৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালীর চেতনায় চির ভাস্বর এক ঐতিহাসিক ঘটনা। দেশের সর্বস্তরের মানুষের মহান দেশপ্রেমের নিদর্শন আমাদের স্বাধীনতা। এই মহান সংগ্রামে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। রাজপথে নিজের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন বাংলার স্বাধীনতা। বাঙ্গালী এক মহান জাতি। কেননা শুধু আমরাই করেছি ভাষার জন্য সংগ্রাম, দেশকে স্বাধীন করার জন্য দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। পৃথিবীর মানচিত্রে আমরাই এঁকেছি লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের এই মহান মুক্তির সংগ্রামে বাংলার সর্বস্তরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। তারই মূর্তপ্রতীক বিখ্যাত ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর বিজয়’৭১ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিজয়’৭১। পরম আকাক্সিক্ষত বিজয়ের এ চিহ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অসংখ্য বাঙালির প্রেরণার উৎস।
ভাস্কর্যটি দুইটি অংশে বিভক্ত। মূল অংশে ৬ ফুট বেদির উপর রয়েছে একজন নারী, একজন কৃষক ও একজন ছাত্র মুুক্তিযোদ্ধার নজরকাড়া ভঙ্গিমা যা দর্শনার্থীদের বারবার মনে করিয়ে দেয় মুুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা। একজন কৃষক মুুক্তিযোদ্ধার হাতে শোভা পায় লাল-সবুজের পতাকা। দৃষ্টি তার অসীম আকাশের দিকে, এইতো স্বাধীন বাংলাদেশ, স্বাধীন দেশের মানুষের উপর নেই কোনো অত্যাচার, নেই কোনো নির্যাতন, সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছে এই দেশের মানুষেরা। দু’চোখে তার শুধু প্রেরণা, স্বাধীন হবে বাংলাদেশ। তার ডান পাশেই শাশ্বত বাংলার সর্বস্বত্যাগী ও সংগ্রামী এক নারী দৃঢ়চিত্তে আহ্বান জানাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের। যার সঙ্গে আছে রাইফেল, নেই কোনো ভয়। অকুতোভয় এ নারী সবাইকে বলছে, এসো জেগে উঠি, নারী-পুরুষ সবাই মিলে দেশকে স্বাধীন করি, দেশকে হানাদারমুক্ত করি। অন্যদিকে একজন ছাত্র যার ডান হাতে আছে গ্রেনেড আর বাম হাতে রাইফেল। তেজোদীপ্ত চিত্তে দাঁড়িয়ে নয়া যৌবনের আভা ছড়াচ্ছে তার চারদিকে। মনের দীপ্ত সংকল্প নিয়ে সে যেন বলছে- কে আছিস সামনে আয়, দেশকে মুক্ত করবই। অপর অংশে বেদির দুই পাশে রয়েছে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের গল্প। এতে চিত্রিত হয়েছে ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬ এর ছয় দফা, শিক্ষা আন্দোলনসহ বহু আন্দোলনে বাঙ্গালির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
বিজয়’৭১ ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রায় ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভাস্কর্যটির কাজ ২০০০ সালের জুন মাসে শেষ হয়। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা ইতিহাস সম্বন্ধে দর্শনার্থীদের কিঞ্চিৎ হলেও ধারণা দেয় এই ভাস্কর্য। আর তাই বিজয়’৭১ ভাস্কর্যটি দেখতে প্রায় প্রতিদিন অগণিত মানুষ ভিড় জমায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয় শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা। ভাস্কর্যটির বেদিতে খালি পায়ে উঠার নিয়ম থাকলেও প্রায়ই দেখা যায় অনেকেই সে নিয়মের তোয়াক্কা না করে জুতো পরে ওঠে। উৎসাহিত হয় বাংলাদেশের মানুষের সফল আন্দোলনের জীবন্ত এই মূর্ত প্রতীক দেখে। এ জাতি গর্র্ব করে বলতে পারে বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছে, দেশকে স্বাধীন করেছে মাত্র নয় মাস যুদ্ধ করে, শহীদ হয়েছে ৩০ লক্ষ মানুষ, হারিয়েছে হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত। দেশকে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের আদলে সাজাতে আপোশহীন এ জাতি কখনও মাথা নোয়াবার নয়। তাইতো ভাস্কর্যটিতে একপাশে লিখা রয়েছে বিদ্রোহী কবিকিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই অমর কথা- ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
বাকৃবি’র বধ্যভূমি গণহত্যার নীরব সাক্ষী
গৌরবময় মুত্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাশাপাশি বাকৃবির সবুজ চত্বরকে সেদিন রক্তে রঞ্জিত করেছিল পাক হানাদার বাহিনী। সে সময় এ দেশের লাখো কোটি জনতার পাশাপাশি বাকৃবি’র ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে, ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জানা অজানা অনেক ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরীতে একজন শিক্ষকসহ ১৮ জন শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। শহীদের স্মৃতিকে ধরে রাখার লক্ষ্যে তাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ জামাল হোসেন হল, শহীদ শামসুল হক হল এবং শহীদ নাজমুল আহসান হল নামে তিনটি হলের নামকরণ করা হয়েছে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর শামসুল ইসলাম, সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ রফিকুল হক, প্রফেসর আতিয়ার রহমান মোল্লা, প্রফেসর ড. সাখাওয়াত হোসেন, প্রফেসর ড. শেখ জিনাত আলী, প্রফেসর ড. নূর মোঃ তালুকদার, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাবেক রেজিস্ট্রার মোঃ নজিবুর রহমানসহ ৮৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরীতে উল্লেখ রয়েছে।
রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ শহরের আনাচে কানাচে থেকে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে আনে বাকৃবি’র পাশ দিয়ে বহমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। তা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এমন কোনো লোক বাকি নেই যারা তাদের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে। হানাদার বাহিনী কুয়া খুড়ে ফেলে দেয় লাশ। কারো কারো লাশ শেয়াল, কুকুরের খাদ্য হিসেবে মাটির উপরে ফেলে রেখেই চলে যায়।
পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হয়। বিজয়ের পতাকা হাতে নিয়ে গণকবরের কাছে কেউ তার মাকে, কেউ তার স্বামী, কেউ তার সন্তানকে খুঁজে ফেরে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে অগণিত মানুষকে মেরেছে পাক হানাদার বাহিনী। এ সকল বীর শহীদদের আত্মাহুতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বাকৃবি’র ফাস্টগেট এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বধ্যভূমি।
পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে এক সাথে সব জেলায় বধ্যভূমি নির্মাণ করা হয়। তখন বাকৃবিতে এ বধ্যভূমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পিডব্লিওডি (চডউ) এর অর্থায়ন ও পরিকল্পনায় বধ্যভূমির নির্মাণ কাজ শুরু করে। পরে ১৯৯৩ সালের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. শাহ মোঃ ফারুক বাকৃবি’র এ বধ্যভূমি উন্মোচন করেন।
এরপর থেকে প্রতি বছর বধ্যভূমি ও গণকবর স্মৃতিফলকে শহীদদের প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বাকৃবি’র ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরাসহ ময়মনসিংহবাসী।
-মোঃ আব্দুর রহমান, শিক্ষার্থী, বাকৃবি, ময়মনসিংহ