আমাদের দেশে এখন শিক্ষা বিপ্লবের যুগ চলেছে। নানা মাত্রিকতায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ধ্যান-ধারণায় শিক্ষার মানগত উন্নয়নে বহুমাত্রিক পরিকল্পনা চলছে। একটি যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সুস্থ সমৃদ্ধ ও আধুনিক প্রগতিশীল জাতি উপহার দিতে সক্ষম। এই লক্ষ্যে মহাজোট সরকার চালু করেছে প্রাথমিক ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা শিক্ষার্থীর মেধার উন্নয়ন ঘটায়।
বাংলাদেশে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে, ফলও দিনে দিনে রেকর্ড গড়ছে, পিএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার খুদে শিক্ষার্থী। এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। শিশুরা বৈচিত্র্যময় মনের অধিকারী। তাদের বিস্ময়ের জগৎ নিয়ে মনীষীদের ভাবনার অন্ত নেই। শিশুদের মনোজগৎ নিয়ে শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক ও মনোবিজ্ঞানীরা বিস্তর গবেষণা করেছেন। কারণ শিশুরাই হচ্ছে ভবিষ্যৎ কর্তধার। এই কারণেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
নতুন শিক্ষানীতির আওতায় শিশুরা প্রথম স্তর থেকে পর্বতসমান পাঠ্যসূচির বোঝা বহন করে অংশগ্রহণ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়। উন্নত বিশ্বের ধাঁচে মেধা বিকাশের পদ্ধতি অনুসরণ করে আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসৃত হয়েছে। পরীক্ষা হলো শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন এবং যোগ্যতা পরিমাপের মাপকাঠি। এই পরীক্ষা পদ্ধতির ওপর তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। এটি যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তবে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। পরীক্ষার ইংরেজি শব্দ হলো- Examination যাকে সংক্ষেপে বলা Exam. এর অর্থ হলো অনুসন্ধান করা, তদন্ত করা বা পরীক্ষা করা, তলিয়ে দেখা প্রভৃতি।
বর্তমানে সারাদেশে ৮টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ১টি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, ১টি কারিগরি শিক্ষাবোর্ড, ৬টি ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান, সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রহণ করে থাকে। পৃথিবীর সব দেশেই পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিক্ষাবোর্ড। বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) নিয়ন্ত্রণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, জুনিয়র দাখিল (জেডিসি) পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড। পরগাছা অধিদপ্তর ও বোর্ডের পিএসসি, জেএসসি ও জেডিসি কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কারণে পরীক্ষা সংক্রান্ত নানান কিচ্ছা-কাহিনীর জন্ম দিচ্ছে। দেশব্যাপী ৩০ লাখ পরীক্ষার্থী এক সাথে পরীক্ষা নেয়া বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৮০ হাজার ৩৯৭টি। কোনও কোনও গ্রামে ২/৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কুমিল্লায় ১১৭৩টি, মানিকগঞ্জে ৫৪৮টি, টাঙ্গাইলে ৫২৮টি, দিনাজপুরে ৩৩৬টি, রংপুরে ২৩৭টি, জয়পুরহাটে ৩২৬টি, সাতক্ষীরায় ৩৩৫টি এবং নেত্রকোনায় ৮৭৯টি গ্রামে কোনও প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। যেখানে স্কুল প্রয়োজন সেখানে স্কুল না থাকলেও কোনও কোনও জায়গায় অতিরিক্ত বিদ্যালয় রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী দেশের ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে সরকারি বা বেসরকারি কোনও বিদ্যালয় নেই। তবে লোকসংখ্যার বিচারে ১২ হাজার ৯৪৩টি গ্রামে বিদ্যালয় থাকা উচিত।
এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে বিপুলসংখ্যক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এরজন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এইসব স্থানে স্কুল প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজন হলে ভবিষ্যৎ এমপিওভুক্তি ঘোষণা দিতে হবে। এজন্য একটি স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন।
আমাদের দেশে অধিকাংশ শিশুর অভিভাবক দরিদ্র। তাদের কাছে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়! সন্তানের রুজি-রোজগারের ওপর নির্ভরশীল। এই শিশুদের ঝরে পড়া রোধ করতে হলে, প্রতিষ্ঠিত স্কুলে মর্নিং, ডে, ইভিনিং, নাইট, শিফট চালু করতে হবে।
বাংলাদেশে জ্ঞানের উৎপাদন ও বিতরণের কাজে সবচাইতে মেধাবীরা আকৃষ্ট হচ্ছে না। আমাদের দেশে জ্ঞানের উৎপাদন ও বিতরণের কাজে সর্বোচ্চ মেধাবীদের আকর্ষণ করার মতো ওহপবহঃরাব নেই। এ কারণে সম্ভাবনাময় তরুণরা সাধনা ও ত্যাগের পথে পা বাড়াতে রাজি হয় না। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের পিটিআইগুলোতে ১২ মাস, ১৮ মাস মেয়াদি সংক্ষিপ্ত ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন কোর্স বাতিল করে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স চালু সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিকমানের ডিপ্লোমাধারীরা শিক্ষা প্রশিক্ষণে পারদর্শী হয়ে উঠবে। ডিপ্লোমা শিক্ষা অর্জনের কারণে দেশে অন্যান্য ডিপ্লোমা পেশাজীবীদের ন্যায় ২য় শ্রেণি ও গ্রেডের মর্যাদা প্রাপ্ত হবে। পিয়ন দারোয়ানের বেতন কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সরকারি/রেজিস্টার্ড/এনজিও/ কিন্ডারগার্টেনগুলোকে জুনিয়র স্কুলে পরিণত করার একটি নীতিমালা করা প্রয়োজন। জুনিয়র স্কুল পরিচালনার জন্য নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হলে দ্রুততম সময়ে সকল বিদ্যালয়গুলোকে অষ্টম শ্রেণিতে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পিএসসি, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি) এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা গ্রহণ করবে এই বোর্ড। এ সমস্ত সার্টিফিকেটের মান দেশ-বিদেশে মূল্যায়িত হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক চিত্র সৃজনশীল কল্যাণমুখী হবে।
লেখক- খনরঞ্জন রায়, চকবাজার, চট্টগ্রাম