ক্যাম্পাস’র আয়োজনে ১৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ফ্রি সেমিনার অন প্রোএকটিভ এন্ড পজিটিভ এটিচিউড এর ৩১তম পর্ব। ক্যাম্পাস’র নিজস্ব অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে উপস্থিতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র-যুবক।
ছাত্র-তরুণ তথা যুব-সমাজ হলো দেশের চালিকাশক্তি; তাদেরকে জাগাতে না পারলে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে গতিসঞ্চার হবে না; দেশ কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। এজন্যই ক্যাম্পাস সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (সিএসডিসি) অন্যান্য বিভিন্ন ডায়নামিক কর্মসূচির পাশাপাশি নিয়মিত আয়োজন করে ফ্রি সেমিনার অন প্রোএকটিভ এন্ড পজিটিভ এটিচিউড। রিএকটিভ না হয়ে যেকোনো পরিবেশে প্রোএকটিভ ও পজিটিভ থেকে সফল ও জনপ্রিয় হওয়ার গুণ ও কৌশল শেখানো হয় এ সেমিনারে।
সেমিনারে মূল বক্তা ছিলেন ক্যারিশমেটিক উপস্থাপক, প্রোএকটিভ এটিচিউড আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ও গবেষক ড. আলমাসুর রহমান।
ড. আলমাসুর রহমান
ড. আলমাসুর রহমান বলেন, আমরা সবাই সফল হতে চাই এবং অনেকে সেরা হতে চাই। সফল ও সেরা মানুষের মধ্যে সাধারণত ৭টি গুণ থাকে। তন্মধ্যে প্রথম গুণ হলো প্রোএকটিভ এন্ড পজিটিভ এটিচিউড। সফল মানুষরা যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো পরিবেশে যা কিছু ঘটুক না কেন, পরিস্থিতি অনুকূলে থাকুক বা না থাকুক আবেগপ্রবণ না হয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রোএকটিভ মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারঙ্গম।
পজিটিভ এটিচিউড হচ্ছে মানুষের ইতিবাচক, গঠনমূলক, সুন্দর, সৃষ্টিশীল হবার গুণ। পজিটিভ এটিচিউড সৃষ্টি করে, পৌঁছে দেয় সাফল্যের শীর্ষে। অন্যদিকে রিএকটিভ এটিচিউড মানে প্রতিক্রিয়াশীল, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি; এটি ধ্বংস করে, সৃষ্টি করে না।
ড. আলমাস বলেন রাসূল (দঃ) এর উপর বিধর্মীরা কত অত্যাচার করেছে, রক্তাক্ত করেছে; কিন্তু শত অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি React করেননি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রতিকূল অবস্থায় তিনি যদি React করেন, তাহলে তার মিশন ভন্ডুল হয়ে যাবে। ইসলাম ধর্মের এত প্রসার ও বিস্তৃতির মূলে ছিল রাসূলাল্লাহ (দঃ) এর দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি, অনুকরণীয় আদর্শ; ক্ষমাশীল, ধৈর্যশীল আচার-আচরণ; মানবিক গুণাবলিতে পরিপূর্ণ সে জীবন ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক, প্রেরণাদায়ী।
তিনি বলেন প্রোএকটিভ এটিচিউডের মানুষকে রাগানো যায় না, রাগ তার ধারে-কাছেও ভিড়তে পারে না। রাগার কারণ থাকা সত্ত্বেও প্রোএকটিভ মানুষরা রাগবে না; ঘুষ খাবার প্রচুর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঘুষ খাবে না; অসৎ উপায়ে বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলা কিংবা বড়লোক হবার চারপাশে অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অসৎ হবে না। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই তারা আদর্শের পথে, কল্যাণের পথে থাকতে পারেন।
ড. আলমাস বলেন যার যত কন্ট্রোল পাওয়ার, সে তত বড়। প্রোএকটিভ মানুষ নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেন। তাই তিনি আকর্ষণীয় চারিত্রিক মাধুর্যের অধিকারী। তিনি মানুষের কল্যাণ কামনা করেন, শান্তি কামনা করেন। তাকে দেখলে সবাই খুশি হয়, আগবাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়, তার সাথে প্রাণখুলে আলাপ করে। আন্যদিকে রিএকটিভ মানুষের নিজের উপর কন্ট্রোল নেই। রিএকটিভ তথা ভারসাম্যহীন মানুষ আর পাগলের মধ্যে তফাৎ কোথায়! রিএকটিভ মানুষকে দেখলে পরিচিতজনরাও অস্বস্তিবোধ করে, বেশিক্ষণ কথা বলতে চায় না, সে তাড়াতাড়ি চলে গেলেই যেন বাঁচে।
বাস্তব উদাহরণ টেনে ড. আলমাসুর রহমান বলেন আমার পরিচিত একজন একটি বড় কর্পোরেশনের ডিজিএম, অবসরে গেছেন। এখন রোগে-শোকে জর্জরিত। তিনি আমাকে বললেন কারো সাফল্যের খবর শুনলে আমার ভীষণ রাগ হতো, মনে হতো যেন আমার ক্ষতি হয়ে গেলো। কারো প্রমোশনের কথা শুনলে আমার গা-জ্বালা ধরতো; মনে হতো, আমার যেন সর্বনাশ হয়ে গেলো। অথচ এটা বুঝতাম না, অন্যের প্রমোশন হলে আমার ডিমোশন হবে কেন? আমার আর্থিক ক্ষতির কি কারণ হতে পারে? আমি কেন ঈর্ষান্বিত হব; সহজ-সরল জিনিসটাই সেদিন বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি, কিন্তু অনেক দেরিতে। আপনার কাছে এসেছি, এ অবস্থার উত্তরণে আপনার সাহায্য-সহযোগিতার জন্য।
আরেকটা উদাহরণ দিয়ে ড. আলমাস বলেন রাসুলুল্লাহ (দঃ) একবার কয়েকজন সাহাবীর সাথে বসে আলাপ করছিলেন; তখন একজন লোক সেখানে এলেন কি যেন খুঁজতে, আবার চলেও গেলেন। রাসুলাল্লাহ (দঃ) বললেন যে লোকটি এসেছিল, সে বেহেশতী। সাহাবীরা এ কথায় অবাক হলেন। একজন সাহাবার কৌতূহল হলো লোকটা কি এমন কাজ করে যে, সে বেহেশতী হবে। উক্ত সাহাবী কয়েকদিন লোকটিকে Observe করলেন, কিন্তু কোনো প্রমাণ পেলেন না। শেষে সরাসরি লোকটিকেই জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ভাই- রাসুলুল্লাহ আপনাকে বেহেশতী ঘোষণা দিয়েছেন আপনি এমন কি মহৎ কাজ করেছেন, যাতে আপনি বেহেশতের বাসিন্দা হবেন। লোকটি বললেন আমিতো আপনাদের চেয়ে বেশি কিছু করি না; তবে কারুর সাফল্যের কথা শুনলে আমার মনে হয় যে এ সাফল্যটা আমার নিজের সাফল্য, অন্যের হাসি দেখলে আমার মন আনন্দে ভরে ওঠে।
ড. আলমাস বলেন, প্রোএকটিভ মানুষ হওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। প্রোএকটিভ হতে হলে মানুষকে কঠোর সাধনা করতে হয়। তিনি বলেন, পশু-পাখির শাবকরা জন্মের পরপরই পশু-পাখি, তাদেরকে কিছু শেখাতে হয় না। অন্যদিকে মানব-শিশুকে মানুষ করতে হয়, সে অটোমেটিক মানুষ নয়। মানব শিশুকে আদর-যতœ করে শিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষ করতে হয়, ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে মানুষ হবার শিক্ষা দিতে হয়।
ড. আলমাসুর রহমান বলেন Proactive & Positive Attitude অটোমেটিক গড়ে উঠবে না; একে চর্চা করতে হবে, লালন করতে হবে। রাগ করা, অন্যের সাথে খারাপ ব্যবহার করা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমাদের ব্রেন শান্ত থাকবে, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেব এটাই স্বাভাবিক। পুকুরের শান্ত জলে ঢিল ছুঁড়লে যেমনি Abnormal অবস্থার সৃষ্টি হবে; তেমনি মানুষের মনও যদি Normal না থাকে, তাহলে অশান্তি সৃষ্টি হবে; মন অশান্ত থাকলে শান্তি বিঘিœত হবে। ফুলের বাগানের পাশে ডাস্টবিন থাকলে আমি কেন সেদিকে তাকাবো। আমার দৃষ্টি থাকবে বাগানের সৌন্দর্যের দিকে, ফুলের সৌরভের দিকে। কথায় আছে Thought we create, feelings we generate & action we perform.. অভ্যাস মানুষেরই সৃষ্টি, অভ্যাসের সমষ্টিতে গড়ে ওঠে লোকচরিত্র। তাই কুঅভ্যাস ত্যাগ করে সুঅভ্যাসে ফিরে আসতে মানুষকেই চেষ্টা করতে হবে।
ড. আলমাস বলেন, মানুষের খারাপ হবার পেছনে দায়ী তার ব্রেন প্রোগ্রামিং। ব্রেনে যা ইনপুট করা হবে, আউটপুট তা-ই হবে। বাস্তবে আমরা আমাদের সন্তানদেরকে শৈশব-কৈশোরে সাধারণত চালাক-চতুর হতে, স্বার্থপর হতে শেখাই; সহজ-সরল-নিঃস্বার্থ হওয়ার শিক্ষা দেই না। অভিভাবকের কথা সন্তান চালাক-চতুর না হলে প্রতিযোগিতায় টিকবে না, ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে আসবে। এভাবে আমাদের সন্তানদের স্বার্থপর করে তুলেছি, পরবর্তী জীবনে তাদের দ্বারা নিঃস্বার্থ কোনো কাজ কীভাবে আশা করা যায়? স্বার্থপরতার মনোভাব ত্যাগ করতে না পারলে উদার মনোভাব গড়ে উঠবে না, মহৎ কিছু করা সম্ভব হবে না। মনকে সুন্দর করতে হলে বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়ালে চলবে না, মনের ভেতরটাও সুন্দর করতে হবে।
শরীরের উপরটা পরিষ্কার করার জন্য আমরা কত না কসরৎ করছি; তেল-সাবান, সেন্ট ব্যবহার করছি, কিন্তু ভেতরটা পরিষ্কারের কোনো খবর নেই না। ভেতরের বাতি জ্বালাতে পারলেই সব অন্ধকার দূর হবে, তখন মানুষ অন্যের হাসিতে হাসতে পারবে, অন্যের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হবে।
ক্যাম্পাস’র পরবর্তী প্রোএকটিভ সেমিনার হবে ২০ জুলাই, ২০১৭; ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে বিকাল সাড়ে ৪টায়। বিষয়ঃ How to Develop Relationship.