত সহজ আপনার দুনিয়া। এ প্রান্ত হতে ওই প্রান্ত, সবই হাতের মুঠোয়। কিন্তু এসব আসল কোথা হতে? কে এর ভিতর এত মজার উপাদান প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে? এগুলোর নতুন নতুন ভার্সন কোথা থেকে আসে? সেটা নিয়ে কি কখনও ভেবেছেন? যে ভাবে, আর যার ভাবনা ব্যবহার করে আমরা দৈনন্দিন সুখ অনুভব করি, সেই গবেষক।
এখন ভাবুন, সে কীভাবে গবেষণা করে? তার গবেষণার জন্য কী কী জিনিস প্রয়োজন? বলবেন প্রয়োজনীয় উপাদান তথা যন্ত্রপাতি। যার যোগানের জন্য প্রয়োজন অর্থ। অর্থ আসবে কোথা হতে? এটা আসবে বিভিন্ন কোম্পানি হতে, আসবে সরকারের কাছ থেকে। এ গবেষণা করবেন কারা? এ গবেষণা সাধারণত দু ধরনের। একটা হলো কোম্পানি ভিত্তিক, আরেকটি হলো বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক। বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক গবেষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। তার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। না দিলে কি হবে? সহজ প্রশ্ন। উত্তরও সহজ। তারা গবেষণা করবেন না। আপনি অন্য দেশ থেকে এনে তা ব্যবহার করবেন।
আমাদের এই সোনার বাংলায় তা-ই হচ্ছে। আমাদের উৎপাদনের প্রতি মনযোগ নেই। আমরা রেডিমেইড কিনে আনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। বলবেন, এতে ক্ষতি কি? ক্ষতি কিছুই নেই। ক্ষতি হলো আপনি যখন কিনবেন বিক্রেতা আপনার কাছ থেকে সে গবেষণার অর্থসহ অন্যান্য মুনাফা সুদাসলে আদায় করবেন। ফলে প্রত্যেক ক্ষেত্রে আপনি অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। দেশ পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষার সকলক্ষেত্রে গবেষণা সম্ভব। বাংলায় হলে সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে। ইতিহাসে হলে দেশের ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে। বাণিজ্যে হলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। বিজ্ঞানে হলে নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হবে। কৃষিতে গবেষণার কারণেই আজ ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের সংকুলান হচ্ছে। যদিও দিন দিন কৃষি জমির পরিমাণ কমছে।
আপনারা হয়তো জহর লাল নেহেরুর নাম শুনে থাকবেন, যিনি আধুনিক ভারতের প্রণেতা। তাকে তার সভাসদরা একদা প্রস্তাব করেছিলেন, সুধীজনদের দাঁড়ি কামানোর সুবিধার্থে কিছু ব্লেড বিদেশ হতে আমদানি করতে। প-িত জহর লাল নেহেরু ভাবার জন্য এক সপ্তাহ সময় নিলেন। এক সপ্তাহ পর তিনি সভাসদদের দাঁড়ি রাখার পরামর্শ দিলেন এবং বললেন আপনারা দেশীয় ব্লেডের উন্নয়ন সাধন করুন। সভাসদরা তাই করলেন এবং কিছুদিন পর সে ব্লেডই বিদেশে রপ্তানি করা শুরু হল। এমন অসংখ্য ঘটনারই ফসল আজকের উন্নত ভারত।
এবার ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট দেখুন। আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না। যখন তার সাথে আমাদের সবচেয়ে বেশি বাজেটের বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা করবেন। সাথে সাথে আপনার চিন্তার পরিবর্তন নিশ্চয়ই ঘটবে। আপনি নিজেই বলবেন, এতো বিশ্বাসযোগ্য নয়। এত নগণ্য বাজেটে ২০০০ কেন? সবার শেষের বিশ্ববিদ্যালয় হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ নাই তুললাম। বিশ্ব সেরা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বরাদ্দ ২০১২ অর্থবছরে ছিল ৭৯৯, ৪৩২ হাজার ডলার। ম্যাসাচ্যুয়েসটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বরাদ্দ ছিল ৮২৪,১৩০ হাজার ডলার। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪ অর্থবছরে ৩০৮,৫০০ হাজার পাউন্ড।
বাংলাদেশের বুয়েট’র বরাদ্দ ২০১৫ অর্থবছরে ১০৮৭ হাজার ডলার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬২ হাজার ডলার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ হাজার ডলার। ভেবে দেখুন আপনার র‌্যাংকিং কতো হলে আপনি খুশি থাকবেন। শিক্ষক প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বরাদ্দ ২২,৫০০ টাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২৮৫ টাকা।
বিশ্বের প্রতিটি দেশে গবেষণার জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু আছে, আমাদের দেশেও আছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। এর বরাদ্দ বাড়িয়ে, এটি শিক্ষার্থীর কাছে সহজতর উপায়ে বন্টন করা অত্যন্ত জরুরি। তবে স্বচ্ছ মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে অযথা অপব্যবহার না ঘটে। তথাপি প্রফেসর ওরিয়েন্টেড শিক্ষাবৃত্তি চালু করে এর ব্যাপ্তি বাড়ানোর ব্যবস্থাকরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এমন অনেক শিক্ষক দেখেছি, যারা উন্নত দেশ হতে গবেষণা করে আসার পর অর্থের অভাবে, তা আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। তাহলে সে গবেষকের গবেষণার প্রকৃত মূল্য কি রইল! তাকে কিভাবে সক্রিয় রাখা যায়, সে দায়িত্ব দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় দুয়েরই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা থাকলে শিক্ষকদের অবাধে রাজনীতি করা সম্ভবপর হত না। গবেষণারত শিক্ষার্থী থাকলে তিনি কখনো বিশ্ববিদ্যালয় বিমুখ হতে পারতেন না। অনেক শিক্ষক আছেন, যারা বন্ধের দিনেও তার গবেষণার কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। শুধু শিক্ষক নয়, গবেষণারত শিক্ষার্থীরাও একই কাজ করেন। এমনকী অনেকে রাত অবধি কাজ করেন।
পর্যাপ্ত ফান্ড থাকলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আরো বেশি গবেষণামুখী হতেন। মনে রাখতে হবে, আর্থিক সংকট নিয়ে আর যাই হোক, সঠিক গবেষণা অসম্ভব। বরাদ্দ থাকলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিত্য নতুন গবেষণা বেরিয়ে আসবে। এভাবেই দেশ এগিয়ে যাবে উন্নয়নের পথ মাড়িয়ে।

-লেখকঃ মোঃ আবদুল মাজেদ পাটোয়ারী,
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, রসায়ন বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়


বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাস পত্রিকার সংখ্যা সমূহ

আরো সংবাদ

শিশু ক্যাম্পাস

বিশেষ সংখ্যা

img img img