॥ পূর্ব প্রকাশিতের পর -৩৬ ॥
অধ্যায় ৯
॥পর্ব ১॥
প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি
আমার স্বল্প জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় যতদূর বুঝতে পেরেছি সর্বক্ষেত্রে সর্বদা ভালোর চর্চা এবং ইতিবাচক চিন্তা-চেতনার মাধ্যমে সুস্থতা, দীর্ঘজীবন এবং মানসিক প্রশান্তিলাভ কঠিন কিছু নয়। এজন্য প্রয়োজন খাদ্যগ্রহণ, চলন-বলন ও জীবনযাপনের প্রতি পদে পদে তথা সর্বক্ষেত্রে সর্ববিষয়ে ইতিবাচক ধ্যান-ধারণার লালন ও উন্মেষের নিশ্চয়তা।
অবিরাম ভালোর চর্চা ও সুস্থ চিন্তা লালনের পরও যদি অসুস্থতা থাকে এবং ধৈর্যধারণ সম্ভব না হয়, তাহলেতো চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার দরকার হতে পারে। এক্ষেত্রে ডাক্তারকে রক্ষাকবচ বলে মনে করলেও তাতেও প্রয়োজন সচেতনতা। কারণ মানবসেবা ও মানবমুক্তির এ সুমহান পেশাও ভেজালমুক্ত নয়। আমাদের অধিকাংশ চিকিৎসক পেশায় প্রতিশ্রুতিশীল, তা সত্ত্বেও কিয়দংশের মানবিক গুণাবলীর অভাবে এ সুমহান পেশার প্রতিও সন্দেহ-সংশয় কম নয়।
এমন চিকিৎসকও দেখেছি, যারা নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে ডাক্তারি বিদ্যা অর্জন করে সমগ্র পেশাজীবন এমনকি শেষ জীবনও ত্যাগ করেছেন পীড়িত ও দুঃস্থের সেবায়, মানুষ ও মানবতার কল্যাণে। আবার এমনও দেখা গেছে, বাবার অর্থবিত্ত-বৈভবে ডাক্তার হয়ে জীবনভর ছুটেছেন অর্থেরই পেছনে। মানুষ হিসেবে মানবতার মূল্য দেয়ার মানসিকতা তৈরি না হলে সেই ডাক্তার-ব্যক্তির কাছে কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা পাওয়া সুদূরপরাহত। তাই এক্ষেত্রে ঝঃঁফবহঃং ধৎব ঃযব নবংঃ লঁফমবং ড়ভ ঃবধপযবৎং এর ন্যায় দীর্ঘমেয়াদে রোগীই হতে পারে ডাক্তারের ভালোত্বের বিচারক।
ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার আগে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্বাচন রোগীর প্রাথমিক কাজ। আমাদের দেশে কবিরাজি, হারবাল, হোমিও এবং এলোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি সাধারণভাবে প্রচলিত। আসল-ভেজাল নির্ণয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে কবিরাজির সনাতনী চিকিৎসা পদ্ধতি এখন লুপ্তপ্রায়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন বলে হারবাল নামে আধুনিক কবিরাজি চিকিৎসা ও চর্চা স্বল্প পরিসরে হলেও ক্রমবিকাশমান। অন্যদিকে রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপত্রে স্বচ্ছতা না থাকায় এবং আরোগ্যলাভে দীর্ঘসূত্রতার কারণে হোমিওপ্যাথির ব্যবহারও তেমন ব্যাপক নয়। এক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ে ও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে স্বচ্ছতা এবং ঔষধের সহজলভ্যতার কারণে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার কথা জানা থাকা সত্ত্বেও এলোপ্যাথি চিকিৎসা এবং ঔষধেই অধিকাংশ মানুষ অভ্যস্ত।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা
হোমিওপ্যাথি (ঐড়সবড়ঢ়ধঃযু) হচ্ছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা পদ্ধতি। বিভিন্ন সময়ে হোমিও ঔষধ ব্যবহারকারী হিসেবে আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি রোগ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় হোমিও ঔষধ প্রয়োগ করতে পারলে ২/১ ডোজ ঔষধেই অনেক রোগ ভালো হয়ে যায়; আবার যথাযথ ঔষধ প্রয়োগ না হওয়ার ফলে বছরের পর বছর হোমিও ডাক্তারের কাছে ঘোরাঘুরি করেও কোনো ফল হয় না।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রবর্তক ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। গ্রীক শব্দ ঐড়সবড় বা ঐড়সড়রড়ং এবং চধঃযু বা চধঃযড়ং থেকে এসেছে ঐড়সবড়ঢ়ধঃযু শব্দটি। গ্রীক ভাষায় ঐড়সবড় মানে সদৃশ, খরশব ংরসরষধৎষু এবং চধঃযড়ং মানে উপায়, পদ্ধতি বা কষ্টভোগ। আভিধানিক অর্থে হোমিওপ্যাথির অর্থ হলো সদৃশ রোগ।
রোগ নিরাময়ের প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে সদৃশ রোগ সৃজনক্ষম ঔষধ দিয়েই আরোগ্য সম্ভব (খবঃ ষরশব নব পঁৎবফ নু ষরশব)। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল সূত্র হচ্ছে সুস্থাবস্থায় কোনো ঔষধ স্থূল মাত্রায় সেবন করলে মানুষের দেহে ও মনে যে সকল অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায়, ঐ প্রকার লক্ষণযুক্ত প্রাকৃতিক অসুস্থতায় উক্ত ঔষধের শক্তিকৃত সূক্ষ্মমাত্রা প্রয়োগে লক্ষণসমূহ অন্তর্হিত হয়।
হোমিওপ্যাথি তত্ত্বের মূলকথা হলো মানবদেহে সংক্রামিত দুর্বলতর প্রাকৃতিক রোগ অধিকতর শক্তিশালী অপর এক রোগের সংক্রমণ দ্বারা স্থায়ীভাবে নির্মূল করা যায়, যদি শেষোক্ত রোগটির উৎপত্তি ভিন্ন কারণ থেকে হয় এবং পূর্বের রোগের সঙ্গে সদৃশ লক্ষণ-বিশিষ্ট হয়।
মহাত্মা হ্যানিম্যান সুস্থদেহে কুইনিন সেবন করে ম্যালেরিয়া হতে দেখেন এবং কৌতূহলবশত আরও নানা ঔষধের স্থূলমাত্রা সুস্থদেহে গ্রহণ করে বুঝতে পারেন যে, ঔষধের কৃত্রিম রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা রয়েছে। আবার ঐ সকল ঔষধের সূক্ষ্মমাত্রা ব্যবহার করে ঔষধের লক্ষণ দূরীভূত হওয়ার ঘটনাও তিনি প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর এ গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় সকল শক্তিশালী ভেষজের রোগ সৃষ্টির কৃত্রিম ক্ষমতা এবং শক্তি আরোপিত অবস্থায় আরোগ্যের ক্ষমতা আছে।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সুবিধা হলো, এ ঔষধের ক্রিয়া একেবারে সোজা পীড়িত স্থানের ওপর পড়ে। হোমিও ঔষধের ক্রিয়া মৃদু; এতে বল প্রয়োগের রূঢ়তা নেই, কিন্তু এর আবেদন দুর্বার। ঔষধ প্রয়োগের পর রোগের উপশম ছাড়া রোগী আর কিছুই বুঝতে পারে না। এরূপ শান্ত ক্রিয়ার কারণে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের পরিমাণ বেশি দরকার হয় না। অতি ক্ষুদ্র মাত্রায় কাজ হয়।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ। অন্যান্য চিকিৎসায় দেহের প্রতিটি যন্ত্র ধরে ধরে রোগের উপশমের জন্য নানা পর্যায়ের ঔষধ ব্যবহার করা হয়, কিন্তু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সমগ্র ব্যক্তিসত্তাই হলো মূল লক্ষ্য। সেই মূল ধরে ঔষধ প্রয়োগ করে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা স্পর্শ করা হয়। সেজন্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ব্যক্তিসত্তাকে কেন্দ্র করে একটিমাত্র ঔষধ রোগের সমগ্র লক্ষণকে দূরীভূত করে।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ফল স্থায়ী। রোগকে চাপা দেয়া বা বল প্রয়োগ করে দমন করা হোমিওপ্যাথির নীতিবিরুদ্ধ। বল প্রয়োগে জোর করে যা দমন করা হয়, আবার এক অসতর্ক মুহূর্তে তা পুনঃপ্রকাশের সম্ভাবনা থাকে এবং সেই প্রতিক্রিয়া তীব্রও হয় খুব বেশি। হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মুখ্য ক্রিয়া দেহের রোগের সাথে একমুখী। এর বৃহত্তর শক্তি ব্যাধি-শক্তিকে আত্মসাৎ করে নিজেও অন্তর্ধান করে এবং রোগীকে স্থায়ী আরোগ্য দান করে।
আমাদের দেশে প্রচলিত হোমিও চিকিৎসায় নেগেটিভ ৪টি বিষয় আমার কাছে লক্ষণীয়। এক, রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে রোগীর কোনো ধারণা থাকে না; দুই, ডাক্তার কোন্্ রোগের জন্য কী ঔষধ প্রয়োগ করেছেন এরূপ কোনো ব্যবস্থাপত্র রোগীর কাছে থাকে না, ফলে ডাক্তারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে; তিন, ঔষধের মূল্যের হার সম্পর্কে রোগীর নিকট স্বচ্ছতা অনুপস্থিত; চার, ঔষধটি কোন্্ দেশের কোন্্ কোম্পানির বা কী উপাদানে তৈরি সেসবের কিছুই জানতে পারে না রোগী। এককথায়, বিশ্বাসই হচ্ছে হোমিও-রোগীর অবলম্বন।
এলোপ্যাথি চিকিৎসা
কেবল আমাদের দেশেই নয়, বিশ্ব পরিসরেও এলোপ্যাথি হলো সর্বাধিক প্রচলিত চিকিৎসা। বিজ্ঞানের উন্নতি ও ক্রমবিকাশের সহায়তায় ভ্যাকসিন ও ড্রাগের মাধ্যমে সাধারণ অসুখ-বিসুখ ও মরণব্যাধির সাথে মোকাবেলায় সক্ষম এলোপ্যাথি চিকিৎসা জনসাধারণের কাছে সবদেশেই জনপ্রিয়।
এলোপ্যাথি চিকিৎসায় রোগ চিহ্নিতকরণ ও সার্জারির যেসব উপকরণ আছে, তা রোগ নির্ণয় ও উপশমে চমৎকার ফলপ্রসূ। শরীরের কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গে যখন সার্জারির প্রয়োজন হয়, তখন এলোপ্যাথি চিকিৎসা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। এলোপ্যাথি পদ্ধতির সাহায্যেই এখন সম্ভব শরীরের কোনো অঙ্গ ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন (অন্যত্র স্থাপন)। এলোপ্যাথির সাহায্যে এবডমিনাল ও গাইনোকলজিক্যাল সার্জারি এত সহজ হয়ে গেছে এবং এসব রোগীকে যে ত্বরিত উপশম ও আরাম দিচ্ছে, তা একসময় চিন্তাই করা যেত না।
যদিও এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় রোগের তাৎক্ষণিক উপশম হয়, তবে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এলোপ্যাথিক মেডিসিন দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত ব্যবহার করতে থাকলে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা অসম্ভব। অন্যদিকে উচ্চ রক্তচাপসহ কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে একবার ঔষধ সেবন শুরু করে দিলে বন্ধ করা কঠিন।
১৮৪২ সালে এলোপ্যাথি শব্দটির পরিচিতি ব্যাপক হতে শুরু করে। এলোপ্যাথি নামটি স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের দেয়া; যিনি নিজে একজন এলোপ্যাথিক চিকিৎসক হয়েও পরবর্তীতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উৎপত্তি ঘটান। তিনি মনে করতেন, ডাক্তারদের নিজের ঔষধ নিজেই তৈরি করে নেয়া উচিত; এতে ঔষধের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ডাক্তার নিশ্চিত হতে পারেন। কেননা এলোপ্যাথিক ঔষধ তৈরি করে ঔষধ কোম্পানিগুলো একচেটিয়া ব্যবসায়ের কর্তৃত্বলাভ করার ফলে চিকিৎসকরা তাদের কাছে অসহায় পুতুল হয়ে পড়েন।
এলোপ্যাথি চিকিৎসা ও ঔষধের নেতিবাচক বিভিন্ন দিকের বিবেচনায় উন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ঔষধ সেবনে বিধি-নিষেধ থাকে। সেসব দেশে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এলোপ্যাথি ঔষধ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ডাক্তাররাও রোগীকে সহজে ঔষধ প্রেসক্রাইব করেন না। এ বিষয়ে হল্যান্ডের একাকী প্রবাস জীবনে আমার স্ত্রীর প্রচন্ড দাঁতের ব্যথায় ডাক্তারের কাছে গিয়ে ঔষধহীনভাবে ফেরার গল্প এ বইয়ের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ১ম পর্বে বলেছি।
উন্নত বিশ্বের মানবিক গুণাবলির সেরূপ ডাক্তারের সংখ্যা বাংলাদেশে হাতে গোনা হলেও কম কিন্তু নয়। আমাদের দেশে এলোপ্যাথি চিকিৎসার নেতিবাচক দিক ও কুফল এবং ভেজাল ঔষধের রমরমা ব্যবসা সম্পর্কে শুধু সমাজ হিতৈষীরাই উদ্বিগ্ন নন; এর প্রতিকার ও প্রতিরোধে সোচ্চার অনেক কল্যাণকামী ও মানবতাবাদী ডাক্তারও। এ সোচ্চার এখন আর ডাক্তারের চেম্বারে সীমাবদ্ধ নয়, সংবাদ মাধ্যমেও ডাক্তারদেরই লেখা এরূপ প্রবন্ধ/নিবন্ধ কম দেখা যায় না। বাংলাদেশের প্রবীণতম চিকিৎসাবিদ, পিজি হাসপাতালের সাবেক প্রধান, চিকিৎসাশাস্ত্র ও বিজ্ঞানে বিশেষায়িত প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসি’র ফাউন্ডার ভাইস-চ্যান্সেলর, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত ডাঃ নুরুল ইসলাম ‘সব অসুখে ঔষধ লাগে না’ শীর্ষক নিবন্ধে বাংলাদেশের এলোপ্যাথি চিকিৎসা এবং ঔষধ সম্পর্কে সবিস্তারে বলেছেন।
সব অসুখে ঔষধ লাগে না
জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম
ব্যবস্থাপত্রে ভরপুর দরিদ্র বাংলাদেশে অসংখ্য ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ অসহায়ভাবে অযৌক্তিক ব্যবস্থাপত্রের শিকার হয়ে পড়ে। এতে তাদের মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিক ক্ষতি হয়; এজন্য দায়ী শুধু ব্যবসায়ী মহল নয়, যারা ব্যবস্থাপত্র লেখেন তারাও। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা যাতে জনসাধারণের কল্যাণে আসে এটি রক্ষা করা চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত্ব।
ব্যাধিগ্রস্ত অগণিত মানুষের রোগমুক্তির জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন লেখা হয়; উদ্দেশ্য রোগমুক্তি অর্থাৎ উপশম। যে রোগ দুরারোগ্য এবং যে ব্যক্তি মৃত্যুর মুখোমুখি, যতটুকু সম্ভব তাদের কষ্ট লাঘব করা একটা নীতিগত ব্যাপার।
এককথায় ব্যবস্থাপত্রের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের রোগ নিরাময়ে সাহায্য করা এবং সম্ভব না হলে কষ্ট লাঘব করা। একটা ব্যবস্থাপত্র লেখার ব্যাপারে চিকিৎসক, ঔষধ ব্যবসায়ী এবং রোগী এ তিন পক্ষ সরাসরি অথবা কোনো না কোনোভাবে জড়িত। ব্যবসায় প্রসারলাভ প্রতিটি ব্যবসায়ীরই কাম্য। কোন্্ ঔষধ কী পরিমাণে তৈরি হবে, তা নির্ধারণ করা হয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এগুলোকে সবসময় বিচার করে দেখা হয় না। ফলে যেখানে হাজার হাজার অপ্রয়োজনীয় ঔষধ দিয়ে বাজার ভর্তি, সেখানে জীবন রক্ষাকারী অনেক ঔষধই পাওয়া যায় না।
বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী মহল নিজেদের তৈরি বিভিন্ন ঔষধের চাহিদা বাড়ানোর জন্য যারা ব্যবস্থাপত্র লেখেন তাদের প্রভাবিত করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। কাগজে আকর্ষণীয়ভাবে এমনসব অবাস্তব তথ্য তুলে ধরা হয়, যা প্রাথমিক দৃষ্টিতে সত্য মনে হবে। চিকিৎসাক্ষেত্রে যারা অর্বাচীন, অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত তারাই বেশি প্রভাবান্বিত হয়ে থাকেন। সুন্দর কাগজে বাহারি লেবেলের ওপর বিভিন্ন উপাদানের সুদীর্ঘ তালিকা ও চাহিদার বিজ্ঞাপন সহজ-সরল জনগণের ওপর নিঃসন্দেহে প্রভাব বিস্তার করে। কাজেই এটি অস্বাভাবিক হলেও সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপত্র লেখার আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ শেষে এক বা একাধিক ঔষধ লেখার জন্য রোগীরাই অনুরোধ জানান। যেমন ধরুন রক্তের ঔষধ, হজমি ঔষধ, ঘুমের ঔষধ, মাথাব্যথার ঔষধ, স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ঔষধ ইত্যাদি।
পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে ১৯৮১ সালেই বিভিন্ন ধরনের এলোপ্যাথিক ঔষধের জন্য খরচ হতো ১৫৩ কোটি টাকা। আর বাজারজাত হতো প্রায় চার হাজারের মতো বিভিন্ন ধরনের ঔষধ। এগুলোর অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক। এমন এক দুঃখজনক পরিস্থিতিতে একটি জাতি বেশিদিন নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারে না। শুধু সরকারের ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিজের গা বাঁচিয়ে চললে এটিকে নৈতিক দিক দিয়ে সমর্থন দেয়া যায় না। আমরা যারা ব্যবস্থাপত্র লিখি তাদের উদ্দেশ্য যদি রোগের উপশম হয়, তাহলে সেদিকে আমরা কতটুকু ভুলের মধ্যে এখনও ডুবে আছি একটি দৃষ্টান্ত তা-ই প্রমাণ করবে।
কিছুদিন আগে কোনো একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের একজন পদস্থ কর্মচারী চিকিৎসার জন্য আমার সঙ্গে দেখা করেন। অনিদ্রা, বুক ধড়ফড় করা, বদহজম, মাথাব্যথা, হাত-পায়ে ঝিনঝিন করা এগুলোই ছিল তার প্রধান উপসর্গ। বিগত সাত-আট মাস ধরে একে একে চার পাঁচজন চিকিৎসকের পরামর্শ তিনি নেন। বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনেক ব্যবস্থাপত্র তাকে দেয়া হয়। ঘুমের বড়ি, হজমি টনিক, ভিটামিন ইনজেকশন ইত্যাদি ঔষধ বিভিন্ন সময়ে দেয়া হয়েছে। সব ঔষধের তালিকা একসঙ্গে যোগ করলে প্রায় অর্ধশতকের কাছাকাছি হবে, অথচ রোগের উপশম হয়নি। রোগীর ভিড়ের মধ্যে আগাগোড়া রোগের ইতিহাস শোনা এবং পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিশদ বিশ্লেষণ করে দেখা কোনোভাবেই সম্ভব নয় এই ভেবে ভদ্রলোককে অনুরোধ জানালাম সবকিছু নিজ হাতে লিখে সে যত লম্বাই হোক, আমার সহকর্মীর কাছে একসময় রেখে যেতে। সপ্তাহখানেক পর আমার সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় ধার্য করা হলো। তিনি নির্দেশনা অনুযায়ী দু’এক দিনের মধ্যেই সব ইতিহাস এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ঘটনা লিখে অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করলেন। এর মধ্যে তার ইতিহাস সম্পূর্ণ পড়ে নিয়ে যেখানে যেখানে দরকার লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করলাম। নির্ধারিত দিন তিনি এলেন। রোগীর ইতিহাস পাশের ড্রয়ার থেকে তুলে নিয়ে তাকে দেখালাম। বললাম, আর কোনো ঔষধ দরকার নেই। কারণ, অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আপ্রাণ চেষ্টা করেও মতের মিল ঘটাতে না পারায় তার এ উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ঔষধ ব্যবহারে এগুলোর উপশম হবে না।
অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে, এমনকি কিছুটা দুঃখজনক পরিস্থিতিকে সত্য করে নিতে হবে; নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছি এ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মানসিক শান্তি থেকে দৈহিক শান্তি আসবে। ট্যাবলেট কিংবা টনিক দিয়ে কোনোদিনও উপশম হবে না। বরং অহেতুক অর্থব্যয়ে পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হতে পারে। আমার এসব কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় পরিবর্তন দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ আগেকার বিমর্ষ আশঙ্কাজড়িত ভদ্রলোকের চোখে-মুখে হাসি ফুটে উঠল। অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে এবং আর ঔষধ ব্যবহার করবেন না এ অঙ্গীকার করে তিনি বিদায় নিলেন।
আর্থিক অসঙ্গতির সঙ্গে অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপত্র তৈরি করে সামাজিক সংঘাত। এর প্রতিবিধান করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। নিতান্ত অসহায়, অনেকাংশে নিরুপায় রোগীদের সমস্যা জর্জরিত না করে সংকটমুক্ত করাকে নৈতিকভাবে এবং বিবেক ও অনুভূতির মাধ্যমে বিচার করতে হবে। রোগ থাকলে রোগের মূল উদ্ঘাটন না করে ব্যবস্থাপত্রের পর ব্যবস্থাপত্র লিখে সংকটের সৃষ্টি করা একটি অমার্জনীয় অপরাধ। রোগী এলেই যে ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে, অসুখ হলেই ঔষধ লাগবে এমন কোনো কথা নেই।
না বুঝে, অপ্রয়োজনে, অত্যল্প প্রয়োজনে কেমিক্যাল ঔষধ-পথ্য খাওয়া উচিত নয়। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। সাধারণ অসুখের ক্ষেত্রে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অথবা প্রাকৃতিক চর্চায় অসুখ ভালো না হলে তখন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ-পথ্য সেবন করা যেতে পারে।
চলবে।