শত শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ এবং তৎপরবর্তীতে প্রকৃতি ও মনুষ্য-সৃষ্ট দুর্যোগ ও দুর্গতির কারণে বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এরূপ অবস্থায়ও ডিজিটাল সরকার ও দেশপ্রেমী স্টেকহোল্ডারদের দৃঢ় মনোবলের কারণে যখন-
নতুনরূপে বদলে যাচ্ছে ঢাকা, বদলে যাচ্ছে দেশ
’৫২ আর ’৭১ এর সেই উত্তাল বাংলাদেশ ॥
পদ্মাসেতু-মনোরেল-ফ্লাইওভার-এক্সপ্রেসওয়ে
নব নব উন্নয়ন-কর্মযজ্ঞের পরিবর্তনে এগিয়ে..॥
দেশ ও জাতি জাগরণী এরূপ কার্যক্রমে
আহ্বান জানিয়ে ‘ক্যাম্পাস’ যখন বলছে-
আসুন- নিজকেও বদলাই কর্মে ও চিন্তায়,
দুর্নীতিমুক্ত ও প্রতিভাবান জাতিসত্তায়।
১৬ কোটি সৃজনশীল মাথা ও ৩২ কোটি কর্মের হাত উঁচিয়ে
বিশ্বশীর্ষ দেশ ও জাতিরূপে, শামিল হই নতুন বীরের অভ্যুদয়ে।
অপ্রতিরোধ্য গতিতে দেশ বিনির্মাণে এরূপ দুর্বার সৃষ্টিসুখের উল্লাস-সময়ে বাংলার আকাশে নতুন এক দুর্যোগের ঘনঘটা। ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার গণতান্ত্রিক একটি দেশে হঠাৎ জঙ্গিবাদের ব্যর্থ আস্ফালনে শুধু দেশবাসীই নয়, সারা বিশ্বও স্তম্ভিত, হতবাক! তাই ক্যাম্পাসও থেমে নেই এ অস্থিরতার কারণ অনুসন্ধানে।
ক্যাম্পাস’র অনুসন্ধান মতে সামাজিক অস্থিরতা ও জঙ্গিবাদের অন্যতম কারণ- মৌলিক শিক্ষায় ব্যাপক ত্রুটি, দেশপ্রেম-মানবপ্রেম ও ন্যায়নীতির আকাল, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-আত্মকেন্দ্রিকতা, শ্রেণিবৈষম্য, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি-সুশাসনের অভাব, খাদ্যে ভেজাল ও বিষ প্রয়োগে জাতীয় স্বাস্থ্যহানি, জিঞ্জিরা ও ইউরিয়া আক্রান্ত অর্থনীতি ইত্যাদি। এত্তসব মৌলিক সমস্যার সাথেও নতুন উপসর্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে নিরীহ ও প্রবাসী মানুষদের উপর জঙ্গিদের কাপুরুষোচিত আকস্মিক আক্রমণ।
গুলশান, কল্যাণপুর, শোলাকিয়ায় মানুষ হত্যায় জঙ্গি নামধারী উচ্চশিক্ষিত ছাত্র-যুবকদের আত্মাহুতির অব্যাহত ঘটনাবলি দেশ ও জাতিকে দাঁড় করিয়েছে এক নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি। বাংলাদেশে প্রবাসী বিদেশি নাগরিক এবং নিরীহ মানুষদের জীবন রক্ষার নিশ্চিয়তা এখন আমাদের জাতীয়ভাবে সকলের চিন্তার বিষয়। আরও চিন্তার বিষয় যে, হামলাকারী জঙ্গিদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কিছু ছাত্র। ফলে উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তানদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি Talk of the Country. এমনও দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিত এসব তরুণ ইসলাম কায়েমের নামে পবিত্র রমযানে তারাবির নামাজে শামিল না হয়ে বেপরোয়া হয়েছে আল্লাহু আকবার বলে নিরীহ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণে!
এ অবস্থায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন আমাদের ১৬ কোটি মস্তিষ্ককে সুচিন্তায় প্রোগ্রামিং করে পারস্পরিক কল্যাণ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতায় উদ্বুদ্ধ ও নিবেদিত করা; তথা সমগ্র জাতিকে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের কল্যাণকর্মে আন্দোলিত করা। সেক্ষেত্রে পারিবারিক ভালোবাসায় এবং আধুনিক ও উন্নত স্কুলিং শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশু-কিশোরদের মনন ও চিন্তাকে সুউন্নত করতে হবে সর্বাগ্রে।
শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারি বিধায় আজকের শিশুর প্রতিভা বিকাশের ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির উন্নতি ও অগ্রগতি -যা নিশ্চিত করা সম্ভব অভিভাবকের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও সদিচ্ছার মাধ্যমে। অভিভাবকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও কৌশল যদি যথার্থ হয় -তাহলে শিশুকে তারা যেভাবে গড়ে তুলতে চান, অবশ্যই সেভাবে বেড়ে উঠবে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন শিশুটি তথা দেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারি।
Seniors are followed by the Juniors. একথা যদি স্বতঃসিদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে পরিবারে-সমাজে বা জাতিতে যুব-তরুণদের বর্তমান অবক্ষয় কিংবা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-ইভটিজিং বা অনুরূপ নিগেটিভ ভূমিকার জন্য তারা যতটা না দায়ী, তার চেয়ে কম দায়ী নই আমরা অভিভাবকরা। সে বিষয়ে এ অধম কর্তৃক প্রণীত এলাকাভিত্তিক স্কুলিং মডেলেও লিখেছিলাম- ১৬ কোটি জনসংখ্যার এদেশ থেকে ১৬ জন ভালো মানুষ খুঁজে বের করতে হিমশিম খাচ্ছে যে ছাত্র-তরুণ, যার সম্মুখে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের বড় অভাব -সেই যুবকের কাছ থেকে বিপথগামিতা, জঙ্গিবাদ বা অনুরূপ নিগেটিভ, উচ্ছৃঙ্খল বা অমানবিক কার্যকলাপ ছাড়া আর কী মহত্ব আশা করা যায়!
বিত্তের প্রতি আমাদের উন্মত্ত আসক্তি এবং বিত্তের কাছে সব নৈতিকতার পরাজয় আমাদের সন্তানদের মাঝে জাগিয়েছে লোভের আগুন। বিত্ত অর্জনে আমরা মরিয়া হয়ে উঠেছি। নীতি-আদর্শ-বিবেক কোনো কিছুর স্থান নেই এ অন্ধ নেশার কাছে। সেসাথে অভিভাবকদের অনৈতিক কিংবা নৈতিক অঢেল উপার্জনে গড়ে তুলছি সন্তানদের; তাদের পেছনে ঢালছি অঢেল টাকা, তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে হার মানছি, নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছি অন্যায় আবদার।
লক্ষ্যহীণ এক সর্বনাশী প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি আমরা। কি আত্মীয়, কি বন্ধু, কি স্বজন; সবার সঙ্গেই আমাদের অঘোষিত যুদ্ধ, নিত্য প্রতিযোগিতা, সমানে সমান হতে হবে; অর্জন করতে হবে লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, ফ্যাশনের বাড়ি। আর এই প্রতিযোগিতার যুদ্ধংদেহী ডামাডোলে জড়িয়ে পড়েছে আমাদের শিশুরাও। তারা জানে না একসঙ্গে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার কী আনন্দ, মাঠে খেলার আনন্দতো উবেই গেছে কবে। সহপাঠী-বন্ধুর সঙ্গে পারস্পরিক ভাগাভাগির যে সম্পর্ক, তাও তারা জানে না। একজনের সঙ্গে অন্যজনের বইয়ের আদান-প্রদান নেই, নেই ভালো লেখা বা নোটের দেয়া-নেয়া; সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি তারা জানে না। অভিভাবকরাও বাচ্চাদের এ ধরনের আদান-প্রদানে নিরুৎসাহিত করেন। ‘শুধু আমার সন্তান শ্রেষ্ঠ হোক’ এরূপ আত্মকেন্দ্রিক বা ক্ষুদ্র চিন্তায় সংকীর্ণ করে ফেলেছি আমাদের সমষ্টিগত বিশাল স্বার্থকে। ফলে স্বার্থপরতা, হীনম্মন্যতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার শিক্ষালাভ করছে আমাদের সন্তানরা। তাই কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মাথায় লেখাপড়ার বিষয় কিঞ্চিৎ খেলা করলেও কল্যাণকর জ্ঞানের বিষয় কাজ করে না মোটেও। সৃজনশীল বিষয় নিয়ে কথা বলে না তারা সহপাঠীর সাথে, এমনকি পিতা-মাতার সাথেও। পাঠের ভালো নোট তৈরির চেয়ে চকচকে ও নজরকাড়া লেটেস্ট ফোনসেট-ট্যাব-ল্যাপটপ এবং কড়কড়ে টাকার নোটের গন্ধ তাদের বেশি প্রিয়; নিজ মস্তিষ্ক (Necktop) উন্নতির খেয়াল নেই, অথচ সারাক্ষণ এসব যন্ত্রে নিজ জীবন-যৌবন নিঃশেষ করে চলেছে। ফলে আমাদের সন্তানের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত আচরণ পাওয়া যাচ্ছে না।
আমাদের সন্তানরা এখন কথা বলে অদ্ভুত ভাষায়; আধো বাংলা, আধো ইংরেজি, কিঞ্চিৎ হিন্দী। জগাখিচুড়ির এই ভাষা তাদের স্মার্টনেসের প্রকাশ বলে তারা মনে করে। কিন্তু পরখ করলে দেখা যায় যে- তারা না জানে শুদ্ধ বাংলা, না জানে ইংরেজি, না জানে হিন্দী। কোন্ ভাষা বা কোন্ পরিচয় তাকে সম্মান দেবে বা সমৃদ্ধ করবে; কোন্ আচরণ-চালচলন তাকে করবে স্মার্ট বা সম্ভ্রান্ত, পরিবার-সমাজ ও বিশ্ব পরিসরে কার জন্য কী করণীয় -এসবের কোনো কিছুই তারা জানে না।
মাল্টিসিম ও মূল্যবান স্মার্টফোনে রাতজেগে মূল্যহীন আলাপ, ফেসবুকিং, ল্যাপটপ-ট্যাবে অবিরাম চ্যাটিং, কড়কড়ে টাকার নোট, বিলাসী রঙিন গাড়ি, জগাখিচুড়ির ভাষা সব মিলিয়ে শিশু-কিশোর-তরুণ-যুব সমাজ চরম বিভ্রান্ত। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে চাতুর্যপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর ধারণায় তারা ভুগছে মূল্যবোধ সংকট ও পরিচয় সংকটে। এরূপ নানা বিভ্রান্তি ও অশিক্ষায় আমরা সন্তানদের সঠিক পথ চেনাতে ব্যর্থ হচ্ছি, তারাও ব্যর্থ হচ্ছে জীবন ও জগতের কাঙ্খিত পাঠ নিতে। বঞ্চিত হচ্ছে মমতা ও ভালোবাসার আনন্দ থেকে; মানব সেবার তৃপ্তি ও সুখ থেকে।
ছাত্র-তরুণদের এ অবক্ষয়ের কারণ কিন্তু আমরা এই বড়রা; অভিভাবক-সমাজপতি-রাজনীতিকরা। আমাদের নীতি-সিদ্ধান্তের ভ্রান্তি কিংবা অপরিপক্কতা কিশোর-তরুণ সমাজকে বিপথগামী করে তুলছে; আসক্ত করে ফেলছে ইভটিজিং, মাদক, সন্ত্রাস ও বিভিন্ন নিগেটিভ বিষয়ের প্রতি। যে চিন্তা-চেতনা থেকে জঙ্গিবাদ, টিজিং, মাদক বা অনুরূপ অন্যায়ের উৎপত্তি, সেই চিন্তার সূত্রপাত তথা Primary brain programming হয় পরিবারে; যে প্রোগ্রামিংয়ের এডভান্সড লার্নিং হয় শিক্ষায়তনে এবং শেষতক তা বদ্ধমূল হয় তার আশপাশের সামাজিক ও রাজনৈতিক আচার-আচরণের প্রভাবে। তাই পরিবারে-ক্লাসে-ক্লাবে-পাড়ায়-মহল্লায়, অফিস-আদালতে নেতিবাচক কথা-চিন্তা-কর্ম পরিহার এবং তদস্থলে ইতিবাচক চিন্তা ও কর্মের উদ্যোগ যত দ্রুত গৃহীত হবে, তত দ্রুতই এসব অপরাধ হ্রাস পাবে। আর সে উদ্যোগের বাস্তবায়ন যতদিন পর নিশ্চিত হবে, ততদিন পরই বন্ধ হবে এরূপ সামাজিক ব্যাধি।
মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি, সন্ত্রাস, টিজিং, মাদক, ঘুষ-দুর্নীতি, ছিনতাই ও চুরিসহ সকল অপকর্ম, অপশক্তি ও কুচিন্তার অবসানে প্রয়োজন সুস্থ মনন ও প্রোএকটিভ এটিচিউড; যা কেবল সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থেকেই আসে। মৌলিক শিক্ষা তথা প্রাথমিক স্কুলিংই সকল শিক্ষা ও জ্ঞানের মূল ভিত্তি। শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন নির্মাণ যেমনি পাগলামির সামিল, তেমনি সঠিক প্রাইমারি শিক্ষা ছাড়া উন্নত ও আদর্শ জাতির প্রত্যাশা নির্বুদ্ধিতা মাত্র। দুর্বল প্রাথমিক শিক্ষার ভিত থেকে জাতির কোনো সুফল আশা করা যায় না।
শিক্ষা জীবনের শুরুতেই তথা মৌলিক শিক্ষায় পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে এবং পরবর্তী জীবনেও পারিবারিক-সামাজিক বিভিন্ন প্রথাগত ত্রুটির কারণে আমাদের মনন ও চিন্তার ভুবনে ভাঙন ধরাতে ধরাতে তথা হৃদয় খন্ডিত করতে করতে এখন আমরা হৃদয়হারা হয়ে গেছি। এরপর হৃদয়হরী হয়ে জীবনহরীর অভিযানে নেমেছি। আর তাইতো এখন শিক্ষা ও আদর্শ ছেড়ে মৌলবাদের নামে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয়েছি। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে- মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ কালে কালে ছিল, আছে; কিন্তু এ অশুভ শক্তিও কিছু মিডিয়ার দায়িত্বহীন প্রচারে স্থান পেয়ে বিকশিত হবার সুযোগ নিচ্ছে।
মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের ওপর সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ বা Concentration হতে দেখে সুবোধ বালকটিও এখন জঙ্গি হয়ে উঠছে, মৌলবাদের নামে কচি প্রাণের আত্মাহুতি হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য ও সংক্রমিত মহামারিরূপে; তৈরি করছে জাতীয় সমস্যার ইস্যু। ক্লাসে যে অর্ধেক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে, কেবল তাদের নিয়ে শিক্ষক-অভিভাবকদের হা-পিত্তেশ, মাতামাতি ও মনোযোগ দেখে ক্লাসে উপস্থিতরাও ক্রমান্বয়ে অনুপস্থিতির খাতায় নাম লেখাতে থাকবে -এটি কিশোর মনস্তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য। গ্লাসের যে অর্ধেক অংশ খালি, সেদিকে কম তাকিয়ে যে অর্ধেকে পানি আছে, সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে তাতে খালি অংশ ভরাটের সুযোগ তৈরি হয় -এ Common Psychology এবং Power of Positive Thinking বিদ্যার কথা আমরা সবাই ভুলে বসলে কি চলবে? জঙ্গিবাদ কি নিগেটিভ না পজিটিভ জিনিস, কোমল ও সুবোধ প্রাণগুলো তা না বুঝেই একে গ্রহণ করছে Popular Idea হিসেবে; এ Idea -সংক্রমণের জন্য আমাদের Strategy--ই কি দায়ী নয়? এ যেন ‘পাগলা, সাঁকো নাড়িস না’ প্রবাদের ন্যায়।
গ্লাসের খালি অংশ পছন্দ না করলে তা যেমন পানি দিয়ে ভরতে হয়, তেমনি সকল কুকর্ম ও কুচিন্তা দূর করতে হলে তরুণদের মাঝে ভালো কথা-চিন্তা-কর্মের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। তাহলেই কেবল এসব সামাজিক ব্যাধি দূর করা সম্ভব। বড়দের Mis-strategy ও Mis-handling এর কারণেই কিন্তু যুব-অবক্ষয় বৃদ্ধি পেতে পারে।
তাই এসব নিগেটিভ বিষয়কে স্লোগানে-বক্তৃতায় বা প্রচার-প্রপাগান্ডায় না এনে তৎপরিবর্তে পারিবারিক ভালোবাসা আন্দোলনে এবং প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও জাগ্রত করলেই এক্ষেত্রে দ্রুত সুফল মিলত বলে আমার বিশ্বাস। ক্যাম্পাস’র শিক্ষানবিশ কার্যক্রম এবং ‘প্রোএকটিভ এন্ড পজিটিভ এটিচিউড’ এর ওপর নিয়মিত সেমিনার পরিচালনা করে অনুরূপ সুফল সম্পর্কে আমি নিশ্চিত হয়েছি।
আসলে এই আমরা সবাই যাচ্ছি কোথায়, যাব কোথায় অথবা কোন্ পথ ও পদ্ধতি আমাদের জন্য সুগম ও সঠিক -এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা কিংবা নিরাপদ গবেষণার সুযোগ আছে কি, এ বাংলার মাটিতে? সত্যিকথা বললেতো আবার নিরাপদ দূরত্ব থেকে এ কলমের প্রতি নিক্ষিপ্ত হবে লাঠি-গুলি। তাই ভাসানী নানার সে ‘হক কথা’ অথবা অযোগ্য এ নাতির ‘সোজা কথা’ রেখে সত্য কথার আশপাশে ঘুরঘুর করি।
মুরগির খাঁচার ন্যায় রিক্সা ভ্যানে বা কাভার্ড ভ্যানে ভরে শিশুকে স্কুলে নেয়া-আনা করালে সে শিশুর কাছ থেকে Chicken Heart ছাড়া উদার বা বড় কিছু আশা করা যায় না। তাই শিশু-মেধার বিকাশ ও লালনকে রাস্তার যানজটে আটকে রেখে, শিশুকে গাড়ির ধোঁয়া ও ধুলিবালি খাইয়ে যে শিশুস্বাস্থ্য ও শিশুমেধা বিনষ্ট করা হচ্ছে এবং জাতির সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, তা রক্ষার্থে এখনই প্রয়োজন এলাকাভিত্তিক স্কুলিং ব্যবস্থার বাস্তবায়ন।
এলাকাভিত্তিক ও আধুনিক স্কুলিং ব্যবস্থা আমাদের জাতীয় বহু সমস্যার সমাধান এনে দেবে; আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হয়ে যাবে অর্থনৈতিক নানা সমস্যার; শক্তভাবে গড়ে উঠবে গুণগত শিক্ষার প্রাথমিক ভিত, সহায়ক হবে উন্নততর ও কার্যকর উচ্চশিক্ষা কাঠামো নির্মাণে; বর্তমান বিভাজিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে যে বিভক্ত করে ফেলছে, তা থেকেও রক্ষা পাবে জাতি; হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মতো জেএমবি কিংবা জঙ্গি তৈরির সুযোগ থাকবে না শিক্ষাঙ্গনে।
১৯৯৯ সালে ক্যাম্পাস’র প্রণীত এলাকাভিত্তিক স্কুলিং মডেল এখনই বাস্তবায়ন করলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিরোধসহ ৫ বছরের মধ্যেই দেশ ও জাতি শতভাগ লাভবান হবে এভাবে-
দুর্বিষহ যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস, জ্বালানি তেল আমদানি ও প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয় রোধ; বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়; অভিভাবকের শ্রম-সময়-টেনশন-হয়রানি হ্রাস; স্কুলে ভর্তি-দুর্নীতি প্রতিরোধ; কোচিং-বাণিজ্য ও শিক্ষা-ব্যবসার অবসান; শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক ও মৌলিক মানোন্নয়ন; ড্রপআউট-টিজিং ও মাদকসহ কিশোর অপরাধ হ্রাস; শিশু-কিশোরদের মধ্যে শৃঙ্খলা-দেশপ্রেম-মূল্যবোধ-টিমস্পিরিট-শেয়ারিং-কেয়ারিং-স্মার্টনেস ইত্যাকার শিক্ষালাভ; শিশুর জন্ম ও ক্রমবৃদ্ধির সঠিক ও যথাযথ পরিসংখ্যান; নকলমুক্ত-সন্ত্রাসমুক্ত-জঙ্গিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন; সর্বোপরি মেধাবী-প্রতিভাবান-আলোকিত জাতি এবং জ্ঞানভিত্তিক-ন্যায়ভিত্তিক-শ্রেণিবৈষম্যহীন-কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
এভাবেই জাতীয় বহুমুখী সমস্যার প্রথম ও প্রধান সোপান ‘এলাকাভিত্তিক স্কুলিং’। প্রাথমিক ও মৌলিক শিক্ষার এ পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে প্রাথমিক শিক্ষার মজবুত ভিতের ওপর তৈরি হবে উচ্চশিক্ষার কাঠামো, যে কাঠামোতে প্রবেশাধিকার থাকবে শুধু মেধাবীদের। শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত এ মেধাবী শ্রেণিই দেশের শিক্ষা-গবেষণা-সরকার ও রাজনীতি পরিচালনার জন্য তৈরি হবে। বাকি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার পেছনে সময় ও অর্থের অপচয় না করে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের মধ্য দিয়ে দক্ষ ও সুযোগ্য নাগরিকে পরিণত হবে। এলাকাভিত্তিক স্কুলিংয়ের মাধ্যমে এরূপ পরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা মেধাবী ছাত্র ও দক্ষ নাগরিকরাই পরিণত হবে সৃজনশীল, প্রতিভাবান ও আলোকিত জাতিতে। এভাবে গড়ে ওঠা একটি মেধাবী প্রজন্মই সহজে বদলে দেবে সমাজ, দেশ কিংবা সমগ্র বিশ্ব।
এলাকাভিত্তিক স্কুলিং পদ্ধতির এরূপ বহুমুখী সুবিধা ও দীর্ঘমেয়াদি লাভের কথা লিখে পাঠিয়েছি মান্যবর সকল মন্ত্রী ও সচিব মহোদয়কে; শিক্ষানীতি প্রণয়নকারী এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণকেও পাঠিয়েছি। আকাশেও ছড়িয়ে রেখেছি সে মডেল (www.helal.net.bd/model)। তাই এর পুনরাবৃত্তি না করে বরং সটকে পড়ি এ লেখা থেকে।
পূবাকাশে কিঞ্চিৎ লালিমা দেখা দিয়েছে, একটু পরই ভোর হবে, তারপর সকাল। সে সকাল থেকে রাত অবধি রাস্তার ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ে থেকে অন্যদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানিকৃত তেল পুড়িয়ে পুড়িয়ে আমাকে আরো ভাবতে হবে, কী করলে নেতা-নেত্রীগণকে সে মডেলটিতে একটিবার চোখ বুলাতে বলতে পারি! অথবা তাঁদের কাছে জানতে পারি, কী কী অসুবিধার কারণে দুর্বিষহ যানজটসহ জাতীয় বহু সমস্যার একক সমাধানরূপে এ মডেল সর্বসমক্ষে থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়নে তাঁরা এগিয়ে আসছেন না! তাঁরাওতো দেশপ্রেমী, জনগণের হিতাকাক্সক্ষী, সর্বোপরি জনউন্নয়নের নির্বাহী দায়িত্ব গ্রহণকারী। তাহলে কেন যে এ মডেলে তাঁদের এত দ্বিধা!
সৎ-ন্যায়নিষ্ঠ ও যুগশ্রেষ্ঠ শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় কিংবা ডায়নামিক ও দুর্জয় সাহসী প্রধানমন্ত্রী তথা বর্তমান ডিজিটাল সরকারের যদি এ মডেলের প্রতি নজর পড়ে যেত, তাহলে জাতীয় বহু সমস্যার একক সমাধান হয়ে যেত বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী এরূপ মডেল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার ও নীতি নির্ধারকগণের সদিচ্ছা অত্যাবশ্যক। তাঁরা যদি চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন, তাহলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে দেশব্যাপী এলাকাভিত্তিক স্কুলিং নিশ্চিত করা সহজেই সম্ভব। দেশ ও জাতি এ মডেলের শতভাগ সুফল এক্ষুনি না পেলেও এটি শিশু-কিশোরদের আত্মোন্নয়ন ও মানোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত ভূমিকা রাখবে। অর্থাৎ এটি আগামীর ছাত্র-তরুণদেরকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। আর যারা বর্তমানে ছাত্র-তরুণ-যুবক, তাদেরকে অবক্ষয় থেকে রক্ষায় কী করণীয়?
বর্তমানের ছাত্র-তরুণ-যুব সমাজকে নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক চিন্তা থেকে ফিরিয়ে পজিটিভ এন্ড কনস্ট্রাকটিভ এটিচিউডে নিবিষ্ট করে তাদের সামগ্রিক আত্মোন্নয়ন ও মানোন্নয়নে এখনই জরুরি প্রয়োজন মফস্বলের প্রতি ইউনিয়নে এবং শহরের প্রতি ওয়ার্ডে পাবলিক ট্রেনিং এন্ড মোটিভেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা; যে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছি ‘বাংলাদেশের সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান’ মডেলে (www.helal.net.bd/model)।
এ কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্র-তরুণসহ আপামর সাধারণ নাগরিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য-সুরক্ষা, আত্মোন্নয়ন ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, ঐক্যবদ্ধতা, নীতি-নৈতিকতাসহ বিভিন্ন মানবিক গুণাবলি অর্জনের প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশন সার্ভিস সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে দেয়া উচিত। অর্থাৎ জীবনকে যাপনযোগ্য করার যাবতীয় প্রোগামিং তথা Human Wiring এর পাশাপাশি কৃষি, স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস, খাদ্য-ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নিয়মিত নিবিড় প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা থাকবে এ প্রশিক্ষণ সেন্টারে। যেমন-
প্রাকৃতিক খাদ্য-পথ্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে মানুষের রোগ নিরাময় ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা (যাতে স্বাস্থ্যখাতে জাতীয় বাজেট-ব্যয় হ্রাস পায়), খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও খাদ্য-ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা বজায় রাখার বিষয়ে অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষকে প্রশিক্ষিত করা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে উন্নত, আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত জীবন যাপনে জনগণকে প্রশিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা থাকবে এরূপ ট্রেনিং ও মোটিভেশন সেন্টারে। মফস্বলের প্রত্যেক ইউনিয়নে এবং পৌর ওয়ার্ডে এরূপ সেন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন, যা স্থানীয় নাগরিকদের প্রয়োজনীয় ও ব্যবহার্য বিভিন্ন তথ্যের সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করবে।
পৌরওয়ার্ড ও ইউনিয়নভিত্তিক এ মডেল বাস্তবায়ন সরকারের জন্য সুদূরপরাহত বলে কেউ মনে করলে সেক্ষেত্রেও সরকারি নেতৃত্বে এনজিওসমূহের মাধ্যমে কিংবা সামরিক বাহিনীকে দায়িত্ব দিয়ে দেশব্যাপী এরূপ ট্রেনিং সেন্টার এ মুহূর্তেই বাস্তবায়ন করা যায় এবং জাতীয়ভাবে এ যুগোপযোগী কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক আলোকিত জাতি অচিরেই গড়ে তোলা সম্ভব। উচ্ছল-উজ্জ্বল-কর্মযোগী-প্রোএকটিভ জাতি গড়ে তুলতে হলে জাতীয়ভাবে এরূপ প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
এভাবেই জঙ্গি তৈরির কারখানাগুলোকে নিষ্ক্রিয় ও সমূলে উৎপাটন করে এমনকি এরূপ আত্মঘাতী মানসিকতাকে সংশোধন ও সংস্কার করে দিয়ে আমাদেরকে ফিরে আসতে হবে সৌন্দর্যের কাছে, মানবিক মূল্যবোধের কাছে। বর্তমান ও আগামীর ছাত্র-তরুণ সমাজকে দিতে হবে অনন্ত সৌন্দর্যময় জগতের সন্ধান; দেখাতে হবে সৃজনশীল আনন্দের জগৎ; নিয়ে যেতে হবে দেশ গড়ার উৎপাদনশীল আনন্দালোকে; শেখাতে হবে দেশপ্রেম, মানবতা ও ভালোবাসার মাধুর্য। তবেই তারা জ্বলে উঠবে আপন শক্তিতে এবং হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ মান-হুঁশ; দেশ যাদের নিয়ে গর্ব করবে এবং যারা গর্ব করবে দেশ ও জাতিকে নিয়ে।
লেখকঃ
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক
ফোনঃ ৯৫৫০০৫৫, ৯৫৬০২২৫
web: www.helal.net.bd
e-mail: m7helal@yahoo.com